গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/ধূমকেতু
এ-পর্য্যন্ত আমরা সূর্য্যের কথা এবং সূর্য্যের চারিদিকে যে-সব গ্রহ-উপগ্রহ ঘুরিতেছে, তাহাদেরি কথা বলিলাম। ভাবিয়া দেখ, সূর্য্যের রাজ্যটি কত বড় এবং কেমন সুন্দর! বুধ হইতে আরম্ভ করিয়া নেপ্চুন্ পর্য্যন্ত সকল গ্রহ নিজেদের কাজ করিতে সর্ব্বদা ব্যস্ত। ঠিক্ সময়ে ঠিক্ পথে তাহারা সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসে,—তাহাদের চলাফেরাতে একটুও অনিয়ম নাই। গ্রহদের চাঁদগুলিও তেমনি। ইহারাও ঠিক্ সময়ে ঠিক্ পথে গ্রহদের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়। কখনই পথ ভুল করে না, বা এক সেকেণ্ডের জন্য আগু-পিছু হয় না। খুব ভাল ঘড়িও স্লো ফাষ্ট্ যায় কিন্তু ইহাদের স্লো ফাষ্ট্ নাই। এমন শাসন, এমন কড়া নিয়ম-কানুন তোমরা আর কোনো জায়গায় দেখিয়াছ কি? তোমরা ইতিহাস পড়িয়াছ, কিন্তু কোনো রাজাকে সূর্য্যের মত অনায়াসে এবং নিরাপদে রাজ্য চলাইতে দেখিয়াছ কি? আমরা দশ পাঁচ জন লোক একত্র হইলে কত ঝগড়া, কত হানাহানি, কত মারামারি করি, কিন্তু গ্রহ-উপগ্রহেরা এক জায়গায় থাকিয়া এত দৌড়াদৌড়ি করিয়াও কেহ কাহাকে ধাক্কা দেয় না। ইহা কি কম আশ্চর্য্যের কথা!
এমন সুন্দর এমন সুশাসিত সূর্য্যের রাজ্যেও কিন্তু কখনো কখনো এক-একটা বিভীষিকা দেখা দেয়। বিভীষিকাটা কি, তোমরা বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছ,—ধূমকেতু। তোমরা নিশ্চয়ই ধূমকেতু দেখিয়াছ। কয়েক বৎসর আগে (ইংরাজি ১৯১০ সালের বৈশাখ মাসে) পূর্ব্ব দিকের আকাশে একটা প্রকাণ্ড ধূমকেতু উঠিয়াছিল। এই রকম একটা আকাশজোড়া প্রকাণ্ড জিনিসকে দেখিলে ভয় হয় না কি? এই জন্যই আমরা বলিতেছিলাম, ধূমকেতুরা সূর্য্যের রাজ্যের বিভীষিকা। ভয় দেখাইলেও কিন্তু ইহারা কাহারো অনিষ্ট করে না এবং অনিষ্ট করিবার শক্তিও ইহাদের নাই। ধূমকেতুদের অত বড় বড় লেজগুলি এমন হাল্কা বাষ্প দিয়া প্রস্তুত যে, তাহাদের লেজের ভিতর দিয়া পিছনের ছোট তারাগুলিকে স্পষ্ট দেখা যায়।
এখানে একটি ধূমকেতুর ছবি দিলাম। ইংরাজি ১৯০৮ সালের ভোর রাতে পূবের আকাশে ইহাকে কিছুদিন দেখা গিয়াছিল। দেখ, ইহার লেজের ভিতর দিয়া পিছনের তারাগুলিকে দেখা যাইতেছে। ইহা হইতেই তোমরা বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছ, লেজ যত বড়ই হউক না কেন, তাহাতে সার পদার্থ কিছুই নাই। এইজন্যই জ্যোতিষীরা বলেন, ধূমকেতুর লেজে যে পদার্থটুকু আছে তাহা যদি এক সঙ্গে করিয়া ওজন করা যায়, তাহা হইলে তাহার ওজন আধ্সের বা তিন পোয়ার বেশি হয় না,—অর্থাৎ যদি সুবিধা হয় তাহা হইলে তোমরা একটা বড় ধূমকেতুর লেজ অনায়াসে গুটাইয়া পকেটে পুরিয়া রাখিতে পার।
