মঙ্গল

এবার আমরা মঙ্গলগ্রহের কথা বলিব। শুক্রের পথের বাহিরে পৃথিবীর ভ্রমণ-পথ। ইহার পরেই মঙ্গলের পথ। আগেকার সেই ছবিখানি দেখিলে তোমাদের এই-সব কথা মনে পড়িবে। কাজেই দেখা যাইতেছে, পৃথিবীর এক দিকে আছে শুক্র এবং আর এক দিকে আছে মঙ্গল। শুক্র ও মঙ্গল যেন পৃথিবীর দুইপাশের দু’জন প্রতিবেশী। ইহাদের দু’জনের মধ্যে শুক্রই পৃথিবীর একটু কাছে, মঙ্গল একটু দূরে। ঘুরিতে ঘুরিতে সে যখন পৃথিবীর খুব কাছে আসিয়া দাঁড়ায়, তখন তাহার দুরত্ব চাঁদের দূরত্বের প্রায় এক শত গুণ হয়। মঙ্গল কখনই ইহার চেয়ে পৃথিবীর কাছে আসিতে পারে না।

 মঙ্গলকে ইংরাজিতে Mars বলে। আমাদের দেশের প্রাচীন জ্যোতিষীরা ইহাকে নানা নামে ডাকিতেন;—অঙ্গারক, লোহিতাঙ্গ, যম, কুজ, সম্বর্ত্ত এই রকম অনেক নাম আমাদের পুরাণ ও জ্যোতিষের বইতে দেখা যায়। কিন্তু “মঙ্গল” এই নামটা ইহার নিতান্তই আদরের নাম। গ্রহ-নক্ষত্রের স্থান ইত্যাদি দেখিয়া যাঁহারা মানুষের ভাগ্য গণনা করেন, তাঁহারা মঙ্গলকে ভাল গ্রহ বলেন না। মঙ্গলের স্বভাব অত্যন্ত ক্রূর, এজন্য ইহার দৃষ্টি যাহার উপরে পড়ে, তাহার নাকি অমঙ্গল হয়। এই জন্যই বলিতেছিলাম, “মঙ্গল” এই নামটি উহার আদরের নাম। যাহা হউক গণক ঠাকুরদের কথা বলিব না, আকাশের বহুদূরের গ্রহেরা এক-একটা মানুষের উপরে দৃষ্টি দিয়া কি রকমে তাহার অদৃষ্টকে কখনো ভাল কখনো মন্দ করে, তাহা জানি না।

 মঙ্গল-গ্রহের জন্ম-সম্বন্ধে আমাদের পুরাণে একটি মজার গল্প আছে।

 দক্ষ-যজ্ঞে সতীর প্রাণত্যাগের গল্প তোমরা শুন নাই কি? সতী অর্থাৎ দুর্গার পিতা দক্ষরাজা খুব জাঁকজমকের সঙ্গে এক ভোজের আয়োজন করিলেন এবং তাঁর সব মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করিলেন কিন্তু সব চেয়ে ছোট মেয়ে সতী ও তাঁহার স্বামী শিবকে নিমন্ত্রণ করিলেন না। শিব শ্মশানে বেড়াইতেন, বড় বড় সাপ গলায় বাঁধিয়া রাখিতেন, গায়ে ছাইভস্ম মাখিতেন এবং ষাঁড়ের উপর চাপিয়া ভিক্ষা করিতেন। এইসব দেখিয়া দক্ষরাজা শিবের উপরে রাগ করিয়াছিলেন; তাই শিবকে অপমান করিবার জন্যই তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করেন নাই।

 পিতা মহাযজ্ঞ করিতেছেন শুনিয়া সতী স্থির থাকিতে পারিলেন না, তিনি শিবকে না বলিয়া বিনা-নিমন্ত্রণে বাপের বাড়ী গিয়া হাজির হইলেন। কিন্তু বাপ তাঁহাকে আদর করিলেন না; উপরন্তু শিবের অনেক নিন্দা করিতে লাগিলেন। বাপের বাড়ীতে গিয়া এই রকম অনাদর হইবে তাহা সতী আগে বুঝিতে পারেন নাই, বুঝিলে তিনি নিশ্চয়ই শিবের কাছ-ছাড়া হইয়া আসিতেন না। যাহা হউক, স্বামীর নিন্দা শুনিয়া সতী মনে খুব কষ্ট পাইয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। মূর্চ্ছা ভাঙাইবার জন্য খুব চেষ্টা করা হইল কিন্তু সে মূর্চ্ছা আার ভাঙিল না,—সতীর মৃত্যু হইল।

