গ্রাম্য উপাখ্যান
গ্রাম্য উপাখ্যান
৺রাজনারায়ণ বসু প্রণীত।
Sweet....! loveliest village of the plain,
Where health and plenty cheered the labouring swain;
Where smiling spring its earliest visit paid,
And parting Summer's lingering blooms delayed;
Dear lovely bowers of innocence and ease,
Seats of my youth, when every sport could please,
How often have I loitered o’er thy green,
Where humble happiness endeared each scene;
How often have paused on every charm
The sheltered cot, the cultivated farm,
Sweet smiling village! loveliest of the lawn,
Thy sports are fled, and all thy charms withdrawn
A time there was, ................
When every rood of ground maintained its man;
For him light labour spread her wholesome store
Just gave what life required, but gave no more;
His best companions, innocence and health;
And his best riches, ignorance of wealth.
১৯১৪ সাল।
কুন্তলীন প্রেস,
৬১নং বৌবাজার ষ্ট্রীট, কলিকাতা ;
শ্রীপূর্ণচন্দ্র দাস কর্তৃক মুদ্রিত ও
রায় এম্, সি, সরকার বাহাদুর এণ্ড সন্স
৭৫।১।১নং হ্যারিসন রোড হইতে
শ্রী প্রবোধচন্দ্র সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ।
১২৯০ সালে “সুরভী” নামীর পত্রিকায় প্রকাশিত শ্রীযুক্ত বাবু রাজনারায়ণ বসু লিখিত “গ্রাম্য উপাখ্যান” ও “চল্লিশ বৎসর পূর্ব্বে বঙ্গদেশ ভ্রমণ” এই প্রবন্ধদ্বয় এক্ষণে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইল।
স্বর্গীয় রাজনারায়ণ বসু।
RAJ NARAIN BOSE. (1896.)
Of his many portraits given in this volume, the one facing p. 64 probably taken in 1889) is the most expressive. The deep pensive eyebrows and steady gaze are no doubt brooding over man's infirmities, looking straight into the hearts of things, and tearing off the masks of hypocrites. But there are just a twinkle lurking in the eye, a curve in the majestic sweep of the nose, an elevation of the nostrils, which indicate that the judge has infinite humour and will not be hard upon us, for he knows all and has pity for all. The broad massive forehead marks out the stern champion of truth and opponent of sham; but the waving hair and wealth of beard and moustache framing the face betoken the patriarch standing on an ethereal height whence he is looking graciously down on frail men engaged in Such was Raj their puppet-show of life. Narain Bose, the Grand Old man of Baidyanath, with the record of a well-spent life behind him and serenely facing the prospect of eternity.
রাজনারায়ণ বসু।
“ছেলেবেলায় রাজনারায়ণ বাবুর সঙ্গে যখন আমাদের পরিচয় ছিল তখন সকল দিক হইতে তাঁহাকে বুঝিবার শক্তি আমাদের ছিল না। তাঁহার মধ্যে নানা বৈচিত্র্যের সমাবেশ ঘটিয়াছিল। তখনই তাঁহার চুল দাড়ি প্রায় সম্পূর্ণ পাকিয়াছে, কিন্তু আমাদের দলের মধ্যে বয়সে সকলের চেয়ে যে ব্যক্তি ছোট তাহার সঙ্গেও তাঁহার বয়সের কোনো অনৈক্য ছিল না। তাঁহার বাহিরের প্রবীণতা শুভ্র মোড়কটির মত হইয়া তাঁহার অন্তরের নবীনতাকে চিরদিন তাজা করিয়া রাখিয়া দিয়াছিল। এমন কি, প্রচুর পাণ্ডিত্যেও তাঁহার কোনো ক্ষতি করিতে পারে নাই। তিনি একেবারেই সহজ মানুষটির মতই ছিলেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাস কোনো বাধাই মানিল না। —না বয়সের গাম্ভীর্য্য, না অস্বাস্থ্য, না সংসারের দুঃখ কষ্ট, ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন, কিছুতেই তাঁহার হাসির বেগকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারে নাই। একদিকে তিনি আপনার জীবন এবং সংসারটিকে ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া দিয়াছিলেন, আর একদিকে দেশের উন্নতি সাধন করিবার জন্য তিনি সর্ব্বদাই কত রকম সাধ্য ও অসাধ্য প্ল্যান্ করিতেন তাহার আর অন্ত নাই। রিচার্ডসনের তিনি প্রিয় ছাত্র, ইংরাজি বিদ্যাতেই বাল্যকাল হইতে তিনি মানুষ কিন্তু তবু অনভ্যাসের সমস্ত বাধা ঠেলিয়া ফেলিয়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে পূর্ণ উৎসাহ ও শ্রদ্ধার বেগে তিনি প্রবেশ করিয়াছিলেন। এদিকে তিনি মাটিরমানুষ, কিন্তু তেজে একেবারে পরিপূর্ণ ছিলেন। দেশের প্রতি তাঁহার যে প্রবল অনুরাগ, সে তাঁহার সেই তেজের জিনিষ। দেশের সমস্ত খর্ব্বতা দীনতা অপমানকে তিনি দগ্ধ করিয়া ফেলিতে চাহিতেন। তাঁহার দুই চক্ষু জ্বলিতে থাকিত, তাঁহার হৃদয় দীপ্ত হইয়া উঠিত, উৎসাহের সঙ্গে হাত নাড়িয়া আমাদের সঙ্গে মিলিয়া তিনি গান ধরিতেন—গলায় সুর লাগুক আর না লাগুক তিনি খেয়ালই করিতেন না,—
এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন,
এক কার্য্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন।
এই ভগবদ্ভক্ত চিরবালকটির তেজঃপ্রদীপ্ত হাস্য-মধুর জীবন, রোগে শোকে অপরিম্লান তাঁহার পবিত্র নবীনতা আমাদের দেশের স্মৃতিভাণ্ডারে সমাদরের সহিত রক্ষা করিবার সামগ্রী তাহাতে সন্দেহ নাই।”
“জীবন-স্মৃতি”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রাজনারায়ণ বসু।
প্রাচীন-নবীন যুগ সঙ্গমের জলে
স্নান করি’ উঠি মুক্ত সৈকত শেখরে,
যে বিপ্লব দেখেছিলে সমাজের স্তরে,
সাহিত্যে, শিক্ষায়, ধর্ম্মে, সূক্ষ্ম দৃষ্টিবলে,
আঁকিয়া সে স্মৃতি-চিত্র যতনে বিরলে,
বিমল রহস্য-রাগে সুরঞ্জিত করে’,
উদার অন্তরে, ভক্তি অনুরাগ ভরে,
অর্পিয়াছ মাতৃভাষা চরণ-কমলে।
আলোক-আলেখ্য তব আত্ম-বিবরণ,
একাল ও সেকালের দর্পণ উজ্জ্বল,
ইতিহ অভাব বঙ্গে করিয়া পূরণ,—
হে মনস্বী, কর্ম্মবীর, ধর্ম্মাত্মা, সরল,—
তোমার জীবন-কথা রাখিবে স্মরণ,
স্বদেশ-প্রেমিক তুমি সুহৃদ-বৎসল!
দর্শক পত্রিকা, ৪ঠা ভাদ্র, ১৩২১। |
|
শ্রীনবকৃষ্ট ঘোষ, বি-এ
|
ভূমিকা।
“A great man is the product of a great age.”
