গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/সূর্য্যের গ্রহণ

সূর্য্যের গ্রহণ

সূর্য্যের আকাশের আরো দুইটা আবরণ আছে। তাহাদের কথা এখনো বলা হয় নাই। সে-সব কথা বলিবার পূর্ব্বে সূর্য্যের গ্রহণের কথা তোমাদিগকে বলিয়া লইব।

 তোমরা অবশ্যই সূর্য্য-গ্রহণ দেখিয়াছ। গ্রহণের সময়ে কত দূরদেশ হইতে যাত্রী আসিয়া গঙ্গায় স্নান করে, আহ্নিক-পূজা করে। পাঁজিতে গ্রহণের সময় ঠিক লেখা থাকে। লোকে ঘড়ি খুলিয়া সেই সময়টার জন্য প্রতীক্ষা করে। আকাশে একটুও যে নাই, অথচ দেখা যায়, একটু একটু করিয়া সূর্য্যের দেহটা ঢাকা পড়িয়া যাইতেছে। আমরা যখন তোমাদের মত ছোট ছিলাম, তখন প্রদীপের শিখার কালী কাচে লাগাইয়া, সূর্য্যের গ্রহণ দেখিতাম। সূর্য্য এত উজ্জ্বল যে, খালি চোখে তার দিকে তাকানো যায় না, তাকাইলেও চোখ খারাপ হয়। কালী-লাগানো কাচের মধ্য দিয়া দেখিলে সূর্য্যের অনেকটা আলো কাচে আট্‌কাইয়া যায়; তখন তাহাকে ঠিক চাঁদখানির মত দেখা গিয়া থাকে। দূরবীণ দিয়া দেখিবার সময়েও এই-রকম কালী-মাখানো কাচ দিয়া সূর্য্যকে দেখিতে হয়।

 যাহা হউক, গ্রহণ দেখিয়া আমরা খুব আমোদ পাইতাম; তখন একটু একটু ভয়ও হইত। কোথায় কিছু নাই, দিন-দুপরে সূর্য্য এমন ক্ষয় পাইয়া যায় কেন, এই কথাই মনে হইত। তার পরে যখন দেখিতাম, দুপরে ঠিক বিকালের মত অন্ধকার হইয়া পড়িয়াছে, পাখীরা বাসায় যাইবার জন্য চেঁচামেচি আরম্ভ করিয়াছে, চারিদিকের কাঁসর-ঘণ্টা ও খোল-করতালের শব্দে কান পাতা যাইতেছে না, তথন আরো ভয় হইত। প্রায় কুড়ি বৎসর আগে আমরা একটা খুব বড় সূর্য্য-গ্রহণ দেখিয়াছিলাম। বেলা দুইটা তিনটার সময়ে সেদিন সূর্য্য এত ঢাকা পড়িয়া গিয়াছিল যে, ঠিক সন্ধ্যার মত অন্ধকার হইয়াছিল এবং সে সময়ে আকাশে দুই-চারিটা নক্ষত্রও দেখা গিয়াছিল। এই ভারতবর্ষের কতক কতক স্থানে সে-সময়ে সূর্য্য একেবারে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছিল। ইংলণ্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশের বড় বড় জ্যোতিষীরা নানা রকম যন্ত্র দিয়া এই সূর্য্য-গ্রহণ দেখিবার জন্য ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন।

 সূর্য্যের কতকটা ক্ষয় পাইয়া গেল, এরকম আংশিক গ্রহণ বৎসরের মধ্যে দুই-একবার প্রায় সব দেশেই দেখা যায়। কিন্তু সূর্য্যের সর্ব্বাঙ্গ একটু একটু ক্ষয় পাইয়া দিনে রাত হইয়া গেল, এরকম গ্রহণ খুব অল্পই হয়; তার পর আবার এই সব পূর্ণ গ্রহণ সাধারণতঃ দু’মিনিট তিন মিনিটের অধিক থাকে না। এজন্য এই-রকম গ্রহণের সময় দূর দেশ হইতে বড় বড় পণ্ডিতেরা অনেক রকম যন্ত্র লইয়া গ্রহণ দেখিবার আয়োজন করেন। গ্রহণের সময় সূর্য্যের আকাশের অনেক অংশ ভাল করিয়া দেখা যায়। তার কথা আমরা তোমাদিগকে পরে বলিব।

