গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/সূর্য্যের বর্ণমণ্ডল
সূর্য্যের বর্ণমণ্ডল
পূর্ণগ্রহণের সময়ে চাঁদ সূর্য্যকে একেবারে ঢাকিয়া ফেলিলে, সূর্য্যের আকাশের দ্বিতীয় আবরণটিকে কি-রকম দেখায়, পূর্ণগ্রহণের ছবিতে তাহা দেখিতে পাইবে। দেখ, কালো চাঁদটিকে ঘেরিয়া লাল বর্ণমণ্ডল কেমন সুন্দর দেখাইতেছে! সূর্য্যের এই আবরণটা রঙিন্ বলিয়াই জ্যোতিষীরা ইহাকে বর্ণমণ্ডল অর্থাৎ Chromosphere নাম দিয়াছেন।
কিন্তু তাই বলিয়া ভাবিও না, লাল ফুলঝুরি বা দেশলাই জ্বালাইলে যে লাল আগুন হয়, ইহা তাই। আমাদের পৃথিবীর আকাশে কেবল একটা আবরণ অর্থাৎ বায়ুমণ্ডল আছে; ইহা পৃথিবী হইতে প্রায় পঁচিশ ক্রোশ উপরপর্য্যন্ত জুড়িয়া রহিয়াছে; সূর্য্যের দ্বিতীয় আবরণের গভীরতা কত জান?—প্রায় তিন হাজার মাইল; কোনো কোনো স্থানে দশ হাজার মাইল। এখন ভাবিয়া দেখ, এত বড় সূর্য্যটাকে ঘিরিয়া দশ হাজার মাইল গভীর যে বাষ্প দিবারাত্রি জ্বলিতেছে তাহা কি ভয়ানক! কেবল ইহাই নয়, পূর্ণ সূর্য্য-গ্রহণের সময়ে জ্যোতিষীরা দেখিয়াছেন, বর্ণমণ্ডল হইতে এক-একটা শিখা এমন উঁচু হইয়া বাহির হয় যে, তাহার বিষয় শুনিলে অবাক্ হইয়া যাইতে হয়। এখানে দুইটি শিখার ছবি দিলাম। ইহাদের মধ্যে কোনোটাই পঞ্চাশ হাজার মাইলের কম উঁচু নয়। ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে যে একটা সূর্য্য-গ্রহণ হইয়াছিল, সে সময়ে জ্যোতিষীরা একটা শিখাকে প্রায় আড়াই লক্ষ মাইল উঁচু হইতে দেখিয়াছিলেন। সূর্য্যে যে অগ্নিকাণ্ড হইতেছে এবংসেই আগুন ঝড়ের মত উপর নীচে ছুটাছুটি করিয়া সূর্য্যকে কি ভয়ানক করিয়া রাখিয়াছে, ইহা হইতে তোমরা বুঝিতে পারিবে।
ছবিতে যে মটরের মত সাদা বিন্দুটা রহিয়াছে, তাহা আমাদের পৃথিবী। বর্ণ-মণ্ডলের এক একটা শিখা পৃথিবীর তুলনায় কত বড় তাহা ভাবিয়া দেখ! যেন মহাপ্রলয়ের আগুন ঐ সকল শিখায় রহিয়াছে!
বৈজ্ঞানিকদের ক্ষমতা অদ্ভুত! খুব দূরের নক্ষত্র হইতে যে একটু আলো আমাদের চোখে আসিয়া পড়ে, তাহা কোন্ কোন্ বাষ্প জ্বলিয়া জন্মিতেছে, এই ছোট পৃথিবীতে বসিয়া একটা খুব ছোট যন্ত্র দিয়া তাঁহারা স্থির করিতে পারেন। ইহা বড় কম ক্ষমতা নয়। মনে কর, তুমি খুব উঁচু এক পাহাড়ে চড়িয়া কতকগুলি বাষ্প মিশাইয়া আগুন করিতে লাগিলে, দশ মাইল বা বিশ মাইল দূরে বৈজ্ঞানিক-মহাশয় তাঁহার ঘরের বারান্দায় বসিয়া সেই আলো দেখিতে লাগিলেন। এখন তিনি যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে তাঁহার সেই যন্ত্র দিয়া বলিয়া দিতে পারেন, তুমি কোন্ কোন্ বাষ্প জ্বালিয়া আগুন করিয়াছ। দশ মাইল বিশ মাইল ত অতি সামান্য কথা, কোটি কোটি মাইল দূরে নক্ষত্রদের উপরকার আলো কি কি পুড়িয়া জন্মিতেছে, তাহাও ঐ-রকমে তাঁহারা বলিয়া দিতেছেন এবং সূর্য্যের আলোক-মণ্ডলে ও বর্ণমণ্ডলে কি কি জিনিস জ্বলিতেছে, তাহাও স্থির করিতেছেন। এই-রকমে সূর্য্যে আমাদের জানা-শুনা প্রায় কুড়িটি জিনিস আছে বুঝা গিয়াছে এবং তাহার সবগুলিই জ্বলিতেছে বলিয়া ঠিক হইয়া গিয়াছে। লোহা, সীসা, টিন আছেই এবং রৌপ্যও সম্ভবত আছে, কিন্তু ইহাদের সকলই বাষ্প হইয়া জ্বলিতেছে।
সূর্য্যের বর্ণ-মণ্ডল হইতে যে সকল ভয়ানক লাল শিখা বাহির হয়, জ্যোতিষীরা পূর্ণ সূর্য্যগ্রহণের সময়ে তাহা যন্ত্র দিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন। ইহাতে জানা গিয়াছে, সেগুলি হাইড্রোজেন্ গ্যাস্ জ্বলিয়াই জন্মে। তা’ছাড়া ক্যাল্সিয়ম ও হেলিয়ম্ নামে আমাদের জানা-শুনা দুইটা জিনিসও হাইড্রোজেনের সহিত মিশিয়া জ্বলে। কেবল জ্বলা নয়, জ্বলিতে জ্বলিতে হাজার হাজার ক্রোশ উপরে উঠে এবং একটু ঠাণ্ডা হইলে নীচে নামে, আবার গরম হইলে ঝড়ের বেগে উপরে উঠে। সেখানে কি ভয়ানক কাণ্ড হয়, একবার ভাবিয়া দেখ!