গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/ইউরেনস্
বুধ হইতে আরম্ভ করিয়া শনি পর্য্যন্ত যে ছয়টি গ্রহের কথা তোমাদিগকে বলিলাম, দেড় শত বৎসর পূর্ব্বেকার জ্যোতিষীরা কেবল ইহাদেরই কথা জানিতেন; শনির পরে ইউরেনস্ ও নেপ্চুন নামে যে দুটি গ্রহ আছে, তাহাদের কথা জানিতেন না।
আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা খুব জ্যোতিষের আলোচনা করিতেন; তাছাড়া অনেক প্রাচীন সভ্যজাতিও জ্যোতিষ লইয়া নাড়াচাড়া করিতেন। ইউরেনস্ ও নেপ্চুনের কথা ইহাদেরও জানা ছিল না; জানা থাকিলে আমাদের প্রাচীন জ্যোতিষের পুঁথিপত্রে ইউরেনসের একটা ভাল নাম লেখা থাকিত। প্রাচীনকালে দূরবীণ ছিল না, এইজন্যই যে-সব দূরের গ্রহ-উপগ্রহদিগকে খালি চোখে দেখা যায় না, তাঁহারা সেগুলির সন্ধান করিতে পারেন নাই। খুব ভাল দূরবীণ হাতের গোড়ায় পাইয়াই আজকালকার জ্যোতিষীরা ইউরেনসের মত দূরের গ্রহকে হাজার হাজার তারার মধ্য হইতে চিনিয়া লইতে পারিয়াছেন।
ইংরাজি ১৭৮১ সালে সার্ উইলিয়ম্ হার্সেল্ নামে ইংলণ্ডের একজন বড় জ্যোতিষী সকলের আগে ইউরেনস্কে দেখিতে পাইয়াছিলেন। তিনি নিজের হাতে একটা বড় দূরবীণ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। এই দূরবীণেই ইউরেনস্ ধরা দিয়াছিল।
হার্সেল্ সাহেবের জীবনের ঘটনা এবং তাঁহার ইউরেনস্ আবিষ্কারের কথা বড়ই আশ্চর্য্য। নানা অসুবিধার মধ্যে থাকিয়া কেবল নিজের চেষ্টায় হার্সেল্ যেমন মহাপণ্ডিত হইয়াছিলেন, বোধ হয় কেহই এমন হইতে পারেন নাই।
হার্সেল্ গরিবের ছেলে ছিলেন। এজন্য ছেলেবেলায় তাঁহার লেখাপড়া করা হয় নাই। গরিব বাপ কেমন করিয়া স্কুলের বেতন এবং বইয়ের খরচ জোগাইবেন? সেজন্য তিনি এক সৈন্যের দলে চাকুরী লইয়াছিলেন। তিনি বেশ গান-বাজনা করিতে পারিতেন, ঐ সৈন্যের বলে ব্যাণ্ড বাজানো তাঁর কাজ ছিল, হয় ত তিনি জয়ঢাক বাজাইতেন, না হয় ফ্লুট্ বাজাইতেন।
যাহা হউক প্রায় দেড় শত বৎসর পূর্ব্বে য়ুরোপের হানোভারদের সঙ্গে ফরাসীদের লড়াই বাধিয়াছিল, তখন হার্সেল্কে লড়াইয়ে যাইতে হইয়াছিল। লড়াইয়ের সময়ে সৈন্যদের সকলকেই খুব কষ্ট স্বীকার করিতে হয়। হয় ত দুদিন খাওয়া হয় না; রাত্রিতে ঘুমের অবকাশ হয় না; শীতে বৃষ্টিতে খোলা মাঠের মাঝে পড়িয়া থাকিতে হয়। সৈন্যদের সঙ্গে