 সূর্য্য-গ্রহণ কি রকমে হয় জান কি? লোকে এ-সম্বন্ধে কত কথাই বলে? কেহ বলে, রাহু নামে এক দৈত্য সূর্য্যকে গ্রাস করিয়া ফেলে; কেহ বলে, সূর্য্যের ক্ষয় রোগ আছে, তাই তাহার দেহ ক্ষীণ হইয়া আসে। এ সকলই মিথ্যা গল্প; কিন্তু অতি প্রাচীন কালে লোকদের এই সব অদ্ভুত মিথ্যা গল্প সত্য বলিয়াই বোধ হইত। ঠিক কি রকমে সূর্য্যের গ্রহণ হয়, তখনকার সাধারণ লোকে তাহা জানিত না।

 একটা মজার গল্প বলি শুন। গল্পমাত্রই প্রায় মিথ্যা হয়, কিন্তু এটা সত্য গল্প। তোমরা কলম্বস্ সাহেবের নাম বোধ হয় শুনিয়াছ; ইনি স্পেন্ দেশের লোক ছিলেন। আমেরিকা বলিয়া যে একটা মহাদেশ আছে, কলম্বসের সময়ে তাহা কেহই জানিত না। কলম্বস্ সাহেবই জাহাজে করিয়া গিয়া আমেরিকা আবিষ্কার করেন। কলম্বস্ আমেরিকায় গিয়া পৌঁছিলেন, কিন্তু সে দেশের লোকদের সঙ্গে তাঁর চেনা-শুনা ছিল না এবং তাহাদের ভাষাও জানা ছিল না। মাথায় পাখীর-পালক-পরা, গায়ে নানা-উল্কি-পরা আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা কলম্বস্ ও তাঁর সঙ্গীদের বেশভূষা চাল-চলন দেখিয়া অবাক্ হইয়া গেল। বোধ হয় তাহাদের একটু ভয়ও হইল। কলম্বস্ আকার-ইঙ্গিতে বুঝাইয়া দিলেন যে, তাঁহারা কাহারো অনিষ্ট করিতে আসেন নাই, কিছু খাবার জিনিসের প্রয়োজন। সেই অসভ্য জাতির সর্দ্দারদের একটা সভা বসিয়া গেল, কত চেঁচামেচি তর্ক-বিতর্ক হইল। শেষে কলম্বস্ দেখিলেন, তাহারা কিছু খাবার সামগ্রী সংগ্রহ করিয়া তাঁহাদের কাছে রাখিয়া গেল। খাবার ফুরাইয়া গিয়াছিল, এজন্য তাঁহারা বড় চিন্তিত ছিলেন, এখন নিশ্চিন্ত হইলেন।

 কিন্তু দশ পনেরো দিন পরে এই খাবারও ফুরাইয়া গেল, কলম্বস্ আবার চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। অসভ্য আমেরিকান্‌দের অনেক করিয়া সাধ্য-সাধনা করিতে লাগিলেন, কিন্তু এবারে তাঁহাদের কথায় তাহারা কানই দিল না। ক্ষুধা ও পিপাসায় কলম্বসের দলের সকল লোকই অস্থির হইয়া পড়িল। এই সময়ে একদিন কলম্বসের মনে হঠাৎ একটা মতলব দেখা দিল। তিনি পাঁজি খুলিয়া দেখিলেন, সে দিন সূর্য্য-গ্রহণ হইবে। সূর্য্য-গ্রহণ প্রভৃতি প্রাকৃতিক ব্যাপারকে অসভ্যেরা ভয় করে, একথা তাঁহার জানা ছিল। সূর্য্য-গ্রহণের ভয় দেখাইয়া তিনি অসভ্যদের কাছ হইতে কিছু খাবার আদায় করিবার মতলব ঠিক করিতে লাগিলেন।

