গ্রাম্য উপাখ্যান/মধুসূদন বসু
মধুসূদন বসু।
রামসুন্দর বসুর দুই সংসার। তাঁহার জ্যেষ্ঠা পত্নীর গর্ভে মধুসূদন বসু জন্ম গ্রহণ করেন। মধুসূদন বসু পাঠকবর্গের পরিচিত রামনারায়ণ বাবুর জেঠা। রামনারায়ণ বাবু যখন নিতান্ত বালক তখন মধুসূদন বসু তাঁহাকে হাঁটুর উপর বসাইয়া “মা নিষাদ” এই প্রয়োগাদ্য শ্লোক অভ্যাস করাইতেন। সে কালে বালকদিগকে সংস্কৃত শ্লোক অভ্যাস করাইবার রীতি ছিল। বাপ খুড়ো জেঠা প্রভৃতি গুরুজনেরা তাহাদিগকে ঐ সকল শ্লোক অভ্যাস করাইতেন। যে শ্লোকের আদিতে “মা নিষাদ” আছে সেই চিরবিখ্যাত শ্লোক সর্ব্বপ্রথমে মুখস্থ করাইতেন। এ রীতিটা কেন উঠিয়া গেল আমরা বুঝিতে পারি না। যে শ্লোকটী সংস্কৃত ইতিহাস পুরাণ ও উপপুরাণের ভিত্তি স্বরূপ, যে সকল অনুষ্টপ শ্লোক দ্বারা সংস্কৃত সাহিত্যরূপ বৃহৎ ও সুশোভন অট্টালিকার অধিকাংশ বিরচিত, তাহার মধ্যে যেটী সর্ব্বপ্রথম রচিত হয়, যাহা রামায়ণে ঐ ছন্দের অন্যান্য শ্লোকের মধ্যে পবিত্র স্বভাব মহর্ষি বাল্মীকির পবিত্র রসনা হইতে দেব প্রেরণা প্রভাবে প্রথমে বিনিঃসৃত হইয়া নিজ শ্লোক রচয়িতাকেও বিস্মিত করিয়াছিল, যে ছন্দের শ্লোকে অবনীমণ্ডল পবিত্রকারী পুণ্য গাথা রামায়ণ বিরচিত, যে শ্লোক জীবের প্রতি কারুণ্যরসের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শক, সে শ্লোক যদি অগ্রে বালকদিগকে কণ্ঠস্থ করান উচিত না হয়, তবে কোন শ্লোক করান উচিত? রোগের সময়ে খই খাইবার প্রথা যেমন বিনা কারণে উঠিয়া গিয়া সাগু খাইবার প্রথা প্রচলিত হইয়াছে, তেমনি বিনা কারণে “মা নিষাদ” কণ্ঠস্থ করাইবার রীতি উঠিয়া গিয়াছে। খই অতি শুভ্র পবিত্র লঘুপাক দ্রব্য, তাহাকে তাড়াইয়া দিয়া সাগু তাহার স্থান কেন অধিকার করিল তাহা আমরা বুঝিতে পারি না। সেই “মা নিষাদ” বালকদিগকে কণ্ঠস্থ করাইবার রীতি কেন উঠিয়া গেল বুঝিতে পারি না। “মা নিষাদ” প্রয়োগাদ্য শ্লোকটী হিন্দুজাতির একটী কীর্ত্তিস্তম্ভ ও উচ্চ জাতীয় স্বভাবের মহত্ত্বের পরিচায়ক। সেই শ্লোক কণ্ঠস্থ না করান পরিতাপের বিষয় সন্দেহ নাই। প্রাচীন কালে গ্রীসদেশের লোকেরা যেমন থিওগিনস্ (Theoginus) কবি রচিত নীতিসূত্র বালকদিগকে অভ্যাস করাইত তেমনি সে কালে আমাদিগের দেশে গুরুজনেরা বালকদিগকে চাণক্য শ্লোক অভ্যাস করাইতেন। মধুসূদন বসুজা মহাশয় রামনারায়ণ বাবুকে হাঁটুর উপর বসাইয়া চাণক্যের শ্লোকও অভ্যাস করাইতেন। বালকদিগকে হিতোপদেশগর্ভ কবিতা অভ্যাস করান অতি উত্তম রীতি। দেখা যায় মনুষ্যের বিদ্যালয় পরিত্যাগের পর সংসার পথে বিচরণ করিবার সময় তাঁহার বিদ্যালয়ে কণ্ঠস্থ করা পদ্যময় হিতোপদেশ অনেক সময়ে তাঁহার সাংসারিক কার্য্য নিয়মিত করে। চাণক্য শ্লোকে অনেক হিতোপদেশ আছে। বালকদিগকে তাহা অভ্যাস করান উত্তম রীতি বলিতে হইবেক। বালকদিগকে তাহা অভ্যাস করাইবার