গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/হ্যালির ধূমকেতু

ইংরাজি ১৯১০ সালের বৈশাখ মাসে পূবে ও পশ্চিমে যে খুব বড় ধূমকেতুটিকে তোমরা অনেক দিন ধরিয়া দেখিয়াছিলে, তাহার নাম হ্যালির ধূমকেতু। হ্যালি সাহেব একজন বড় জ্যোতিষী ছিলেন। তিনি ইহার চলাফেরার কথা আবিষ্কার করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহারই নাম অনুসারে ধূমকেতুটির নাম রাখা হইয়াছিল। ইহাকে নেপ্‌চুন্ গ্রহই সূর্য্য-জগতে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে। তাই সে নেপ্‌চুনের কাছ হইতে সূর্য্যের কাছ পর্য্যন্ত একটা লম্বা রাস্তা দিয়া পঁচাত্তর বৎসর অন্তর সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসে এবং এক একবার আমাদিগকে দেখা দেয়।

 হ্যালির ধূমকেতুর কথা বলিতে গিয়া হ্যালি সাহেবের কথা মনে পড়িয়া গেল। ইঁহার গল্পটা বলি শুন,—বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার! প্রায় একশত সত্তর বৎসর হইল তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে কিন্তু আজও তাঁহার কথা কেহ ভুলিতে পারে নাই।

 দুই শত বৎসর পূর্ব্বেকার জ্যোতিষীরা মনে করিতেন, ধূমকেতুর চলাফেরা পরীক্ষা করা বৃথা। ইহাদের সকলেই বুঝি, একবারমাত্র আমাদের দেখা দিয়া চিরকালের জন্য সূর্য্যের রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া যায়। জ্যোতিষীদের এই কথাটি হ্যালি সাহেবের মনের মত হয় নাই। তিনি খুব অঙ্ক জানিতেন,—পুরানো কাগজপত্র ঘাঁটিয়া কোন্ সালের কোন্ তারিখে পৃথিবী হইতে বড় বড় ধূমকেতু দেখা গিয়াছিল, তাহার হিসাব করিতে লাগিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে অঙ্ক কষিতে বসিলেন। হিসাব করিয়া তাঁহার মনে ঠিক বিশ্বাস হইল, সব ধূমকেতু পৃথিবী ছাড়িয়া চলিয়া যায় না। এক একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ের শেষে আমাদের বারবার দেখা দেয় এ-রকম ধূমকেতুও অনেক আছে। কিন্তু এ-রকম একটা নূতন কথা ফস্ করিয়া বলা ঠিক্ নয়,—তাই কোন কোন ধূমকেতু বারবার পৃথিবীকে দেখা দিয়াছে, হ্যালি সাহেব তাহার হিসাবে লাগিয়া গেলেন।

 ইংরাজি ১৬৮২ সালে হ্যালি সাহেব জীবিত ছিলেন। ঐ বৎসরে একটা বড় ধূমকেতু দেখা গিয়াছিল। হ্যালি সাহেব হিসাব করিয়া দেখিলেন ১৫৩১ এবং ১৬০৭ সালে ঠিক্ ঐ রকমের বড় ধূমকেতুকে পৃথিবী হইতে দেখা গিয়াছিল। যে পথ ধরিয়া ঐ দুইটি ধূমকেতু সূর্য্যকে ঘুরিয়াছিল, তাহার সহিত ১৬৮২ সালের ধূমকেতুর পথেরও মিল ধরা পড়িল। এখন হ্যালি সাহেব উদাহরণ দিয়া নিজের কথাটি বলিবার সুবিধা পাইয়া গেলেন। তিনি অন্যান্য জ্যোতিষীদিগকে বলিলেন,—১৬৮২ সালের ধূমকেতুটি নূতন জিনিস নয়। ইহাই ১৫৩১ সালে এবং ১৬০৭ সালে আমাদিগকে এক-একবার দেখা দিয়া গিয়াছে। ইহা পঁচাত্তর বৎসর অন্তর এক একবার সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসে, অতএব ১৭৫৭ বা ১৭৫৮ সালে তাহাকে আবার দেখা যাইবে।

 এমন ভবিষ্যদ্বাণী জ্যোতিষীরা আগে কখনই শুনেন নাই। হ্যালির কথা শুনিয়া সকলে অবাক্ হইয়া গেলেন। ১৭৫৭ সালে ধূমকেতুর উদয় হয় কিনা দেখিবার জন্য জ্যোতিষীরা প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু হ্যালি সাহেবের আর প্রতীক্ষা করা হইল না। নিজের গণনা সত্য হইল কিনা তাহা তিনি জানিতে পারিলেন না। যে-সময়ে ধূমকেতুর ফিরিয়া আসিবার কথা ছিল, তাহার দশ বৎসর আগে ছিয়াশী বৎসর বয়সে হ্যালি সাহেবের মৃত্যু হইল।