 মতলব ঠিক হইয়া গেল। কলম্বস্ সর্দ্দারদের ডাকিয়া ইঙ্গিতে বুঝাইয়া বলিলেন,—“দেখ, আমরা দেবতার বংশধর, তোমরা যদি আমাদের খাবার না দাও, তবে আজ দুপরে সূর্য্যকে নিভাইয়া দিব; তোমাদের এই দেশটা চিরদিন অন্ধকার থাকিবে।”

 সর্দ্দারেরা একথা বিশ্বাস করিল না। কলম্বস্ এক গাছতলায় বসিয়া সূর্য্য-গ্রহণের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। ঠিক সময়ে গ্রহণ লাগিল এবং একটু একটু করিয়া সূর্য্যের অর্দ্ধেকটা কালো হইয়া গেল; সূর্য্যের আলো কমিয়া আসিল।

 এদিকে অসভ্যদের মধ্যে হাহাকার পড়িয়া গেল; তাহাদের সকলেই ভাবিল, কলম্বসের দলের লোকেরা সত্যই দেবতার বংশধর। তাহারা খাবার না পাইয়া রাগ করিয়া সূর্য্যকে নিভাইয়া দিতেছে। অসভ্যগণ দলে দলে আসিয়া কলম্বসের পা জড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল, এবং নানা-রকম খাবার ভারে ভারে তাঁহার গাছতলায় পৌঁছিতে লাগিল।

 কলম্বস্ খুব চতুর লোক ছিলেন। যখন দেখিলেন, ছয় মাসের মত খাবার মজুত হইয়াছে, তখন তিনি সর্দ্দারদের ডাকিয়া বলিলেন,—“আচ্ছা, সন্তুষ্ট হইয়াছি, সূর্য্যকে আবার আলো দিতে বলিলাম।”

 তখন গ্রহণ প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছিল, দেবতার বংশধর কলম্বসের কথা সত্য হইল; একটু একটু করিয়া সূর্য্য আবার পূর্ব্বের মত পূর্ণ হইল এবং আগেকার মতই আলো দিতে লাগিল। আমেরিকার আদিম অসভ্য অধিবাসীরা ঢাকঢোল বাজাইয়া আনন্দ করিতে লাগিল। ইহার পর হইতে কলম্বসের দলের লোকের আর খাদ্যের অভাব হয় নাই।

 এই ঘটনা অনেক দিন আগে ঘটিয়াছিল। তখন খুব সভ্য দেশের লোকেরাও এখনকার মত আকাশের নক্ষত্রদের কথা ভাল করিয়া জানিত না। কিন্তু আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা এসব খুব জানিতেন; তাঁহাদের পূজা আহ্নিক হোম জপতপ সকলি গ্রহ-নক্ষত্র ও চন্দ্র-সূর্য্যের গতিবিধি-অনুসারে করিতে হইত। তাঁহারা গ্রহণের সময় ঠিক করিয়া বলিয়া দিতে পারিতেন। তা-ছাড়া চন্দ্র-সূর্য্যের উদয়-অস্তের সময় এবং কোন্ দিন কখন চন্দ্র-সূর্য্য আকাশের কোন্ অংশে থাকিবে, এসবও হিসাব করিতে পারিতেন। সে সময়ে দূরবীণ ছিল না, হিসাব করিবার মত অন্য যন্ত্রাদিও ছিল না। তথাপি আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা যে কি রকমে এই সব হিসাব-পত্র করিতেন, তাহা ভাবিলে অবাক্ হইতে হয়। যাহা হউক, আজও পৃথিবীর অনেক দেশে এমন অসভ্য-জাতি আছে, যাহারা চন্দ্র-সূর্য্যের গ্রহণ ভয়ের চোখে দেখিয়া ভাবে, বুঝি কোনো দৈত্য-দানবেই চন্দ্রসূর্য্যকে ঢাকিয়া ফেলে।

