গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/শনি
শনি
নামটি শুনিলেই ভয় হয়। শনির দৃষ্টি যাহার উপরে পড়ে, তাহার আর উদ্ধার নাই। শনি একবার নাকি আদর করিয়া গণেশের দিকে চাহিয়াছিল, ইহাতে গণেশের কি দুর্গতি হইয়াছিল, তাহা ত তোমরা জান। তাঁহার মাথাটি উড়িয়া গিয়াছিল, শেষে একটা হাতীর মাথা আনিয়া জোড়া দেওয়ায় গণেশ বাঁচিয়া ছিলেন। যাহা হউক, সেই শনিই এখন আকাশে গ্রহরূপে বিরাজ করিতেছেন। আমাদের পূর্ব্ব পুরুষেরা শনি-গ্রহকে বেশ জানিতেন। ইহার গতিবিধি উদয়-অস্ত সকলি হিসাব পত্র করিতেন। কাজেই শনি অতি পরিচিত গ্রহ। হয় ত দুই হাজার বৎসর পূর্ব্বেও ইহার কথা আমাদের জ্যোতিষীদের জানা ছিল।
বৃহস্পতির পরেই শনির পথ। ইহার মত আশ্চর্য্য গ্রহ তোমরা সমস্ত আকাশে খুঁজিয়া পাইবে না। গ্যালিলিয়ো সাহেব তাঁহার নিজের দূরবীণ দিয়া শনিকে প্রথন দেখিয়া যেমন অবাক্ হইয়াছিলেন, তিন শত বৎসর পরে এখনো শনিকে দেখিয়া ঠিক্ সেই রকমেই অবাক হইতে হয়। বড় দূরবীণে বুধ শুক্র মঙ্গল বা বৃহস্পতিকে দেখিলে কোনোটিকে চাঁদের মত বড় দেখায়, কোনোটিকে হয় ত ভাঁটার মত দেখায়। কিন্তু শনির আকৃতি ইহাদের কাহারো সহিত মিলে না। দূরবীণে শনিকে কি রকম দেখায়, এখানে তাহার একখানি ছবি দিলাম।
ছবিতে দেখ,—চাকার মত কয়েকটি উজ্জ্বল গোল জিনিস রহিয়াছে এবং তাহারি ফাঁকে ভাঁটার মত শনি-গ্রহ দাঁড়াইয়া আছে। চাকাগুলির সহিত শনির আসল দেহের কোনো যোগ নাই,—মাঝে বেশ একটু ফাঁক। দূরবীণ দিয়া কোনো গ্রহকে যদি হঠাৎ এই রকম আকারে দেখা যায়, তাহা হইলে আশ্চর্য্য না হইয়া থাকা যায় কি? শনি সত্যই এই রকম আশ্চর্য্য জিনিস। এই রকমটি আর কোথায়ও দেখা যায় না।
আকাশের এতগুলো তারার মধ্যে কোন্টি শনি, তাহা স্থির করা কঠিন নয়। যাঁহারা তোমাদের চেয়ে বয়সে বড় তাঁদের মধ্যে কাহারো একটু জ্যোতিষ জানা থাকিলে, কোন্ নক্ষত্রটি শনি তাহা তিনি দেখাইয়া দিতে পারিবেন। যদি সে-রকম কাহাকেও না পাও, নিজেরাই পাঁজি দেখিয়া শনির সন্ধান করিতে পারিবে। প্রতিমাসে শনি-গ্রহ কোন নক্ষত্র-রাশিতে থাকে, তাহা পাঁজিতে লেখা থাকে। কিন্তু খালি চোখে শনিকে দেখা আর না দেখা উভয়ই সমান। শনির সেই প্রকাণ্ড আকৃতি, তাহার চারিদিকের চাকা এবং তাহার গোটা দশেক চাঁদ, কিছুই খালি চোখে দেখা যায় না। দূরবীণ না দিয়া দেখিলে তাহাকে একটা উজ্জ্বল তারার মতই দেখিবে।
যে-সকল জ্যোতিষী শনিকে প্রথমে দেখিয়াছিলেন, তাঁহারা উহার চাকাগুলিকে গায়ে লাগানো না দেখিয়া বড়ই আশ্চর্য্য হইয়াছিলেন। চাকা শনির চারিদিক বেড়িয়া কি রকমে শূন্যে দাঁড়াইয়া থাকে ইহাই তাঁহাদের চিন্তার বিষয় হইয়াছিল, এখন অবশ্য এরকম দুশ্চিন্তার কারণ নাই, আজকালকার জ্যোতিষীরা শনির খুঁটিনাটি অনেক খবরই জানিতে পারিয়াছেন। আমরা একে একে সেই সব খবরই তোমাদিগকে দিব। তোমরা যদি কাছে থাকিতে, তাহা হইলে আমাদের দূরবীণটা দিয়া শনির আশ্চর্য্য আকৃতি তোমাদিগকে দেখাইতে পারিতাম। কিন্তু তাহা যখন হইবার নহে, কাজেই এখন শনির ছবি দেখিয়া ও তাহার গল্প শুনিয়া তোমাদিগকে সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে।