 শিব সতীর মৃত্যু-সংবাদ পাইবামাত্র তাঁহার অনুচর ভূত-প্রেত পিশাচদের সঙ্গে করিয়া দক্ষরাজার যজ্ঞ-স্থানে আসিয়া হাজির হইলেন। ভূতগুলা ভোজের সব আয়োজন নষ্ট করিয়া ফেলিল। স্ত্রীর মৃত্যুতে শিব শোকে এবং ক্রোধে পাগলের মত হইলেন। পুরাণে লেখা আছে, এই সময়ে তাঁহার কপাল হইতে এক বিন্দু ঘাম মাটিতে পড়িয়া এক ভয়ানক বীরপুরুষের উৎপত্তি করিয়াছিল। ভূত-প্রেতেরা দক্ষের যজ্ঞ নষ্ট করিবার জন্য অনেক পরিশ্রম করিতেছিল, কিন্তু ঐ বীরপুরুষটি জন্মগ্রহণ করিয়া এক নিমেষে একাই যজ্ঞক্ষেত্রকে শ্মশানক্ষেত্র করিয়া ফেলিল। লোকে ভাবিল, বুঝি বা প্রলয়কাল উপস্থিত হইয়াছে। শিব এই বীরপুরুষের নাম দিলেন বীরভদ্র।

 বীরভদ্র কিন্তু দক্ষ-যজ্ঞ নষ্ট করিয়াই ক্ষান্ত হইল না,—এক লাফে স্বর্গে উঠিয়া স্বর্গ নষ্ট করিল, আর এক লাফে পাতালে নামিয়া পাতালপুরী ধ্বংস করিল; সপ্ত সমুদ্রে পর্য্যন্ত আগুন ধরাইয়া দিল, সমুদ্রের জল দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে লাগিল। স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালের লোকেরা বীরভদ্রের অত্যাচারে ‘ত্রাহি ত্রাহি’ ডাক ছাড়িতে লাগিল!

 শিব এই-সব দেখিয়া মহা চিন্তায় পড়িলেন। বীরভদ্রের মত পালোয়ানকে ত্রিভুবনের মধ্যে রাখিলে যে, সৃষ্টি লোপ পাইয়া যাইবে, তাহা তিনি স্পষ্ট বুঝিলেন। বীরভদ্রের ডাক পড়িল। শিব তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া বলিলেন, তাহার অদ্ভুত শক্তির পরিচয় পাইয়া তিনি খুবই খুসী হইয়াছেন। কিন্তু এখন আর তাহার ত্রিভুবনে থাকা চলিবে না; আকাশের উপরে গ্রহের আকারে বাস করিতে হইবে। শিবের আদেশ অমান্য করা কাহারো সাধ্য নাই। আদেশ হইবামাত্র, বীরভদ্র একটি গ্রহের আকার লইয়া আকাশের উপরে ভাসিয়া বেড়াইতে লাগিল। পুরাণের মতে এই গ্রহটিই আমাদের মঙ্গল গ্রহ।

 তোমরা কখনো মঙ্গলকে দেখিয়াছ কি? যদি না দেখিয়া থাক, সুবিধামত একবার দেখিয়া লইয়ো। সাধারণতঃ ইহাকে লাল রঙের নক্ষত্রের মত দেখায়,—বোধ হয় এই জন্য আমাদের দেশের প্রাচীন জ্যোতিষীরা ইহার “অঙ্গারক” এবং “লোহিতাঙ্গ” নাম দিয়াছিলেন। কিন্তু মঙ্গলকে কখনই শুক্রের মত উজ্জ্বল দেখা যায় না। এই জন্য ইহাকে যখন-তথন চিনিয়া লইতে মুস্কিল হয়। লাল রঙের অনেক নক্ষত্র আকাশে আছে, এই সব নক্ষত্রের মধ্যে মঙ্গলকে হারাইয়া ফেলা আশ্চর্য্য নয়। কিন্তু সে যখন পৃথিবীর নিকটে আসে তখন তাহাকে বেশ চেনা যায়। দূরের জিনিস কাছে আসিলেই বড় দেখায়। এজন্য মঙ্গলকেও ঐ সময়ে বেশ বড় দেখায়; তা’র উপরে আবার লাল রঙ্ থাকে। আকাশে যখন লাল রঙের বড় তারা দেখিবে, তখন জানিবে উহা মঙ্গলগ্রহ।

