গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/চাঁদের দিবা-রাত্রি
চাঁদের দিবা-রাত্রি
চাঁদের উপরটা পৃথিবীর চেয়ে গরম কি ঠাণ্ডা একথা তোমাদিগকে বলা হয় নাই। এ সম্বন্ধে যাহা কিছু জানা গিয়াছে, তাহাতেও বুঝা গিয়াছে, চাঁদে জীবজন্তু গাছপালা থাকিতে পারে না।
তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ, শুক্ল পক্ষ হউক আর কৃষ্ণ পক্ষ হউক, যখনি চাঁদকে দেখা যায় তখনি তাহার একটা পিঠই আমাদের নজরে পড়ে। এজন্য চাঁদের একটা পিঠে যত পাহাড়-পর্ব্বত ও সাগর-উপসাগরের দাগ আছে আমরা কেবল সেইগুলিকেই জানি। চাঁদের অপর পিঠে কি আছে আমাদের জানা নাই। জানা না থাকিলেও, ইহা বেশ বুঝা যায় যে, পৃথিবীর উপরের সকল জায়গায় মাটি-পাথর যেমন এক রকমের, চাঁদের দুই পিঠেরও অবস্থা তেমনি একই রকমের।
যাহা হউক চাঁদের একটা পিঠ সকল সময়েই পৃথিবীর দিকে থাকাতে, চাঁদের দিনরাত্রি দুইই খুব বড় হইয়া পড়িয়াছে। তোমরা দেখিয়াছ, পৃথিবী চব্বিশ ঘণ্টায় একবার মেরুদণ্ডের চারিদিকে ঘুরপাক খায়, ইহাতে ঐ চবিবশ ঘণ্টারই মধ্যে একবার দিন ও একবার রাত্রি হয়। কিন্তু পৃথিবী জোর করিয়া চাঁদের একটা মুখই নিজের দিকে টানিয়া রাখে। এ জন্য চাঁদ যে সময়ের মধ্যে একবার পৃথিবীকে ঘুরিয়া আসে সেই সময়ের মধ্যে সে নিজের মেরুদণ্ডের চারিদিকে একবারের বেশি ঘুরপাক দিতে পারে না। কিন্তু চাঁদ পৃথিবীকে ঘুরিয়া এক অমাবস্যা হইতে আর এক অমাবস্যায় আসিতে প্রায় সাড়ে ঊনত্রিশ দিন সময় লয়, ইহা আমরা আগেই দেখিয়াছি। সুতরাং বলিতে হয়, পৃথিবীর দিবারাত্রির পরিমাণ যেমন চব্বিশ ঘণ্টা, চাঁদের দিবারাত্রি সেই রকম সাড়ে ঊনত্রিশ দিনে।
কাজেই মোটামুটি হিসাবে চাঁদের উপরকার প্রত্যেক জায়গায় পনেরো দিন রাত্রি এবং পনেরো দিন লম্বা দিন হয়। আমাদের পৃথিবীতে গ্রীষ্মকালে যখন দিনগুলো একটু বড় হয় এবং শীতকালে রাত্রি লম্বা হয়, তখন বড় দিন ও বড় রাত্রির একটিকেও ভাল লাগে না। চাঁদে যদি মানুষ থাকিত তাহার নিকটে পনেরো দিন লম্বা রাত্রি এবং পনেরো দিন লম্বা দিন, কত অসহ্য হইত তাহা ভাবিয়া দেখ।
তোমরা ভাবিতেছ, চাঁদে যদি পনেরো দিন ধরিয়া সূর্য্যের আলো ও তাপ লাগে, তাহা হইলে চাঁদের মাট পাথর তাতিয়া আগুন হইয়া পড়িবে। কিন্তু জ্যোতিষীরা ইহার ঠিক উল্টা কথা বলেন। তাঁদের মতে আমাদের পনেরো দিনের মত লম্বা দিনগুলা চাঁদকে একেবারে গরমই করিতে পারে না। বারো ঘণ্টা মাত্র সূর্য্যের তাপ পাইলে যে, পৃথিবী এত গরম হয়, তাহার একমাত্র কারণ পৃথিবীর চারিদিকের বাতাস এবং জলের বাষ্প। সূর্য্যের আলোর সঙ্গে পৃথিবীর উপরে যে তাপ আসে, আমাদের আকাশের বাতাস ও জলীয় বাষ্প তাহাকে পৃথিবী ছাড়িয়া পলাইতে দেয় না। কোনো জিনিসকে গরম রাখিতে হইলে যেমন আমরা তাহার চারিদিকে কম্বল মুড়িয়া দিই বা লেপ-কাঁথা জড়াই, পৃথিবীর আকাশের বাতাস ঠিক যেন লেপ বা কম্বলেরই কাজ করে। বাহির হইতে পৃথিবীতে যে তাপ আসে, আমাদের বায়ুর আবরণ তাহাকে পৃথিবী হইতে যাইতে দেয় না;—এজন্যই পৃথিবী বেশ গরম থাকিয়া মানুষের বাসের যোগ্য হইয়াছে।
কিন্তু চাঁদে ত একটুও বাতাস নাই এবং জলের বাষ্পও নাই। কাজেই সূর্য্যের আলোর সঙ্গে যে তাপ চাঁদের উপরে আসিয়া পড়ে, নিমেষের মধ্যে তাহা চাঁদ ছাড়িয়া আবার মহাকাশের দিকে ছুটিয়া যায়। কাজেই সকল সময়ে মহাশূন্যের মতই চাঁদ ঠাণ্ডা থাকে। দিনের তাপে চাঁদ যদি এত ঠাণ্ডা থাকে, তাহা হইলে উহার যে আধ্খানায় পনেরো দিন ধরিয়া রাত্রি থাকে, তাহা যে আরো ঠাণ্ডা হইবে, তোমরা ইহা অনায়াসে বুঝিতে পারিতেছ।
চাঁদ কি পরিমাণ ঠাণ্ডা তাহাও জ্যোতিষীরা হিসাব করিয়াছেন। তোমরা জ্বর মাপিবার থারমোমিটার নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। মানুষের গায়ের গরম সাড়ে আটানব্বুই ডিগ্রির সমান। সুতরাং সাড়ে আটানব্বুই ডিগ্রির গরম কি রকম তোমরা আন্দাজ করিতে পার। এই গরম কমিয়া কমিয়া যখন শূন্য হইয়া পড়ে, তখন কত ঠাণ্ডা হয় এখন ভাবিয়া দেখ। জ্যোতিষীরা বলেন, চাঁদ এত ঠাণ্ডা যে, সেখানে থার্মোমিটার রাখিলে তাহার তাপ শূন্যের নীচেও পঞ্চাশ ডিগ্রি কমিয়া যায়। ভাবিয়া দেখ কি ভয়ানক ঠাণ্ডা! যদি চাঁদে একটুও জল থাকিত তাহা হইলে এই ঠাণ্ডায় জমিয়া তাহা পাথরের মত শক্ত বরফ হইয়া দাঁড়াইত না কি? এই রকম চাঁদে কি মানুষ থাকিতে পারে, না গাছপালা জন্মিতে পারে?
তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, গাছপালা জীবজন্তুকে বাঁচাইয়া রাখিবার মত তাপও চাঁদে নাই।