 ক্রমে ১৭৫৭ সাল উপস্থিত হইল। ধূমকেতুর উদয় হয় কিনা দেখিবার জন্য চারিদিকে আয়োজন চলিতে লাগিল। ভাবিয়া দেখ, সে সময়ে জ্যোতিষীদের মনে কত উদ্বেগ, কত উৎসাহ। তাঁহারা দূরবীণ খাটাইয়া কাগজ পেন্‌সিল্ লইয়া হিসাব করিতেই রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া কাটাইতে লাগিলেন। এই সময়ে ফরাসীদের মধ্যে একজন বড় জ্যোতিষী ছিলেন। ইঁহার নাম ক্লারট্ (Clairut); ইনি হিসাব করিয়া বলিলেন, হ্যালির ধূমকেতুর সঙ্গে পথের মাঝে বৃহস্পতির দেখাশুনা হইবে। বৃহস্পতির টানে হয় ত ধূমকেতু কিছুকাল পরে দেখা দিবে।

 যাহা হউক ১৭৫৭ সালের শীতকাল উপস্থিত হইল। নানা দেশের জ্যোতিষীরা দূরবীণ দিয়া ধূমকেতুর খোঁজ আরম্ভ করিলেন। দুই তিন মাস খোঁজ করার পরও কিন্তু ইহার সন্ধান পাওয়া গেল না। জোতিষীরা ভাবিতে লাগিলেন, তাহা হইলে কি হ্যালির কথা মিথ্যা। তবুও তাঁহারা খোঁজ করা ছাড়িলেন না। কিন্তু আর বেশি দিন প্রতীক্ষা করিতে হইল না, সেই বৎসরের ২৩শে ডিসেম্বর তারিখে ধূমকেতুর ছোট দেহ দূরবীণে ধরা পড়িল এবং কয়েকদিনের মধ্যে প্রকাণ্ড লেজ বাহির করিয়া সকলকে অবাক্ করিয়া দিল। এই রকমে হ্যালি সাহেবের ভবিষ্যদ্বাণী কথায় কথায় সত্য হইয়া গেল!

 ভাবিয়া দেখ, জ্যোতিষীদের সেদিন কি আনন্দ। হ্যালি সাহেব যদি সেদিন বাঁচিয়া থাকিতেন, তাঁহার কি আনন্দ হইত তাহাও একবার ভাবিয়া দেখ। যাহা হউক, ঐ দিন হইতেই জ্যোতিষীরা বুঝিয়াছিলেন, সকল ধূমকেতু একবার দেখা দিয়া পলাইয়া যায় না। নির্দ্দিষ্ট সময়ে নির্দ্দিষ্ট পথে গ্রহদের মত সূর্য্য-প্রদক্ষিণ করে, এমন ধূমকেতুও অনেক আছে।

 ১৭৫৮ সালের পরে ছিয়াত্তর বংসর কাটিয়া গেলে হ্যালির ধূমকেতু ১৮৩৫ সালে একবার দেখা দিয়াছিল। তার পরে ১৯১০ সালে সেই ধূমকেতুই আবার আমাদিগকে দেখা দিয়া গিয়াছে। সুতরাং এই হিসাবে ইংরাজি ১৯৮৫ সালে সে পুনরায় দেখা দিবে। তখন আমরা বাঁচিয়া থাকিব না, কিন্তু তোমরা উহাকে দেখিতে পাইবে।

 তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেছ, ১৯১০ সালে বৈশাখ মাসে তোমরা
১৯১০ সালের বৈশাখ মাসে হ্যালির ধূমকেতু
যে ধূমকেতুকে দেখিয়াছিলে, সেটি অতি পুরাতন জিনিস। ইহাকে দেখিয়াই হ্যালি সাহেব দুই শত বৎসর পূর্ব্বে ধূমকেতুদের সম্বন্ধে অনেক নূতন খবর জানিতে পারিয়াছিলেন। কেবল ইহাই নহে, জ্যোতিষীরা পুরাতন ইতিহাস খুঁজিয়া দেখিয়াছেন, ইংরাজি ১০৬৬ সালে যখন দিগ্‌বিজয়ী রাজা উইলিয়ম্ ইংলণ্ড আক্রমণ করেন, তখনো এই ধূমকেতুর উদয় হইয়াছিল; এবং খৃষ্টজন্মের দুই হাজার বৎসর পূর্ব্বে চীনবাসীরা ইহার উদয় দেখিয়া একবার ভয় পাইয়াছিল।