গ্রাম্য উপাখ্যান/আনন্দকিশোর বসু
আনন্দকিশোর বসু।
আনন্দকিশোর বসু রামসুন্দর বসুর দ্বিতীয় পত্নীর প্রথম সন্তান। ইনি রামমোহন রায়ের স্কুলে পড়েন। হিন্দুকলেজ সংস্থাপিত হইবার পূর্ব্বে রামমোহন রায় স্বদেশীয় লোকদিগকে ইংরাজী শিখাইবার জন্য এক স্কুল সংস্থাপন করেন। ঐ স্কুল কলিকাতার সিমুলিয়া পল্লীতে সংস্থিত ছিল। ইহা “পূর্ণ মিত্রের স্কুল” নামে পশ্চাৎ খ্যাত হয়। আনন্দ বাবু ফুট ফুটে ও বুদ্ধিমান্ বালক ছিলেন। তাঁহার পঠদ্দশা হইতেই রামমোহন রায়ের স্নেহদৃষ্টি তাঁহার উপর পতিত হয়। ইনি স্কুল ছাড়িয়া দিন কয়েক রামমোহন রায়ের কেরাণীগিরি করেন। ইহাকে রামমোহন রায় যে সার্টিফিকেট দিয়াছিলেন তাহা আমরা আনন্দ বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র রামনারায়ণ বাবুর নিকট দেখিয়াছি। রামমোহন রায় যে তেজস্বী পুরুষ ছিলেন তাহা তাঁহার হস্তলিপি পর্য্যন্ত প্রমাণ করিতেছে। হাতের লেখা দ্বারা মনুষ্যের স্বভাব অনেক অনুমান করা যায়। আনন্দ বাবুর স্ত্রী দেখিতে তত ভাল ছিলেন না। যখন তাঁহার শ্বশুর বিবাহের পূর্ব্বে মেয়ে দেখান তখন আপনার কন্যাকে না দেখাইয়া পাড়ার একটি সুন্দরী বালিকাকে দেখান। আনন্দ বাবু বিবাহের পর এই জুয়াচুরী টের পাইয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার স্ত্রীকে সপত্নী দেখাইবার মানস করিয়াছিলেন। কিন্তু রামমোহন রায় তাঁহাকে পুনরায় বিবাহ করিতে নিষেধ করেন। তিনি বলিয়াছিলেন যে বৃক্ষের উৎকর্ষ ফলের উৎকৃষ্টতা দ্বারা বিবেচনা করা কর্ত্তব্য। এই স্ত্রী দ্বারা যদি তোমার ভাল সন্তান হয় তাহা হইলে এই স্ত্রীকেই অতি সুন্দরী জ্ঞান করা কর্ত্তব্য। আনন্দ বাবুর পুত্র রামনারায়ণ বাবুর নাম ব্রাহ্মমহল ছাড়া সাধারণবর্গ জানে না, আর ব্রাহ্মমহলেও তাঁহার খ্যাতি তত বেশী নহে। তথাপি ব্রাহ্মদিগের মধ্যে একটি গণ্য ব্যক্তি হইয়া তিনি রামমোহন রায়ের ভবিষ্যদ্বাণী যে কিয়ৎপরিমাণে সার্থক করিয়াছেন ইহাতে আমরা আহ্লাদিত আছি। আনন্দ বাবু রামমোহন রায়ের কেরাণীগিরি পদ ছাড়িয়া “হরকরা” আফিসে কেরাণীগিরি করেন। এই “হরকরা” পত্র এক্ষণে ইণ্ডিয়ান ডেলিনিউজের সহিত একীভূত হইয়াছে। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি সে সময়ে উহা একটী অতি প্রসিদ্ধ কাগজ ছিল। সেকালের ইংরাজী কবি নন্দগোপাল চট্টোপাধ্যায় তাঁহার প্রণীত Golden Moon নামক কবিতা পুস্তকের এক স্থানে লিখিয়াছিলেন, “Englishman wife, Hurkeru husband.” Englishman এর কলম তখন জোর কলম ছিল না, Hurkeruর জোর কলম ছিল। আমাদিগের কোন বিখ্যাত বন্ধু খবরের কাগজ আদৌ পড়েন না। তিনি বলেন উহা রাতকাণার গল্পে পরিপূর্ণ। একবার