গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/মঙ্গলের চাঁদ
মঙ্গলের চাঁদ
বুধ শুক্র পৃথিবীর অনেক কথা তোমাদিগকে বলিয়াছি। ইহাদের মধ্যে পৃথিবী ছাড়া আর কাহারো চাঁদ অর্থাৎ উপগ্রহ নাই। মঙ্গল-গ্রহকে শত বৎসর ধরিয়া জ্যোতিষীরা দূরবীণ দিয়া দেখিয়া আসিতেছেন, কিন্তু তাঁহারা ইহার একটি চাঁদেরও সন্ধান পান নাই। কাজেই জ্যোতিষীরা বলিয়া আসিতেছিলেন, শুক্র ও বুধের মত মঙ্গল একা একাই সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। যদি তোমরা প্রাচীন জ্যোতিষীদের বই পড়িতে যাও, দেখিবে তাহাতে লেখা আছে, মঙ্গলের একটাও উপগ্রহ নাই।
প্রায় চল্লিশ বৎসর আগে একটা মজার ঘটনা হইয়াছিল। আমেরিকার একজন বড় জ্যোতিষী হল্ সাহেব তাঁর বড় দূরবীণ দিয়া এক রাত্রিতে মঙ্গলকে দেখিতেছিলেন। সেই সময়ে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়িয়া গেল, ছোট আলোর বিন্দুর মত দুইটা জিনিস মঙ্গলের কাছে রহিয়াছে এবং তাড়াতাড়ি তাহাকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। এই দুটি যে মঙ্গলের চাঁদ তাহাতে তাঁহার আর একটুও সন্দেহ রহিল না। দেশ-বিদেশে টেলিগ্রাফে খবর গেল, হল্ সাহেব মঙ্গলের দুটা উপগ্রহ আবিষ্কার করিয়াছেন। সেদিন পৃথিবীর সমস্ত জ্যোতিষীদের মনে যে কি আনন্দ হইয়াছিল, তাহা একবার ভাবিয়া দেখ। তাঁহারা রাত্রি জাগিয়া দূরবীণ দিয়া মঙ্গলের চাঁদকে দেখিতে লাগিলেন। কেবল দেখা নয়, চাঁদ দুটি কত বড় এবং কতদূরে থাকিয়া কত দিনে তাহারা মঙ্গলকে ঘুরিয়া আসিতেছে, এই সব খবর জানিবার জন্যও তাঁহারা কাগজ-পেন্সিল্ লইয়া বড় বড় অঙ্ক কষিতে লাগিলেন। কিছুদিনের মধ্যে উহাদের সব বিবরণই জানা গিয়াছিল; তখন জোতিষীরা নিশ্চিন্ত হইয়া দিনকতক আরামে ঘুমাইতে পারিয়াছিলেন।
মঙ্গলের চাঁদের কথা শুনিয়া তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, চাঁদ দুটি আমাদের চাঁদের মত বড়। কিন্তু তাহা নয়,—সে দুটি আকারে এত ছোট যে, আমাদের চাঁদের সহিত তাহাদের তুলনাই করা যায় না। আমাদের চাঁদকে যদি একটা মাঝারি গোছের ফুটবল্ বলিয়া মনে করা যায়, তাহা হইলে মঙ্গলের চাঁদ দুটি একটি মটরের আধখানার সমান হয়। ভাবিয়া দেখ, কত ছোট।
নূতন গ্রহ-উপগ্রহের সন্ধান পাইলেই জ্যোতিষীরা তাহাদের এক একটা নাম দিয়া থাকেন। মঙ্গলের খুব কাছে থাকিয়া যে চাঁদটি ঘুরিতেছে, জ্যোতিষীরা তাহার নাম দিয়াছেন ফোবো (Phobo), এবং যেটা দূরে আছে তাহার নাম হইয়াছে ডাইমো (Diemo)। ইহাদের মধ্যে ফোবো একটু বড়। কিছু বড় হইলে কি হয়, তাহার বেড় একশত মাইলের কিছু বেশি। অথাৎ ফোবোর উপর দিয়া যদি একটা রেল-লাইনের বেড় থাকিত, তাহা হইলে তোমরা সেখানকার রেলের গাড়ীতে চড়িয়া দু-ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টায় তাহাকে ঘুরিয়া আসিতে পারিতে। অর্থাৎ কলিকাতা হইতে ডাক-গাড়ীতে গোয়ালন্দ যাইতে বা বোলপুরে যাইতে যতটা সময় লাগে, ফোবোকে দুরিয়া আসিতে তাহার বেশি সময় লাগে না।
ডাইমো আরো ছোট। ইহার বেড় ত্রিশ মাইলের বেশি নয়। তোমরা দু-চার জন যদি ডাইমোতে যাও, তাহা হইলে হাঁটিয়াই তাহার অর্দ্ধেকটা একদিনে দেখিয়া আসিতে পার।
