গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/নেপচুন্
নেপচুন্
ইউরেনসের পরেই নেপ্চুন্ গ্রহ। ইহার পরে আর কোনো গ্রহ আছে কি না, আমাদের জানা নাই। কাজেই নেপ্চুন্ সূর্য্য-জগতের সীমায় আছে বলিতে হয়। সে যেন প্রহরীর মত সূর্য্যের রাজ্যের চারিদিকে পাহারা দিতেছে।
“নেপ্চুন্” এই নামটি শুনিয়াই বুঝিতেছ, আমাদের দেশের প্রাচীন জ্যোতিষীরা ইহার কথা জানিতেন না। জানা থাকিলে আমাদের প্রাচীন পুঁথিপত্রে ইহার একটা সংস্কৃত নাম লেখা থাকিত। নেপ্চুন্কে পঁচাত্তর বৎসর পূর্ব্বে ইয়ুরোপের জ্যোতিষীরা আবিষ্কার করিয়াছিলেন। কাজেই আমাদের হাজার দু’হাজার বৎসর পূর্ব্বেকার পুঁথিতে কেমন করিয়া ইহার নাম থাকিবে? যে-সব জ্যোতিষী পঁচাত্তর বৎসর পূর্ব্বে মারা গিয়াছেন, তাঁহারাও নেপ্চুনের কথা জানিতেন না।
ইউরেনস্ আবিষ্কারের যেমন একটি গল্প শুনিয়াছ, নেপ্চুনের আবিষ্কারের সেই-রকম আশ্চর্য্যজনক গল্প আছে। তোমরা রামায়ণ-মহাভারতের গল্পে অবশ্যই “আকাশবাণী” বা “ভবিষ্যদ্বাণীর” বিষয় পড়িয়াছ। মহাভারতের কোনো রাজা যুদ্ধে যাইতেছেন, হয় ত আকাশবাণী হইল,—“মহারাজ, যুদ্ধে যাইবেন না, বিপদ আছে।” রাজা ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়া যুদ্ধে যাওয়া বন্ধ করিলেন। এ সব ভবিষ্যদ্বাণী নকি দেবতারা করিতেন, কিম্বা খুব গুণী লোকেরা গণনা করিয়া বলিতেন। নেপ্চুন্ গ্রহটিকে জ্যোতিষীরা ভবিষ্যদ্বাণীর দ্বারাই খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন। আকাশের কোন্ কোণে সে লুকাইয়া আছে তাহা অবশ্য দেবতারা জ্যোতিষীদিগকে বলিয়া দেন নাই, গুণী লোকে গুণিয়া বলিয়া দিয়াছিল। নেপ্চুন্ আবিষ্কারের গল্পটা বড় মজার।
জ্যোতিষীদের ক্ষমতা বড় অদ্ভুত। কোন্ গ্রহ-উপগ্রহ আকাশের কোন্ জায়গায় দেখা যাইবে, তাঁহারা অঙ্ক কষিয়া বলিয়া দিতে পারেন। তোমরা ত দেথিয়াছ, চন্দ্র-সূর্য্যের গ্রহণ হইবার কত দিন আগে জ্যোতিষীরা গ্রহণের দিনক্ষণ পাঁজিতে লিখিয়া রাখেন এবং তাঁহারা যে হিসাব করেন, গ্রহণের সময়ে তাহার এক চুলও এদিক-ওদিক হয় না। হার্সেল্ সাহেব ইউরেনস্ আবিষ্কার করিলে, উহা কোন্ পথে ঘুরিতেছে এবং কোন্ দিন কোন্ সময়ে উহাকে কোথায় দেখা যাইবে, জ্যোতিষীরা এই-সব হিসাব করিয়া ফেলিয়াছিলেন। কিন্তু কয়েক বৎসর পরে বুঝা গেল, হিসাবে কোথাও ভুল আছে, কারণ হিসাব-অনুসারে যেখানে দেখিবার কথা, জ্যোতিষীরা ইউরেনস্কে সেখানে দেখিতে পাইলেন না।
সব মিথ্যা হইতে পারে, কিন্তু অঙ্কশাস্ত্র মিথ্যা হইবার নহে। জ্যোতিষীরা ভাবিলেন, নিশ্চয়ই অঙ্ক কষিতে ভুল হইয়াছে। চার পাঁচজন বড় বড় জ্যোতিষী হিসাব করিতে বলিয়া গেলেন, কিন্তু ভুল বাহির হইল না। জ্যোতিষীদের মাথায় মাথায় ভাবনা চাপিল। সকলেই ভাবিতে লাগিলেন, ইউরেনস্ কেন ঠিক্ সময়ে দেখা দেয় না।