যাইতে যাইতে হার্সেল্ একদিন রাত্রিতে অবসন্ন হইয়া মাঠের মাঝে এক নর্দ্দামার মধ্যেই শুইয়া পড়িলেন। কিন্তু শীতে হিমে তাঁর ঘুম হইল না; তিনি ভাবিতে লাগিলেন, সংসারের বিশেষ কোনো কাজে না লাগিয়া তাঁহার জীবনটা কি এই রকমেই শেষ হইবে? স্থির করিলেন, সৈন্যদের সহিত তিনি থাকিবেন না। যখন দলের লোকেরা দেই খোলা মাঠে শুইয়া ঘুমে অচেতন, তখন কাহাকেও কিছু না বলিয়া হার্সেল্ সৈন্যদল ত্যাগ করিয়া চলিতে লাগিলেন। তিনি পলাইয়া যাইতেছেন, এই খবর যদি অপর সৈন্যেরা জানিতে পারিত, তাহা হইলে হয় ত বন্দুকের এক গুলির আঘাতেই তাঁহার মৃত্যু হইত। কিন্তু তখন কেহ কিছু জানিতে পারিল না। পথে অনেক কষ্ট পাইয়া হার্সেল্ ইংলণ্ডে উপস্থিত হইলেন।
বাড়িতে পৌঁছিলেন বটে, কিন্তু গরিব বাপ-মা হার্সেল্কে লইয়া কি করিবেন কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। শেষে ঠিক্ হইল, বাড়ির কাছে একটা গির্জ্জায় তিনি হার্মোনিয়ম্ বাজাইবেন এবং ইহারি জন্য মাসে মাসে কিছু বেতন পাইবেন। হার্সেল্ কাজে লাগিয়া গেলেন;—গির্জ্জায় হারমোনিয়ম্ বাজাইতে লাগিলেন এবং বাড়িতে যাহারা গান-বাজনা শিথিতে আসিত, তাহাদিগকে সঙ্গীত শিক্ষা দিতে লাগিলেন। এখনো কিন্তু কেহ ভাবিতে পারেন নাই যে, এই গানের ওস্তাদটি কয়েক বৎসর পরে পৃথিবীর সেরা পণ্ডিত হইবেন।
গান-বাজনাকে তোমরা কি রকম ভাব জানি না। হয় ত ভাবিয়া থাক, গলায় সুর থাকিলেই ওস্তাদ হওয়া যায়; কিন্তু তা’ নয়। গানের উঁচু-নীচু সুর নানা রকমে মিলাইয়া যন্ত্রে বাজাইতে গেলে অনেক হিসাব পত্রের দরকার হয়। হার্সেল্ যখন গানের ওস্তাদ হইলেন, তখন তাঁহার এই রকম হিসাব-পত্রের জ্ঞান ছিল না। তিনি খুব অঙ্ক কষিতে লাগিলেন এবং শেষে অঙ্কের বড় বড় বই পড়িয়া ফেলিলেন। এই সময়েই তাঁর জ্যোতিষ শাস্ত্রের দিকে নজর গেল। অঙ্ক কষিতে কষিতে তিনি গ্রহ-উপগ্রহদের চলাফেরার বিষয় বুঝিতে আরম্ভ করিলেন এবং খালি চোখে আকাশে যাহা কিছু দেখিবার আছে, তাহা দেখিয়া ফেলিলেন।
আকাশে এখনো দেখিবার শুনিবার অনেক বিষয় রহিয়া গেল, সেগুলিকেও দেখিবার জন্য হার্সেলের ভয়ানক ইচ্ছা হইতে লাগিল। কিন্তু দেখিবেন কি করিয়া, দূরবীণ কোথায় পাইবেন? সেকালে দূরবীণের দাম অত্যন্ত বেশি ছিল, গরিব হার্সেল্ দূরবীণ কিনিবার টাকা কোথা হইতে পাইবেন?
অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া হার্সেল্ ঠিক্ করিলেন, নিজের হাতে দূরবীণ প্রস্তুত না করিলে গ্রহ-নক্ষত্রদের দেখিবার উপায় হইবে না। তিনি দূরবীণ প্রস্তুতে লাগিয়া গেলেন। নিজের হাতে কাচ ঘসিয়া কাঠ কাটিয়া দূরবীণের আয়না ও চোঙ্ তৈয়ার করিতে লাগিলেন। এই সময়টা তাঁহাকে বড় কষ্টে কাটাইতে হইয়াছিল। দূরবীণের কাজে লাগিয়া আছেন, এমন সময়ে গান-বাজনা করিবার জন্য গির্জ্জায় ডাক পড়িলে তাঁহাকে ছুটিয়া সেখানে যাইতে হইত। গান-বাজনার মধ্যে যদি এক ঘণ্টা সময়ও পাইতেন, তাহা হইলে তিনি ছুটিয়া বাড়িতে আসিয়া আবার দূরবীণের কাজে লাগিয়া যাইতেন। এই রকমে তাঁহার আহার-নিদ্রা বন্ধ হইল; মনে হইতে লাগিল, দূরবীণ প্রস্তুত করিয়া গ্রহ-নক্ষত্রদিগকে না দেখিলে তাঁহার যেন শান্তি নাই।
অনেক কষ্টে ও অনেক চেষ্টায় দূরবীণ নির্ম্মিত হইল। জ্যোতিষের পুস্তকে গ্রহ-চন্দ্রের আকার-প্রকারের কথা যেমন পড়িয়াছিলেন, তাহাই চাক্ষুষ দেখিতে পাইয়া হার্সেল্ অবাক হইয়া গেলেন। গ্রহ-চন্দ্র-তারার পরিচয় লইতে এই রকমে তাঁহার পাঁচ ছয় বৎসর কাটিয়া গেল। আকাশ পরিষ্কার থাকিলে সমস্ত রাত্রি জাগিয়া তিনি গ্রহ-নক্ষত্র দেখিতেন; পাশে তাঁহার ভগিনী ক্যারোলিনা বসিয়া থাকিতেন, কোন্ নক্ষত্রকে কোথায় কি রকম দেখা যাইতেছে, ভগিনী তাহা লিখিয়া রাখিতেন। ভয়ানক শীত,—বরফ পড়িতেছে, দোয়াতের কালি জমিয়া শক্ত হইয়া যাইতেছে, তবুও ভাই-ভগিনী ঘরে যাইতেন না,—গ্রহ-নক্ষত্রদের দেখিতে দেখিতে যেন অজ্ঞান হইয়া পড়িতেন!
এই রকমে জ্যোতিষের আলোচনা করিতে করিতে হার্সেল্ এক রাত্রিতে একটি ছোট নক্ষত্রকে দেখিয়া অবাক্ হইয়া গেলেন। তোমরা আগেই শুনিয়াছ, নক্ষত্রেরা পৃথিবী হইতে কোটি কোটি ক্রোশ দূরে আছে। খুব বড় দূরবীণেও তাহাদিগকে নিকটে আনা যায় না। এজন্য দূরবীণ দিয়া দেখিলে নক্ষত্রদিগকে বেশি উজ্জ্বল দেখায় মাত্র; শুক্র, বৃহস্পতি প্রভৃতি গ্রহদিগকে দূরবীণে যেমন ভাঁটার মত বড় দেখায়, কোনো নক্ষত্রকে সে রকম দেখা যায় না। কিন্তু হার্সেল্ যে নক্ষত্রটিকে দেখিতেছিলেন, দূরবীণে তাহাকে বেশ বড় দেখাইল। তিনি আকাশের মানচিত্র খুলিলেন, পাঁজি খুলিয়া দেখিতে লাগিলেন, কিন্তু আকাশে সেই অংশে যে কোনো গ্রহ থাকিতে পারে, একথা কোনোখানে লেখা দেখিলেন না। হার্সেল্ মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, তাহা হইলে এই নক্ষত্রটি কি একটি গ্রহ? গ্রহেরা দিবারাত্রি সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায় এবং নক্ষত্রেরা স্থির হইয়া আকাশে দাঁড়াইয়া থাকে। নূতন নক্ষত্রটি নড়িয়া-চড়িয়া বেড়ায় কিনা দেখিবার জন্য দুই ভাই-বোনে রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া আকাশ-পানে তাকাইয়া রহিলেন। তাঁহাদের আহার নিদ্রা বন্ধ হইয়া গেল। কয়েক দিন পরে দেখা গেল, সেটি এক একটু চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছে। হার্সেল্ ইহা দেখিয়া আরো অবাক্ হইয়া গেলেন।
এই রকমের একটা বড় আবিষ্কারের খবর ত আর চাপা দিয়া রাখা যায় না। হার্সেল্ দেশের বড় বড় জ্যোতিষীদের কাছে খবর দিলেন যে, একটা নূতন গ্রহের আবিষ্কার হইয়াছে।
হার্সেল্ তখনো বড় লোক হন নাই, গান-বাজনা করাই তাঁর তখনো ব্যবসায় ছিল। এই রকম একটা লোকের কথায় কি কেহ কখনো বিশ্বাস করে? তাই অনেকেই তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিলেন না। কেবল দুই-একজন জ্যোতিষী মজা দেখিবার জন্য তাঁহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হার্সেল্ কড়া-ক্রান্তি পর্য্যন্ত হিসাব করিয়া তাঁহাদিগকে নূতন গ্রহ দেখাইলেন। তাঁহাদের মুখ গম্ভীর হইয়া পড়িল এবং সকলেই বুঝিলেন, ইহা একটা নূতন গ্রহই বটে!
পর দিন ভোর হইতে না হইতে দেশ-বিদেশে খবর গোল, ইংলণ্ডের একজন সঙ্গীত-শিক্ষক একটি নূতন গ্রহের আবিষ্কার করিয়াছেন। পৃথিবী সুদ্ধ লোক অবাক্ হইয়া গেল। ইংলণ্ডের তখনকার রাজা তৃতীয় জর্জ হার্সেল্কে রাজবাড়ীতে ডাকাইয়া দূরবীণ দিয়া নূতন গ্রহটিকে দেখিলেন। ভগিনী ক্যারোলিনাও সঙ্গে গেলেন; এবং ভাই-ভগিনী দুজনেই অনেক রাজ-সম্মান পাইলেন। শেষে এই সঙ্গীত-শিক্ষকই ইংলেণ্ডের রাজ-জ্যোতিষী হইলেন এবং সমস্ত পৃথিবীর লোক তাঁর জয়-জয়কার করিতে লাগিল।
তোমরা বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছ, হার্সেল্ সাহেব ঐরকমে যে গ্রহের আবিষ্কার করিয়াছিলেন, এখন তাহাকেই আমরা ইউরেনস্ বলিয়া থাকি।
বাপ-মা আত্মীয়-স্বজন পরামর্শ করিয়া ছেলে-মেয়েদের নামকরণ করেন। ইহাতে কোনো গোলযোগ হয় না। কিন্তু হার্সেলের নূতন গ্রহের নামকরণে বেশ একটু তর্ক-বির্তক হইয়াছিল। হার্সেলের ইচ্ছা ছিল, গ্রহটির নাম ইংলণ্ডের রাজা জর্জের নাম-অনুসারে হয়, তাই তিনি উহার “জর্জিয়ম্” নাম রাখিয়াছিলেন। কিন্তু অপর দেশের জ্যোতিষীরা ইহাতে ঘোর আপত্তি করিলেন। তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, গ্রহদের