“A great man is not born without a great mission.”
১২৮৮ সালে সুপ্রসিদ্ধ শ্রদ্ধাস্পদ ৺রাজনারায়ণ বসু মহাশয় স্বাস্থ্যলাভার্থ কলিকাতা পরিত্যাগ পূর্ব্বক সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত বৈদ্যনাথ দেওঘর নামক স্থানে বাস করিতে আরম্ভ করেন। এই স্থানে বাসকালে তিনি তাঁহার শেষ জীবনে রচিত ‘সারধর্ম্ম’, ‘বৃদ্ধ হিন্দুর আশা’ ‘তাম্বুলোপহার’ ইত্যাদি সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ সকল রচনা করেন।
১২৯০ সালে তাঁহার সুযোগ্য ও সর্ব্বগুনান্বিত জ্যেষ্ঠ পুত্ত্র ৺যোগীন্দ্রনাথ বসু, সুরভী নামক সাপ্তাহিক সংবাদ পত্র প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন। উত্তর কালে যোগীন্দ্রনাথ বসু ইংলণ্ডে ও এমেরিকায় ইংরাজি ভাষায় প্রতিভাশালী লেখক বলিয়া সংবাদ পত্র ও মাসিক পত্রের ইংরাজ ও এমেরিকান সম্পাদকগণের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছিলেন। তাঁহার কিশোর জীবনকালে, বাঙ্গালা ভাষায় সম্পাদিত এই সাপ্তাহিক সুরভী পত্রিকাও বিবিধ সারগর্ভ ও শিক্ষাপ্রদ বিষয় প্রকাশিনী পত্রিকা স্বরূপে তৎকালে বঙ্গদেশে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিল। রাজনারায়ণ বসু মহাশয় তাঁহার তৎকালীন নানা বিষয়ক কার্য্যে ব্যস্ত জীবনের অবসরকালে বিবিধ সারবান রচনা প্রকাশ পূর্ব্বক এই সুরভী পত্রিকার পরিপুষ্টি সম্পাদনে সহায়তা করিতেন। সুরভী পত্রিকায় বহুবিধ রচনা প্রকাশের সহিত, তিনি তাঁহার নিজ জন্মভূমি বোড়াল গ্রামের তাঁহার সময়ের ঊর্দ্ধতন দেড় শত বৎসরের পূর্ব্বেকার হইতে তাঁহার নিজ বাল্য জীবনের সমকালীন অধিবাসিবর্গের সামাজিক, নৈতিক ও আর্থিক এবং সাধারণ জীবন যাপন সম্বন্ধে “গ্রাম্য উপাখ্যান” শিরস্ক রচনাবলী ওজস্বী ও মধুর ভাষায় ধারাবাহিকরূপে প্রকাশ করেন। তাঁহার এই “গ্রাম্য উপাখ্যান” শিরস্ক রচনাবলী সমূহে একদিকে যেরূপ তাঁহার নানা বিষয়িণী বিপুল পাণ্ডিত্যের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় সেইরূপ অন্যদিকে তাঁহার সময়ের দেড় শত বৎসরের পূর্ব্বেকার হইতে তাঁহার বাল্য জীবনের সমকালীন সাধারণ বাঙ্গালী সমাজের সামাজিক, নৈতিক ও আর্থিক এবং সাধারণ জীবন যাপন প্রথা সম্বন্ধীয় সুচিত্রিত জীবন্ত আলেখ্য আমাদের নিকট উদ্ঘাটিত করিয়া দেয়। গ্রাম্য জীবন যাপন প্রথাই তৎকালীন বাঙ্গালী জাতির প্রাণ স্বরূপ ছিল। বর্ত্তমান কালিন ইউরোপীয় সভ্যতার প্রথম নিদর্শন নাগরিক জীবন যাপন প্রথা সে কালে একান্ত ধারণার অতীত ছিল। তৎকালের বাঙ্গালী জাতির জাতীয় জীবনের ইতিহাস অন্বেষণ করিতে হইলে, তাঁহাদের তৎকালীন গ্রাম্য জীবনের প্রতিই দৃষ্টি নিবদ্ধ করা সঙ্গত। বসু মহাশয় লিখিত তাঁহার স্বগ্রামের গ্রাম্য উপাখ্যানে তৎকালীন সমগ্র সাধারণ বাঙ্গালী জাতির জাতীয় জীবন চিত্রেরই সঠিক উজ্জ্বল আভাষ প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাঁহার গ্রাম্য উপাখ্যানে চিত্রিত তৎকালীন সাধারণ বাঙ্গালী জাতির জাতীয় চরিত্র চিত্র বর্ত্তমান সময়ে কল্পনা স্থানীয় হইয়া উঠিয়াছে। বসু মহাশয় বর্ণিত তৎকালীন বাঙ্গালী জাতির জাতীয় চরিত্র চিত্র অনেকাংশে পুরাকালীন ভারতবর্ষীয় জাতীয় জীবনের আভাষে ওতপ্রোত ও তেমনি দয়া, দাক্ষিণ্য, আতিথেয়তা ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের পুত হোম ধুম স্নাত। অশোক ও চন্দ্রগুপ্তের রাজত্ব কালে, তাঁহাদের রাজ সভায় অবস্থিত গ্রীক রাজদূতগণের লিখিত ভারতবর্ষের বিবরণী গ্রন্থে তৎকালিন হিন্দু জাতির জাতীয় চরিত্রের দয়া, দাক্ষিণ্য, আতিথেয়তা, ও নৈতিক চরিত্রের সম্বন্ধে পরিশুদ্ধ নিঁখুত বিবরণ দৃষ্ট হয়। বসু মহাশয় চিত্রিত গ্রাম্য উপাখ্যানে তৎকালীন সাধারণ বাঙ্গালী জাতির জাতীয় চরিত্র চিত্র অনেকাংশে গ্রীক রাজদূতগণ বর্ণিত তাঁহাদের হিন্দু পূর্ব্ব পুরুষগণের যে অবিকল সঠিক আদর্শ মাত্র তাহাতে সন্দেহ নাই।
এক্ষণে এই প্রশ্ন হইতে পারে যে একটি সামান্য গণ্ডগ্রামের অধিবাসিবর্গের সামাজিক নৈতিক ও আর্থিক অবস্থা এবং চরিত্র চিত্র কিরূপে তৎকালীন সমগ্র বাঙ্গালী জাতির জাতীয় চরিত্র স্বরূপে পরিগণিত হইতে পারে। কিন্তু ইংরাজিতে একটি কথা আছে যে কোন একটি সমগ্র জাতির জাতীয় চরিত্র অধ্যয়ন করিতে যদি কেহ অগ্রসর হন, তাহা হইলে সেই জাতির কোন একটি নগর কিম্বা ক্ষুদ্র পল্লীর অধিবাসিবর্গের সামাজিক ও নৈতিক চরিত্রের সহিত পরিচিত হইলে তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট হইবে। কেন না একটি মাত্র নগর কিম্বা পল্লিবাসির জীবন চিত্রই কোন একটি সমগ্র জাতি সমষ্টির সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারবান ইতিহাস মাত্র।
এক্ষণে এস্থলে আমরা বসু মহাশয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রদান পূর্ব্বক এই ভূমিকা সমাপ্ত করিব। কিন্তু বসু মহাশয়ের সংক্ষিপ্ত জীবন চিত্র প্রদান করিবার পূর্ব্বে বাবু রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ১৯০৯ সালের এপ্রিল মাসের Modern Review পত্রিকায় বাবু যদুনাথ সরকার লিখিত Rajnarain Bose শিরস্ক ইংরাজি প্রবন্ধ হইতে কয়েকটি প্যারাগ্রাফ এস্থলে উদ্ধৃত করিতেছি। তিনি কি প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন তাঁহার জীবনী সম্বন্ধে এই স্থলে Modern Review হইতে উদ্ধৃত কয়েকটী মাত্র প্যারা হইতে তাহার স্পষ্ট আভাষ প্রাপ্ত হওয়া যায়।His Life.
