গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/সূর্য্যের আলোক ও তাপ
সূর্য্যের আলোক ও তাপ
সূর্য্যের মোটামুটি খবর তোমাদিগকে দিলাম। কিন্তু এখনো উহার অনেক খবর বড় বড় জ্যোতিষীরাও জানেন না, যাহা তাঁহারা জানেন, তাহারও অনেক কথা বলিতে বাকি রহিল। তোমরা আর একটু বড় হইলে সে-সব কথা জানিতে পারিবে ও বুঝিবে। সূর্য্যের আলোক ও তাপ-সম্বন্ধে দুই একটা কথা বলিয়া এখানেই সূর্য্যের গল্প শেষ করিব।
সূর্য্যের আলো যে কত বেশি তোমরা তাহা প্রতিদিনই দেখিতেছ। পণ্ডিতেরা এই আলোর একটা হিসাব করিয়াছেন। পূর্ণিমার চাঁদের আলো কত তাহা তোমরা দেখিয়াছ। ঐ চাঁদের আলোতে বই পড়াও যায়। কিন্তু হিসাব করিলে দেখা যায়, ছয় লক্ষ চাঁদের আলো একত্র না করিলে একটা সূর্য্যের আলোর সঙ্গে সমান হয় না। ছয় লক্ষ চাঁদ বড় সোজা কথা নয়। এত-গুলো চাঁদ যদি এক সঙ্গে আকাশে উঠে, তাহা হইলে সব আকাশটা চাঁদে চাঁদে ভরিয়া যায়। কাজেই দেখা যাইতেছে, আমাদের সব আকাশটা যদি চাঁদের মত উজ্জ্বল হয়, তাহা হইলেই কেবল সূর্য্যের আলো আমরা পাইতে পারি। দেখ সূর্য্য কত আলো দেয়! বিজ্ঞানের দ্বারা, লোকে ইলেক্ট্রিক্ আলো, লাইম্ আলো কত আলোই প্রস্তুত করিতেছে, কিন্তু সূর্য্যের আলোর সমান একটি আলোও এ-পর্য্যন্ত করিতে পারে নাই!
সূর্য্যের আলো যেমন বেশি, তাপও তেমনি বেশি। সূর্য্য কত দূরে আছে; তাহা ত তোমরা শুনিয়াছ। এত দূরে থাকিয়া সূর্য্য যে তাপ ছাড়িতেছে, তাহার একটুখানি-মাত্র আমাদের পৃথিবীতে আসিয়া পড়িতেছে। বাকি সবই মহা-আকাশের মহাশূন্যে ছড়াইয়া পড়িতেছে। কিন্তু এই একটুখানি তাপের যে কত তেজ, তাহা প্রতিদিনই তোমরা দেখিতে পাও। সূর্য্যের তাপে খাল-বিল, নদী-নালা সব শুকাইয়া যায়, এক এক সময়ে এত তাপ হয় যে, ছাতা মাথায় দিয়াও দুপরে ঘরের বাহির হওয়া যায় না। এত দূরে থাকিয়া যে এত তাপ দিতে পারে, তাহার কাছে গেলে যে কত তাপ পাওয়া যায়, এখন তোমরা ভাবিয়া দেখ!
জ্যোতিষীরা ও বৈজ্ঞানিকেরা বড় মজার লোক। তাঁহারা যাহা দেখেন ও যাহা শুনেন, তাহা লইয়া হিসাব-পত্রে বসিয়া যান। কত পরীক্ষা ও কত অঙ্ক কষার পরে তবে তাঁহাদের হিসাব-পত্র ঠিক হয়। সমস্ত সূর্য্যটা কত তাপ ছাড়িতেছে, জ্যোতিষীরা অনেক অঙ্ক কষিয়া অনেক পরীক্ষা করিয়া স্থির করিয়াছেন। একটা হিসাবে একজন জ্যোতিষী বলিয়াছেন, যদি সমস্ত সূর্য্যটাকে পঞ্চাশ হাত গভীর বরফ দিয়া মোড়া যায়, তাহা হইলে সূর্য্য নিজের তাপ দিয়া এই পঞ্চাশ হাত বরফের আবরণ এক মিনিটে গলাইয়া দিতে পারে। ভাবিয়া দেখ কি ভয়ানক তাপ! আর একটা হিসাবের কথা বলি। দুই হাত লম্বা ও দুই হাত চওড়া জায়গা যে কত ছোট তোমরা নিজে তাহা মাপিয়া দেখিতে পার। এতটুকু জায়গায় তোমাদের মত দুই জন মানুষ হয় ত কোনো গতিকে বসিয়া থাকিতে পারে মাত্র। সূর্য্যের উপরকার এতটুকু ছোট জায়গা হইতে এক ঘণ্টায় যে তাপ বাহির হয়, আমাদের এখানে একশত সত্তর মণ কয়লা না পুড়াইলে তাহা পাওয়া যায় না। ভাবিয়া দেখ, কত কোটি কোটি মণ কয়লা পুড়াইলে তবে সূর্য্যের তাপের মত তাপ আমরা এক ঘণ্টার জন্য সৃষ্টি করিতে পারি।