 আচ্ছা, সূর্য্য-গ্রহণ কি রকমে হয় তোমরা বলিতে পার কি? গ্রহণের সময়ে সূর্য্য যে ঢাকা পড়িয়া যায় একথা ঠিক, কিন্তু কে সূর্য্যকে ঢাকে এবং কি রকমে ঢাকে, এসব কথা তোমরা জান কি? যেমন ছাতা দিয়া আমরা সূর্য্যক ঢাকি বা হাতের তেলো দিয়া সূর্য্যের আলো রোধ করি, ইহা যেন সেই রকমেরই ঢাকা-পড়া। একখানা কালো মেঘ ভাসিয়া আসিয়া কি রকমে সূর্য্যকে সম্পূর্ণ ঢাকিয়া ফেলে, বা তাহার আধখানা ঢাকিয়া রাখে, তাহা তোমরা দেখিয়াছ। এই রকমে সূর্য্য ঢাকা পড়িলে, তাহার তেজ থাকে না, চারিদিক অন্ধকার হইয়া যায়। সত্য সত্যই, এই রকমে কিছু দিয়া ঢাকা পড়িলে সূর্য্যের গ্রহণ হয়। আকাশের মত উঁচু জায়গায় কেহ ত ছাতা খুলিয়া সূর্য্যকে ঢাকিতে পারে না, মেঘের দ্বারাও এ কাজটি হইবার নহে; কারণ সূর্য্য-গ্রহণের সময়ে মেঘ দেখা যায় না এবং আবার গ্রহণের অন্ধকারটাও মেঘের ছায়ার মত একটুখানি স্থান জুড়িয়া থাকে না। কাজেই মানিয়া লইতে হয়, আকাশের উঁচু জায়গায় কোনো একটা বড় জিনিস ধীরে ধীরে আসিয়া সূর্য্যকে ঢাকিয়া ফেলে। কিন্তু জিনিসটা কি?

 তোমরা যেমন মনে মনে ভাবিতেছ, কোনো প্রকাণ্ড জিনিস সূর্য্য ও পৃথিবীর মাঝখানে আসিয়া সূর্য্যকে ঢাকিয়া দেয়, অনেক দিন আগে আমাদের দেশের বড় বড় পণ্ডিতেরাও তোমাদের মত মনে মনে এই কথাই ভাবিয়াছিলেন। কেবল ভাবিয়াই তাঁহারা ক্ষান্ত হন নাই, বার-বার সূর্য্য-গ্রহণ পরীক্ষা করিয়াছিলেন এবং কত অঙ্ক কষিয়া হিসাব-পত্র করিয়াছিলেন। শেষে তাঁহারা ঠিক করিয়াছিলেন, আমাদের চাঁদই গ্রহণের সময়ে পৃথিবী ও সূর্য্যের মাঝে দাঁড়াইয়া সূর্য্যকে ঢাকিয়া ফেলে।

 তোমরা ভাবিতেছ, এ আবার কি কথা, দিনের বেলায় কোথা হইতে চাঁদ আসিয়া সূর্য্যকে ঢাকিবে। কিন্তু তোমরা যদি একবার ভাবিয়া দেখ, তাহা হইলে বেশ বুঝিতে পারিবে দিনের বেলায় চাঁদ আকাশে থাকে। অমাবস্যার কাছাকাছি অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের একাদশী দ্বাদশীতে চাঁদের কখন উদয় হয় দেখিয়াছ কি? তখন শেষ রাত্রিতে চাঁদ উঠে, তখন তোমরা ঘুমাইয়া থাক। এই সময়ে চাঁদ পূর্ব্ব দিকের আকাশের একটু উপরে উঠিলেই সূর্য্যের উদয় হয়। সূর্য্য উদিত হইলে তাহার আলোতে চাঁদকে দেখা যায় না—কিন্তু চাঁদ আকাশেই থাকে। সূর্য্যের একটু আগে আগে চলিয়া সে সূর্য্যাস্তের আগেই অস্ত যায়, কাজেই সন্ধ্যার পরে তাহাকে দেখা যায় না।