Raj Narain Bose was born in September, 1826, at a village 12 miles from Calcutta. He entered David Hare’s School at the blissful dawn of English education in Bengal, and thence in 1840 went up to the old Hindu College, where he soon distin– guished himself by his knowledge of English and fondness for literature, and carried off many prizes and scholarships. Perhaps, there never was a College which contained at the same time so many brilliant youths all destined to attain to the highest eminence in the various spheres of life, as the Hindu College of that year. Among Raj Narain’s fellow-students were Michel Madhusudan Dutt, the poet, Peary Churn Sircar, the educationist and temperance organiser, Jnanendra Mohan Tagore, the first Indian barrister, Bhudev Mukherji, sometime acting Director of Public Instruction, Bengal, Nil Madhav Mukherji, the Doctor, Jagadish Nath Roy, the first Indian District Superintendent of Police, Gobinda Chandra Dutt, the poetic father of Miss Toru Dutt, and many more. And we can imagine no better proof of Raj Naraian’s intellectual powers than this that in that troop of giants he was not the least eminent. Leaving College in 1844 he embraced Brahmoism and two years afterwards entered the service of the Adi Brahmo Samaj, at first as English translator of the Upanishads. In May 1849, he became Second English Teacher at the Sanskrit College, Calcutta, and thence in February 1851, he joined Midnapur School as Headmaster. This post he retained till March 1866, when he was invalided, and these 16 years were the crowning period of his active life. Thereafter he travelled up country in quest of health and at last settled at Baidyanath, where his house became the Mecca of Bengali reformers and lovers of literature, attracted thither by the fame of his wonderful humour and fond of anecdotes.
উদ্ধৃত প্যারা হইতে দৃষ্ট হইতেছে যে তিনি ২৪ পরগণার অন্তৰ্গত বোড়াল নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি স্বগ্রামের পাঠশালায় পাঠ সমাপন পূর্ব্বক কলিকাতাতে তৎকাল প্রসিদ্ধ হেয়ার স্কুলে প্রথমে ভর্ত্তি হয়েন। কিছুকাল হেয়ার স্কুলে অধ্যয়নের পর, তদানীন্তন নবপ্রতিষ্ঠিত হিন্দুকলেজে প্রবেশ করেন। হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্রস্বরূপে পরিগণিত হইয়াছিলেন। কবিবর মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁহার সহাধ্যায়ী ছিলেন। সপ্তদশ বৎসর বয়ক্রমকালে তিনি হিন্দুকলেজের সর্ব্বশেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েন। কলেজে অধ্যয়নকালে, তাঁহার সেই কৈশোর কালের জীবনেই তাঁহার হৃদয় স্বদেশ প্রেমে মন্ত্রসিদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। রাজা রামমোহন রায়ের তিরোধানের পর, তাঁহার কলেজে অধ্যয়ন জীবনকালে বঙ্গদেশে সর্ব্ববিষয়িণী সংস্কারের বিপুল বিপ্লব মন্ত্র ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছিল। দুর্যোগগ্রস্ত নিশীথ অন্ধকারের মধ্যে, প্রভাতের প্রথম আশাজ্বল কিরণরেখা পতিত হইলে, সেই বিভীষিকাময়ী নিশীথের অন্ধকার মধ্যে যেরূপ একটা বিপুল বিপ্লবের আলোড়ন উপস্থিত হয়, সেইরূপ পাশ্চাত্য জ্ঞান ও সভ্যতার প্রথম রশ্মিপাতে, অজ্ঞানতাপূর্ণ বঙ্গদেশে তৎকালে একটা বিপুল বিপ্লবের তাণ্ডব সৃষ্টি করিয়া তুলিয়াছিল। চারিদিকে বিপ্লবের ঝটিকা রব উত্থিত হইয়াছিল। যাহা কিছু প্রাচ্য, তাহাই অসার ও কুসংস্কারপন্ন অসভ্য জাতির মস্তিষ্ক প্রসূত। প্রাচ্য হিন্দুজাতির সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম্ম ও সমাজনীতি সমস্তই চূর্ণ করিয়া ফেলিতে হইবে, পাশ্চাত্য সভ্যতার অননুমোদিত কুসংস্কার বিকৃত হিন্দু আচার প্রথা সমূলোৎপাটিত করিতে হইবে; অসার হিন্দুসাহিত্য, ধর্ম্ম ও দর্শনশাস্ত্র শিক্ষার পথ হইতে ফিরাইয়া দেশকে পরিশুদ্ধ ও উন্নত সভ্যতানুমোদিত পাশ্চাত্য সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রে কৃতবিদ্য করিয়া তুলিতে হইবে, সত্যপথভ্রষ্ট হিন্দুসমাজের বিষাক্ত বায়ু সেবনে হিন্দুজাতিকে নির্জীব করিবার পথে বিপুল প্রতিবন্ধক উত্থিত করিতে হইবে। তৎকালের হিন্দুকলেজের অধ্যায়ী ছাত্রবৃন্দের চিত্ত, হিন্দু সমাজের এইরূপ আমূল সংস্কার মন্ত্রে উদ্ভ্রান্ত হইয়া উঠিয়া ছিল। হিন্দুসমাজের জীর্ণ ভিত্তির উপর পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জ্ঞানের বিজয়পতাকা প্রোথিত করিবার মানসে বঙ্গদেশের তৎকালীন আশাস্থল হিন্দুকলেজের ছাত্রগণ ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। বিকৃতভাবাপন্ন প্রাচীন হিন্দুসাহিত্য, শিল্প ও সভ্যতার জীর্ণ ভিত্তিগাত্রে, কোন স্থানে যে উন্নত প্রণালীর Art এর সমাবেশ থাকিতে পারে, ইহা তাঁহাদের ধারণার অতীত ছিল। রাজনারায়ণ বসু মহাশয় লিখিত “সেকাল একাল” গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে যেদিন হিন্দুকলেজের ছাত্রগণ মুসলমানের দোকান হইতে প্রথম বিস্কুট ক্রয় করিয়া আহার করেন, সেদিন তাঁহারা রাজপথ কাঁপাইয়া হিপ্ হিপ্ হুররে ধ্বনি করিয়া উঠিয়াছিলেন। মুসলমান দোকানের বিস্কুট আহার করিয়া, হিন্দুসমাজের কুসংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত করিয়াছেন, তাঁহারা এই উল্লাসে রাজপথ কাঁপাইয়া বিজয়ধ্বনি করিয়া উঠিয়াছিলেন। সমাজবিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষিত এই যুবকবৃন্দের অগ্রণী হইয়াও, রাজনারায়ণ বসু মহাশয় কোন্ পথে চলিয়াছিলেন, তাহা আমরা Modern Reviewতে বাবু যদুনাথ সরকার লিখিত Raj Narain Bose শিরস্ক প্রবন্ধ হইতে এবং ১৯০৯ সালের নবেম্বর মাসে উক্ত পত্রিকায় বাবু জীতেন্দ্রলাল বন্দোপাধ্যায় লিখিত Study শিরস্ক প্রবন্ধ হইতে পুনরায় কয়েকটি প্যারাগ্রাফ উদ্ধৃত করিয়া দেখাইতেছি। উহা হইতে দৃষ্ট হইবে যে বিপ্লব ঝটিকার স্রোতে উদ্ভ্রান্ত চিত্তে ছুটিবার পরিবর্ত্তে, অনাময় অন্তঃকরণে কোন্ সত্য পন্থার তিনি অনুসরণ করিয়াছিলেন—
Preacher of Nationalism.
To the largest circle of men, in fact to all outside the Brahmo Samaj, Raj Narain Bose was best known as a staunch old Nationalist. The first fruits of English education in Bengal were a disgust with Indian dress, customs, religion, and even language, and a passion for everything English. Foremost among the Anglo-maniacs stood Madhusudan Dutta, who used to say, “I can speak in English, write in English, think in English, and shall be supremely happy when I can dream English! He abjured his native faith, dress, society and even name; but with what result? His only title to fame now is as a Bengali poet! Another was Jnanendra Mohan Tagore, who gave up his home and kindred and settled in England with the (courtesy) title of Prince Tagore, and whose vast ancestral estates are now being enjoyed by an English attorney’s son named Ramsden.
To Raj Narain Bose belongs the credit of heading the reaction against this spirit and preaching the gospel of nationalism to the educated public. A philanthropist to the core of his heart, he still held
He who loves his country most
Is the truest cosmopolite.
Mr. Townshend of the Spectator or Rudyard Kipling would probably paint the finger of scorn at his actions as another case of educated Indians ‘going fantee,’— as the negroes of West Africa do, when they suddenly discard civilised dress and ways and revert to their ancestral barbarism with unmixed glee. But in our eyes there is no nobler feature in the career of Raj Narain than his passionate lifelong endeavour to diffuse among his less fortunate brethren the new thoughts and new spirit which he had got from his English teachers,—to raise the entire Indian community to his own level, instead of abjuring their society and joining the “Ingo-Bangas” who tried to pass themselves off as Englishmen and succeeded only in being mistaken for thirdrate Eurasians. Raj Narain’s everpresent thought was ‘I am one of the people. How can I make them realise our national one— ness?’ For this as early as 1861 he proposed the formation of a “Society for the Promotion of National Feeling among the Educated Natives of Bengal” and a Hindu Mela or National Exhibiton, which were long afterwards realised by his friend Navagopal Mitra (pp. 83,11o, 2o8, and 215). For this he delivered his famous lecture on the Superiority of Hinduism, which galvanised the Indian society of the day and excited ludicrous consternation and anger in Lal Behari De and other dreamers of the vain dream of nirvana in complete Anglicisation. (Pp. 86-92). For this, Brahmo as he was, he advocated a Universal Hindu League, for uniting all parts of India on the platform common to all sects. (See his pamphlet Old Hindu’s Hope, 1889). For this he insisted on the use of pure Bengali, and by a fine of one pice for every English word used penalised that mixture of Bengali and English[১] in our familiar conversation of which Risley has recently made such fun in his People of India.
At his suggestion Jagadish Nath Roy organised in 1875, the first College Reunion or “Old Boys’ Day” of the Hindu College (p. 205). How far Raj Narain was in advance of his time will be shown by the fact that the Presidency College formed its Old Boys’ Association only in February 1909!
Before Swadeshi.
“Babu Raj Narayan Bose, a man of the most striking and remarkable personality, and one who realised in his life the nationalistic aspirations of our country long before they found any definite or articulate expression among any considerable body of men. He was called in his time ‘the grandfather of Indian Nationalism,’ and right well did he deserve that name.
He lived at a time when Western influences and Western culture were first making head-way in the country, when their glamour and fascination had laid under its spell all young, ardent, and generous minds, and when the best spirits of the land were eager to mould their national life after the models of the West. But Raj Narayan Bose, though he was himself steeped in the culture and education of Europe, though his soul burned with a generous enthusiasm to reform the social abuses of his country, yet never lost the balance and sanity of his mind nor shut his eyes to the superior spirituality of Hindu civilization. He wrote and spoke most forcibly on ‘The Superiority of Hinduism’ and on the sad contrast between the ‘Past and Present’, established societies for the conservation of the national principle, and instituted measures for improving the physique of the Bengalis. In all he said and did, there was that passionate attachment to his country and his race, that strong resentment of the spurious affectation of superiority on the part of an alien people, which form a portion of that rich heritage of intellectual capacity, moral integrity, and spiritual fervour which...... that most remarkable and original old man........
But Raj Narayan Bose was something more than the passionate and impulsive lover of his country; and certainly he was no man to cling blindly to the old, wornout rags of the past. His was a most complex and composite personality; and together with his intense love for India and things Indian, there was in his character a hatred of all sham and untruth, of whatever might hinder the free development of a virile manhood in the country. Thus there was realized in his character that rare and curious combination-the ardent, almost militant defender of his country and the institutions thereof dwelling side by side with the aggressive social reformer who shocked the effete orthodoxy of his time by the plainness of his speech and the directness of his action.”