নাম এপর্য্যন্ত প্রাচীন দেবতাদের নামেই হইয়া আসিতেছে, অতএব নূতন গ্রহের নাম রাজার নামে না হওয়াই ভাল। সভাসমিতি করিয়া বোধ হয় কোনো ছেলে-মেয়ের নাম রাখা হয় নাই; কিন্তু সূর্য্যের এই নূতন ছেলেটির নাম ঠিক করিবার জন্য সভা হইল, কত পরামর্শ হইল, জ্যোতিষীদের কত বক্তৃতা হইয়া গেল; এবং শেষে তাহাকে “ইউরেনস্” নামে ডাকাই স্থির হইল।
অতি অল্প দিন হইল আমরা ইউরেনসের সন্ধান পাইয়াছি, কিন্তু তাই বলিয়া তোমরা মনে করিয়ো না এটা নিতান্ত ছোট গ্রহ। আমাদের কাছ হইতে সূর্য্য কত দূরে আছে, তাহা তোমরা জান। ইউরেনস্ পৃথিবী হইতে তাহারি আঠারো গুণ দূরে আছে। এত দূরে আছে বলিয়াই সে এতদিন আকাশের কোণে লুকাইয়া থাকিতে পারিয়াছিল। আকারে সে পঁইষট্টিটা পৃথিবীর সমান। কাজেই ইহাকে ছোট গ্রহ বলা যায়। না। কিন্তু বৃহস্পতি ও শনির মত দেহে গরম বাষ্পই অধিক আছে বলিয়া ইহার ওজনটা খুব বেশি নয়। ইউরেনসের ওজন মোটে চৌদ্দটা পৃথিবীর ওজনের সমান।
তোমরা মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনির বিবরণে দেখিয়াছ, সূর্য্য হইতে যাহারা বেশি দূরে থাকে, তাহাদের সূর্য্য-প্রদক্ষিণের পথও বেশি লম্বা হয়। ইউরেনস্ শনির বাহিরে থাকিয়া সূর্য্যকে ঘুরিতেছে, এজন্য শনির চেয়ে অধিক পথ না চলিলে সে সূর্য্যকে চক্র দিয়া আসিতে পারে না। তার উপরে সে চলেও বড় ধীরে ধীরে। পৃথিবী চলে সেকেণ্ডে ঊনিশ মাইল করিয়া, কিন্তু ইউরেনস্ সেকেণ্ডে চারি মাইলের বেশি চলিতে পারে না। এই-সব কারণে একবার সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসিতে সে চুরাশী বৎসর কাটাইয়া দেয়। তাহা হইলে দেখ, ইউরেনসের এক বৎসর আমাদের চুরাশী বৎসরের সমান।
বৎসরের পরিমাণ এত বড় হইলেও, ইহার দিনগুলা খুব ছোট। ইউরেনস্ সাড়ে নয় ঘণ্টায় একবার নিজের মেরুদণ্ডের চারিদিকে ঘুরিতে পারে। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, আমাদের দিনরাত্রি যেমন চব্বিশ ঘণ্টায়, ইউরেনসের দিনরাত্রি সেইরূপ সাড়ে নয় ঘণ্টায়।
কিন্তু ইহার ঘোরাঘুরিতে একটু বেশ মজা আছে। তোমাদিগকে আগেই বলিয়াছি, সূর্য্যের রাজ্যে যত ছোট বড় গ্রহ-উপগ্রহ আছে তাহাদের সকলেই এক পাকে ঘুরে। অর্থাৎ সকল ঘড়ির কাঁটা যেমন বাঁদিক হইতে ডান দিকে চলে, সকল গ্রহ-উপগ্রহেরা ঠিক্ সেই রকমেই এক পাকে চলা-ফেরা করে। কিন্তু ইউরেনস্ সাড়ে নয় ঘণ্টায় যখন নিজের মেরুদণ্ডের চারিদিকে পাক খায়, তখন এই নিয়ম মানিয়া চলে না। সে ঠিক উল্টা পাকে ঘুরপাক খায়। ইউরেনসের এই সৃষ্টিছাড়া ব্যবহারে পণ্ডিতেরা কিছুদিন চিন্তিত ছিলেন। এখন ইহার একটা কারণ জানা গিয়াছে।