যাহার লেজ এত হাল্কা তার মুণ্ডটা খুব ভারি হইবে, এই কথা বোধ হয় তোমরা ভাবিতেছ? কিন্তু ধূমকেতুর মুণ্ডও খুব ভারি নয়,—তবে লেজের চেয়ে মুণ্ড ভারি।
ছেলে-বেলায় আমরা যখন ভূতের গল্প শুনিতাম, তখন আমার বড় ভয় করিত। তোমরাও হয় ত খুব ছেলে-বেলায় ভূতের গল্প শুনিয়া ভয় পাইয়াছ। কিন্তু ঠাকুর মা যখন বলিতেন, ভূত কিছুই নয় কেবল একটা হাওয়া; তাহারা কাহারো অনিষ্ট করে না, এমন কি ভূতে ঢিল মারিলে তাহা কাহারো গায়ে লাগে না।;—তখন মনে মনে একটু সাহস হইত। ধূমকেতুগুলো যেন সূর্য্যের রাজ্যের ভূত,—কোথায় কিছু নাই, হঠাৎ দেখা দিয়া ইহারা লোকের মনে ভয় লাগাইয়া দেয়। কিন্তু যখন জ্যোতিষীদের কাছে শুনি যে, তাহাদের গায়ে সার জিনিস কিছুই নাই, আগাগোড়া সবই ফাঁকি, তখন সাহস হয়।
কিন্তু কিছুদিন আগেও জ্যোতিষীরা এরকমে সাহস দিতে পারিতেন না; কারণ তখন তাঁহারা ধূমকেতুর ভিতরের খবর জানিতেন না। এজন্য আগেকার লোকে ধূমকেতু দেখিলেই ভয় পাইত এবং ভাবিত, ইহাদের উদয় হইলে বুঝি দেশে অজন্মা হয়, মারী-ভয় দেখা দেয়। যাঁহারা জ্যোতিষের খবর জানেন না, তাঁহারা আজও ঐ রকম বৃথা ভয় করেন।
ধূমকেতু জিনিসটা কি এখন তোমাদিগকে বলিব। বুঝিতেই পারিতেছ ইহারা সূর্য্যের রাজ্যের প্রজা নয়। ধূমকেতু যদি পৃথিবী বৃহস্পতি বা শনির মত জিনিস হইত, তাহা হইলে অনেক আগে জ্যোতিষীরা ইহাদের কথা পুরানো পুঁথিপত্রে লিখিয়া রাখিতেন। কিন্তু পুরানো কাগজ-পত্রে ধূমকেতুর গতিবিধি-সম্বন্ধে কোনো কথাই লেখা নাই।
এই আকাশে যে হাজার হাজার নক্ষত্র রহিয়াছে সেগুলি যে কি, তাহা তোমাদিগকে একবার বলিয়াছি। ইহাদের প্রত্যেকেই এক-একটা সূর্য্যের মত বড় জিনিস; হয় ত তাহাদের চারিদিকে আমাদের পৃথিবী বৃহস্পতি শনি ইত্যাদির মত অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহ দিবারাত্রি ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, একা সূর্য্যই এই আকাশে রাজত্ব করে না। সূর্য্যে সূর্য্যে আকাশ ভরিয়া আছে। আমাদের সূর্য্য এই অসংখ্য সূর্য্যের মত একটি। এখন ভাবিয়া দেখ, সূর্য্য তাহার গ্রহ-উপগ্রহ লইয়া যে জায়গাটুকুতে রহিয়াছে তাহা অনন্ত আকাশের তুলনায় কত ছোট! পৃথিবীর উপরে যদি কেহ একটি কুঁড়ে ঘর বাঁধিয়া কয়েকটি ছেলে-মেয়েকে লইয়া ঘরকন্না পাতায়, তাহা হইলে ইহা যেমন একটা ছোট ব্যাপার হয়, বুধ বৃহস্পতি প্রভৃতি গ্রহ-উপগ্রহদিগকে লইয়া সূর্য্য যে ঘরকন্নাটি পাতাইয়াছে, অনন্ত আকাশের কাছে এবং অসংখ্য নক্ষত্রদের কাছে তাহা ঐ রকমই একটা ছোট ব্যাপার।