 কিন্তু মঙ্গলকে দেখিবার ঐ রকম সুবিধা সকল বৎসরে হয় না। দুই বৎসর অন্তর কয়েক মাসের জন্য যখন উহা পৃথিবীর কাছে আসে কেবল সেই সময়েই উহাকে বড় দেখায়। অন্য সময়ে মঙ্গলকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইলে তোমরা পাঁজি দেখিয়া উহার স্থান ঠিক করিয়া লইতে পারিবে। পাঁজিতে যেখানে মাসের বিবরণ আরম্ভ হইয়াছে, তাহার ঠিক আগেকার পাতায় কোন্ গ্রহ আকাশের কোন রাশিতে আছে তাহা স্পষ্ট করিয়া লেখা থাকে। রাশিচক্রের সঙ্গে তোমাদের যখন পরিচয় হইবে, তখন রাশিগুলিকে খুঁজিয়া তোমরা তাহাদের মধ্যে গ্রহদের সন্ধান করিতে পারিবে।

 মনে কর, আমরা বাংলা ১৩২১ সালের বৈশাখ মাসে মঙ্গলগ্রহকে চিনিবার জন্য পাঁজি দেখিতেছি। পাঁজিতে লেখা আছে ৫ই বৈশাখ মঙ্গল কর্কট-রাশিতে আছে। রাশিচক্রের সহিত তোমাদের যখন পরিচয় হইবে, তখন কর্কট-রাশি আকাশের কোন্ জায়গায় আছে একবার আকাশের দিকে তাকাইয়াই তোমরা চিনিতে পারিবে। কাজেই এই কর্কট-রাশিতে খোঁজ করিলেই তোমরা মঙ্গলকে দেখিতে পাইবে। নক্ষত্রদের মধ্য হইতে গ্রহদিগকে চিনিয়া বাহির করিবার এমন সহজ উপায় আর কোথাও পাইবে না।

 যাহা হউক এখন মঙ্গলের অন্যান্য বিষয়গুলির কথা বলা যাউক।

 আয়তনে মঙ্গল পৃথিবীর অনেক ছোট, এমন কি শুক্রের চেয়েও ছোট। চারিটা মঙ্গল জোড়া না দিলে একটা পৃথিবী গড়া যায় না। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, আয়তনে মঙ্গল পৃথিবীর সিকির সমান। ইহার উপরে আবার সে বেশি ভারিও নয়। একটা প্রকাণ্ড দাঁড়িপাল্লায় এক দিকে যদি পৃথিবীকে চাপাও, তাহা হইলে আর একদিকে নয়টা মঙ্গলকে না চাপাইলে দুইয়ের ভার সমান হইবে না। যে মাল-মসলা দিয়া ভগবান মঙ্গলকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা পৃথিবীর মাটিপাথরের চেয়ে অনেক হাল্‌কা।

 মঙ্গলের একটা ভাল লক্ষণ এই যে, বুধ ও শুক্রের মত ইহার এক পিঠে চিরদিনের জন্য রাত্রি এবং আর এক পিঠে চিরদিনের জন্য দিন নাই। দিন-রাত্রি ঋতু-সম্বৎসর সকলি মঙ্গলে আছে। এই হিসাবে ইহাকে পৃথিবীরই মত গ্রহ বলা যাইতে পারে। এই জন্যই আাজকালকার জ্যোতিষীরা বলিতেছেন, সম্ভবতঃ মঙ্গলে জীবজন্তু গাছপালা এবং মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণী আছে।

 পৃথিবীতে দিন-রাত্রি কি রকমে হয়, তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। পৃথিবী প্রায় চব্বিশ ঘণ্টায় তাহার মেরুদণ্ডের চারিদিকে একবার লাট্টুর মত ঘুরপাক খায়, তাই আমাদের দিবারাত্রির পরিমাণ চব্বিশ ঘণ্টা। কিন্তু মঙ্গল তাহার মেরুদণ্ডের চারিদিকে ঘুরিতে প্রায় সাড়ে চব্বিশ ঘণ্টা সময় লয়। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, মঙ্গলে দিবারাত্রির পরিমাণ আমাদের দিবারাত্রির প্রায় সমান; কেবল কয়েক মিনিট মাত্র বেশি। কিন্তু মঙ্গলের এক বৎসরের সহিত আমাদের এক বৎসরের তফাৎ বড় বেশি। পৃথিবী তিন শত পঁইষট্টি দিনে একবার সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসে, তাই আমাদের এক একটা বৎসর তিন শত পঁইষট্টি দিনে শেষ হয়। মঙ্গল ঐ রকমে সূর্য্যকে ঘুরিতে কেবলমাত্র ছয় শত সাতাশী দিন লয়। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, মঙ্গলের এক বৎসর আমাদের প্রায় এক বৎসর এগারো মাসের সমান।

 সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসিতে মঙ্গল কেন এত বেশি সময় লয়, তোমরা অনুমান করিতে পার কি? একটু ভাবিয়া দেখিলেই বুঝিবে, সূর্য্য হইতে পৃথিবীর দূরত্ব যত, মঙ্গলের দুরত্ব তার চেয়ে অনেক বেশি। এই জন্য মঙ্গলের পথটা পৃথিবীর পথের চেয়ে অনেক বড় হইয়া পড়িয়াছে। অল্প রাস্তা চলিতে অল্প সময় লাগে এবং বেশি রাস্তা চলিতে বেশি সময় লাগে, ইহা তোমাদের জানা কথা। এই জন্যই মঙ্গল সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসিতে বেশি সময় লয়। এ সম্বন্ধে আর একটা কথাও বলা যাইতে পারে। পৃথিবী কত বেগে চলিয়া সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসে, তাহা তোমরা জান না কি? সে প্রতি সেকেণ্ডে ঊনিশ মাইল করিয়া চলে। কিন্তু মঙ্গল ইহার চেয়ে অল্প বেগে সূর্য্যকে ঘুরে। এই বেগের পরিমাণ সেকেণ্ডে পনেরো মাইল মাত্র। কাজেই দেখ, মঙ্গল দু’রকম অসুবিধার মধ্যে থাকিয়া সূর্য্যকে ঘুরে,—প্রথমে তাহার রাস্তাটা খুব লম্বা, তার উপরে সে চলে আস্তে আস্তে। এই দুই কারণেই মঙ্গল এক বৎসর এগারো মাসের কমে সূর্য্যকে ঘুরিতে পারে না।

 মঙ্গলের চাল-চালন সম্বন্ধে মোটামুটি কতকগুলি কথা তোমাদিগকে বলিলাম। এখন উহার উপরকার খবর তোমাদিগকে দিব। আমাদের প্রতিবেশী বলিয়া মঙ্গলের অনেক খবরই আমাদের জানা আছে। এথনো দু’এক জন জ্যোতিষী বড় বড় দূরবীণ দিয়া কেবল মঙ্গলকেই পর্য্যবেক্ষণ করিতেছেন, তাহার ফোটোগ্রাফ্-ছবি তুলিতেছেন, এবং তাহার উপরে কি কি জিনিস আছে ভাল করিয়া দেখিতেছেন। এই রকমেই মঙ্গল গ্রহ-সম্বন্ধে অনেক খবর আমরা অল্পদিনের মধ্যে জানিতে পারিয়াছি।

 মঙ্গলে বাতাস আছে এবং বাতাসে কিছু জলীয় বাষ্পও মিশানো আছে, কিন্তু পৃথিবীর আকাশের মত মঙ্গলের আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে না। এই জন্য মঙ্গলের উপরকার অনেক জিনিস আমরা দূরবীণ দিয়া পরিষ্কার দেখিতে পাই।

 এখানে মঙ্গলের দুইখানি ছবি দিলাম। খুব বড় দূরবীণে মঙ্গলকে যে রকম দেখায়, ছবি ঠিক সেই রকমের। ছবির উপরে যে শাদা দাগ দেখিতেছ, তাহা কিসের দাগ বলিতে পার কি? জ্যোতিষীরা


মঙ্গলের বরফ
 
মঙ্গলের বরফের বন্যা

ঠিক্ করিয়াছেন, শীতকালে মঙ্গলের দুই মেরুপ্রদেশে যে বরফ জমে, ঐ দাগটি তাহারি। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, পৃথিবীর মেরুপ্রদেশ, শীতকালে যেমন বরফে ঢাকা পড়ে, মঙ্গলের মেরুপ্রদেশও ঠিক্ সেই রকমে বরফে আচ্ছন্ন হয়।