এখন তোমরা জিজ্ঞাসা করিতে পার, সূর্য্য যে ক্রমাগত এই রকম ভয়ানক তাপ ছাড়িতেছে, সে তাপ কোথা হইতে আসে? উনুনে কয়লার আগুন জ্বালা হইয়াছে, এই আগুন এক ঘণ্টা কি দুই ঘণ্টা বেশ জ্বলিবে এবং তাহার পরে নিভিয়া যাইবে। উনুনের আগুন যদি ঠিক রাখিতে চাও, তাহা হইলে মাঝে মাঝে উনুনে নূতন করিয়া কয়লা দিতে হইবে। সূর্য্যের আগুন কত লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরিয়া জ্বলিতেছে, কিন্তু ইহার আগুনের তাপ একটুও কমে নাই। ইহাতে কে কয়লা জোগায় এবং কি রকমেই বা ইহার কয়লার জোগাড় হয়, তোমরা ভাবিয়া ঠিক করিতে পার কি? একজন জ্যোতিষী হিসাব করিয়া বলিয়াছেন, যদি সমস্ত সূর্য্যটা কয়লা দিয়াই প্রস্তুত হইত এবং এই কয়লা পুড়াইয়া যদি সূর্য্য তাপ দিত, তাহা হইলে এক হাজার বা দুই হাজার বৎসরের মধ্যে তাহার সমস্ত কয়লা নিঃশেষে পুড়িয়া যাইত এবং সূর্য্য নিভিয়া এক গাদা ছাই হইয়া দাঁড়াইত। কিন্তু দুই হাজার বৎসরেও ত সূর্য্য নিভিয়া যায় নাই, বা তাপও ত একটু কমে নাই। তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেছ, কয়লা বা কাঠের আগুনে সূর্য্যের তাপ রক্ষা হয় না। কে গাড়ী গাড়ী করিয়া কয়লা বহিয়া সূর্য্যে ঢালিবে? ঢালিতে পারিলে এত কয়লাই বা কোথায়?
সূর্য্য কি রকমে নিজের দেহের তাপ রক্ষা করে, তাহা জানিবার জন্য বৈজ্ঞানিকেরা অনেক পরীক্ষা, অনেক হিসাবপত্র করিয়াছেন। এখন স্থির হইয়াছে, সূর্য্য নিজের শরীরটাকে সঙ্কুচিত করিয়া তাহার তাপ রক্ষা করে।
কথাটা বোধ হয় বুঝিলে না। একটু বুঝাইয়া বলি। সমস্ত জিনিসেরই একটা প্রধান গুণ এই যে, যদি জোর করিয়া আকারে ছোট করা যায়, তাহা হইলে পদার্থমাত্রই গরম হইয়া পড়ে। ইট্ বা পাথরের মত শক্ত জিনিসকে আকারে সহজে ছোট করা যায় না, কিন্তু যে-সকল জিনিস বাতাসের মত বাষ্পীয় অবস্থায় থাকে, চাপ দিয়া তাহাদিগকে অনায়াসে ছোট করা যায়।
ফুট্বলের সেই ছোট রবারের থলি অর্থাৎ ব্লাডারের ভিতরে তুমি যে বাতাসটা পম্প্ করিয়া দাও, তাহা বাহিরে অনেকটা জায়গা জুড়িয়া থাকে। কাজেই বাহিরের অনেকটা বাষ্পকে জোর করিয়া যখন ছোট ব্লাডারের মধ্যে পোরা যায়, তখন বাতাসকে সঙ্কুচিত করা হয়। সদ্য সদ্য পম্প্ করার পরে তুমি যদি ব্লাডারে হাত দাও, তবে দেখিবে রবারের উপরটা গরম হইয়াছে। বাইসিকেল্ গাড়ীর চাকায় যে রবারের টায়ার অর্থাৎ গদি লাগানো থাকে, তাহার ভিতরে জোর করিয়া যখন অনেক বাতাস পম্প্ করা যায়, তখন সেটাও গরম হইয়া পড়ে। কাজেই দেখা গেল, বাষ্পীয় জিনিস সঙ্কুচিত অর্থাৎ আকারে ছোট হইয়া পড়িলে তাহাতে তাপের সৃষ্টি হয়।
সূর্য্য এতকাল ধরিয়া ক্রমাগত তাপ বিলাইয়া কেন আজও ঠাণ্ডা হইতেছে না, ইহার কারণ দেখাইতে গিয়া পণ্ডিতেরা ব্লাডার গরম হওয়ার কথাই বলিয়াছেন। সূর্য্য আমাদের পৃথিবীর মত মাটি-পাথর দিয়া গড়া নয়, উহার দেহে কেবল বাষ্পই আছে। বাষ্প জিনিসটার আর একটা প্রধান গুণ এই যে, ঠাণ্ডা পাইলেই তাহা আকারে খুব ছোট হইয়া আসে। কাজেই সূর্য্যের দেহের বাষ্প তাপ ছাড়িয়া ক্রমে ঠাণ্ডা হইয়া আসিতেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহার দেহ সঙ্কুচিত হইতেছে। কিন্তু দেহ সঙ্কুচিত হইলে তাহাতে তাপ জন্মে, তাহা আমরা আগেই বলিয়াছি। সুতরাং দেখা যাইতেছে, সূর্য্যের দেহ যেমন ঠাণ্ডা হইয়া সঙ্কুচিত হইতেছে, তেমনি সঙ্কুচিত হওয়ার দরুণ সঙ্গে সঙ্গে তাহাতে তাপেরও সৃষ্টি হইতেছে। ‘যত্র আয় তত্র ব্যয়’, কাজেই এত তাপ খরচ করিয়াও সূর্য্য ঠাণ্ডা হইতে পারিতেছে না।