রীতি কেন উঠিয়া গেল তাহা আমরা বুঝিতে পারি না। নিদান পক্ষে বাঙ্গালা ভাষায় ঐ প্রকার নীতিসূত্র বিরচিত হইবার পূর্ব্বে ঐ রীতি উঠাইয়া দেওয়া ভাল কায হয় নাই। মধুসূদন বসু সে কালের রীত্যনুসারে রামনারায়ণ বাবুকে ইংরাজী শব্দের মর্ম্মও অভ্যাস করাইতেন যথা, গড, ঈশ্বর; লার্ড ঈশ্বর; আই, আমি; ইউ, তুমি; গো, যাও; কম, আইস। সে কালে বালকদিগকে ইংরাজী শব্দের অর্থ শিখাইবার সময় গুরুজনেরা অনেক ভুল অর্থ শিখাইতেন; যথা, Plum, কুল; Apple, আতা; Wood-apple,বেল; Blackberry, কালজাম; Thrush, ছাতারে পক্ষী; Nightingale, বুলবুল; Can, বাটি; Basin, কড়া; Dish, রেকাব। অন্য দেশের পদার্থ সকল আমাদিগের দেশীয় সেই জাতীয় পদার্থের ন্যায় অবিকল ঠিক নহে, অতএব সেই সকল পদার্থের তদ্দেশীয় নামের অর্থ শিখিবার সময় অনেক ভুল শিখিবার সম্ভাবনা। ইহা বিদেশীয় ভাষা শিক্ষা সংঘটিত একটি বিষম অসুবিধা বলিতে হইবে। আমরা উচ্চ শিক্ষার অতিশয় পক্ষপাতী। আমাদিগের এই বিশ্বাস যে উচ্চশিক্ষা রহিত হইলে দেশের বহুল অনিষ্ট সাধিত হইবে, তথাপি আমরা ইংরাজী শিক্ষার দোষের প্রতি অন্ধ নহি। ইংরাজী ভাষা অতি শ্রুতিকটু। ইংরাজী ভাষা ইংরাজী পরিচ্ছদের ন্যায় কঠোর। ইংরাজেরা তাঁহাদিগের খোদিত পাষাণময় মূর্ত্তিকে হ্যাট কোট কখন পরান না। সেই সকল মূর্ত্তিকে এক প্রকার ঢলঢলে পোষাক পরাইয়া দেন। অতএব ইংরাজেরা যে আপনাদিগের পরিচ্ছদকে কঠোর পরিচ্ছদ জ্ঞান করেন তাহা এতদ্দ্বারা প্রমাণিত হইতেছে। তাহাদিগের পরিচ্ছদ যেমন কঠোর ভাষাও তেমনি কঠোর। ইংরাজীর ন্যায় শ্রুতিকটু ভাষা আমাদিগকে পড়িতে হয়, ইহা সুখদায়ক কার্য্য বলা যাইতে পারে না। ইংরাজীতে উচ্চারণের কোন নিয়ম নাই। Cholmondeley শব্দ ঠিক বানান অনুসারে উচ্চারণ করিতে গেলে “চলমণ্ডলি” হয়,কিন্তু উহার প্রকৃত উচ্চারণ চমলি। St. Omar বানান অনুসারে উচ্চারণ করিতে হইলে সেণ্ট ওমার হয়, কিন্তু উহার প্রকৃত উচ্চারণ “সামার”। “Yacht” শব্দ ঠিক বানান অনুসারে উচ্চারণ করিতে গেলে ইয়াচট্ হয়, কিন্তু উচ্চারণ ইয়ট্। ইংরাজী উচ্চারণের এত গোলমাল যে ইংরাজী শিক্ষার্থীদিগের আত্মহত্যা করিতে ইচ্ছা হয়। পূর্ব্ব জন্মের অনেক পাপ না থাকিলে আমাদিগকে এরূপ ভাষা পাঠ করিতে বাধ্য হইতে হইত না। ইংরাজী প্রথম শিখিবার সময় ইংরাজী অনেক শব্দের প্রকৃত অর্থ সম্যকরূপে বালকগণ বুঝিতে সক্ষম হয় না। যখন বয়স বৃদ্ধি হয় তখন সেই সকল শব্দের প্রকৃত অর্থ তাহাদিগের মনে প্রতিভাত হয়। এই সকল অসুবিধা ব্যতীত ইংরাজী শিক্ষার অন্যান্য অসুবিধা আছে। মনে কর একজন পাঁচ বছর বয়সের সময় ইংরাজী পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, এক্ষণে তাঁহার বয়স ষাট বৎসর। পঞ্চান্ন বৎসর ইংরাজী পড়িয়াও কোন কোন প্রয়োগ ব্যবহার করিবার সময় সে প্রয়োগ ইংরাজী