গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/মহাপ্রলয়

মহাপ্রলয়

তোমরা এখন জিজ্ঞাসা করিতে পার, আচ্ছা, প্রতিদিনই সূর্য্য যখন নিজের দেহকে এক-একটু ছোট করিয়া ফেলিতেছে, তথন গত বৎসরের সূর্য্যের চেয়ে এ বৎসর সূর্য্যকে ছোট দেখি না কেন? জ্যোতিষীরা তোমাদের এই প্রশ্নেরও উত্তর দিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, যখন বিশ্ব-সংসারে মানুষ জন্মে নাই এবং পৃথিবীর জন্ম হয় নাই, সেই অতি পুরাতন কালে, সূর্য্য খুবই বড় ছিল। এখন আকাশের যে জায়গায় পৃথিবী মঙ্গল বৃহস্পতি শনি ইউরেনাস্ ও নেপ্‌চুন্ রহিয়াছে, সূর্য্যের দেহটা সেই কোটি কোটি মাইল জায়গা জুড়িয়া ছিল। জায়গা জুড়িয়া ছিল বটে, কিন্তু তাহার দেহটা খুবই হাল্‌কা ছিল। এখন সূর্য্যের দেহে যে ঘন বাষ্প আছে, তখন ইহা অপেক্ষা খুব হাল্‌কা বাষ্প তাহার দেহে ছিল। সেই সময় হইতে আজ-পর্য্যন্ত সূর্য্য নিজের দেহ গুটাইয়া ছোটই করিয়া আসিতেছে। তাই সূর্য্য আগেকার তুলনায় এত ছোট। যাহা হউক, সূর্য্যের ছোট হইবার ভাবটা এখনো আছে, কিন্তু এখন যে পরিমাণে ছোট হইতেছে তাহা নিতান্ত অল্প, তাই এখন দুই দশ বৎসরে বা দু-হাজার দশ হাজার বৎসরে সূর্য্য কতটা ছোট হইল, তাহা নজরেই পড়ে না।

 মনে কর, একটা বড় জালার ভিতরে দশ মণ তিল বোঝাই আছে, আর তুমি যেন সেই জালা হইতে প্রতিদিন এক একটি করিয়া তিল উঠাইয়া লইতেছ। প্রতিদিনই এক-একটি করিয়া তিলের ক্ষয় হইতেছে এবং প্রতিদিনই জালাটা এক একটু করিয়া খালি হইতেছে; কিন্তু এই ক্ষয় এত সামান্য যে, তুমি দু-বছরে কি দশ বৎসরেও চোখে দেখিয়া বুঝিবে না যে, জালা খালি হইয়া যাইতেছে। সূর্য্যের আকারে ছোট হওয়াও এই রকমের; এখন প্রতি বৎসরে সে এমন তিলে তিলে ছোট হইতেছে যে, দু-হাজার দশ হাজার বৎসরে আমরা সূর্য্যকে খুব ভাল যন্ত্র দিয়া পরীক্ষা করিয়াও ছোট দেখিব না।

 কিন্তু খুব অনেক দিন পরে, হয় ত লক্ষ লক্ষ বৎসর পরে, এই তিলে তিলে কমার জন্য সূর্য্যকে নিশ্চয়ই ছোট হইতে দেখা যাইবে। তখন মানুষ পৃথিবীতে থাকিবে কি না জানি না, যদি থাকে তবে তাহারা সূর্য্যকে ছোট দেখিয়া অবাক্ হইয়া যাইবে। কেবল তাহাই নয়, তখন তাহারা দেখিবে সূর্য্য ছোট হইতে হইতে এমন ঘন হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, সে আর ছোট হইতে পারিতেছে না, সেই দিনই মহাপ্রলয় আরম্ভ হইবে। কারণ সূর্য্য তথন যে তাপ ক্ষয় করিবে, তাহার আর পূরণ হইবে না। কাজেই দিনে দিনে ঠাণ্ডা হইয়া সূর্য্য একদিন একেবারে নিভিয়া যাইবে। পৃথিবী আর তাপ-আলোক না পাইয়া ঘোর অন্ধকারে বরফের চেয়েও বেশী ঠাণ্ডা হইয়া পড়িবে। মেঘ হইবে না, বৃষ্টি পড়িবে না, নদী চলিবে না, বাতাসও বহিবে না। সমুদ্রের জল শক্ত বরফ হইয়া দাঁড়াইবে। সূর্য্যের আলোতে বাড়িয়া যে-সকল গাছ-পালা আমাদের খাদ্য জোগায়, তাহারা চিরদিনের জন্য লোপ পাইয়া যাইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পশু প্রভৃতি প্রাণীদিগের চিহ্নমাত্রও পৃথিবীতে থাকিবে না।

 সূর্য্য নিভিয়া যাওয়ার পরে পৃথিবীর এই দুর্দ্দশার কথা মনে করিলে সত্যই ভয় হয়। কিন্তু আপাততঃ ভয়ের কারণ নাই, লক্ষ লক্ষ বৎসর পরে পৃথিবীতে এই মহাপ্রলয় উপস্থিত হইবার অনেক আগে হয়ত মনুষ্য জাতি পৃথিবী হইতে লোপ পাইয়া যাইবে! আমাদের এই অতি প্রাচীন হিমালয় পর্ব্বত ব্যতীত আর কেহই এই মহাপ্রলয় দেখিবে না। কিন্তু তখন তাহার এই শ্যামল দেহখানি থাকিবে না, তপঃক্লিষ্ট ঋষির মত তাহার শরীর তখন কঙ্কালসার হইবে এবং মাথার তুষার-জটা আরো ভারি ও আরো শাদা হইয়া পড়িবে।