আমরা কোন খবরের কাগজে পড়িয়াছিলাম যে একটী কিছু কিছু স্ত্রীচিহ্নবিশিষ্ট ক্লীব ক্রমে ক্রমে পুরুষে পরিণত হইয়া পরিশেষে সৈনিক দলে প্রবেশ করে। Englishman কাগজের সেই পরিবর্ত্তন ঘটয়াছে। এক্ষণে তিনি কেবল পুরুষ হইয়াছেন এমন নহে; পুরুষত্বের বাড়াবাড়ি করিতেছেন, তাঁহাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া কর্ত্তব্য। আনন্দকিশোর বাবু হরকরা আফিসের কেরাণীগিরির পরে অন্য অনেক স্থানে কেরাণীগিরি করিয়া, গাজীপুরের আফিঙের এজেণ্টের আফিসে কার্য্য করেন। তখন John Frotter ওপিয়াম এজেণ্ট ছিলেন। গাজীপুরে অবস্থিতি কালে একদিন আনন্দ বাবুর শরীর অসুস্থ হওয়াতে তথাকার ডাক্তার সাহেব এমন একটী জোলাপ দেন যে অসংখ্য দাস্ত হয়। সেই অবধি আনন্দ বাবুর শরীর এমনি ভগ্ন হয় যে তিনি চিররোগী হইয়া পড়েন। সে কালে ডাক্তারদিগের মধ্যে দাস্ত খোলা, জোঁক লাগানো, খুব জোলাপ দেওয়া, কেলোমেল খাওয়ান রীতি অত্যন্ত প্রচলিত ছিল। এক্ষণে সেরূপ দেখা যায় না। সেকালে ডাক্তারেরা রোগীকে যে কত ঔষধ গেলাইতেন তাহা বলা যায় না। যে সকল রোগী এই বীরোচিত চিকিৎসায় বাঁচিয়া যাইত তাহাদিগকে ভাগ্যবান বলিতে হইবে। এক্ষণে এইরূপ শুভ পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে যে কোন কোন এলোপেথিক ডাক্তার পর্যন্ত এলোপেথিক ঔষধ অতি অল্প পরিমাণে, এমন কি প্রায় হোমিওপেথিক পরিমাণে দিয়া থাকেন। আনন্দ বাবু গাজীপুর হইতে ফিরিয়া কলিকাতার অনেক স্থানে কেরাণীগিরি করিয়া পরিশেষে খাস কমিসনের হেড কেরাণী পদে নিযুক্ত হয়েন। এই খাস কমিসন ব্রহ্মোত্তর জমী বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য গবর্ণমেণ্ট দ্বারা নিযুক্ত হয়। এই খাস কমিসনে আনন্দ বাবু যেরূপ কাজ করিতেন তাহা এক্ষণে কোন কোন আফিসের রেজিষ্ট্রারের উপযুক্ত। কিন্তু তিনি তাঁহার কার্য্যের উপযুক্ত বেতন পাইতেন না। মনে করিলে তিনি এই কর্ম্মে অনেক ঘুষ খাইয়া বড় মানুষ হইতে পারিতেন। কিন্তু তিনি ঘুষ খাইতেন না; তিনি বড় সৎপ্রকৃতির লোক ছিলেন। আনন্দকিশোর বাবু ইংরাজী বেশ লিখিতে পারিতেন। কিন্তু ইংরাজী ভাল উচ্চারণ করিতে পারিতেন না। তিনি “to” শব্দ উচ্চারণ না করিয়া “টো” উচ্চারণা করিতেন। তাঁহার পুত্র রামনারায়ণ বাবু হিন্দু কলেজের একটা বিখ্যাত ছাত্র। তিনি পিতার মৃত্যুর পর তদানীন্তন সুপ্রিম কাউন্সিলের লেজিশ্লেটিব মেম্বার Hon’ble C. H. Gameron সাহেবের নিকট হইতে তখনকার বেঙ্গল সেক্রেটারী Halliday সাহেবের নামে একটী অনুরোধ পত্র লইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। এই হালিডে সাহেব পরে বঙ্গদেশের লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণরের পদে নিযুক্ত হয়েন। হালিডে সাহেব রামনারায়ণ বাবুকে তাঁহার পিতার পরিচয় জিজ্ঞাসা করাতে এবং রামনারায়ণ বাবু তাহা বলাতে তিনি বলিয়াছিলেন, “That Ananda Kishore who used to write English so well” “সেই আনন্দকিশোর যিনি ইংরাজী ভাল লিখিতে পারিতেন?” আনন্দকিশোর বসু পারস্য ভাষাও বিলক্ষণ জানিতেন। তখন আদালতের কার্য্য পারস্য ভাষায় সম্পাদিত হইত। এক্ষণে যেমন বাঙ্গালার সঙ্গে ইংরাজী শব্দ মিশাইয়া কথা কহিবার রীতি প্রচলিত, আনন্দকিশোর বসুর সময়ে বিদ্বান ব্যক্তিদিগের মধ্যে বাঙ্গালার সঙ্গে পারস্য শব্দ মিশাইয়া কথা কহিবার রীতি প্রচলিত ছিল। আমাদিগের জীবদ্দশাতে ক্রমে ক্রমে আমাদিগের অজ্ঞাতসারে পারসী মিশ্রণ রীতি রহিত হইয়া ইংরাজী মিশ্রণ রীতি প্রচলিত হইল। এক্ষণকার লোকে যেমন বলে “এ জিনিষটা nourishing” তখনকার লোকে বলিত এ জিনিষটা বড় “মকব্বি”। আনন্দ বাবু, আপনার বিদ্যা ও কার্য্য-নৈপুণ্য দ্বারা তাঁহার সাহেব প্রভুদিগকে অতিশয় সন্তুষ্ট করিয়াছিলেন। তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহাকে আমরা একটা দাঁড়াডেস্কের নিকট দাঁড়াইয়া দিবারাত্রি কাজ করিতে দেখিয়াছি। আফিসের কাগজ বাটীতে লইয়া আসিয়া কাজ করিতেন। দাঁড়াইয়া লিখিতে ডাক্তার তাঁহাকে পরামর্শ দিয়াছিল। তিনি ১৬০৲ টাকা বেতন পাইতেন, এতদ্ব্যতীত লোকের কাগজ পত্র তরজমা করিয়া মাসে প্রায় চল্লিশ টাকা রোজগার করিতেন। তখনকার এই দুই শত টাকা এখনকার ছয় শত টাকার সমান। তখন জিনিষপত্র এত সস্তা ছিল যে তিনি এই দুই শত টাকাতে দিব্য সম্পন্ন মানুষের ন্যায় কাটাইতেন। তাঁহার আয়ের বিশিষ্ট অংশ পরোপকারে ব্যয়িত হইত। ১৮৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমে আনন্দ বাবুর জ্বরবিকার হয়। পীড়াক্রান্ত হইয়া বাদলগ্রামের বাটীতে আইসেন, তথায় তাঁহার মৃত্যু হয়।
আনন্দকিশোর বাবু রামমোহন রায়ের শিষ্য ছিলেন। সে কালের ব্রাহ্মদিগের কিরূপ ধর্ম্মমত ছিল পাঠকবর্গ সে বিষয়ে কৌতুহলাক্রান্ত হইতে পারেন। আনন্দকিশোর বাবু বৈদান্তিক ছিলেন। জীবাত্মা পরমাত্মা অভেদ, জগৎ স্বপ্নবৎ, নির্ব্বাণ মুক্তি এই সকল মতে বিশ্বাস করিতেন। একদিন তিনি, রামনারায়ণ বাবু ও কলিকাতা সিমুলিয়া নিবাসী পরম বৈষ্ণব নন্দলাল বাবু এই তিন জনে বসিয়া ধর্ম্মালোচনা করিতেছিলেন। রামনারায়ণ বাবু তখন হিন্দ কালেজে পড়েন। নির্ব্বাণ মুক্তির বিষয়ে কথা হইতেছিল। আনন্দকিশোর বাবু নির্ব্বাণ মুক্তি মত সমর্থন করিতেছিলেন। নন্দলাল বাবু বিদায় হইয়া সিঁড়িতে নামিবার সময় রামনারায়ণ বাবুকে চুপি চুপি বলিলেন, “বাপু! তোমার বাবার মতে