রীতিসম্মত কি না সে বিষয়ে তাঁহার সন্দেহ উপস্থিত হয়। ইহা কম বিড়ম্বনা নহে। ইহার উপর আবার আমাদিগের দুরাকাঙ্ক্ষা যে ইংরাজের ন্যায় ইংরাজী ভাষা কহিতে ও লিখিতে পারিব। ইংরাজের ন্যায় ইংরাজী কহিতে ও লিখিতে পারিবার জন্য আমরা কত কষ্ট স্বীকার না করি। কেন রে বাপু! কি দায় পড়িয়া গিয়াছে? কিন্তু না করিলেও নয়। আমাদিগের কোন বন্ধু ইংরাজী বিলক্ষণ জানেন, তথাপি তাঁহার কখন কখন ইংরাজী উচ্চারণ করিবার বা লিখিবার সময় ভুল হয়। তাঁহার কোন ইংরাজ বন্ধু সেই ভুল ধরিলে তিনি তাহাতে লজ্জিত না হইয়া অম্লানবদনে বলেন, “It is a language foreign to me.” এ বিষয়ে তাঁহার নির্লজ্জতা দেখিয়া আমরা বিস্মিত হই। ইংরাজী ভাষা সামান্যরূপে আয়ত্ত করিতে প্রায় আমাদিগের বিশ বৎসর লাগে। একটা ভাষা সামান্যরূপে শিখিতে বিশ বৎসর! কি ভয়ানক কথা! বাঙ্গালী সচরাচর হদ্দ চল্লিশ বৎসর বাঁচে। তাহার অর্দ্ধেক জীবন যদি একটা বিদেশীয় ভাষা শিখিতে গেল, তবে আর কি হইল? আমাদিগের মাতৃভাষা যদি সেরূপ সম্পন্নশালিনী হইত তাহা হইলে এই বিশ বৎসরে কেবল সেই ভাষার পুস্তক পাঠ করিলে আমরা কতই শিখিতাম তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। এতদ্ব্যতীত যখন বিবেচনা করা যায় যে ইংরাজী ভাষা অধ্যয়ন জন্য আমরা শারীরিক স্বাস্থ্য নষ্ট করিয়া চিররোগী হইয়া পড়িতেছি, তখন ইংরাজী ভাষার শিক্ষার প্রতি বিশেষ বিরাগ জন্মে। ইংরাজী ভাষায় সম্পাদিত এ দেশীয় কোন সংবাদপত্র সম্পাদক বলিয়াছেন;—
“Why and how it is we know not, but it is a fact, that with his Mohabharat and Subhunkar, his coarse Dhuti and clumsy slippers, the old venerable looking Brahmin of Bhatpara was a healthy, strong and stout specimen of humanity, but the modern Baboo with his Shakespeare and Milton, his china-coat and tight boots his Municipality and Bahadurship, is a sorry, shrunken creature, a fit illustration of dyspepsia, whose income only goes to fatten the doctor and the druggist. The Nuddea Pandit in days gone by used to eat voraciously both smriti and luchis, doing justice to both and proving beyond a doubt that his stomach was as capacious as his brain and his muscles as vigorous as his intellect. But look at those Lilliputian bipeds, crawling out of the Senate-house after passing matriculation examination, looking as if they had meant to go to the adjoining Hospital, but had by mistake entered the Senate house. The greater the civilization and academic culture, the more emaciated and sickly looks the product of our university.”[১]