খুব নির্জ্জন মাঠের মধ্যে যদি আমরা একখানি ছোট ঘর বাঁধিয়া বাস করি, তাহা হইলে কখনো কখনো দুই একজন অতিথি বা রবাহূত অনাহূত লোক মাঝে মাঝে বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হয়। তখন আমরা কি করি? তাহাদের স্নানের ও আহারের জোগাড় করিয়া দিই। হয় ত এক বেলা, না হয় এক দিন দুদিন থাকিয়া অতিথি যে দিকে ইচ্ছা চলিয়া যায়। আমাদের সূর্য্যদেবটি এই অনন্ত আকাশের এক কোণায় যে একটি কুঁড়ে ঘর বাঁধিয়া আটটি গ্রহকে লইয়া বাস করিতেছেন, সেখানেও মাঝে মাঝে দুই একটি অতিথি বা পথিক আসিয়া দেখা দেয়।
সূর্য্যের বাড়ীর অতিথি কাহাকে বলিতেছি তোমরা বোধ হয় এখনো বুঝিতে পার নাই। আমাদের গ্রহ-উপগ্রহদের চেয়ে অনেক ছোট যে-সব জড়পিণ্ড সূর্য্যের রাজ্যের বাহিরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, আমরা তাহাদিগকেই অতিথি বলিতেছি। অতিথি বা পথিকের খবর যেমন আমরা জানি না, ইহাদেরও খবর আমরা জানি না। ইহারা সূর্য্যের জগতের জিনিস নয়। নেপ্চুনের ভ্রমণ-পথের বাহিরে সমস্ত আকাশের যেখানে-সেখানে নিজেদের খেয়াল মত ইহারা ঘুরিয়া বেড়ায়। আকারে বড় নয়, তার উপরে সূর্য্য বা নক্ষত্রদের মত আলোও তাদের নাই, এজন্য দূরবীণ দিয়াও তাহাদের খোঁজ করা যায় না। যখন পথিকের বেশে অতিথি হইয়া সূর্য্যের রাজ্যে প্রবেশ করে, আমরা তখনি ইহাদিগকে সূর্য্যের আলোতে দেখিতে পাই। এই অজ্ঞাতকুলশীল জড়পিণ্ডেরাই আমাদের কাছে, ধূমকেতুর আকারে দেখা দেয়।
বুঝিতে পারিলে কি? তাহা হইলে দেখ,—আমাদের পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহদের সহিত সূর্য্যের যেমন আত্মীয়তা আছে, ধূমকেতুদের সহিত মোটেই তাহা নাই। ইহারা সূর্য্য-জগতের অতিথিমাত্র। কোনো অজানা দেশ হইতে হাঁপাইতে হাঁপাইতে ছুটিয়া আসিয়া ইহাদের অনেকেই কেবল কয়েকদিনের জন্য এই জগতে আসে। কিন্তু সূর্য্য ছাড়িবার পাত্র নয়; একবার এরাজ্যে প্রবেশ করিলে কেহই তাহার হাত হইতে সহজে মুক্তি পায় না। অতিথি ধূমকেতুরাও মুক্তি পায় না। সূর্য্য জগতে পা ফেলিবা মাত্র সূর্য্য তাহাদিগকে জোরে টানিতে থাকে। কাজেই তাহারা ছুটিয়া সূর্য্যের দিকে চলে এবং শীঘ্র শীঘ্র একবার মাত্র সূর্য্য-প্রদক্ষিণ করিয়া এই রাজ্য হইতে চিরদিনের জন্য বিদায় গ্রহণ করে।