তুমি বিশ্বাস করিও না; দেখ চিনি হবার চেয়ে চিনি খাওয়া ভাল।” মৃত্যুসময়ে যখন আনন্দ বাবু তাঁহার গ্রামের আদ্য গঙ্গার ঘাটে নীত হয়েন, তখন তাঁহার পরম বন্ধু ভূতপূর্ব্ব দারোগা শ্যামচাঁদ ঘোষ তাঁহার নিকট শঙ্কর ভাষ্য পাঠ করিতে লাগিলেন। আনন্দ বাবু প্রণব জপ করিতে করিতে প্রাণত্যাগ করিলেন। মৃত্যুর পর দৃষ্ট হইল অঙ্গুলির উপর অঙ্গুলি রহিয়াছে। আনন্দ বাবু হাফেজ, জেলালুদ্দীন রুমি প্রভৃতি সুফী সম্প্রদায়স্থ পারস্য কবির কবিতা আবৃত্তি করিতে বড় ভাল বাসিতেন। পাঠকবর্গ অবশ্য জ্ঞাত আছেন যে বৈদান্তিক ও সুফীদিগের মতের পরস্পর অনেক সাদৃশ্য আছে। কিন্তু আনন্দ বাবু নিজের ধর্ম্মমত “Universal Religion” অর্থাৎ বিশ্বজনীন ধর্ম্ম বলিতেন আর ভাবে গদগদ হইতেন। যখন “Universal Religion” বলিতেন তখন তদ্দারা বৈদান্তিক মত সে বিশ্বজনীন ধর্ম্ম বুঝাইতেন এমন বোধ হয় না। একমাত্র নিরাকার অদ্বিতীয় পরমেশ্বরে বিশ্বাস সকল ধর্ম্মের মূলে আছে ঐ বাকা দ্বারা ইহাই কেবল বুঝাইতেন সন্দেহ নাই। আনন্দ বাবু ক্রিয়াকলাপ বিষয়ে অতিশয় শিথিলতা প্রকাশ করিতেন। আনন্দ বাবু বাৎসরিক শ্রাদ্ধ করা ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, তৎপরে রামনারায়ণ বাবুও তাহা করা ছাড়িয়া দিলেন। তৎপরে তাহা করিবার ভার বংশের একটা নিতান্ত বালক মধুসূদন বসুর পুত্ত্রের উপর গিয়া পড়িল। এই জন্য ঐ বালককে আনন্দ বাবুর সহধর্ম্মিণী বলিতেন “তুই আমাদের বংশধর, আর সকলে বয়ে গিয়েছে, তুই কেবল বংশের নাম রাখিবি।” আনন্দ বাবু আহার বিষয়ে জাতিভেদের বিচার করিতেন না। খানা খাওয়ার একটা স্রোত রামমোহন রায় হইতে বাহির হয়, আর একটী স্রোত ডিরোজিওর শিষ্যদিগের নিকট হইতে বাহির হয়, উভয় স্রোত পরস্পর মিলিত হইয়া পরে প্রবলবেগে হিন্দু সমাজে প্রবাহিত হয়। কিন্তু রামমোহন রায়ের শিষ্যেরা ইংরাজীতর আহার ভাল বাসিতেন না; তাহারা মুসলমানীতর আহার ভাল বাসিতেন। একদা আনন্দ বাবু রামনারায়ণ বাবুর পরম বন্ধু হিন্দু কলেজের বিখ্যাত শিক্ষক শ্যামতনু বাবুকে আহারের নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহাকে পোলাও কালিয়া ব্রাহ্মণ দ্বারা পাক করাইয়া খাওয়ান। শ্যামতনু বাবু তাহা খাইবার সময় বলিয়াছিলেন, “It is too rich” অর্থাৎ ইহা বড় ঘিওয়ালা। ইহাতে আনন্দ বাবু আপনার পুত্ত্রের বন্ধুর প্রতি বিরক্ত হইয়া বলিয়াছিলেন, “বাবু ইংরাজ হয়েছেন।” শ্যামতনু বাবু ডিরোজিওর শিষ্য। তিনি এখনও জীবিত আছেন। রামনারায়ণ বাবু স্বপ্নে ও জানিতেন না যে তাঁহার পিতার যবন স্পৃষ্ট আচার চলে। তিনি মনে করিতেন আমরা কালেজের ছোকরা, আমাদিগেরই ঐরূপ আহার চলে। তিনি কখন মনে করেন