“কেন এবং কি কারণে এইরূপ হইয়াছে আমরা বলিতে পারি না। কিন্তু কেহই অস্বীকার করিবেন না। যে সে কালের মহাভারত ও শুভঙ্কর অধ্যায়ী, মোটা ধুতি ও ধূলিপূর্ণ চটিজুতা পরিধায়ী, ভাটপাড়ার শ্রদ্ধাভাজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ সুস্থকায়, দ্রড়িষ্ঠ ও বলিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু আজকালের সেক্সপিয়ার ও মিলটন অধ্যায়ী, চায়নাকোট ও বুট পরিধায়ী, মিউনিসিপাল ওয়ালা, বাহাদুর উপাধিধারী বাবুরা অতি অপদার্থ জীব, দেখিতে কৃশকায়, এক একজন যেন অজীর্ণতার অবতার, তাঁহাদের যাহা কিছু আয় হয় তাহা ডাক্তার ও ঔষধ বিক্রেতার উদর পূরণে ব্যয়িত হয়। সে কালের নদীয়ার পণ্ডিতেরা যেমন প্রচুর পরিমাণে স্মৃতি আহার করিতে পারিতেন, তেমনি রাশিকৃত লুচিও খাইতে পারিতেন। উভয়েরই প্রতি তাঁহারা সমান সুবিচার করিতেন। ইহা দ্বারা নিঃসংশয়িতরূপে প্রমাণিত হয় যে তাহাদের উদরটী যেমন ফলাও, মস্তিষ্কও তেমন প্রশস্ত ছিল, এবং তাঁহাদের শরীর যেমন বলিষ্ঠ, বুদ্ধিশক্তিও তেমনি তেজস্বী ছিল। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়া সেনেট হাউস হইতে ঐ যে লিলিপট্বাসীদিগের ন্যায় খর্ব্বকায় দ্বিপদ জীবগুলি বাহির হইয়া আসিতেছে উহাদিগের প্রতি একবার চাহিয়া দেখ। উহাদিগকে দেখিলে বোধ হয় যেন উহারা পার্শ্বস্থ হাঁসপাতালে যাইবার মনস্থ করিয়াছিল, ভ্রমক্রমে সেনেট হাউসে প্রবেশ করিয়াছে। যতই শিক্ষা ও সভ্যতার বৃদ্ধি হইতেছে, ততই আমাদিগের বিশ্ববিদ্যালয়—প্রসূত ছাত্রগণ রুগ্ন ও কৃশতনু হইয়া যাইতেছে।”
মধুসূদন বসুজা মহাশয় উদোমাদা লোক ছিলেন। একদা তাঁহার কোন পীড়া হওয়াতে তাঁহার কোন বন্ধু তাঁহাকে বিহিদানা খাইতে বলেন। বাদল গ্রামের নিকট গড়াইগ্রামে অনেকগুলি দোকান আছে, উহা একটি গঞ্জ বিশেষ স্থান। ঐ স্থানে সপ্তাহে একটা নির্দ্দিষ্ট দিবসে হাট হইয়া থাকে। মধুসুদন বসু গড়াইয়া বেণের দোকানে বিহিদানা ক্রয় করিবার মানসে তথায় যাত্রা করিলেন, কিন্তু পথিমধ্যে বিহিদানা ভুলিয়া গেলেন, বেণের দোকানে গিয়া বিহিদানা নামটী না চাহিয়া মিহিদানা চাহিলেন। পাঠকবর্গ অবশ্যই জ্ঞাত আছেন বেণেরা কোন খোদ্দেরকে ফিরায় না। কোন ঔষধের দ্রব্য না থাকিলেও অন্য কোন দ্রব্য সেই দ্রব্য বলিয়া দেয়। মিহিদানা বলতে বেণিয়া তাহাকে অতি সূক্ষ্ম এক প্রকার দানা দিল। বসুজা মহাশয় তাহাই লইয়া আসিলেন, কিন্তু তাঁহার যে বন্ধু বিহিদানা ব্যবস্থা করিয়াছিলেন তিনি তাঁহাকে উহা খাইতে নিষেধ করিলেন। আমরা যে সকল ঔষধ বেণের দোকান হইতে ক্রয় করি তাহা আমাদিগের অপরিচিত থাকিলে বিলক্ষণরূপে তাহা যাচাই করিয়া লওয়া কর্ত্তব্য। তাহা না হইলে বিহিদানা পরিবর্ত্তে মিহিদানা খাইবার অনিষ্ট ভোগ করিতে হয়।
- ↑ Indian Mirror, Sunday Edition. I5th December —1878.