উপরে উদ্ধত প্যারাগ্রাফ সমূহ হইতে দৃষ্ট হইতেছে যে তাঁহার সহপাঠি যুবকবৃন্দের ন্যায়, একেবারে ধ্বংশ নীতির দণ্ডাঘাতে সমাজ ভিত্তী গাঁথুনী চূর্ণ করিবার পন্থায় তিনি ভ্রমেও পদার্পণ করেন নাই। যাহা কিছু সত্য ও সুন্দর, তাহাই রক্ষা করিয়া এবং যাহা কিছু অসার ও জীর্ণ তাহা পরিহার পূর্ব্বক, ভারতীয় সমাজ বনিয়াদ সুদৃঢ় ও মজবুত করিয়া গঠন করনার্থ, তিনি বাহির হইতে তদুপযোগী মাল মসলা সংগ্রহ করিবার পন্থারই অনুসরণ করিয়াছিলেন।
এক্ষণে আমরা বসু মহাশয়ের ব্যক্তিগত জীবনের সম্বন্ধে আরো কয়েকটি প্রসঙ্গ উত্থাপন পূর্ব্বক, এই ভূমিকা শেষ করিব। তাঁহার কলেজ পরিত্যাগের এক বৎসর পর অষ্টাদশ বৎসর বয়ক্রম কালে, তাঁহার পিতৃবিয়োগ হয়। মৃত্যুকালে তাঁহার পিতার বয়ক্রম তেতাল্লিশ বৎসর মাত্র হইয়াছিল। তাঁহার পিতা নন্দকিশোর বসু, রাজা রামমোহন রায়ের শিষ্য, ও তাঁহার প্রবর্ত্তিত ব্রাহ্মধর্ম্ম মতাবলম্বি ছিলেন। পাশ্চাত্য জ্ঞানে কৃতবিদ্য করিবার পর, ভারতবর্ষের তৎকালিন অক্সফোর্ড কাশিতে সংস্কৃত ও পাটনা নগরে আরবী ও পারসী ভাষায় বুৎপন্ন করিবার জন্য পুত্রকে প্রেরণ করিতে, তাঁহার পিতার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল। অকালে কালগ্রাসে পতিত না হইলে, তিনি তাঁহার এই ইচ্ছা জীবনে সাধন করিয়া যাইতে পারিতেন। পিতার মৃত্যুর পর, সেই অল্প বয়সে তিনটি শিশু ভ্রাতা, বিধবা মাতা ও বিপুল পরিবারের ভার তাঁহার উপর পতিত হয়। পিতা মৃত্যু সময়ে তাঁহার শোকার্ত্ত পত্নীকে সান্তনা প্রদানার্থ বলিয়াছিলেন-“আমি চলিলাম, কিন্তু কৃতবিদ্য পুত্র রাজনারায়ণ রহিল। আমার অবর্ত্তমানে সেই তোমাদের দেখিবে ও রক্ষণাবেক্ষণ করিবে।” পিতৃ বিয়োগের পর, রাজনারায়ণ বসু মহাশয় কলিকাতায় আসিয়া কিছু দিন সংস্কৃত কলেজে শিক্ষকতা করেন। কলেজ হইতে বহির্গত হইবার পর, তিনি রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজের সম্পর্কে আসিতে আরম্ভ করেন। এই সময়েই তাঁহার ধর্ম্ম বিশ্বাস, ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণে, একটি নির্দ্দিষ্ট পথ অবলম্বন করে। কলেজে অধ্যয়ন কালে তাঁহার ধর্ম্ম বিশ্বাস একটা অনির্দিষ্ট পথে আন্দোলিত হইতেছিল। বাইবেল অথবা কোরাণ অনুমোদিত এই উভয় ধর্ম্মের মধ্যে কোন ধর্ম্মে আস্থা স্থাপন করিলে, প্রকৃত সত্য ধর্ম্মের সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায়, ইহা নির্ণয়ে তিনি সংশয় আন্দোলিত চিত্ত হইতেছিলেন। কলেজ হইতে বহির্গত হইবার পর ব্রাহ্ম ধর্ম্ম গ্রহণে তাঁহার অন্তরের ধর্ম্ম বিশ্বাস সম্বন্ধিয় সমস্ত সংশয় ভাব বিদূরিত হয়। কলেজে অধ্যয়ন কালে, সমাজ সংস্কার বিষয়ে অগ্রবর্ত্তী ও দৃষ্টান্ত স্বরূপ হওনার্থ তিনিই সর্ব্ব প্রথম বিধবা বিবাহ করিতে সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। কিন্ত তাঁহার পিতা, তাঁহার বিধবা বিবাহের সঙ্কল্পের সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া,—“আমাদের দেশে এখনো এরূপ দুঃসাহস জনক কার্য্য করিবার সময় উপস্থিত হয় নাই” তাঁহাকে এই উপদেশ প্রদান পূর্ব্বক এই কার্য্য হইতে তাঁহাকে প্রতিনিবৃত্ত করেন। সংস্কৃত কলেজে শিক্ষকতা কার্য্য কালে, তিনি প্রথম ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মধর্ম্ম বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার সেই সময়ের প্রদত্ত বক্তৃতা সমস্ত, “রাজনারায়ণ বসুর বক্তৃতা” নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। শুনা যায় যে বাবু কেশবচন্দ্র সেন তাহার বক্তৃতা পুস্তক পাঠে ব্রাহ্ম ধর্ম্মের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া, ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ করেন। ইহার পর তিনি মেদিনীপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ পূর্ব্বক, তথায় গমন করেন। মেদিনীপুরই, তাঁহার মহৎ জীবনের কার্য্যাবলীর সর্ব্ব প্রথম স্ফুরন ক্ষেত্র। মেদিনীপুরে তাঁহার জীবনের কার্য্যাবলী কি ভাবে সর্ব্ব প্রথম বিকাশ প্রাপ্ত হয়, তাহার নিদর্শন আমরা Modern Review হইতে পুনরায় এস্থলে সঙ্কলন করিতেছি—
Teacher and Reformer.
Raj Narain’s name is lovingly cherished at Midnapur for his work as Head Master. His heart was in his work, and like Goldsmith’s village preacher he declined preferment elsewhere rather than leave his beloved flock. “In 1856, Mr. J. H. Young, Commissioner of Burdwan, came on tour to Midnapur and was highly pleased with my School and conversation. In the Annual Report he recommended me for a Deputy Collectorship. If I had set about a little I could have got the post. But I loved Midnapur so well that I declined to leave it. On Peary Churn Sircar being promoted, the Director offered me the Headmastership of Hare School vacated by him. But I again declined to leave my work of improving dear Midnapur....The Director exclaimed about me, ‘Don’t talk of him, he is a madcap; he wants neither pay nor promotion.’ (p 105) [What higher proof of disinterested love of duty can we imagine than this?] It was my principle as a teacher to guide the boys by means of love. Early in my career I inflicted corporal punishment on one or two boys, but afterwards gave it up altogether. While teaching them I used to narrate instructive but interesting stories, which drew their hearts to me. I never told them the meaning of a passage outright, but drew it out of them by questioning. But I hear that now-a-days our College students are mere listeners, the professor lectures and they take down notes. The teacher does not ask them any question nor do they ask him. I hate this system of teaching. (P. 73) Besides establishing a debating club for my boys, I constructed a Racket Court for their physical exercise by raising public subscriptions, without soliciting any aid from Government.”...During the 16 years of his Headmastership the strength of the School rose from 80 to 300 and the number of teachers doubled. Year after year his boys carried off university scholarships by competition. Nor were his beneficent energies confined to the School. He took a leading part in establishing a Girls’ School, a Technical School, a Temperance Association, a Public Library and many clubs for public improvement in various ways. No philanthropic project, no scheme of reform, but had Raj Narain among its promoters. What immense good he did by reclaiming drunkards will be seen from pp. 79-85. In the field of social reform he was equally bold and active: the 3rd and 4th widow marriages celebrated by Vidyasagar were arranged by Raj Narain between his cousin and his brother and two widows, in defiance of the entreaties of his orthodox relatives and the threats of his neighbours. “The people of my native village cried out, ‘If Raj Narain Bose comes here we shall stone him.’ I replied, ‘That would highly please me. I knew the Bengali race to be apathetic. If they act thus, I shall conclude that on being convinced of the utility of widow marriage they would support it as vigorously as they are now opposing it.” (P. 100).
