গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/শনির চাঁদ
শনির চাঁদ
যেমন শনি তার চাঁদও তেমনি। দশটা চাঁদ তাহার চারিদিকে ঘুরিতেছে। কয়েক বৎসর আগে আমরা ইহার কেবল আটটি চাঁদের কথাই জানিতাম। অতি অল্প দিন হইল, বাকি দুটা চাঁদের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে।
যে চাঁদটি সকলের চেয়ে বড়, তাহার নাম টাইটান্ (Titan)। ছোট দূরবীণ দিয়া যদি তোমরা শনিকে দেখ, তাহা হইলেও শনি হইতে একটু দূরে ইহাকে দেখিতে পাইবে। টাইটান্ নিতান্ত ছোট বস্তু নয়;—আমাদের চাঁদের চেয়ে অনেক বড়, এমন কি বুধ গ্রহের চেয়েও বড়। আকারে সে যেন একটা ছোটখাটো গ্রহবিশেষ। শনির কাছ হইতে প্রায় আট লক্ষ মাইল দূরে থাকিয়া সে ষোল দিনে এক একবার শনিকে ঘুরিয়া দিয়া আসে। বাকি চাঁদগুলির অনেকেই টাইটানের চেয়েও দূরে দূরে আছে; আবার দুই-একটা কাছেও আছে। ইহাদের মধ্যে কোনো কোনোটি আমাদের চাঁদের চেয়ে ছোট।
তোমাদিগকে আগেই বলিয়াছি, সূর্য্যের রাজ্যে গ্রহ-উপগ্রহেরা একটুও এলোমেলোভাবে চলা-ফেরা করে না। সূর্য্যকে ঘুরিবার সময়ে পৃথিবী যে পাকে ঘুরে, নিজের মেরুদণ্ডের চারিদিকে পাক খাইবার সময়েও সে ঠিক্ পাকেই ঘুরে। বৃহস্পতি শুক্র শনি প্রভৃতি গ্রহেরা কোন্ পাকে ঘুরিতেছে যদি পরীক্ষা করা যায়, সেখানেও ঐরকম ঐক্য দেখা গিয়া থাকে। পৃথিবী যে পাকে ঘুরিতেছে, ইহাদের প্রত্যেকেই ঠিক্ সেই পাকে ঘুরে। কেবল ইহাই নয়, উপগ্রহদের চলাফেরাতেও তোমরা ঠিক্ ঐ নিয়মই দেখিতে পাইবে। এই-সব লক্ষণ দেখিয়াই জ্যোতিষীরা বলেন,—সূর্য্য রাজা, আর বুধ শুক্র প্রভৃতি আটটি গ্রহ তাহার প্রজা। সূর্য্য সকলকে নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধিয়া এক পাকে ঘুরাইয়া লইয়া বেড়ায়।
রাজার নিয়ম মানিয়া চলিতেছে না, এরকম একটি ক্ষুদ্র প্রজাকে যদি তোমরা এই সুশাসিত সূর্য্যের রাজ্যে দেখিতে পাও, তাহা হইলে তোমাদের কি মনে হয়? তোমরা নিশ্চয়ই মনে কর,—সে অন্য কোনো রাজ্য হইতে এই রাজ্যে নূতন আসিয়াছে। তাই সে দেশের নিয়ম-কানুন জানে না। সম্প্রতি শনির চাঁদগুলির মধ্যে এই রকম একটি আনাড়ী চাঁদ ধরা পড়িয়াছে। অপর নয়টি চাঁদ যে পাকে শনিকে প্রদক্ষিণ করে, সে ঠিক্ তাহার উল্টা পাকে ঘুরিয়া বেড়ায়। বড়ই মজার চাঁদ নয় কি? এই ব্যবহার দেখিয়া জ্যোতিষীরা বলিতেছেন, সম্ভবতঃ সে আগে শনির কাছে ছিল না। মহাকাশের কোন্ এক অজানা রাজ্যে হয় ত সে ভাসিয়া বেড়াইতেছিল; শনি কোনো একদিন কাছে পাইয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিয়াছিল। এইজন্যই সে সূর্য্যের রাজ্যের নিয়ম মানিয়া চলে না।
যাহা হউক, দশটি চাঁদে শনির আকাশের যে শোভা হয়, বোধ হয় সমস্ত সূর্য্য-জগৎ খুঁজিয়া বেড়াইলে তাহা দেখা যায় না। প্রত্যেক রাত্রিতেই সেখানে চারি পাঁচটি বড় বড় চাঁদের উদয় হয়। তার পরে আবার শনির সেই তিনটি অপূর্ব্ব চাকা আছে। এইগুলি সূর্য্যের আলোকে আলোকিত হইয়া আকাশটিকে যে কত সুন্দর করে তাহা আমরা মনেই ভাবিতে পারি না। রাত্রিতে শনিগ্রহে বোধ হয়, একটুও অন্ধকার থাকে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এত শোভা এত চাঁদের আলো ভোগ করিবার জন্য একটি প্রাণীও সেখানে নাই। শনি আজও ভয়ানক গরম রহিয়াছে,—তাহার দেহটি হয় ত আগাগোড়াই বাষ্প দিয়া নির্ম্মিত; সেখানে পা রাখিবার মত একটু মাটি নাই। কাজেই তাহার উপরে জীবজন্তু গাছপালা কিছুই নাই।