আমরা যত ধূমকেতু দেখিতে পাই, তাহাদের অনেকেই এই রকমের অতিথি-জ্যোতিষ্ক। ইহারা আমাদিগকে খবর দিয়া আসে না,—কিন্তু আসিলেই সূর্য্য জানিতে পারে এবং তাহাদিগকে টানিয়া নিজের চারিদিকে একবার কলুর বলদের মত ঘুরপাক্ খাওয়ায়।
তোমরা বোধ হয় ভাবিতেছ, অতিথিদিগকে এরকমে লাঞ্ছনা দেওয়া সূর্য্যের ভারি অন্যায়; কিন্তু এই ঘটনা বৎসরের মধ্যে অনেক দিনই ঘটে। জ্যোতিষীরা ইহার সাক্ষী। তাঁহারা প্রতি বৎসরেই অন্ততঃ আটটি দশটি নূতন অতিথিকে সূর্য্যের রাজ্যে প্রবেশ করিতে দেখিতেছেন এবং প্রত্যেকটিকেই সূর্য্য এই রকমে কষ্ট দিয়া ছাডিয়া দিতেছে, ইহা স্বচক্ষে দেখিতেছেন। এগুলির মধ্যে অনেকেই ছোট, তাই খালি চোখে আমরা তাহাদিগকে দেখিতে পাই না। জ্যোতিষীরা দূরবীণ দিয়া ইহাদের লাঞ্ছনা দেখিতে পান। যদি বড় ধূমকেতু হঠাৎ আসিয়া পড়ে, আমরা কেবল তখনি তাহাদিগকে খালি চোখে দেখিতে পাই।
তাহা হইলে বুঝা যইতেছে, বাড়িতে কবে অতিথি আসিবেন, তাহা যেমন আমরা এক বৎসর ছমাস কি এক মাস আগেও জানিতে পারি না, সেই রকম আকাশে কবে ধূমকেতু উঠিবে তাহাও আমরা দুমাস ছমাস বা দশ দিন আগেও জানিতে পারি না। ইহারা হঠাৎ আসে এবং হঠাৎ চলিয়া যায়। যত বড় বড় ধুমকেতু দেখা গিয়াছে, তাহাদের প্রায় সকলেরই যাওয়া-আসা এই রকমেই হইয়াছে। কয়েক বৎসর আগে (১৯০৮ সালে) শীতকালে যে একটি বড় ধূমকেতুকে সন্ধ্যার সময়ে পশ্চিম আকাশে দেখা গিয়াছিল, তাহার কথা তোমাদের মনে আছে কি না জানি না। এটাও ঐ-রকম হঠাৎ আসিয়া দেখা দিয়াছিল, আবার কয়েক দিনের মধ্যে সূর্য্যের রাজ্য ছাড়িয়া পলাইয়া গিয়াছিল।
ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ছট্ফট্ করিতে করিতে পথিক বাড়ীতে আসিল। তাহাকে আহার করানো গেল, দুই বেলা তিন বেলা খাইল এবং শেষে চিরজীবনের মত বাড়িতে থাকিয়া গেল, এ-রকম ঘটনা তোমরা দেখিয়াছ কি? আমি কিন্তু স্বচক্ষে দেখিয়াছি।
আমাদের বাড়িতেই একটি হিন্দুস্থানী পথিক ঐ রকমে আসিয়াছিল। সে বাড়িতে দুদিন থাকিয়া আমার ছোট ছোট ভাইদের খুব যত্ন করিতে লাগিল। বাবা ও মা বলিলেন, কোদো তা হ’লে বাড়িতেই থাক্। লোকটার নাম ছিল কোদো। সে ঐদিন অবধি আমাদের বাড়িতে আছে; এখন সে যেন আমাদের বাড়িরই লোক। দেখ,—অতিথ-পথিক লোক এক বেলার জন্য বাড়িতে আসিয়া কি রকমে ঘরের লোক হইয়া গেল।
১৯০৮ সালের বহুপুচ্ছবিশিষ্ট ধূমকেতু
