গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/বৃহস্পতির চাঁদ
বৃহস্পতির চাঁদ
বুধ ও শুক্রের চাঁদ নাই; পৃথিবীর চাঁদ মোটে একটি; এবং মঙ্গলের দুটি। কিন্তু একে একে বৃহস্পতির আটটি চাঁদের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে।
বৃহস্পতির যে ছবিটি দিয়াছি, তাহাতে তোমরা আটটি চাঁদের মধ্যে কেবল চারিটিকে দেখিয়াছ। সাধারণ দূরবীণে এই চারিটিকেই দেখা যায়। তিন শত বৎসর পূর্ব্বে দূরবীণের ব্যবহার ছিল না। সেই সময়ে জ্যোতিষীরা বৃহস্পতির চাঁদের কথা একেবারেই জানিতেন না। ইটালি দেশের বড় জ্যোতিষী গ্যালিলিয়োর নাম তোমরা শুনিয়াছ কি? ইনিই সর্ব্বপ্রথমে দূরবীণ দিয়া বৃহস্পতির ঐ বড় চাঁদ চারিটিকে আবিষ্কার করিয়াছিলেন।
তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, ইহাতে আর বাহাদুরি কি? একটা দূরবীণ পাইলে সকলেই চাঁদ বাহির করিতে পারিত। কিন্তু তোমরা যদি তাঁর জীবনের কথাগুলি শুন, তাহা হইলে অবাক্ হইয়া যাইবে।
গ্যালিলিয়ো প্রথম জীবনে তোমার আমার মত সাধারণ লোক ছিলেন। ইটালির একটা কলেজে ছেলেদিগকে অঙ্ক কষাইতেন এবং বাড়িতে চুপ্চাপ্ বসিয়া দিনগুলা কাটাইতেন। এই সময়ে তিনি এক দিন খবর পাইলেন, হল্যাণ্ড্ দেশে একটা আশ্চর্য্য কাচের যন্ত্র বাহির হইয়াছে,—উহা চোখে লাগাইয়া দেখিলে দূরের জিনিস কাছে বোধ হয়। সব কাজকর্ম্ম ছাড়িয়া গ্যালিলিয়ো নিজের হাতে ঐ রকম একটা যন্ত্র নির্ম্মাণ করিতে লাগিয়া গেলেন।
সেকালে এখনকার মত যেখানে সেখানে ভাল কাচ পাওয়া যাইত না। ভাঙা চশ্মার পরকলা কাঠের চোঙের মধ্যে পুরিয়া তিনি পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। তাঁহার এই কাজ দেখিয়া বাহিরের লোকে ভাবিতে লাগিল গ্যালিলিয়ো পাগল হইয়াছেন। তাহা না হইলে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়া লোকটা কাচ জোড়া দিয়া সময় কাটাইবে কেন? গ্যালিলিয়ো কিন্তু লোকের হাসি তামাসা গ্রাহ্য না করিয়া কাজ করিতে লাগিলেন। শেষে তাঁহার শ্রম সার্থক হইল,—একদিন দেখিলেন, তাঁহার কাঠের চোঙের ভিতরকার কাচগুলি দিয়া দূরের জিনিসকে সত্যই কাছে দেখায়। ভাবিয়া দেখ সেদিন গ্যালিলিয়োর কত আনন্দ! তিনি তাঁহার বন্ধুবান্ধবদিকে ডাকিলেন এবং রাত্রিতে ঐ যন্ত্র দিয়া আকাশের গ্রহনক্ষত্র দেখিতে হইবে বলিয়া প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
সন্ধ্যা হইল,—সেদিন পূর্ব্ব-আকাশে বৃহস্পতি জ্বল্-জ্বল্ করিয়া জ্বলিতেছিল। গ্যালিলিয়ো তাঁহার প্রথম দূরবীণ দিয়া বৃহস্পতিকে দেখিতে লাগিলেন। যন্ত্রে একবার মাত্র চোখ লাগাইয়া তিনি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না; সমস্ত গাম্ভীর্য্য ত্যাগ করিয়া আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন! বন্ধুবান্ধবেরা অবাক্ হইয়া পঞ্চাশ বৎসরের বুড়োর পাগলামি দেখিতে লাগিলেন। যে গ্রহটিকে এ পর্য্যন্ত আলোর বিন্দুর মত দেখা যাইত, তাহাকে প্রকাণ্ড আকারে দেখা গেলে এবং তাহার চারিদিকে চারিটি চাঁদকে ঘুরিতে দেখিলে যে, কত আনন্দ হইতে পারে, গ্যালিলিয়োর বন্ধুবান্ধবেরা তাহা বুঝিলেন না। তোমরা কি মনে করিতেছ জানি না,—কিন্তু তোমরা যদি ঐ রকমে নিজের চেষ্টায় গ্রহ-উপগ্রহ আবিষ্কার করিতে পারিতে, তাহা হইলে তোমরাও আনন্দে ঐ রকম অধীর হইতে।
তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, এই রকম একটা বড় আবিষ্কার করায় গ্যালিলিয়ো দেশের লোকের কাছে এবং রাজার কাছে খুব সম্মান পাইয়াছিলেন। কিন্তু প্রথমে ইহা তাঁহার অদৃষ্টে ঘটে নাই। বরং তাঁহাকে নানা রকম অপমান সহ্য করিতে হইয়াছিল। দেশের বড় বড় পণ্ডিতদিগকে ডাকিয়া যখন গ্যালিলিয়ো বলিলেন যে, বৃহস্পতি শুক্র মঙ্গল প্রভৃতি গ্রহেরা পৃথিবীর মত বড় বড় জিনিস এবং চাঁদ সঙ্গে করিয়া তাহারা সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে,—তখন তাঁহারা গ্যালিলিয়োর কথায় কানই দিলেন না। চারটি চাঁদ বৃহস্পতির চারিদিকে ঘুরিতেছে, তাহা দূরবীণ দিয়া দেখাইলেও তাঁহাদের বিশ্বাস হইল না। তাঁহারা বলিতে লাগিলেন,—গ্যালিলিয়ো যাদু-মন্ত্র জানেন, তাই তিনি মন্ত্রের জোরে ভেল্কি দেখাইতেছেন।
সেসময়ে যাদু-মন্ত্র দিয়া প্রতারণা করা একটা বড় অপরাধ বলিয়া লোকে বিশ্বাস করিত। জজ্ সাহেব গ্যালিলিয়োর অপরাধের কথা শুনিয়া তাঁহাকে ধরিয়া বিচার শুরু করিয়া দিলেন। বিচারে প্রমাণ হইল, গ্যালিলিয়ো সত্যই তাঁর দূরবীণে কোনো রকম মন্ত্র পড়িয়া বৃহস্পতির চারটি চাঁদ দেখাইয়াছেন! চোর ডাকাতের মত গ্যালিলিয়োকে জেলে যাইতে হইল!