ষোড়শ বৎসর, তাঁহার প্রথম কার্য্যক্ষেত্র, মেদিনীপুরে অবস্থান করিবার পর, শারীরিক অসুস্থতা নিবন্ধন, মেদিনীপুর স্কুলের শিক্ষকতা কার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়েন। মেদিনীপুর হইতে বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক, স্বাস্থ্য লাভার্থ তিনি ভারতবর্ষের নানা প্রদেশ পরিভ্রমণ করেন। ভারতবর্ষের নানা দেশ ভ্রমণ কালে, সকল স্থলেই, তিনি ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচার, সমাজ সংস্কার ও স্বদেশ হিতৈষণা মন্ত্রে লোককে উদ্দীপ্ত করিয়া তুলিতেন। নানা দেশ ভ্রমণের পর, তিনি কলিকাতায় আসিয়া দশ এগারো বৎসর পর্য্যন্ত এস্থানে বাস করেন। কলিকাতা অবস্থান কালে, তিনি বিদেশী শিল্প ও পন্য দ্রব্যে প্লাবিত বঙ্গদেশে পুনরায় স্বদেশী শিল্প দ্রব্যের প্রচলনার্থ, তাঁহার বন্ধু স্থানীয় বাবু নবগোপাল মিত্রের সহিত, এক যোগে কলিকাতায় প্রথম হিন্দুমেলা উদ্ঘাটন করেন। বাবু নবগোপাল মিত্র, তাঁহারি উপদেশ অনুসারে, হিন্দুমেলা অর্থাৎ স্বদেশী শিল্প মেলার সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর রূপে প্রাণ পত্তন করেন। দেশে স্বদেশী শিল্প দ্রব্যের বহুল প্রচলনার্থ, হিন্দুমেলার প্রাণ প্রতিষ্ঠা রাজনারায়ণ বসু মহাশয়েরই কীর্ত্তি, অপর কোন ব্যক্তির নহে। তৎকালে দেশে স্বদেশী দ্রব্যের সমাদর ও প্রচলনার্থ হিন্দু মেলার অভিনব উদ্ভাবন বসু মহাশয়ের স্বদেশ প্রীতির গভীর নিদর্শনের অপর একটি অভিব্যক্তি। কলিকাতা অবস্থান কালেই তিনি সেকাল একাল, হিন্দুধর্ম্মের শ্রেষ্ঠতা বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁহার সুপ্রসিদ্ধ বক্তৃতা সকল প্রদান করেন। “সেকাল একাল” ও “হিন্দুধর্ম্মেব শ্রেষ্ঠতা” বিষয়ে, যখন তিনি বক্তৃতা প্রদান করেন, তখন বঙ্গদেশে গভীর আন্দোলন উপস্থিত হয়। তাঁহার সেকাল একাল ও হিন্দু ধর্ম্মের শ্রেষ্ঠতা বিষয়ে বক্তৃতা, সম্বন্ধে বঙ্গদেশে গভীর আন্দোলনের উল্লেখ করিয়া মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছিলেন “রাজনারায়ণ বাবু কিছু একটা বলেন আর দেশে হুলুস্থূল পড়িয়া যায়”।
ব্রাহ্ম ধর্ম্ম সম্বন্ধিয় তাঁহার মতামত, এবং ইহার সম্বন্ধে তাঁহার কার্য্যাবলীর যৎকিঞ্চিৎ বিবরণ প্রদানার্থ আমরা পুনরায় Modern Review যদুনাথ সরকার লিখিত প্রবন্ধ হইতে এই সম্বন্ধে কয়েকটি প্যারাগ্রাফ উদ্ধৃত করিতেছি—
Evolution of the Brahmo Samaj.
Raj Narain was one of the builders of the Brahmo Samaj and its doughtiest controversialists and sweetest preachers. In his memoirs we get a very interesting and fresh history of the evolution of modern Brahmoism, and this history we shall review here. Many who took part in the controversy which shook and split up the new sect are still alive, and the heat engendered by it has not yet entirely cooled. But the cause of truth is best served by having a straight talk, “extenuating nothing, setting down naught in malice.” The present writer, as one standing outside the Brahmo Samaj, is best qualified to handle the subject with a perfect detachment and freedom from the suspicion of partisanship.
Ram mohun Roy, the founder of Brahmoism, regarded himself as a Hindu, and his creed as only the restoration of Hinduism to its pristine purity, just as the early Protestants held themselves to be no schismatics, but the only true Christians. With him the Vedas were revealed Scriptures, and his followers call themselves Brahmajnani Hindus, or Vedantist Hindus (pp 6, 44 & 118). The basis of their faith was the monotheism free from idolatry which the Upanishads taught. Caste was still observed (intermarriage and not interdining is the crucial test of caste). Thus, the first group of Brahmos merely abjured idol worship and retained other Hindu beliefs and practices almost intact.
Here I may observe that if Brahmoism meant mere negation of image-worship, it could have claimed no originality, for such a doctrine already existed in the bundle of faiths labelled as Hinduism. The distinctive merit of Brahmoism must, therefore, be not its doctrinal side, not refusal to bend the knee before idols, -for the dogma of monotheism was an old one in India. With what new elements then has Brahmoism enriched Indian life? My answer is, social and not religious. First, the abjuration of caste in practice, while clinging to an Aryan creed and philosophy and rejecting (except in an eclectic form) the Semitic faiths of Muhammad and Christ. Secondly, a close copy of the religious and moral organization (not dogma) of the Protestant peoples of North Europe, vis., regular weekly religious service in congregation, daily family prayer, a scrupulous and ever vigilant protection of children from indelicate words, sights and literature, adult marriage (and the moral restraint which it implies), persistent and deliberate effort for the development of character by systematic preaching and the moral training of the young, the use of the vernacular in rituals, and sermons at baptism, marriage and funeral,—tending to make religion a part of daily life and to keep alive in the heart an ever present consciousness of it, —the enforcement of method and orderliness in life, the letting in of “light and sweetness” into poor homes by the artistic culture of women folk. How very precious the second is as a factor of race improvement and how deeply though unconsciously Brahmo homes are influencing Hindu ones, time will fully show. But I can say that thoughtful Hindus are heartily sick of the religious chaos and vacuity in which they have been left by the passing away of the old order. Their priests and regular ceremonies have disappeared, and no new system, no Organisation, has been founded for regularly ministering to their spiritual wants, especially the moral training of the young. A few spasmodic efforts in this direction have been made by Dharma Sabhas and Gita Societies, but they have not yet hit upon the right path. The organisation of a new and regular ministry is the problem of Hinduism to-day, and the Brahmo Church alone can throw light on its solution.
Devendra Nath Tagore began with a compromise; at his father’s funeral he omitted to offer pindas (oblations to the names of the dead) but performed the dansagar (gifts). “Many Brahman Brahmos used to take off their sacred threads at prayer, and immediately afterwards resume them!” (P. 63.) True, in 1850, a step forward was taken: the revealed origin of the Vedas was publicly denied. But it required all Raj Narain’s exertions at Midnapur to “make some Brahmos give up idolatrous rites at their domestic ceremonies” (p. 77). Even Raj Narain defended caste: “I argued, —As every country and community has and will have class distinctions in some form or other, why blame the Indian caste system? Can you dine with your servant? Ramtanu Lahiri replied, —Yes, if he washes himself clean with soap” (p. 114). The fallacy of Raj Narain’s analogy between European classes and Indian castes must be obvious to every thoughtful man. But he, with other early Brahmos, clung desparately to Hindu society and gloried in being called a Hindu Brahmo (P. 89). “Babu Dakshina Ranjan Mukherji (of Lucknow) was a Brahmo, but thought it enough to read the Upanishads and sing hymns at service, as was the practice in Ram Mohun Roy’s days. To him the Adi Brahmo Samaj was unHindu. But this view of his was wrong. How can we be other than Hindus as our chief Brahmo Scripture is composed of extracts from the Hindu Shastras?” (P. 118.) This attitude of the Adi Samaj became clearly defined in the difference with Kesav.