যে-সব ছোটবড় ধূমকেতু প্রতি বৎসরে দু’দশ দিনের জন্য সূর্য্যের রাজ্যে অতিথি হয়, তাদের মধ্যেও দু’চারটিকে ঐরকমে সূর্য্যের পরিবারের লোক হইতে দেখা যায়। তখন তাহারা কি করে জান কি? পৃথিবী মঙ্গল বৃহস্পতি প্রভৃতি গ্রহদের মত তাহারা অবিরাম সূর্য্যকে ঘুরিতে আরম্ভ করে। সূর্য্য তাহার পরিবারের সকলকে ক্রমাগত ঘুরপাক্ খাওয়ায়;—যে-সব ধূমকেতু পরিবারভুক্ত হইয়া পড়ে তাহাদিগকেও সে এক-একটা নির্দ্দিষ্ট পথে নির্দ্দিষ্ট সময়ে ঘুরাইয়া আনিতে থাকে।
এখানেও দেখ, সূর্য্যের কত অন্যায়। অজানা রাজ্য হইতে আসিয়া যাহারা হঠাৎ এই জগতে পা দিয়াছে, তাহাদিগকে এই রকমে বন্দী করা কি সূর্য্যের উচিত? কেবল বন্দী করিয়া ক্ষান্ত হয় না, সূর্য্য সেগুলিকে ঘুরাইয়া লইয়া বেড়ায়। ধূমকেতুরা যদি ইচ্ছা করিয়া সূর্য্যের রাজ্যের প্রজা হইত, তাহা হইলে দোষ ছিল না, কিন্তু সূর্য্য এবং বৃহস্পতি শনি ইউরেনস্ প্রভৃতি বড় বড় গ্রহেরা জোর করিয়া ধূমকেতুদিগকে আটক করে এবং ঘুরাইয়া লইয়া বেড়ায়। ইহা কি কম অত্যাচারের কথা!
তোমরা বোধ হয় ভাবিতেছ,—সে আবার কি! সূর্য্য শনি বৃহস্পতি ধূমকেতুদিগকে আটক করে কি করিয়া? কিন্তু ইহারা সত্যই আটক করে। জ্যোতিষীদিগকে জিজ্ঞাসা কর, তাঁহারা ঐ-রকমে বন্দী ধূমকেতুর অন্তত কুড়ি পঁচিশটার নাম বলিয়া দিবেন।
সূর্য্যের নিজের গায়ে কি রকম জোর তাহা তোমরা আগে শুনিয়াছ। দুই শত আশী কোটি মাইল তফাতে আকাশের এক কোণে যে নেপ্চুন্ গ্রহটি লুকাইয়া আছে, সূর্য্য তাহাকেও টানিয়া ঘুরাইয়া লইয়া বেড়ায়। কাজেই যে-সব ধূমকেতু কুক্ষণে এ রাজ্যে পা দেয়, কায়দায় পাইলে সূর্য্য তাহাদের বেগ কমাইয়া বন্দী করিয়া ফেলে। বিড়াল ভয় পাইলে ও রাগিলে কি রকমে লেজ ফুলায় দেখিয়াছ ত! ধূমকেতুগুলিও সূর্য্যের কাছে গেলে সেই রকম লেজ ফুলাইয়া কত ভয় দেখায়। কিন্তু সূর্য্য তাহাতে ভয় পায় না,—সুবিধা পাইলেই উহাদের কোনোকোনোটিকে ধরিয়া নিজের চারিদিকে চিরদিনের জন্য ঘুরপাক্ খাওয়াইতে থাকে।
তোমরা বোধ হয় ভাবিতেছ,—সূর্য্যের হাত হইতে যাহারা রক্ষা পায়, তাহাদের বুঝি ফাঁড়া কাটে। কিন্তু তাহা হয় না। ফিরিবার পথে বা প্রবেশের পথে বৃহস্পতি শনি ইউরেনস্ ও নেপ্চুনের মত বড় বড় গ্রহদের সঙ্গে যদি ধূমকেতুর দেখা হয়, তাহা হইলেই সর্ব্বনাশ! ইহারা ধূমকেতু বেচারাদের লইয়া ভয়ানক টানা-হেঁচ্ড়া করে এবং তাহাদের বেগ কমাইয়া দেয়। ইহাতে দুই একটা ধূমকেতু এমন জখম হইয়া পড়ে যে, তাহারা আর সূর্য্যের রাজ্য ছাড়িয়া পলাইতে পারে না। কাজেই তখন তাহাদিগকে গ্রহদেরি মত সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিয়া মরিতে হয়। এই রকম টানাটানি ধস্তাধস্তিতে দুই-একটা ধূমকেতু ভাঙিয়া চুরিয়া গুঁড়া হইয়া গিয়াছে, এমন ঘটনাও জ্যোতিষীরা স্বচক্ষে দেখিয়াছেন। এ-সম্বন্ধে দু-একটা গল্প তোমাদিগকে পরে বলিব।