জ্যোতিষীরা বৎসরের পর বৎসর ভাবনা চিন্তায় কাটাইয়া দিতে লাগিলেন এবং ইউরেনস্ যেন নিজের খেয়াল মতে কখনো একটু পরে কখনো একটু আগে আসিয়া তাঁহাদিগকে দেখা দিতে লাগিল।
এই সময়ে ইংলণ্ডে আডাম্স্ নামে একটি যুবক এবং ফ্রান্সে লিভেরিয়ার নামে অপর একটি যুবক ইউরেনসের এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ ঠিক্ করিতে লাগিয়া গেলেন। ইঁহারা দুজনেই খুব ভাল অঙ্ক জানিতেন এবং তাঁহাদের কলেজের ভাল ছাত্র ছিলেন। তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, ইঁহাদের দুজনের মধ্যে বুঝি খুব বন্ধুতা ছিল। কিন্তু তাহা নয়। দুজনের মধ্যে কোনো কালে দেখাশুনা ছিল না এবং কেহ কাহারো নামটি পর্য্যন্ত জানিতেন না। তখন পৃথিবীর সব জ্যোতিষীই ইউরেনসের কথা ভাবিতেছিলেন, তাই ইঁহারা দুজনে সেই কথা ভাবিতে ভাবিতে অঙ্ক কষিতে লাগিয়া গেলেন। ইঁহারা স্পষ্ট বুঝিলেন, যেমন চুম্বক লোহাকে টানিয়া রাখে, কোনো একটি বড় গ্রহ সেই রকমে ইউরেনস্কে টানিয়া রাখিতেছে, তাই সে ঠিক্ সময়ে আমাদিগকে দেখা দিতে পারিতেছে না। সেই গ্রহ কোথায়, ইহাই ঠিক্ করা এই দুই যুবকের কাজ হইল।
ভাবিয়া দেখ, এই রকম হিসাব কত শক্ত। কিন্তু আডামস্ বা লিভেরিয়ার কেহই পিছাইলেন না, খুব পরিশ্রম করিয়া হিসাব করিতে লাগিলেন।
দুজনের হিসাবই প্রায় এক সময় শেষ হইল এবং তাহা এমন পাকাপাকি করিয়া ঠিক্ করা হইল যে, শুনিলে অবাক্ হইতে হয়। যে অজানা গ্রহটি ইউরেনস্কে টানিতেছে, তাহা কত বড় এবং তাহা আকাশের কোন্ জায়গায় আছে, সব কথাই তাঁহারা কাগজ-পত্রে লিখিয়া রাখিলেন। তোমরা বোধ হয় ভাবিতেছ, দুজনে পরামর্শ করিয়া অঙ্ক কষিয়া একই রকমের ফল পাইয়াছিলেন। কিন্তু তাহা নয়, তখনো পর্য্যন্ত তাঁহাদের দুজনার আলাপ-পরিচয় হয় নাই।
আডামস্ সাহেবের হিসাবটা প্রথমে শেষ হইয়াছিল। শেষ হইবামাত্র তিনি সব কাগজ-পত্র ইংলণ্ডের রাজ-জ্যোতিষীর কাছে পাঠাইয়া দিলেন। কিন্তু রাজ-জ্যোতিষীর কাজ অনেক, তাই তিনি যুবক আডাম্সের হিসাব-পত্র হাতে পাইয়া তৎক্ষণাৎ তাহা পরীক্ষা করিতে পারিলেন না। এদিকে হিসাব শেষ হইবামাত্র লিভেরিয়ার সাহেব তাঁহার কাগজ-পত্র জর্ম্মানির একজন বড় জ্যোতিষী গল্ সাহেবের কাছে পাঠাইয়া দিলেন। ইনি হিসাব হাতে পাইয়াই তাহা পরীক্ষা করিতে লাগিলেন এবং বুঝিলেন, যুবক লিভেরিয়ার সামান্য লোক নয়।