মঙ্গলের চাঁদ দুটিকে ভগবান্ যেন খেলার সামগ্রী করিয়া গড়িয়াছেন। আমাদের পৃথিবীর এই রকম দুটি চাঁদ থাকিত, তাহা হইলে আমরা হয় ত ছুটির দিনে সেখানে গিয়া বনভোজন করিতাম এবং সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া চাঁদের দেশের গল্প করিতাম।
মঙ্গলের চাঁদ দুইটির চলাফেরার রকম আরো মজার। আমাদের চাঁদ পৃথিবী ঘুরিয়া আসিতে কি-রকম চলাফেরা করে, তাহা তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। প্রায় ঊনত্রিশ দিনে তাহাকে আমরা ঘুরিয়া আসিতে দেখি। এই সময়ের মধ্যে অমাবস্যা হয়, পূর্ণিমা হয়, ক্ষয়বৃদ্ধি কত কি হয়। কিন্তু মঙ্গলকে ঘুরিয়া আসিতে “ফোবো” সাত ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের বেশি সময় লয় না। এই সময়ের মধ্যেই তাহার অমাবস্যা, পূর্ণিমা, ক্ষয়বৃদ্ধি সবই হইয়া যায়! কিন্তু মঙ্গলের দিনরাত্রির পরিমাণ চব্বিশ ঘণ্টার একটু বেশি; কাজেই মঙ্গলের একদিনে ফোবো তাহাকে তিনটা পাক দিয়া আসে, এবং এক একটা পাকে পূর্ণিমা অমাবস্যা সবই এক এক বার হয়। সুতরাং মঙ্গলের প্রত্যেক রাত্রিতে ফোবোর দুইটা করিয়া পূর্ণিমা হয়। ছয় ঘণ্টা অন্তর এক-একটা পূর্ণিমা,—বড় মজার ব্যাপার নয় কি?
কেবল ইহাই নয়;—ফোবোর গতিবিধিও বড় অদ্ভুত। যে-সময়ে মঙ্গল নিজের মেরুদণ্ডের চারিদিকে ঘুরিয়া দিন-রাত্রি দেখাইতে থাকে, সে-সময়ে ফোবো মঙ্গলকে তিনবার ঘুরিয়া আসে। মঙ্গল পশ্চিম হইতে পূর্ব্বদিকে ঘুরপাক্ খায়, ফোবোও ঠিক সেই দিক্ ধরিয়াই মঙ্গলকে ঘুরিয়া আসে। তাহা হইলে তোমরা যদি মঙ্গলগ্রহে গিয়া দাঁড়াও, তবে ফোবোকে পশ্চিমে উদিত হইয়া হু হু করিয়া পূর্ব্বমুখে দৌড়িতে দেখিবে। সেখানে দেখিবার মত আর কিছুও যদি না থাকে, তবুও এই চাঁদটির ঘোড়দৌড় দেখিবার জন্য মঙ্গললোকে বাস করিতে ইচ্ছা করে। এমন মজার চাঁদ বোধ হয় বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডেও আর নাই। সে আমাদের চাঁদের মত পশ্চিম আকাশে উদিত হইয়া যখন উপরে উঠিতে আরম্ভ করে, তখন বোধ হয়, যেন একখানা ঘুঁড়ি শীঘ্র শীঘ্র আকাশের উপরে উঠিতেছে। তার পরে যখন মাথার উপর দিয়া চলিয়া পূর্ব্বে হেলিতে আরম্ভ করে, তখন বোধ হয় যেন সে মাটিতে আছাড় খাইবার জন্য ফানুসের মত নামিতেছে।
মঙ্গলের অপর চাঁদ “ডাইমো” এতটা চঞ্চল নয়। প্রায় সাড়ে ত্রিশ ঘণ্টায় সে একবার মঙ্গলকে ঘুরিয়া আসে। সাড়ে তেরো ঘণ্টা অন্তর উহার পূর্ণিমা হয়। ইহাও বড় কম মজার নয়। কাজেই প্রায় প্রত্যেক রাত্রিতেই এই চাঁদটির পূর্ণিমা হয়। আবার এ রকমও এক এক রাত্রিতে দেখা যায় যে, মঙ্গলের দুটা চাঁদই আকাশের এক জায়গায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং দুটারই পূর্ণিমা হইয়াছে। এই রকম ডবল্ চাঁদের ডবল্ পূর্ণিমা অদ্ভুত নয় কি? মঙ্গলে যদি আমাদের মত প্রাণী থাকে, তবে আর কিছু না হউক সেখানকার এই চাঁদ দুটিকে দেখিয়া তাহারা নিশ্চয়ই খুব আনন্দ পায়! আমাদের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রিগুলার মত মঙ্গলের রাত্রিতে কোনো তিথিতেই অন্ধকার থাকে না; কখনো একটা এবং কখনো দুটা চাঁদ একত্র আকাশে থাকিয়া সেখানে খুব জ্যোৎস্না দেয়। মঙ্গলের রাজ্যে সবই অদ্ভুত!