গ্রাম্য উপাখ্যান/নরনারায়ণ ঘোষ

নরনারায়ণ ঘোষ।

 নরনারায়ণ ঘোষের পিতা ঢাকার দেওয়ান ছিলেন। তাহার পর তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শিবনারায়ণ ঘোষ দেওয়ান হয়েন। হাইদ্রাবাদের প্রধান মন্ত্রীর পদ যেমন বংশ– পরম্পরায় চলিয়া আসিতেছে তেমনি বঙ্গদেশের উক্ত ক্ষুদ্র দেওয়ানি পদও বংশপরম্পরায় চলিয়া আসিত। এই প্রথার জের এমন কি অপেক্ষাকৃত আধুনিক কাল পর্য্যন্ত টানিয়াছিল। অনেকে অবগত আছেন বাবু রামকমল সেনের মৃত্যুর পর ক্রমান্বয়ে তাঁহার তিন পুত্র হরিবাবু প্যারীবাবু ও বংশী বাবু টেঁকশালের দেওয়ান হইয়া ছিলেন। বংশী বাবুর পর হরি বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র যদু বাবু দেওয়ান হন। যদু বাবু জয়পুরে যাত্রা করিলে পরিশেষে বিখ্যাত কেশব বাবু পর্য্যন্ত কিছুদিন উক্ত দেওয়ানি কর্ম্ম করেন। শিবনারায়ণ ঘোষের সতের বৎসর বয়সে তাঁহার পিতার মৃত্যু হয়। তিনি সেই বয়সে হাতের বালা ও কাণের মাকড়ি খুলিয়া দেওয়ানী করিতে যান। ঢাকা নগরে তাহার বাসাবাটিতে তিনি একটী অতি বৃহৎ ঘণ্টা ঝুলাইয়া দিয়াছিলেন। প্রতিদিন আহারের সময় সেই ঘণ্টার বিশাল রব শুনিয়া ঢাকার বাসাড়ে ভদ্রলোক তাঁহার বাটী আসিয়া আহার করিত। প্রতিদিন প্রায় তিন চারি শত পাত পড়িত। নরনারায়ণ ঘোষ নিজে দেওয়ানি করেন নাই। তিনি বাদল গ্রামে থাকিয়া বাটীর কাজ দেখিতেন। সেকালে বড় ভাই কাজ কর্ম্ম করিতেন, ও ছোট ভাই বাটীতে থাকিয়া বাটীর তত্ত্বাবধান করিতেন, এইরূপ প্রথা ছিল। এখনও পল্লীগ্রামের অনেক স্থানে এইরূপ প্রথা আছে। সেকালে কলিকাতায় মিউনিসিপাল সুরতি (Municipal Lottery) হইত। এখন যেমন মিউনিসিপাল কর বসাইয়া নগরের শোভাবর্দ্ধন করা হয় তখন ঐ কার্য্য ঐ সুরতির টাকা দ্বারা সম্পাদিত হইত। নরনারায়ণ ঘোষের নামে এইরূপ সুরতিতে একবার লক্ষ টাকার প্রাইজ উঠে। আমরা শুনিয়াছি কেহ এইরূপ লক্ষ টাকা প্রাইজ পাইবার সংবাদ পাইয়া আহ্লাদে মরিয়া গিয়াছে। কিন্তু নরনারায়ণ ঘোষ মরেন নাই, কারণ তিনি সম্পদে অভ্যস্ত ছিলেন। নরনারায়ণ বড় বাবু ছিলেন। তিনি একবার বাদলগ্রামে আপনার বাটিতে মজলিস্ করিয়া তাহাতে কলিকাতার বড়মানুষদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। এই মজলিস্ উপলক্ষে নরনারায়ণ স্বীয় বাটীর সিঁড়ির ধাপগুলি শাল দিয়া মুড়িয়া দিয়াছিলেন। আমরা বাল্যকালে নরনারায়ণ ঘোষকে দেখি নাই, তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাধানাথ ঘোষকে দেখিয়াছি। রাধানাথ ঘোষজা মহাশয় তাঁহার পিতার বিষয় অপরিমিত ব্যয় দ্বারা উড়াইয়া দিয়াছিলেন। ইনি আফিঙ সেবন করিতেন এবং উত্তম সেতার বাজাইতে পারিতেন। ইনি অতি অমায়িক লোক ছিলেন। তাঁহার এক রোগ ছিল। আহারের সময় তিনি ক্রমাগত ভাত বাছিতেন, তাঁহার এক বন্ধু তাঁহাকে বলিয়াছিলেন “আপনি ক্রমিকই বাছিবেন ত খাবেন কখন?” আমরা সেইরূপ এক্ষণকার সমালোচক মহাশয়দিগকে বলিতে পারি “আপনারা ক্রমিক বাছিবেন ত খাবেন কখন, কেবল যদি কবিতার দোষ গুণ বাছিবেন তবে কবিতা উপভোগ করিবেন কখন।” যেমন রামধনুর কেবল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব জানিতে চেষ্টা করিলে রামধনুর সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায় না, তেমনি বৈজ্ঞানিক প্রণালী অনুসারে কবিতার কেবল দোষগুণ বিচার করিলে কবিতা উপভোগ করা যায় না। রাধানাথ বাবু অহিফেন সেবন নিবন্ধন অতি দীর্ঘসূত্রী হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি কলিকাতায় আসিবার মানসে বাটী হইতে বাহির হইতেন, বাহির হইয়া পাড়ার হরিহর বসুর বাটী আসিয়া যেরূপ গল্প আরম্ভ করিতেন তাহাতে কলিকাতায় আর যাওয়া হইত না। এইরূপ ক্রমাগত প্রত্যহ কিছু দিন করিয়া পরিশেষে কলিকাতা যাওয়ার ইচ্ছা ছাড়িয়া দিতেন। আমরা গরীব রাধানাথ বাবুর দোষ দি কেন, অনেকেই সেক্সপিয়ারের হেম্‌লেটের ন্যায় সংকল্প সাধন করেন, করেন কিন্তু হইয়া উঠে না। তাঁহাদিগের আর কলিকাতায় কখন যাওয়া হয় না। রাধানাথ বাবুর বাটী “বাবুর বাটী” বলিয়া গ্রামে প্রখ্যাত ছিল। পূজার সময় তাঁহার বাটীতে যখন প্রতিমা নির্ম্মাণ হইত তখন আমরা কি ঔৎসুক্যের সহিত সেই প্রতিমা নির্ম্মাণ দেখিতাম! দেবমূর্ত্তির মনোহর বিকাশক্রম দেখিতাম। কাটমা, একমেটে, দোমেটে, রং, পরিশেষে চালচিত্র। গ্রন্থ রচনাতেও এইরূপ কাটমা, একমেটে, দোমেটে, রং, ও তৎপরে চিত্র আছে। এই কয়েকটা ব্যাপারের মধ্যে যিনি একটী রহিত করেন তাঁহার গ্রন্থ ভাল হয়না। গোষ্ঠবিহারের দিন গ্রামে জমাদারদিগের বাটীতে যাঁহারা সং সাজিতেন তাহারা সং সাজিয়া বাবুদের বাটীর সম্মুখের মাঠে উপস্থিত হইতেন। এই উপলক্ষে বিশেষ জনতা হইত। একবার ৭০ বৎসরের বৃদ্ধ রামধন বৈদিক মহাশয় যিনি গড়াই গ্রামে কালীবাটী স্থাপন করিয়া উপজীবিকা নির্ব্বাহ করিতেন তিনি গোষ্ঠবিহারে তিন চারি বৎসরের শিশুর মত কোমর পাটা কোমরে পরিধান করিয়া সন্দেস খাইতেছেন এইরূপ সাজিয়াছিলেন। কালীপদ দে নামক এক অতি সুন্দর বালক এমনি সখী সাজিয়া ছিল যে লোকে আশ্চর্য্য ও মোহিত হইয়াছিল। যখন তাহার বিষয় জল্পনা হইতেছিল তখন আমরা আমাদিগের কালেজী বিদ্যা ফলাইলাম। আমরা বলিলাম যে তাহার “কালী” নাম সংস্কৃত ভাষা হইতে উৎপন্ন নহে; গ্রীক ভাষার ক্যালন (Kalon) শব্দ হইতে উৎপন্ন। গ্রীক ভাষায় ক্যালন শব্দে সুন্দর বুঝায়। সেই বাবুদের বাটী এক্ষণে পতিতাবস্থায়। যেখানে এরূপ আনন্দ উৎসব হইত সেই স্থান এক্ষণে নির্জ্জন, নিরানন্দ ও নিরুৎসব। পৃথিবীর সকলই অস্থায়ী!