তাহা হইলে দেখা যাইতেছে,—ধূমকেতুদের মধ্যে পলাতক ও বন্দী এই দুই রকম ভাগ আছে। পলাতকদের সংখ্যাই বেশি। ইহারা সূর্য্যের রাজ্যে প্রবেশ করিয়া একবার মাত্র সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং তার পরে চিরকালের জন্য এই রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া যায়। যদি আকারে বড় হয়, তবেই আমরা পৃথিবী হইতে ইহাদিগকে একবার মাত্র দেখিতে পাই। তাহার পরে ইহারা যে কোথায় যায়, তাহা ঠিক্ করিতে পারি না।
বন্দী ধূমকেতুরা সূর্য্যজগতে প্রবেশ করিয়া, সূর্য্য বা বৃহস্পতি প্রভৃতির টানে এমন বাঁধা পড়িয়া যায় যে, তাহাদের আর পলাইবার শক্তি থাকে না। কাজেই তাহারা গ্রহদের মত এক-একটা নির্দ্দিষ্ট পথে ও নির্দ্দিষ্ট সময়ে সূর্য্যকে পাক দিতে থাকে। নির্দ্দিষ্ট সময়ের শেষে সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিবার জন্য তাহারা যখনি পৃথিবীর কাছ দিয়া যাইতে আরম্ভ করে, তখনি আমরা তাহাদিগকে দেখিতে পাই। ইহারা বার বার আমাদিগকে দেখা দিয়া বার বার লুকায়। কি প্রকার পথ ধরিয়া কত দিনে ইহাদের সূর্য্য-প্রদক্ষিণ হয়, জ্যোতিষীরা তাহার সকলি জানেন। কাজেই কোন্ বৎসরের কোন্ তারিখে পৃথিবী হইতে তাহাদিগকে দেখা যাইবে, ইহাও হিসাব করিয়া বলা চলে। কিন্তু পলাতক ধুমকেতুদের সম্বন্ধে এ-রকম একটি কথাও বলা চলে না।
বড় বড় গ্রহদের মধ্যে কে কতটি ধূমকেতুকে ধরিয়া বন্দী করিয়াছে, জ্যোতিষীরা তাহার একটা হিসাব করিয়াছেন। গ্রহদের মধ্যে বৃহস্পতি সব চেয়ে বড়,—তেরো শত পৃথিবী জোড়া না দিলে একটা বৃহস্পতিকে গড়া যায় না। সে একাই প্রায় ষোলটি ধূমকেতুকে বন্দী করিয়াছে। ইহাদের সকলগুলিই সাত আট বৎসরে সূর্য্যকে এক একবার ঘুরিয়া আসে এবং বৃহস্পতির ভ্রমণ-পথ ছাড়াইয়া বেশি দূরে যাইতে পারে না। শনি, ইউরেনস্ ও নেপ্চুন্ বৃহস্পতির চেয়ে ছোট বটে কিন্তু ধূমকেতুদের তুলনায় কোটি কোটি গুণ বড়। এজন্য ইহারাও কতকগুলি ধূমকেতুকে আট্কাইয়া রাখিয়াছে। এই প্রকারে শনি দুইটিকে বন্দী করিয়াছে এবং ইউরেনস্ তিনটিকে ও নেপ্চুন্ ছয়টিকে ধরিয়া রাখিয়াছে।