“In 1873 Devendra Nath Tagore introduced into the Brahmo Samaj as much of the ancient thread-investiture as could well be. In this new ceremony the novice was initiated in the Gayatri spell and invested with the sacred thread. If in Europe aristocrats can signify their high birth by wearing rampant lions on their coats of arms, I see no harm in such of our Brahmos as are of Brahman birth wearing the sacred thread as a token of their being spiritual aristocrats, the descendants of ancient Rishis...... We should only see to it that no connection is kept with idolatry. Devendra Babu invested his younger sons Somendra and Rabindra with the sacred thread. All the ceremonies of the Brahmanic religion were observed [at the time] except idol worship. That day on my return to Calcutta from a village I went straight into the hall where the ceremony was being performed, as I did not know that [Devendra Babu] had forbidden non-Brahmans to enter it. Had I known of it I should not have sat down in the hall.” (P. 199).
Now, it is well-known that Devendra Nath Tagore was opposed to the intermarriage of castes. But it is news to us that he figured in the role of a high-priest of pagan Greece standing on the temple steps and shouting to non-Brahmans, “Hence, avaunt, ye profane herd! Ye cannot enter the shrine!” Brahmanic pride and contempt for the “lower castes” comes with better grace and greater logic from a stout old Hindu such as Bhudev Mukherji (see p. 121) than from the “Great Sage” of the Common Fatherhood of God and Brotherhood of Man.
We, however, do not presume to blame Devendra Babu. We know how hard it is to cut one’s self adrift from old moorings and sail into unknown waters. Still, we must admit that the Sadharan Brahmo Samaj alone represents the logical development of Brahmoism, and that their is no half-way house or halting place between it and (old) Hinduism, as the Adi and even Indian (Bharatbarshiya) Samajes fondly imagined.
Kesav Chandra Sen got disgusted with the Hindu leanings of the Adi Samaj. Raj Narain, the best exponent of that church, writes, “I consider the method of the Adi Samaj as the best for preaching Brahmoism among the Hindus. Brahmosim ought to be propagated in lndia on the basis of the sublime Vedas and Vedant.” (P. 132) The Kesav-ites drew their inspiration from the Quran and the Bible; as Kesav’s lieutenant said in a Town-hall speech, “We are Christianised Hindus and Hinduised Christians.” But, to continue the narrative in Raj Narain’s own words.—
“Kesav Babu answered, ‘I am ready to say that we are not Hindus.' ... What a sad day it was on which Kesav Babu said so. That day, as it were, two brothers quarrelled and parted company. One brother remained in the ancestral house, viz., Hindu society; the other left its fold.” (P. 186).
Kesav opened a new Church, and this was the second step in advance. But alas! as surely as fame is the last infirmity of noble minds, man-worship or[২] avatarism is the first infirmity of ignoble minds. The separatists in their new Tabernacle were seized with a very old Indian disease: they began to worship Kesav and Pratap as new Prophets and mediators between lesser mortals and God! Then followed scenes which made every sane Brahmo blush in shame and every unbeliever roar with laughter. “After the service [in the Cawnpur Theistic Church] every Brahmo present clasped the feet of Protap Mazumdar and cried, ‘Save me, lord! ‘Intercede with God for me!’ Then they came, as if ashamed, to clasp my feet. I slid back squatting and shouted ‘Don’t do it, it is improper.’ Dr. A. K. De smiled at the scene (P. 134)... When Kesav Babu went to Simla via Monghyr, his disciples announced that he was an avatar. It was at Monghyr that he first developed into an avatar. To those who questioned him he replied, “I wil not stem the current of their faith.’ ... One day I was talking with Devendra Nath Tagore about Kesav as an avatar, when he remarked, “I wonder why Kesav is ambitious of the rank of an avatar. In this country the Fish and the Tortoise too are worshipped as avatars.! ... When Kesav Babu alighted at Allahabad on his return from Simla, there was quite a scene on the platform as his disciples rushed to clasp his feet and those of each other, while the European stationmaster looked on in amazement.” (P. 136) Evidently the latter gentleman thought, ‘Scratch a Brahmo and you will find a Hindu.’
Then came the Kuch Bihar marriage, when principle was sacrificed to expediency, * * * * Kesav claimed that he had acted under inspiration. But one must live in the age of miracles to believe that this inspiration had come from on high. The logical consequence of avatarism folled the death of Kesav: the alter from which he used to preach was pronounced sacred and Pratap was prevented with unspiritual weapons from occupying it, lest it should be defiled! The argument was presumably the same as the Shia contention that Ali, the heir-at-law of Muhammad, was the true successor of the Prophet and that the first three Khalifas were usurpers, i. e., the headship of religion is heritable like private property and the Founder’s heir enters into possession of the Church “with the live stock in it.” Among the Hindus the alter on which an idol has been installed thenceforth becomes too holy to be occupied by men. Kesav’s alter was similarly guarded from the defiling touch of Pratap or any other mortal. The difference between these two kinds of idolatry is not obvious to any intellect to which the light of the New Dispensation has not been vouchsafed.