নাই যে তাঁহার পিতা এত অগ্রসর। আনন্দ বাবুর বাসা তখন পটলডাঙ্গায় ছিল। রামনারায়ণ বাবু পাড়ার পরমেশ্বর ঘোষাল, প্রসন্নকুমার সেন, আনন্দলাল মিত্র প্রভৃতির সহিত কালেজের গোলদিঘিতে মদ খাইতেন এবং এখন যেখানে সেনেট হাউস হইয়াছে সেখানে কতকগুলি গোমাংসের শিক কাবাবের দোকান ছিল, তথা হইতে উক্ত কাবাব কিনিয়া আনিয়া আহার করিতেন। তিনি ও তাঁহার সহচরেরা এইরূপ গোমাংস ও জলস্পর্শশূন্য ব্রাণ্ডি খাওয়া সভ্যতা ও সমাজ-সংস্কারের পরাকাষ্ঠা-প্রদর্শক কার্য্য মনে করিতেন। একদা রামনারায়ণ বাবু গোলদিঘিতে মদ খাইয়া টুপভুজুঙ্গ হইয়া রাত্রিতে বাটীতে আসাতে তাঁহার মাতা ঠাকুরাণী অতিশয় বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “আমি আর কলিকাতার বাসায় থাকিব না, বাদলগ্রামের বাটীতে গিয়া থাকিব।” আনন্দ বাবু পুত্ত্রের আচরণের বিষয় অবগত হইয়া তাঁহাকে পরিমিত মদ্যপায়ী করিবার জন্য একটা কৌশল অবলম্বন করিলেন। সেই কৌশল অবলম্বন করাতে রামনারায়ণ বাবু প্রথম জানিতে পারিলেন যে বাবারও যবনস্পৃষ্ট আচার চলে। মদ্য পান বিষয়ে রামমোহন রায়ের শিষ্য ও হিন্দু কালেজের ছাত্রাদিগের মধ্যে প্রভেদ ছিল। রামমোহন রায়ের শিষ্যেরা অত্যন্ত পরিমিতপায়ী ছিলেন, হিন্দু কালেজের অধিকাংশ ছাত্র এরূপ ছিলেন না। একবার রামমোহন রায়ের কোন শিষ্য অপরিমিত মদ্য পান করাতে রামমোহন রায় ছয় মাস তাহার মুখ দর্শন করেন নাই। আনন্দ বাবু পুত্ত্রকে পরিমিতপায়ী করিবার জন্য যে কৌশল অবলম্বন করিলেন তাহা বর্ণিত হইতেছে। সে কালে মুন্সী আমির আলি সদর দেওয়ানি আদালতের একজন প্রধান উকীল ছিলেন। এই মুন্সী আমির আলি পরে সিপাহী বিদ্রোহের সময় গবর্ণমেণ্টের উপকার করাতে নবাব উপাধি প্রাপ্ত হয়েন। যে বাটীতে সদর দেওয়ানী আদালত বসিত, সেই বাটীতেই খাস কমিসন হইত। খাস কমিসন সদর দেওয়ানির অঙ্গ ছিল বলিলেই হয়। মুন্সী আমির আলি উভয় সদর দেওয়ানী ও খাস কমিসনে ওকালতি করিতেন। আনন্দ বাবুর সহিত মুন্সী আমিরের অত্যন্ত বন্ধুতা জন্মিয়াছিল। মুন্সী সাহেব আনন্দ বাবুকে “রাজদারদোস্ত” বলিতেন। যে বন্ধুকে গোপনীয় কথা বলা যাইতে পারে পারসীতে তাহাকে রাজদারদোস্ত বলে। প্রায় প্রতিদিন মুন্সি আমির আলির বাটী হইতে আনন্দ বাবুর বাসায় প্রকাণ্ড একটা টিনের বাক্স আসিত। রামনারায়ণ বাবু মনে করিতেন যে মুন্সী আমির তাঁহার পিতাকে তরজমা জন্য সদর দেওয়ানীর কাগজপত্র পাঠাইয়া দিয়া থাকেন। একদিন সন্ধ্যার পর রামনারায়ণ বাবুকে একটা ঘরের ভিতর ডাকিলেন, ডাকিয়া ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। রামনারায়ণ বাবু প্রথমে বুঝিতেই পারিলেন না যে ব্যাপারটা কি। তাহার পর