 অমাবস্যার দু’দিন আগে চাঁদ কথন উঠে জান কি? তথন খুব ভোরে অর্থাৎ সূর্য্যের উদয় হইবার চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট আগে তাহার উদয় হয়। কাজেই পূর্ব্ব-আকাশের একটু উপরে উঠিতে-না-উঠিতে সূর্য্য উঠিয়া পড়ে এবং দিনের আলোতে আর চাঁদকে দেখা যায়। না। কিন্তু চাঁদ সমস্ত দিন আকাশেই থাকে এবং সূর্য্যের আলোতে ডুব-সাঁতার কাটিয়া সূর্য্য অস্ত যাইবার একটু আগে অস্ত যায়। কাজেই আমরা তাহাকে দেখিতে পাই না।

 অমাবস্যার দিন চাঁদ কোথায় থাকে বলিতে পার কি? তোমরা যদি সন্ধ্যা হইতে সমস্ত রাত্রি জাগিয়া আকাশ পানে তাকাইয়া থাক, তাহা হইলেও একটুখানির জন্য চাঁদকে দেখিতে পাইবে না। সে দিন চাঁদের উদয় হয় সূর্য্যের সঙ্গে সঙ্গে। সূর্য্যের আলো বেশি, তাই আমরা সূর্য্যকে দেখিতে পাই; চাঁদ যে তাহারি কাছে থাকিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিতেছে, ইহা আমরা দেখিতেই পাই না। তার পরে সন্ধ্যার পূর্ব্বেই সূর্য্যের সঙ্গে সঙ্গে তাহার অস্ত হয়। কাজেই দিনরাত্রির মধ্যে চাঁদকে কি করিয়া দেখিবে?

 সূর্য্য পৃথিবী হইতে কত দূরে আছে, তাহা তোমাদিগকে পূর্ব্বে বলিয়াছি। চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ, তাই ইহা পৃথিবীর কোলের কাছে থাকে এবং পৃথিবীরই চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়। কাজেই সূর্য্যের চেয়ে চাঁদই পৃথিবীর নিকটে আছে। অমাবস্যার দিন চাঁদ সূর্য্যের খুব কাছাকাছি থাকিয়া উদিত হয় এবং উহা আলোর মধ্যে লুকাইয়া সূর্য্যের পাশাপাশি থাকিয়া সূর্য্যের সঙ্গে সঙ্গে অস্ত যায়। এখন যদি সেদিন চাঁদ সূর্য্যের কাছে যাইতে যাইতে সূর্য্যকে ঢাকিয়া ফেলে, তাহা হইলে কি হয় বলিতে পার কি? তখন আমরা সূর্য্যের ঢাকা-পড়া অংশটা দেখিতে পাই না; সূর্য্যটা আধখানা বা সিকিখানা হইয়া দাঁড়ায়। তার পরে চাঁদ যদি সমস্ত সূর্য্যটাকে ঢাকিয়া ফেলে, তাহা হইলে সূর্য্যের সকলি ঢাকা পড়িয়া যায়, দিনের আলো কমিয়া যায়, সূর্য্যের উজ্জ্বল অংশটাকে ঘোর কালো দেখায়। ইহাই সূর্য্যের পূর্ণ-গ্রহণ।

 সূর্য্য-গ্রহণের দিন তোমরা যদি পাঁজি খুলিয়া দেখ, তাহা হইলে সেদিন পাঁজিতে অমাবস্যা তিথি লেখা আছে দেখিবে। কেন, বুঝিতে পারিতেছ কি? কারণ অমাবস্যার দিনই সূর্য্যের ও পৃথিবীর প্রায় মাঝে আসিয়া চাঁদ সূর্য্যের সঙ্গে সঙ্গে উদিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে অস্ত যায়। এই দিনই একটু এ পাশে বা ও পাশে সরিয়া দাঁড়াইলেই চাঁদ সূর্য্যকে ঢাকিতে পারে। অন্য তিথিতে চাঁদ সূর্য্য হইতে এত দূরে থাকে যে, সে কথনই পৃথিবী ও সূর্য্যের মাঝে দাঁড়াইয়া সূর্য্যকে ঢাকিতে পারে না।