অজানা গ্রহটিকে আকাশের কোন্ জায়গায় দেখা যাইবে, তাহা লিভেরিয়ারের কাগজ-পত্রে লেখা ছিল। গল্ সাহেব ইংরাজি ১৮৪৬ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর রাত্রিতে তাঁহার বড় দূরবীণ দিয়া গ্রহটির খোঁজ করিতে লাগিলেন। কিন্তু অধিক কষ্ট পাইতে হইল না; একটু খোঁজ করার পরেই, সেই অজানা গ্রহ দূরবীণে ধরা দিল। আকাশের দিকে না তাকাইয়া কেবল অঙ্ক কষিয়া লিভেরিয়ার যাহার কথা লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন, গল্ সাহেব এই রকমে তাহাকে নিজের চক্ষে দেখিলেন! লিভেরিয়ারের কথা ভবিষ্যদ্বাণীর মত সত্য হইয়া গেল! সেই নূতন গ্রহটিই এখন আমাদের কাছে নেপ্চুন্ নামে পরিচিত হইতেছে।
নেপ্চুন্-আবিষ্কারের খবর পৃথিবীময় ছড়াইয়া পড়িলে, জ্যোতিষীদর মনে যে কি আনন্দ হইয়াছিল, তাহা বোধ হয় তোমরা বুঝিতেই পারিতেছ। কিন্তু ইংলণ্ডের রাজ-জ্যোতিষী এই আনন্দে যোগ দিতে পারেন নাই। আবিষ্কারের খবর জানিবা মাত্র তাঁহার মনে পড়িয়া গেল, যুবক আডাম্সের একটা হিসাব তাঁহার কাছে আছে। তিনি এই হিসাব অনুসারে তাড়াতাড়ি দূরবীণ দিয়া নূতন গ্রহের সন্ধান করিতে লাগিলেন এবং অনায়াসে নেপ্চুন্কে দেখিতে পাইলেন। তখন রাজ-জ্যোতিষীর মনে হইতে লাগিল, আডামস্ সাহেবের হাতে হিসাব পড়িবা মাত্র যদি তিনি নূতন গ্রহের সন্ধান করিতেন, তাহা হইলে নেপ্চুন্-আবিষ্কারের সম্মান ফরাসী লিভেরিয়ারের ভাগ্যে না পড়িয়া, ইংরাজ আডাম্সের ভাগ্যেই পড়িত এবং ইহাতে ইংলণ্ডেরই গৌরব বৃদ্ধি হইত।
যাহা হউক, শত শত বৎসর গ্রহনক্ষত্রদের হিসাব করিয়া যাহা কখনো দেখা যায় নাই, নেপ্চুনের আবিষ্কারে তাহাই দেখা গিয়াছিল। এই জন্য ঘটনাটি জ্যোতিষের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে।
নেপ্চুনের আবিষ্কার হইলে, তাহার আকৃতি-প্রকৃতি ও চলাফেরা সম্বন্ধে খবর সংগ্রহ করিতে বিলম্ব হয় নাই। দেশবিদেশের জ্যোতিষীরা রাত্রির পর রাত্রি দূরবীণ দিয়া নেপ্চুন্কে দেখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং নানা রকম হিসাবপত্র করিয়া অল্প দিনের মধ্যে উহার সকল খবর প্রকাশ করিয়াছিলেন।
নেপ্চুন্ সূর্য্যের রাজ্যের শেষ সীমায় থাকিয়া ঘুরিতেছে, এজন্য সূর্য্য হইতে ইহা অনেক দূরে আছে। আমাদের কাছ হইতে সূর্য্য যত দূরে আছে, নেপ্চুন্ তাহারি ত্রিশ গুণ দূরে রহিয়াছে। সেখানে যদি জীবজন্তু বা মানুষ থাকিত, তাহা হইলে তাহারা সূর্য্যকে একটি ছোট নক্ষত্রের মত দেখিত। ভাবিয়া দেখ, নেপ্চুন্ কত দূরে আছে। এত দূরে আছে বলিয়াই তাহাকে খালি চোখে দেখা যায় না এবং ছোট দূরবীণেও দেখা যায় না।
