গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/চাঁদের উপরকার অবস্থা
চাঁদের উপরকার অবস্থা
যেখানে এককালে আগ্নেয়-পর্ব্বতের এত উপদ্রব ছিল, সেখানে যে আমাদের পৃথিবীর মত সমতল স্থান থাকিতে পারে না, তোমরা অনায়াসে তাহা আন্দাজ করিতে পার। সত্যই চাঁদের উপরে এক যাইল লম্বা ও এক মাইল চওড়া একটা সমতল জায়গা মেলা কঠিন। তোমাদের ফুট্বল্ খেলার মত একটু ছোট সমতল জায়গাও বোধ হয় চাঁদে মেলে না। তাহাতে কেবল পাহাড়ের পর পাহাড়, উঁচু জমির পর নীচু জমি যেন সাজানো আছে। পৃথিবীর মত নরম মাটিও বোধ হয় সেখানে পাওয়া যায় না। বড় বড় আগ্নেয় পর্ব্বত হইতে গলা ধাতু জমাট বাঁধিয়া মাটি এমন শক্ত করিয়া রাথিয়াছে যে, তাহা কলের লাঙ্গল দিয়া খুঁড়িতে গেলেও খোঁড়া যায় না।
তোমরা ভূগোলে পড়িয়াছ, পৃথিবীর উপরে মোটে একভাগ স্থল এবং বাকি তিন ভাগ সমুদ্র। চাঁদে কিন্তু সমুদ্র কম। হিসাব করিলে দেখা যায়, চাঁদের উপরটাকে যদি তিন ভাগ কর, তাহা হইলে কেবল এক ভাগ সমুদ্র ও বাকি দুই ভাগ স্থল হইয়া দাঁড়ায়। চাঁদে সমুদ্রের চিহ্ন থাকিলেও, সে সমুদ্রে কিন্তু এখন এক-বিন্দুও জল নাই। কাজেই আগেকার কথা ছাড়িয়া দিলে বলিতে হয়, চাঁদে এখন সবই স্থল; সেখানে এখন জলের নাম গন্ধও নাই। জল থাকিলে মেঘ হইত এবং মেঘে চাঁদের উপরটা ঢাকা পড়িয়া যাইত; তখন আমরা চাঁদের গায়ের কালো কালো দাগগুলিকে স্পষ্ট দেখিতে পাইতাম না। কিন্তু চাঁদের কলঙ্ককে ত আমরা কখনই অস্পষ্ট দেখিতে পাই না। কাজেই মানিয়া লইতে হয় চাঁদে জল নাই।
আমাদের পৃথিবীতে জল আছে। এখানে জলে কি কাজ করে তাহা তোমরা হয় ত দেখিয়া থাকিবে। বৃষ্টির জল ও বরফ-গলা জল বড় বড় পাহাড়কে ভাঙিয়া চূরিয়া দেয়, উঁচু জমিকে নীচু করে এবং কখনো কখনো নীচু জমিকেও উঁচু করে। জল যেন প্রতিদিনই পৃথিবীকে নূতন করিয়া গড়িতেছে। কিন্তু আজ তিন শত বৎসর ধরিয়া জ্যোতিষীরা চাঁদকে দিনের পর দিন দেখিতেছেন, তাহার ম্যাপ্ আঁকিতেছেন, কিন্তু এত বৎসরেও চাঁদের উপরকার মাটি-পাথরের একটুও পরিবর্ত্তন দেখেন নাই। ইহা দেখিয়াও তোমরা বলিতে পার চাঁদে জল নাই।
চাঁদে বাতাসও নাই। বাতাসে কি কাজ করে তোমরা জান না কি? ঠিক জলেরই মত তাহার কাজ। লোহাকে কিছু দিন বাতাসে ফেলিয়া রাখিলে যেমন তাহাতে মরিচা ধরে এবং এক-একটু করিয়া তাহা ক্ষয় পাইয়া যায়, পাথরের উপরে ও মাটির উপরে বাতাস ঠিক ঐ রকমেই কাজ করে। পাথরকে এবং শক্ত মাটিকে বাতাস এক-একটু করিয়া ধূলা করিয়া দেয় এবং পরে সেই ধূলাকে উড়াইয়া দূরে ছড়াইয়া ফেলে। ইহাতে ক্রমে ক্রমে পাহাড় ও উঁচু মাটির ঢিবি ছোট হইয়া আসে। কিন্তু চাঁদের পাহাড় ও উঁচু জমির এ-পর্য্যন্ত একটুও ক্ষয় দেখা যায় নাই। কাজেই তাহাতে বাতাস আছে ইহা কেমন করিয়া বলি?
চাঁদে যে বাতাস বা জলের বাষ্প প্রভৃতি কোনো জিনিস নাই, তাহার আর একটা প্রমাণের কথা বলি। তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ, খুব গভীর বাতাসের ভিতর দিয়া দেখিলে সব জিনিসকেই ম্লান বা অস্পষ্ট দেখা যায়। সকাল বেলা যখন সূর্য্য উঠে তখন তাহাকে কি রকম ম্লান দেখায় তাহা তোমরা দেখ নাই কি? তখন তাহার দিকে বেশ তাকানো যায়। অস্তের পূর্ব্বে সূর্য্যকে ঠিক ঐ-রকমই ম্লান দেখায়। ইহার কারণ তোমরা বলিতে পার কি? উদয় ও অস্তের সময়ে সূর্য্য তেরচা-ভাবে কিরণ দেয়, তাই সূর্য্যের আলোককে বায়ু ও নানা বাষ্পের গভীর স্তর ভেদ করিয়া আসিতে হয় এবং ইহাতে আলো কতকটা আট্কাইয়া যায়। তাই দুপুরের সূর্য্যকে যেমন উজ্জ্বল দেখায়, উদয়-অস্তকালের সূর্য্যকে সে-রকম দেখায় না।
বাতাস ও বাষ্পের আলো আট্কাইবার এই কথাটিকে মনে রাখিয়া, চাঁদের আকাশে যে বাতাস বা অন্য বাষ্প নাই, তাহা জ্যোতিষীরা প্রমাণ করিয়াছেন। নিজের পথ ধরিয়া আকাশের উপরে চলিতে চলিতে অনেক সময়ে চাঁদ ছোট-বড় নক্ষত্রদিগকে ঢাকিয়া ফেলে। দেখা গিয়াছে, চাঁদের পিছনে প্রবেশ করিবার সময়ে অতি ছোট নক্ষত্রদেরও আলো একটুও কমিয়া আসে না। যখন তাহার চাঁদের পিছনে যায়, কেবল তখনি তাহারা অদৃশ্য হইয়া পড়ে। চাঁদের আকাশে বাতাস থাকিলে কখনই এ রকমে নক্ষত্র অদৃশ্য হইত না। চাঁদের বাতাসে প্রথমেই তাহার আলো কিছু কিছু আট্কাইয়া যাইত এবং ইহাতে নক্ষত্রগুলিকে ম্লান দেখাইত। তাহার পরে চাঁদের পিছনে একবারে লুকাইয়া পড়িলে তাহারা অদৃশ্য হইত। কিন্তু যখন নক্ষত্রেরা চাঁদে ঢাকা পড়ে, তখন কখনই এ রকমটি দেখা যায় না। কাজেই বলিতে হয়, চাঁদে বাতাস বা জলের বাষ্পাদির নামগন্ধও নাই।