 শীতকালে পৃথিবীর মেরুপ্রদেশে এবং উঁচু পর্ব্বতের উপরে যে বরফ জমে, বসন্ত বা গ্রীষ্মকাল আসিলে তাহা গলিতে আরম্ভ হয় এবং এই বরফ-গলা জলে অনেক নদ-নদী পূর্ণ হইয়া পড়ে। মঙ্গলেও ঠিক্ তাহাই দেখা যায়। পৃথিবীতে কোন্ সময়ে বসন্ত ঋতু আসে এবং কখন গ্রীষ্মকাল উপস্থিত হয়, ইহা আমাদের জানা আছে। জ্যোতিষীরা হিসাব করিয়া মঙ্গলেরও শীত গ্রীষ্ম প্রভৃতি ঋতুর সময় ঠিক্ করিয়াছেন। ইঁহারা বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে মঙ্গলের ছবি উঠাইয়া দেখিয়াছেন, তখন তাহারো দুই মেরুপ্রদেশের বরফ গলিতে আরম্ভ করে এবং সেই বরফ-গলা জল, তাহার উপরকার শত শত খাল দিয়া সর্ব্বাঙ্গে ছড়াইয়া পড়ে।

 এখানে মঙ্গলের আর একখানা ছবি দিলাম। ইহার গায়ে যে-সব
মঙ্গলে খালের চিহ্ন
রেখা কাটা রহিয়াছে, এইগুলিই খালের চিহ্ন। গ্রীষ্মকালে মেরুপ্রদেশের বরফ গলিতে আরম্ভ করিলে, বরফের জল এই খাল দিয়া আসিয়া কয়েক মাসের জন্য মঙ্গলকে আমাদের পৃথিবীরই মত সরস করিয়া তুলে। তথন মঙ্গল গ্রহে পৃথিবীর মত গাছ-পালাও জন্মে। কিন্তু এই সময় ব্যতীত অন্য কোনো সময়ে ইহাতে জলের চিহ্ন দেখা যায় না। শুষ্ক মরুভূমিতে সূর্য্যের আলো পড়িলে যেমন দেখায়, তখন মঙ্গলকে সেই রকম মরুভূমির মত দেখা যায়। মঙ্গলের গায়ের লাল রঙটা, বালির উপরকার রৌদ্রেরই রঙ্।

 পৃথিবীতে যে-সকল নদ নদী হ্রদ ও সমুদ্র আছে, তাহার কোনোটিকে কেহ কোদাল দিয়া খুঁড়িয়া প্রস্তুত করে নাই। এগুলি আপনা হইতে জন্মে এবং আপনা হইতে বুজিয়া আসে। কিন্তু খাল বিল পুষ্করিণী আমরা মজুর দিয়া বা এন্‌জিন্ দিয়া খুঁড়িয়া প্রস্তুত করি। মঙ্গলের উপরে যে সোজা সোজা থাল দেখা যায়, সেগুলি আপনা হইতে জন্মিয়াছে, কি মঙ্গলের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী তাহাদিগকে খুঁড়িয়াছে, এই কথাটির মীমাংসার জন্য অনেক দিন ধরিয়া জ্যোতিষীদের মধ্যে খুব তর্ক-বিতর্ক হইতেছে। এক দল জ্যোতিষী বলিতেছেন, এগুলি মঙ্গলের লোকেদের হাতে প্রস্তুত। হাতে-গড়া জিনিস না হইলে খালগুলি, এমন সোজা এবং এমন পরিষ্কার হইত না। যাহা আপন হইতে প্রস্তুত হয়, তাহা কখনই এমন সিম্‌সাম্ হয় না। পৃথিবীর প্রত্যেক নদীই আপনা হইতে প্রস্তুত হইয়াছে; এজন্য কোনো নদীকে কখনো ঠিক্ সোজা পথে চলিয়া সমুদ্রে মিলিতে দেখা যায় না। কাজেই স্বীকার করিতে হয়, মঙ্গলের খালগুলি স্বাভাবিক নদী-নালা নয়,—তাহা মঙ্গলেরই অধিবাসী কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীদের হাতে প্রস্তুত।