ঘড়ির কাঁটা যে, বাঁ হইতে ডাইনে যায়, ইহা তোমরা সকলেই দেখিয়াছ। কিন্তু কাঁটা দুটিকে তোমরা যদি ঘড়ির পিছন হইতে চলিতে দেখ, তবে তাহাদিগকে কোন্ দিকে পাক খাইতে দেখিবে বলিতে পার কি? এই অবস্থায় তোমরা উহাদিগকে ডাইন হইতে বাঁয়ে ঘুরিতে দেখিবে না কি? ইউরেনস্কে যে, আমরা উল্টা পাকে ঘুরিতে দেখি, তাহারও কারণ ঐ। ইউরেনস্ পৃথিবীর তুলনায় এমন অবস্থায় আছে যে, তাহার ঘুরপাক খাওয়াকে আমরা উল্টা দেখি মাত্র, কিন্তু সত্যই যে উল্টা পাকে ঘুরে না।
এই সকল খবর ছাড়া আমরা ইউরেনস্-সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছু জানি না। যে গ্রহ পৃথিবী হইতে এত দূরে আছে তাহার খবর ইহার বেশি জানাও সম্ভব নয়। সূর্য্য আমাদের কাছ হইতে এত দূরে থাকিয়াও চাঁদের মত বড় দেখায়। কিন্তু ইউরেনসে ঘদি লোক থাকিত, তাহা হইলে তাহারা সূর্য্যকে শুক্রের চেয়ে কখনই বড় দেখিত না। ভাবিয়া দেখ ইউরেনস্ কত দূরের বস্তু। এত দূরের গ্রহ-সম্বন্ধে আমরা অল্প দিনের মধ্যে যে-সব খবর পাইয়াছি, তাহাই কি যথেষ্ট নয়? দিন দিন নূতন যন্ত্র নির্ম্মিত হইতেছে। হয় ত আরো দশ কি বিশ বৎসর পরে তোমরা ইউরেনসের আরো অনেক নূতন খবর পাইবে।
এত দূরে থাকা সত্বেও আমরা ইউরেনসের চারিটি চাঁদের অর্থাৎ উপগ্রহের সন্ধান পাইয়াছি। কিন্তু ইহাদের মধ্যে যেটি বড় তাহা আমাদের চাঁদের চেয়ে অনেক ছোট। মনে করিয়া দেখ, এত দূরের এত ছোট বস্তুর খবর জানা কত কঠিন। এই জন্যই আমরা চাঁদ কয়েকটির খবর বিশেষ কিছু জানিতে পারি নাই। ইহাদের দুটিকে হার্সেল্ সাহেবই আবিষ্কার করিয়াছিলেন; বাকি দুইটির বিষয় আমরা হার্সেলের মৃত্যুর পরে জানিতে পারিয়াছি। খুব বড় দূরবীণ ব্যবহার না করিলে শেষের চাঁদ দুটিকে দেখা যায় না।
ইউরেনস্কে খালি চোখে দেখা বড় কঠিন। ইহা খুব ছোট নক্ষত্রের আকারে আকাশে ঘুরিয়া বেড়ায়,—হঠাৎ দেখিলে ইহাকে নক্ষত্র বলিয়াই মনে হয়। এই জন্য কেহ না দেখাইয়া দিলে, তোমরা কখনই নিজে নিজে ইউরেনস্কে দেখিতে পাইবে না। যদি জোতিষ-জানা কোনো লোককে পাও তাহা হইলে ইউরেনস্ আকাশের কোন্ জায়গায় আছে, তাঁর কাছে জানিয়া লইয়ো। তিনি গ্রহনক্ষত্র সম্বন্ধে ইংরাজি পাঁজি (Nautical Almanac) দেখিয়া, ইউরেনসের সন্ধান তোমাদিগকে বলিয়া দিতে পারিবেন।