আকারে কিন্তু ইহা খুব ছোট নয়,—প্রায় পঁচিশটি পৃথিবীর সমান। কিন্তু ইহার আগাগোড়াই সম্ভবত হাল্কা বাষ্প দিয়া গড়া। তাই দেহটা এত বড় হইলেও, তাহার ওজন বেশি নয়। ওজনে উহা মোটে সতেরোটা পৃথিবীর সমান অর্থাৎ ইউরেনসের চেয়ে একটু ভারি।
নেপ্চুন্ কত সময়ে সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসে, তাহাও আমরা জানিতে পারিয়াছি। সে যে-পথে সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসে তাহা সকলের চেয়ে বড়, তার উপরে প্রতি সেকেণ্ডে সে সাড়ে তিন মাইলের বেশি চলিতে পারে না। এই সব কারণে একবার সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসিতে তাহার প্রায় একশত পঁইষট্টি বৎসর সময় লাগে।
তাহা হইলে দেখ, নেপ্চুনের এক একটা বৎসর আমাদের এক শত পঁইষট্টি বৎসরের সমান। কি ভয়ানক ব্যাপার। আমরা যদি নেপ্চুনে গিয়া বাস করিতাম, তাহা হইলে নেপ্চুনের এক বৎসর বয়স হইবার অনেক আগে আমরা বুড়া হইয়া যাইতাম।
নেপ্চুন্ মেরুদণ্ডের চারিদিকে কত সময়ে ঘুরপাক্ খায়, তাহা জ্যোতিষীরা আজও ঠিক্ করিতে পারেন নাই। কাজেই কত সময়ে তাহার দিনরাত্রি হয়, তাহা তোমাদিগকে বলিতে পারিলাম না। নেপ্চুন্ ভয়ানক দুরে আছে বলিয়াই ইহা ঠিক্ করা যায় নাই; হয় ত কিছুদিন পরে জ্যোতিষীরা ইহা ঠিক্ করিয়া ফেলিবেন।
দিন রাত্রির কথা বলিলাম,—তাই শুনিয়া মনে করিয়ো না, সেখানে পৃথিবীরই মত দিনের আলো দেখা যায়। আগেই বলিয়াছি নেপ্চুন্ হইতে সূর্য্যকে একটি ছোট নক্ষত্রের মত দেখা যায়, কাজেই দিনের আলো সেখানে বেশি হইতে পারে না। কিন্তু সে আলো জ্যোৎস্নার চেয়ে অনেক বেশি। নক্ষত্রেরা কোটি কোটি মাইল দূর হইতে আলো দেয়, কিন্তু সূর্য্য ঐ সব নক্ষত্রদের চেয়ে অনেক কাছে থাকিয়া আলো দেয়। এজন্য সূর্য্যকে ছোট দেখাইলেও তাহার আলো নক্ষত্রদের আলোর মত কম হয় না।
নেপ্চুন্ পৃথিবী হইতে কতদূরে লুকাইয়া আছে ভাবিয়া দেখ, কিন্তু তথাপি জ্যোতিষীরা দূরবীণ্ দিয়া তাহার একটি চাঁদকে ধরিয়াছেন। এবং সেটি কত দিনে কি রকমে নেপ্চুনের চারিদিকে ঘুরিতেছে তাহাও ঠিক করিয়াছেন। এই চাঁদটিও ইউরেনসের চাঁদের মত উল্টা পাকে নেপ্চুন্কে প্রদক্ষিণ করে এবং একবার ঘুরিয়া আসিতে ছয় দিন সময় লয়। তাহা হইলে দেখ, নেপ্চুনের চাঁদ ছয় দিনের মধ্যেই পূর্ণিমা ও অমাবস্যা দেখায়। আমাদের চাঁদটির পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় প্রায় একমাস সময় কাটিয়া যায়।
নেপ্চুনের চাঁদ কেন উল্টা পাকে ঘুরে, তাহা আজও ঠিক্ জানিতে পারা যায় নাই। জ্যোতিষ শাস্ত্রে অজানা ব্যাপার এখনো অনেক আছে, তোমরা যখন বড় হইয়া জ্যোতিষের বড় বড় কেতাব পড়িবে, তখন হয় ত এখনকার অনেক অজানা ব্যাপারের কারণ জানিতে পারিবে।