 তোমরা এখন জিজ্ঞাসা করিতে পার, তাহাই যদি হয়, তবে সব অমাবস্যায় কেন সূর্য্য-গ্রহণ হয় না? এ কথার উত্তর এই যে, সব অমাবস্যায় চাঁদ সূর্য্যের কাছে থাকিয়া উদয় ও অস্ত যায় বটে, কিন্তু পৃথিবী ও সূর্য্যের ঠিক মাঝে আসিয়া দাঁড়ায় না। কাজেই চাঁদে সূর্য্য ঢাকা পড়ে না। দুপর বেলায় তোমরা ছাতাটিকে যদি সূর্য্য ও তোমার দেহের ঠিক মাঝে রাখিতে পার, তাহা হইলেই সূর্য্যকে আড়াল দেওয়া যায় এবং তোমার গায়ে রৌদ্র লাগে না। যে অমাবস্যায় আমাদের চাঁদখানি দিনের আলোর মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি আসিয়া তোমার ছাতার মত পৃথিবী ও সূর্য্যের ঠিক মধ্যে আসিয়া দাঁড়ায়, সেই দিনই কেবল সূর্য্য-গ্রহণ হয়।

 কতক অমাবস্যায় চাঁদ পৃথিবী ও সূর্য্যের মাঝে আসে এবং কতক অমাবস্যায় আসে না কেন, এই প্রশ্নেরও উত্তর দেওয়া যায়। কিন্তু উত্তরটা বড় জটিল, এখন তোমাদের তাহা বলিব না। তোমরা যখন বড় হইয়া জ্যোতিষের বড় বড় বই পড়িবে, তখন এই প্রশ্নের উত্তর পাইবে।

 এখানে সূর্য্যের আংশিক গ্রহণের ছবি দিলাম।


১ম ছবি

সূর্য্য

চাঁদ

 

২য় ছবি

সূর্য্য

চাঁদ

 প্রথম ছবিতে দেখ, সাদা সূর্য্যের অনেকটা কালো কালো জিনিসে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে, তাই সূর্য্য-গ্রহণ হইয়াছে।

 দ্বিতীয় ছবি দেখিলেই বুঝিবে, চাঁদ পৃথিবী ও সূর্য্যের মাঝে আসিয়া সূর্য্যের খানিকটা ঢাকিয়া ফেলিয়াছে এবং ইহাতে সূর্য্যের আলো আটকাইয়া গিয়াছে; তাই গ্রহণ হইয়াছে।

 ইহার পরে যে ছবিটি আছে, তাহা পূর্ণ গ্রহণের ছবি। দেখ, চাঁদ মাঝে দাঁড়াইয়া এত উজ্জ্বল সূর্য্যটাকে কি-রকম কালো করিয়া ফেলিয়াছে।

 এ-রকম পূর্ণ সূর্য্য-গ্রহণ প্রায়ই হয় না। আমার এত বয়স হইয়াছে, আমি একটাও দেখি নাই। প্রায় কুড়ি বৎসর পূর্ব্বে, আমরা যখন কলেজে পড়ি, তখন ভারতবর্ষে এই-রকম গ্রহণ একবার হইয়াছিল, তাহা আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। আমাদের বাঙ্‌লা দেশ হইতে পূর্ণ-গ্রহণ দেখা যায় নাই, কেবল বিহার-অঞ্চলে আরাজিলা-প্রভৃতি জায়গা হইতে সূর্য্যকে একেবারে ঢাকা পড়িতে দেখা গিয়াছিল। ইংলণ্ড, জার্ম্মানি, ফ্রান্স্, আমেরিকা, জাপান প্রভৃতি দেশ হইতে অনেক জ্যোতির্ব্বিৎ পণ্ডিত অনেক খরচ-পত্র করিয়া ভারতবর্ষে উপস্থিত হইয়াছিলেন। বড় বড় দূরবীণ খাটাইয়া ও নানা যন্ত্র দিয়া পূর্ণ-গ্রহণের সময়কার সূর্য্যের ফোটোগ্রাফ্ ছবি তুলিবার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। বর্ষাকালে এরকম গ্রহণ হইলে হয়ত তাঁহারা আসিতেন না, কারণ গ্রহণের সময়ে একখানা মেঘ উঠিয়া সূর্য্য ঢাকিয়া দিলে গ্রহণ দেখা হইত না। সব প্রস্তুত, যন্ত্র-পাতি থাটাইয়া জ্যোতির্ব্বিদ্‌গণ গ্রহণের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া আছেন, হঠাৎ একখানা মেঘ উঠিয়া সূর্য্যকে ঢাকিয়া দিল, এরকম ঘটনা পূর্ব্বে আনেক ঘটিয়াছে। ইহাতে জ্যোতির্ব্বিদ্‌গণের মনে কত কষ্ট হয় ভাবিয়া দেখ। তোমরা কলিকাতার আলিপুরের চিড়িয়াখানায় বেড়াইতে যাইবে বলিয়া বসিয়া আছ, হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি আসিল, তোমাদের যাওয়া হইল না। ইহাতে মনে কত কষ্ট হয় বল দেখি। জ্যোতির্ব্বিদ্‌গণের এর চেয়েও কষ্ট হয়, কারণ কত সাত-সমুদ্র তের-নদী পার হইয়া, কত টাকা খরচ করিয়া, জাহাজে চড়িয়া তাঁহারা আসেন।

 গ্রহণের সময়ে দু’ মিনিটের জন্য সূর্য্য ঢাকা পড়িয়া গেল, চারিদিক অন্ধকার হইল, পাখীরা বাসায় যাইবার আয়োজন করিতে লাগিল, সন্ধ্যার সময়ে যেমন তেঁতুল, লজ্জাবতী প্রভৃতি গাছের পাতা বুঁজিয়া আসে, সেই রকম গাছের পাতা বুঁজিতে লাগিল। জ্যোতির্ব্বিৎ পণ্ডিতগণ এই রকমে দুপরে সন্ধ্যা দেখিবার জন্যই কি এত খরচপত্র করিয়া দূরদেশে আসেন? কিন্তু তাহা নয়।

 আগেই তোমাদের বলিয়াছি, সূর্য্যের উপরে তিনটা বাষ্পমণ্ডল পর-পর সাজানো আছে। প্রথমটাকে অর্থাৎ যেটা সূর্য্যের গায়ে লাগিয়া আছে, তাহাকে আমরা আলোক-মণ্ডল নাম দিয়াছি। ইহার উপরে যে দুটা বাষ্প-আবরণ আছে, আমরা তাহার বর্ণমণ্ডল ও ছটামণ্ডল নাম দিলাম। আলোকমণ্ডলকে খালি চোখে বা দূরবীণ দিয়া বেশ দেখা যার; কিন্তু বর্ণমণ্ডল ও ছটামণ্ডলকে দুরবীণ দিয়াও দেখা মুষ্কিল। সূর্য্যের আলোক-মণ্ডলের আলো সূর্য্যকে সর্ব্বদাই এমনি উজ্জ্বল করিয়া রাখে যে, কোন্‌টা আলোকমণ্ডল, কোন্‌টা বর্ণমণ্ডল এবং কোন্‌টাই বা ছটামণ্ডল, তাহা একেবারেই বুঝা যায় না। তবে এগুলিকে পৃথক্ করিয়া দেখিবার উপায় কি? এই উপায়টা জ্যোতিষীরা সূর্য্যের পূর্ণ গ্রহণের সময়েই কেবল দুই চারি মিনিটের জন্য পাইয়া থাকেন। গ্রহণের সময়ে সূর্য্যকে ও তাহার গায়ের আলোকমণ্ডলকে চাঁদ ঢাকিয়া ফেলে, কাজেই বাহিরে দেখিতে পাওয়া যায় কেবল উহার বর্ণমণ্ডল ও ছটামণ্ডল। এই দুইটি দেখিয়া তাহাদের বিষয় ভাল করিয়া জানিবার জন্যই এত কষ্ট করিয়া জ্যোতিষীরা সূর্য্য-গ্রহণ দেখিবার জন্য বাহির হন।