 আর এক দল জ্যোতিষী এই-সকল কথায় বিশ্বাস করেন না। তাঁহারা বলেন, মঙ্গলের উপরে যে সোজা রেখা দেখা যায়, সেগুলি সত্যই সোজা নয়। দূর হইতে মঙ্গলকে দেখি বলিয়া আমাদের চোখে ধাঁধা লাগে এবং এই ধাঁধায় পড়িয়া আমরা বাঁকা জিনিসকে সোজা দেথি এবং এলোমেলো জিনিসকে বেশ সিমসাম্ সাজানো দেখি।    মঙ্গলের খালের সম্বন্ধে দুই দলের কথাই বলা গেল। এক দলের কথা আর এক দলের কথার ঠিক্ উল্‌টা। এখনো দুই দলের মধ্যে বিষয়টা লইয়া ঝগড়া-ঝাঁটি ও তর্ক-বিতর্ক চলিতেছে। এজন্য কোন্ দলের কথা সত্য, এখন তোমাদিগকে বলিতে পারিলাম না।

 কিন্তু ইহা ঠিক্ যে, মঙ্গলে যদি বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে, তবে তাহারা আমাদের মত সুখী নয়। মঙ্গলে মেঘ হয় না এবং বৃষ্টিও হয় না। কাজেই আমাদের মত প্রাণীকে সেখানে থাকিতে হইলে জলের জন্য তাহাদিগকে দিবারাত্রি হাহাকার করিতে হয়। বৎসরের মধ্যে যখন একবারমাত্র বরফ-গলা জল আসিয়া খালগুলিকে ভরিয়া দেয়, হয় ত তখনি তাহাদিগকে সমস্ত বৎসরের পানীয় জল জোগাড় করিয়া রাথিতে হয়। কূয়ো খুঁড়িয়া জল পাইবার উপায় নাই, কারণ মঙ্গলের খুব নীচেকার মাটিও হয় ত সরস নয়। মঙ্গলে চাষ-আবাদ করাও দায়। বরফ-গলা জলের বন্যা আসিলে মঙ্গলবাসীদিগকে তাড়াতাড়ি চাষ-আবাদ করিয়া বৎসরের খোরাক মরাইয়ে পুরিয়া রাখিতে হয়। সুতরাং মঙ্গলের লোকেদের এই রকম জীবনকে কেমন করিয়া সুখের জীবন বলা যায়!

 তার পরে ভাবিয়া দেখ, সেই লম্বা লম্বা সোজা রেখাগুলি যদি সত্যই মঙ্গলের খাল হয়, তাহা হইলে খাটিয়া খুটিয়া খালগুলিকে ভাল অবস্থায় রাখাও মঙ্গলবাদীদের একটা প্রধান কাজ হইয়া পড়ে। মঙ্গলের সমস্ত খালের দৈর্ঘ্য প্রায় সাত লক্ষ মাইল; এত লম্বা খালগুলিকে ভাল অবস্থায় রাখিতে গিয়া মঙ্গলবাসীদিগকে যেরকম পরিশ্রম করিতে হয়, তাহা বোধ হয় পৃথিবীর মানুষে পারে না।

 মঙ্গল-গ্রহের এই সব কথা জানিয়া জ্যোতিষীরা বলেন, গ্রহটি প্রাণীর বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য না হইলেও, তাহা ক্রমে চাঁদের মত মরিতে চলিয়াছে। মঙ্গলে এককালে পৃথিবীরই মত ঘন বাতাস ছিল; কিন্তু দেহ ক্ষুদ্র এবং টানিবার শক্তি অল্প বলিয়া সে বাতাসকে বাঁধিয়া রাখিতে পারে নাই; এক একটু করিয়া অনেক বাতাসই মঙ্গলকে ছাড়িয়া মহাশূন্যে মিশিয়া গিয়াছে। জলের অবস্থাও তাহাই;—চাঁদের মত মঙ্গলে সাগরের গর্ত্ত আছে বলিয়া মনে হয়, কিন্তু তাহাতে একবিন্দুও জল নাই। প্রায় সকল জলই মাটির গভীর স্থানে বা নানা জিনিসের সহিত মিশিয়া রহিয়াছে,—যখন ইচ্ছা জল পাইবার উপায় নাই। কাজেই দেখ, যেদিন অবশিষ্ট বাতাসটুকু মঙ্গলকে ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে এবং অবশিষ্ট জল মেরুপ্রদেশে জমা না হইয়া মাটির আরও গভীর স্থানে গিয়া লুকাইবে, সেদিন মঙ্গলে জীবের চিহ্নমাত্র থাকিবে না। তখন শ্মশানতুল্য দেহটাকে লইয়া আমাদের চাঁদের মত আকাশে ঘুরিয়া বেড়ানো মঙ্গলের একমাত্র কাজ হইবে।