গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/চাঁদের মৃত্যু
চাঁদের মৃত্যু
চাঁদ সত্যই মরা জিনিস। দেহের শুষ্ক হাড়গোড় বাহির করিয়া সে ভূতের মত পৃথিবীর চারিদিকে দিবারাত্রি পাক্ দিয়া বেড়াইতেছে। যেই সূর্য্য আছে, তাই তাহার গায়ে একটু আলো দেখা যায়, তাহা না হইলে সে ভূতের মতই কালো হইয়া পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করিত! ভাবিয়া দেখ, চাঁদের কি দুর্গতি! মরিয়াও তাহার মুক্তি নাই!
এখন তোমরা হয় ত মনে করিতেছ, চাঁদের এই দুরবস্থা কেন? এক কথায় যদি ইহার উত্তর শুনিতে চাও, তাহা হইলে বলি, ছোট হইয়া জন্মিয়াছিল বলিয়াই—চাঁদের এই অকাল-মৃত্যু। আমাদের পৃথিবীর সকল জীবজন্তুই ছোট হইয়া জন্মে, তার পরে ধীরে ধীরে বড় হয় এবং পরে বুড়ো হইলে মরিয়া যায়। কিন্তু আকাশের জ্যোতিষ্কদের মধ্যে নিয়ম এই যে, কেহ ছোট কেহ বড় হইয়া জন্মে। যাহার বড় হইয়া জন্মে তাহারাই বাঁচে অনেকদিন,—শীঘ্র মরে কেবল ছোটরা। চাঁদ পৃথিবীর পুত্র, সে অদৃষ্টের দোষে ছোট হইয়া জন্মিয়াছিল, তাই সে শীঘ্র শীঘ্র বুড়ো হইয়া মরিয়াছে।
চাঁদকে পৃথিবীর পুত্র বলিলাম কেন, বোধ হয় বুঝিলে না। জ্যোতিষীরা স্থির করিয়াছেন, এমন একদিন গিয়াছে, যখন পৃথিবীর উপরটা এখনকার মত ঠাণ্ডা ছিল না এবং শক্ত মাটি পাথর ইহার উপরে খুঁজিয়াই মিলিত না। বলা বাহুল্য, ইহা অনেকদিন আগেকার কথা। এখনকার পৃথিবী যে-সব জিনিস দিয়া প্রস্তুত তখন তাহা সব একাকারে থাকিয়া বন্ বন্ করিয়া ঘুরিত। কেবল ঘুরা নয়, ঐ সব জিনিস গরম বাষ্পের আকারে থাকিয়া হয় ত একটা ছোট সূর্য্যের মত জ্বলিত। কিন্তু পৃথিবী ত আর সূর্য্যের মত বড় নয়, কাজেই কিছু দিনের মধ্যে সে তাপ ছাড়িয়া নিভিয়া গিয়াছিল ও তাহার শরীরের বাষ্প জমাট বাঁধিবার চেষ্টা করিতেছিল, কিন্তু তখনো তাহাতে ভয়ানক তাপ ছিল এবং সে আগেকারই মত বন্ বন্ করিয়া ঘুরিতেছিল। পৃথিবীর দেহ যখন এই রকম কোমল এবং গরম, তখনি পৃথিবীর দেহ হইতে খানিকটা অংশ খসিয়া গিয়া চাঁদের জন্ম হইয়াছিল। তাহা হইলে দেখ, পৃথিবী নিজের দেহ দিয়াই চাঁদকে গড়িয়াছিল। কাজেই চাঁদকে যদি পৃথিবীর পুত্র বলা যায় তাহা হইলে অন্যায় হয় না।
যাহা হউক চাঁদের মৃত্যু কেমন করিয়া হইল এখন বলি শুন। চাঁদ যখন পৃথিবী হইতে পৃথক হইয়া পড়িয়াছিল, তখন দুইয়েরই তাপ সমান ছিল, এবং দুজনে দেহের তাপ ছাড়িয়া ঠাণ্ডা হইতে আরম্ভ করিয়াছিল। এই অবস্থায় কে শীঘ্র শীঘ্র ঠাণ্ডা হইবে বলিতে পার কি? চাঁদ আকারে ছোট, কাজেই সে শীঘ্র ঠাণ্ডা হইয়া পড়িতে লাগিল। এক হাঁড়ি ভাত যখন উনুন হইতে নামানো হয়, তখন তাহার সব অংশই প্রায় সমান গরম থাকে। কিন্তু যদি এক হাতা ভাত হাঁড়ি হইতে লইয়া একখানা থালায় রাখিয়া দাও, তাহা হইলে হাঁড়ির ভাতের অনেক আগে থালার এক হাতা ভাত ঠাণ্ডা হইয়া পড়ে। এই রকমেই পৃথিবীর চেয়ে ছোট চাঁদটিই শীঘ্র ঠাণ্ডা হইয়াছিল, এবং তাহার সেই বাষ্পীয় দেহ শীঘ্র শীঘ্র তরল হইয়া শেষে জমাট বাঁধিয়া শক্ত হইয়াছিল। কিন্তু তখনো তাহার ভিতরটা গরম ছিল এবং গলা অবস্থায় ছিল;—তাই চাঁদের উপরকার কঠিন আবরণ ভেদ করিয়া ভিতরকার গলা মাটি-পাথর হাজার হাজার আগ্নেয় পর্ব্বতের আকারে উপরে উঠিত। ইহার পরে চাঁদের ভিতর পর্য্যন্ত ঠাণ্ডা হইলে আগ্নেয় পর্ব্বত নিভিয়া গিয়াছিল এবং চাঁদের চারিদিকে তখনো যে-সব হাল্কা রকমের বাষ্প ছিল তাহা দিয়া জলের সৃষ্টি হইয়াছিল। এই সময়টাই চাঁদের ভাল সময় ছিল,—তখন আমাদের এখনকার পৃথিবীরই মত চাঁদের সমুদ্র-ভরা জল ছিল, হয় ত আকাশ-ভরা বাতাসও ছিল। এখন হইতে কতদিন আগে চাঁদের এই সুখের জীবন আসিয়াছিল জানি না,—কিন্তু তখনো আমাদের পৃথিবী যে, ভয়ানক গরম ছিল এবং তাহাতে পশুপক্ষী মানুষ গাছপালা কিছুই জন্মিতে পারে নাই, তাহা নিশ্চয়।
ইহার পরেই যখন চাঁদের সমস্ত দেহ ভিতর পর্য্যন্ত একেবারে ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছিল, তথনি তাহার সুখের জীবনে মৃত্যুর লক্ষণ একে একে দেখা দিতে আরম্ভ করিয়াছিল। গরম না থাকায় সমুদ্রের জল কতক মাটির ভিতরে প্রবেশ করিয়া বরফ হইয়া পড়িয়াছিল ও কতক চাঁদের দেহের নানা জিনিসের সঙ্গে মিশিয়া লোপ পাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। চাঁদে বাতাস ছিল কিনা জানি না, যদি ছিলই ভাবিয়া লওয়া যায় তাহা হইলে উহাও এক একটু করিয়া চাঁদকে ছাড়িয়া মহাকাশের দিকে পলাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। চাঁদের যেমন দেহখানি ছোট, তাহার টানও সেই রকম অল্প। বাতাসের মত চঞ্চল জিনিসকে সে টানিয়া রাখিতে পারিবে কেন?
এই রকমে যখন চাঁদের ভিতরকার তাপ, সমুদ্র-ভরা জল, আকাশ-ভরা বাতাস একেবারে লোপ পাইয়াছিল, তখনি চাঁদের মৃত্যু হইয়াছিল।