শনির চাকার কথা তোমাদিগকে পরে বলিব। এখন উহার আসল দেহটার কথাই বলা যাউক।
আয়তনে শনি বড় ছোট নয়। বৃহস্পতি সব চেয়ে বড়, তার নীচেই শনি। হিসাব করিলে দেখা যায়, সাতশত তিরাশীটা পৃথিবী জোড়া না দিলে একটা শনিকে নির্ম্মাণ করা যায় না। কিন্তু যে-সব পদার্থ দিয়া শনি প্রস্তুত, তাহা নিতান্ত হাল্কা,—আমাদের পৃথিবীর মাটি-পাথরের চেয়েও হাল্কা, এমন কি জলের চেয়েও হাল্কা। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, শনির দেহে পৃথিবীর দেহের মত জমাট জিনিস কিছুই নাই,—ইহার হয় ত সবই বাষ্প। কিন্তু এই বাষ্প খুব ঘন অবস্থায় আছে; আর কিছু দিন গরম ছাড়িলে উহা জমাট বাঁধিতে থাকিবে।
পৃথিবী হইতে সূর্য্য কত দূরে আছে তাহা তোমাদিগকে আগে বলিয়াছি। শনি আমাদের কাছ হইতে তাহারি প্রায় নয় গুণ দূরে আছে। এত দূরে থাকা সত্ত্বেও দূরবীণ দিয়া শনির গায়ে কতকগুলি কালো কালো দাগ দেখিতে পাওয়া যায়। শনির ছবি দেখিলেই তোমরা ঐ দাগগুলিকে চিনিতে পারিবে। জ্যোতিষীরা বলেন, ঐগুলি উহার মেঘের চিহ্ন। কিন্তু তাই বলিয়া শনির মেঘকে পৃথিবীর মেঘের মত মনে করিয়ো না। শনির মেঘ কেবলই জলের বাষ্প নয়। সেখানকার মেঘে বৃষ্টিও হয় না,—নানা জিনিসের গরম বাষ্প একত্র হইয়া শনির আাকাশকে মেঘের মত আচ্ছন্ন করিয়া রাখে।
পৃথিবী প্রতি সেকেণ্ডে ঊনিশ মাইল করিয়া চলিয়াও সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসিতে তিনশত পঁইষট্টি দিন সময় লয়। কিন্তু শনি সেকেণ্ডে ছয় মাইলের বেশি চলিতে পারে না, তার উপরে উহার পথটাও খুব লম্বা। এই দুই কারণে একবার সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসিতে তাহার ত্রিশ বৎসর সময় লাগে। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, শনির এক বৎসর আমাদের ত্রিশ বৎসরের সমান। কিন্তু একটা বিষয়ে শনির জিৎ আছে। পৃথিবী তাহার মেরুদণ্ডের চারিদিকে ঘুরিতে চব্বিশ ঘণ্টা সময় লয়। সেই জন্য আমাদের দিনরাত্রির পরিমাণ চব্বিশ ঘণ্টা। কিন্তু শনি দশ ঘণ্টা চৌদ্দ মিনিটের মধ্যেই তাহার মেরুদণ্ডের চারিদিকে ঘুরা শেষ করিতে পারে। তাহা হইলে দেখ, শনির এক বৎসর আমাদের বৎসরের ত্রিশ গুণ হইলেও, তাহার এক দিন এক রাত্রি দশ ঘণ্টা চৌদ্দ মিনিটের বেশি নয়। শনিতে যদি মানুষ থাকিত, তাহা হইলে তাহারা উদয়ের পাঁচ ঘণ্টা পরেই সূর্য্যকে অস্ত যাইতে দেখিত।
সূর্য্য দূরে আছে বলিয়া শনিতে সূর্য্যের আলো ও তাপ দুইই কম লাগে। হিসাব করিলে দেখা যায়, আমরা যে তাপ ও আলো পাই শনি তাহারি নব্বুই ভাগের এক ভাগ মাত্র পায়। ভাবিয়া দেখ, সেখানে কত অল্প আলো, কিন্তু এত অল্প আলোতেই শনিকে বেশ উজ্জ্বল দেখায়। এই জন্য জ্যোতিষীরা বলেন, সম্ভবতঃ কেবল সূর্য্যের আলোতেই শনির আলো নয়; ইহার দেহের আগুন হয় ত আজও নিভিয়া যায় নাই। তাই সূর্য্যের আলোর সঙ্গে নিজের আলো মিশাইয়া তাহার এত আলো। বৃহস্পতিকে খুব উজ্জ্বল দেখিয়া তাহার সম্বন্ধেও জ্যোতিষীরা এই কথাই বলিয়াছেন।