Then the Sadharam Brahmo Samaj was formed in protest. It must have wrung Raj Narain’s heart to see the infant church split up again, and the brethren hastening to fulfil the proverb, Tin Kanaujia terah chulah (three Kanauji Brahmans require 13 separate cooking-places between them).”
কলিকাতায় অবস্থান কালে, শারীরিক অবনতিগ্রস্ত বাঙ্গালী জাতিকে সুস্থ ও বলিষ্ঠ করিবার উদ্দেশে তিনি এস্থানে এক ব্যায়ামাগার সংস্থাপন করিয়াছিলেন। সেই ব্যায়ামাগারে অশ্বারোহণ ও অন্যান্য ব্যায়াম শিক্ষা প্রদত্ত হইত। কলিকাতায় এইরূপ নানাবিধ সদনুষ্ঠানসুচক কার্য্যে, দশ এগারো বৎসর অতিবাহিত করিবার পর, পুনরায় মেলেরিয়া জ্বরে স্বাস্থ্য ভগ্ন হওয়াতে বায়ু পরিবর্ত্তন উদ্দেশে কলিকাতার কার্য্য ক্ষেত্র হইতে কিছু দিনের জন্য দেওঘরে গমন করেন। এই স্থানে নষ্ট স্বাস্থ্য পুনঃ লাভ করিবার পর, তিনি কলিকাতায় পুনঃ প্রত্যাবর্ত্তনের ইচ্ছা পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। দেওঘরে কার্য্যে ব্যস্ত জীবন ক্ষেত্র হইতে অপসৃত হওয়া সত্ত্বেও, ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচারে, সমাজ সংস্কার চিন্তায় ও সাহিত্য সেবাব্রত হইতে তিনি কখন বিরত হয়েন নাই। দেওঘরে অবস্থান কালে তিনি কত ধর্ম্ম জিজ্ঞাসু ব্যক্তিদিগকে মধুর ও উচ্চ উপদেশ এবং ধর্ম্ম প্রাণতার দ্বারা ব্রাহ্মধর্ম্মের প্রতি আস্থাবান ও আকৃষ্ট করিয়া লইতেন, এবং সমাজ সংস্কার ব্রতে, কত লোককে যে উদ্দীপ্ত করিয়া তুলিতেন তাহার সংখ্যা নাই। বঙ্গদেশের নবীন ও প্রবীণ সাহিত্য সেবীগণ, তাঁহার সহিত সাহিত্য বিষয় আলোচনা করিবার জন্য কত সুদূর স্থান হইতে দেওঘরে উপস্থিত হইতেন। তাঁহার পদার্পণে বন্য ভূমি দেওঘর বঙ্গদেশে অল্পদিনের মধ্যে প্রসিদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। তাঁহার দেওঘরের বসতবাটী, ধর্ম্ম ও জ্ঞানালোচনার সামগানে মুখরিত প্রকৃত ঋষি আশ্রমের ন্যায় পুণ্য ভূমি হইয়া উঠিয়াছিল। কত স্বদেশসেবীগণ তাঁহার নিকট উপদেশ লাভের জন্য উপস্থিত হইতেন। সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যসেবী বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত “আনন্দমঠ” উপন্যাস পাঠ করিয়া তিনি বঙ্কিম বাবুকে এক পত্রে আন্তরিক গভীর আনন্দ প্রকাশ পূর্ব্বক তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদান করিয়া লিখিয়াছিলেন, “আপনার লেখনী অমর হউক।” আনন্দমঠ পাঠ করিবার পর বন্দেমাতরম্ সঙ্গীতের, “বন্দেমাতরম্ সুজলাং সুফলাং এবং সপ্তকোটিধৃত খরকরবালে, কে বলে মা তুমি অবলে,” এই পদগুলি সর্ব্বদা উৎসাহের সহিত উচ্চৈস্বরে তাঁহাকে গাহিতে শুনা যাইত। মৃত্যুর পূর্ব্বে তাঁহাকে এই বলিয়া আক্ষেপ করিতে শুনা গিয়াছিল, যে “আমার শেষ জীবনের দুইটি আশা সফল হইল না,—প্রথম আগ্রার যমুনার তীরে বসিয়া “নির্ম্মলসলিলে বহিছ সদা তট শালিনী সুন্দরী যমুনে ও” এই গানটি রচয়িতার স্বমুখে শুনিবার বাসনা এবং দ্বিতীয় জন্ম ভিটা বোড়াল গ্রামে শেষ মৃত্যু লাভ করা” এই দুইটি আশা আমার সফল হইল না।”
আজীবন কঠোর মানসিক পরিশ্রম শনৈঃ শনৈঃ তাঁহার জীবন ভিত্তী ভূমি ও জীবনীশক্তি হ্রাস করিয়া ফেলিতেছিল। অবশেষে ৭০ বৎসর বয়ক্রম কালে নিদারুণ পক্ষাঘাত রোগ, তাঁহার কার্য্যশীল জীবনগতি একেবারে বিধ্বস্ত করিয়া ফেলিল। পক্ষাঘাত রোগগ্রস্ত হইবার পর, তিনি প্রায় আড়াই বৎসর কাল শয্যাগত অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করেন। নিদারুণ রোগ যন্ত্রণায় শয্যাগত অবস্থার মধ্যেও তাঁহার চির প্রফুল্ল উৎসাহ দীপ্ত সৌম্য বদন একদিনের জন্যও অবসাদের মলিনতা প্রাপ্ত হয় নাই। শয্যাগত অবস্থায়ও সাক্ষাৎকারি জনগণের সহিত পূর্ব্বের ন্যায় উৎসাহদীপ্ত আননে নানা বিষয়ের আলোচনায় ব্যাপৃত হইতেন। রুগ্নাবস্থায় অধিকাংশ সময় তিনি ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন থাকিতেন। তাঁহার শয্যাগত অবস্থার কালে তাঁহার একটি প্রিয়তম দৌহিত্রের মৃত্যু হয়। এই বালকটি তাঁহার এক বিধবা কন্যার পুত্র ছিল। তিনি এই বালকটিকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন। রুগ্নাবস্থায় পাছে এই শোক সংবাদ তাঁহার পক্ষে ঘোর অনিষ্টের কারণ হইয়া দাঁড়ায় এই কারনে তাঁহাকে এই সংবাদ প্রথমে প্রদান করা হয় নাই। বালকটির মৃত্যু সংবাদ অনবগত হেতু তাহার মৃত্যুর কয়েক দিন পরে যখন তিনি তাহাকে দেখিতে চাহিলেন, তখন এই নিদারুণ সংবাদ তাঁহার নিকট গোপন করিয়া রাখা আর অসম্ভব হইয়া উঠিল। চিকিৎসকেরা এই সংবাদ, তাঁহার রুগ্ন শরীরের পক্ষে কিরূপ সাংঘাতিক ফল উৎপাদন করিবে, সে বিষয়ে শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। অবশেষে চিকিৎসকের পরামর্শে, যখন এ সংবাদ তাঁহার নিকট জ্ঞাপন করা হইল, তখন তিনি শান্ত সমাহিত চিত্তে সাংসারিক দুঃখ শোকে উদাসীন প্রকৃত তাপসের ন্যায় এই নিদারুণ শোক সংবাদ শ্রবণ করিলেন। তাঁহার চির প্রফুল্ল সৌম্য বদন, মানসিক অধীরতার একটিও মাত্র সামান্য রেখা পতনেও উদ্বেলিত হইয়া উঠিল না। তিনি মৃদু হাস্য পূর্ব্বক উপস্থিত লোকদিগকে সম্বোধন করিয়া বললেন—“কেন যথা সময়ে আমাকে এ সংবাদ জ্ঞাপন করা হয় নাই? অবিনাশ সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানে গমন করিয়াছে; তাহার জন্য কেন আমরা শোক করিব।”। তৎপরে দৌহিত্রের মৃত্যু সংবাদ শ্রবণ করিবার পর, সমস্ত দিন শান্ত সমাহিত চিত্তে ঈশ্বর প্রার্থনায় নিযুক্ত থাকিয়া, সন্ধ্যাকালে বাটীস্থ সকলকে আহ্বান করিয়া বলিলেন,— “অবিনাশ তাহার সৌন্দর্য্য ও গুণের অনুরূপ স্থানে গমন করিয়াছে, তাহার জন্য কাহারো শোক করিবার আবশ্যক নাই।” একমাত্র পুত্র-শোক-বিধুরা বিধবা কন্যাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “সুকুমারী, তুমি যে এই নিদারুণ আঘাত এরূপ ধৈর্য্যের সহিত সহ্য করিয়া চলিতেছে, ইহাতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছি। ইহজীবন ও ইহজীবনের সুখ দুঃখ ক্ষণসূর্য্যালোক ব্যবধানকারি দ্রুত উড্ডিয়মান মেঘের ন্যায় যে ক্ষণস্থায়ি, এই তত্ত্বের সার মর্ম্ম যে তুমি সম্যক উপলব্ধি করিতে পারিয়াছ, ইহাতে আমি অত্যন্ত সন্তোষ প্রাপ্ত হইয়াছি।” এই ঘটনার দেড় বৎসর পরে, আত্মীয়, বান্ধব, পুত্র কন্যা ও পরিবারবর্গের সেবা শুশ্রুষা, শ্রদ্ধা, ভক্তি ও সম্মানের সমাদরের মধ্যে ৭৬ বৎসর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন।
যে প্রতীভার প্রদীপ্ত প্রদীপ বঙ্গদেশকে আলোকিত করিবার জন্য প্রজ্জ্বলিত হইয়াছিল, তাহা শাশ্বত ধ্রুবলোকে পুনঃ মহোজ্জ্বলরুপে প্রজ্জ্বলিত হইবার জন্য অদৃশ্য হইল। তাঁহার মৃত্যুতে সমগ্র বঙ্গদেশ গভীর শোক প্রকাশপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি আন্তরিক গভীর সম্মান প্রদর্শন করিয়াছিল।
সূচীপত্র
এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।