দেখ, গ্যালিলিয়োর কি দূরদৃষ্ট! জেলে যাইবার সময়েও তিনি বলিতে লাগিলেন,—দূরবীণে যাহা দেখা গিয়াছে সত্য। সূর্য্য আকাশে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং গ্রহেরা তাহারি চারিদিকে ঘুরিতেছে!
সত্য কথা বেশি দিন ঢাকা থাকে না। জেল হইতে গ্যালিলিয়ো খালাস পাইলে লোকে বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তিনি ঠিক্ কথাই বলিয়াছেন। ইহার পর হইতে পৃথিবীর লোকে গ্যালিলিয়োকে খুব সম্মান দেখাইয়াছিল।
বৃহস্পতির যে চারিটি চাঁদকে লইয়া তিন শত বৎসর পূর্ব্বে এত কাণ্ড হইয়াছিল, তোমরা ছোট দূরবীণ হাতে পাইলেও একবার তাহাদিগকে দেখিয়ো। তোমরাও গ্যালিলিয়োর মত আনন্দ পাইবে। আমি যখন তোমাদের মত ছোট ছিলাম তখন একবার বৃহস্পতির চাঁদ দেখিয়াছিলাম,—তার পরে এই বুড়ো বয়সে সেগুলিকে অনেক বার দেখিয়াছি; কিন্তু যখনি দেখিয়াছি তখনি অবাক্ হইয়াছি। আমাদের কাছ হইতে দূরে পৃথিবীরই মত একটা গ্রহ আছে এবং তাহার চারিদিকে অনেকগুলি চাঁদ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, ইহা দেখিলে আশ্চর্য্য না হইয়া থাকা যায় কি?
কেবল ইহাই নয়, দূরবীণ দিয়া যদি তোমরা বৃহস্পতিকে দেখিতে পার, তাহা হইলে স্পষ্ট জানিতে পারিবে, উহার প্রথম চাঁদটি ঘুরিতে ঘুরিতে দুই ঘণ্টা কুড়ি মিনিট অন্তর এবং দ্বিতীয় চাঁদটি প্রায় তিন ঘণ্টা অন্তর এক এক বার বৃহস্পতির পিছনে লুকাইতেছে এবং কিছুক্ষণ পরে আবার হঠাৎ বাহির হইয়া পড়িতেছে। চাঁদগুলির মধ্যে কোন্টি কখন বৃহস্পতির পিছনে লুকাইবে তাহা ইংরাজি পাঁজিতে (Nautical Almanac) লেখা থাকে। পাঁজির সময়ের সঙ্গে মিলাইয়া এই রকম গ্রহণ দেখা, বড় মজার।
আমাদের চাঁদটি কত বড় তোমরা তাহা আগেই শুনিয়াছ। জ্যোতিষীরা হিসাব করিয়া দেখিয়াছেন, বৃহস্পতির প্রথম চারিটি চাঁদ আমাদের চাঁদের মত বড় এবং পৃথিবীর চাঁদের মত তাহাদেরো ক্ষয়বৃদ্ধি অমাবস্যা-পূর্ণিমা আছে।
বৃহস্পতির বাকি চারটি চাঁদ খুবই ছোট। ভাল দূরবীণ দিয়াও তাহাদিগকে দেখা দায়। তাই পঁচিশ বৎসর পূর্ব্বে ইহাদের কথা জ্যোতিষীরা জানিতেন না। আমেরিকার লিক্ মানমন্দিরের বড় দূরবীণটি খাটানো হইলে, তাহা দিয়াই ইংরাজি ১৮৯২ সালে বৃহস্পতির পঞ্চম চাঁদের সন্ধান পাওয়া গিয়াছিল। তার পরে ক্রমে ক্রমে আর তিনটির সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। এই রকমে অল্প দিনের মধ্যে চারটি বদলে বৃহস্পতির চাঁদ এখন আটটি হইয়া দাঁড়াইয়াছে।