দেখিলেন যে আনন্দ বাবু একটী দেরাজ খুলিয়া একটা কর্কস্ক, একটা শেরির বোতল ও একটী ওয়াইনগ্নাস বাহির করিলেন, তৎপরে প্রকাণ্ড টিনের বাক্সটী খুলিলেন। টিনের বাক্স খোলা হইলে, রামনারায়ণ বাবু দেখিলেন যে তাহাতে সদর দেওয়ানির কাগজ নাই, পোলাও কালিয়া, কোপ্তা রহিয়াছে। আনন্দ বাবু রামনারায়ণকে বলিলেন, “তুমি প্রত্যহ সন্ধ্যার পর আমার সঙ্গে এই সকল উত্তম দ্রব্য আহার করিবে, কিন্তু মদ দুই গ্লাসের অধিক পাইবে না। যখনই শুনিব যে অন্যত্র মদ খাও, সেই দিন তোমার এই খাওয়া বন্ধ করিয়া দিব।” এক নিকৃষ্ট প্রবৃত্তির চরিতার্থতা সম্পাদন দ্বারা অন্য একটী নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি দমন করিবার এরূপ উপায় কেহ কখন আপনার পুত্র সম্বন্ধে অবলম্বন করিয়াছেন কি না বলা যায় না। যাহা হউক, অপরিমিত মদ্যপানের সহিত আহারপ্রিয়তা তুলনা করিলে শেষটীকে অপেক্ষাকৃত নির্দ্দোষ বলিতে হইবে। রামনারায়ণ বাবু যেদিন মুন্সী সাহেবকে পড়াইতে যাইতেন সেদিন এরূপ আহার পাইতেন না। দিন কয়েক রামনারায়ণ বাবু মুন্সী সাহেবের প্রাইবেট মাষ্টারী করিয়াছিলেন। মুন্সী সাহেব তাঁহার নিকট School Society দ্বারা প্রকাশিত Spelling Book No. I পড়িতেন। রামনারায়ণ বাবুকে লইয়া যাইবার জন্য তিনি প্রত্যহ পালকী পাঠাইয়া দিতেন। রামনারায়ণ বাবু এইরূপ গৃহশিক্ষকতা জন্য বেতন লইতেন না। কিন্তু প্রত্যহ শিক্ষকতা কার্য্য সম্পাদনের পর মুন্সী সাহেব রামনারায়ণ বাবুকে এক প্লেট কোপ্তা ও এক কোয়ার্ট বোতল উত্তম বীয়র সরাপ খাইতে দিতেন। ঐ বোতল হইতে মুন্সী সাহেব নিজে অল্প পরিমাণে পান করিতেন, বাকি রামনারায়ণ বাবুরই থাকিত। এরূপ প্রাইবেট মাষ্টারী কেহ কখন করিয়াছেন কি না বলা যায় না। রামনারায়ণ বাবু মুন্সী সাহেবকে পড়াইতেছেন, আর সম্মুখে কোপ্তার প্লেট আর বীয়র সরাপের বোতল রহিয়াছে, ইহার একটী উত্তম ছবি হইতে পারে। রামনারায়ণ বাবু অভিনব ব্রাহ্মধর্ম্ম অবলম্বন করিয়াও কিছু দিন মদ খাইতেন, তৎপরে ছাড়িয়া দেন। তেইস বৎসর হইল মদ্যপান একেবারে ছাড়িয়া দিয়াছেন। আনন্দ বাবুর যাবনিক আহার বিষয়ে অন্যান্য অনেক অপূর্ব্ব কাহিনী শুনা যায়। মুন্সী উজীর আলি নামে আনন্দ বাবুর একটী কানপুর নিবাসী মুন্সী ছিল, তিনি তাঁহাকে পারসী কাগজ পত্র অনুবাদ করিতে সাহায্য করিতেন। মুন্সী সাহেব প্রত্যহ টিনের কৌটা করিয়া তাঁহার প্রভুর জন্য মুরগির ডিম অর্দ্ধসিদ্ধ করিয়া তাহার উপর লবণ ও মরিচের গুঁড়া ছড়াইয়া আনিতেন। একদা তিনি এই কৌটা রাখিয়া নীচে প্রস্রাব করিতে গিয়াছিলেন এই অবসরে রামনারায়ণ বাবুর নিতান্ত বালক জোঠতুত ভাই যাঁহার উপর বাৎসরিক শ্রাদ্ধ করিবার ভার অর্পিত ছিল এবং যাঁহাকে তাহার কাকী “বংশধর” বলিয়া ডাকিতেন— ঐ কৌটা লইয়া নিকটস্থ স্নানাগারের মধ্যে লইয়া গিয়া কৌটার অন্তর্গত কয়েকটী ডিম্ব—কি পদার্থ না জানিয়া উত্তম খাদ্য মনে করিয়া কপাকপ্ খাইয়া টিনের কৌটা যেমন বন্ধ ছিল সেইরূপ বন্ধ করিয়া আবার রাখিয়া দিলেন। পরদিবস আনন্দ বাবু ডিম পায়েন নাই বলতে মুন্সী সাহেব বিস্ময়ান্বিত হইলেন। তৎপরে কে খাইল অনুসন্ধান পড়িয়া গেল। কিন্তু তাহা যে “বংশধর” খাইয়াছিলেন তাহা কেহ অনুভব করিতে পারিলেন না। অবশেষে কিছুই মীমাংসা করিতে না পারিয়া মুন্সী সাহেব স্থির করিলেন যে শয়তানে খাইয়াছে। এক্ষণে যেমন কলিকাতার অত্যন্ত গোঁড়া হিন্দুর বাটীতে পর্য্যন্ত কেহ পিয়াজ ব্যবহার করিতে সঙ্কোচ বোধ করে না, সেকালে সেরূপ ছিল না। পিয়াজ খাওয়া হয় ইহা লোকে যাহাতে টের না পায়, এমত উপায় অবলম্বন করা হইত। যেদিন আনন্দ বাবুর সহধর্ম্মিণীকে মাংসে পিয়াজ দিতে হইত সেদিন আনন্দ বাবু রামনারায়ণ বাবুকে বলিতেন যে আজ তোমার মাকে মাংসে (Cepa) দিতে বলিয়া আইস। সিপা শব্দ লাটিন ভাষায় পিয়াজ বুঝায়। লাটিন ভাষায় ঐ শব্দ পিয়াজ বুঝায় রামনারায়ণ বাবু লাটিন অভিধান খুঁজিয়া তাঁহার পিতাকে বলিয়া দিয়াছিলেন। আমরা উপরে উল্লিখিত মুন্সী উজীর আলি বিষয়ে দুই একটা গল্প বলিয়া আনন্দ বাবুর বৃত্তান্ত সমাপন করিব। রামনারায়ণ বাবু, তাঁহার পিতার মৃত্যুর পর দিনকয়েক সংস্কৃত কালেজের দ্বিতীয় ইংরাজী শিক্ষকের কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। একদিন পড়াইতেছেন এমন সময়ে মুন্সী সাহেব আসিয়া উপস্থিত। তিনি গোপনে রামনারায়ণ বাবুকে ডাকিয়া বলিলেন, “আমি কানপুর যাইতেছি, আর কলিকাতায় আসিব না। আমি তোমাকে তোমার পিতার হস্তে লিখিত মুরগির ডিমের আদেশের কতকগুলি চিরকূট দেখাইয়া কিছু টাকা ঠকাইয়া লইয়াছি তাহা আমাকে ক্ষমা করিবে। শেষ বিচারের দিন আমাকে ঈশ্বর দোষী বলিয়া গণ্য না করেন, এই জন্য তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি।” মুন্সীসাহেব বিবেকের দংশনজ্বালা হইতে মুক্তি পাইবার জন্য এইরূপ ক্ষমা প্রার্থনা করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। যাহাদিগের চিত্ত ক্রমাগত কুকর্ম্ম করা জন্য কঠিন না হইয়াছে তাহারা এ জ্বালা হইতে কখন নিষ্কৃতি পায় না। মুন্সী সাহেব একদিন রামনারায়ণ বাবুকে বলিয়াছিলেন “অদ্য রাস্তায় আসিবার সময় একজন ব্যক্তিকে ‘দুঃখে গেল কাল চিরদিন,’ এই গান গাইতে শুনিলাম, এই গানটী আমার অবস্থা ঠিক বর্ণনা করিতেছে।” মুন্সী সাহেব! ঐ গানটী কেবল তোমাতে খাটে এমন নহে, পৃথিবীর অনেক লোকের প্রতিই খাটে।