গ্রাম্য উপাখ্যান/রামসুন্দর বসু
রামসুন্দর বসু
রামসুন্দর বসু রাম প্রসাদ বসুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা। সে কালের রীত্যনুসারে রামপ্রসাদ বসু বিদেশে চাকরি করিতেন ও রামসুন্দর বসু বাটীতে থাকিয়া বাটীর কায দেখিতেন। ইনি অতি উদারস্বভাব ব্যক্তি ছিলেন। বাদলগ্রামবাসীর মধ্যে যাঁহারা কলিকাতায় চাকরী করিতেন তাঁহাদিগের মধ্যে যাহার নূতন বাটী নির্ম্মাণ অথবা পুষ্করিণী খনন আবশ্যক হইত তিনি তাহার তত্ত্বাবধানের ভার রামসুন্দর বসুর প্রতি অর্পণ করিতেন। রামসুন্দর বসু গ্রীষ্ম কালে প্রচণ্ড রৌদ্রের সময় মধ্যমনারায়ণ তৈল বুকে লাগাইয়া ঐ প্রকার কার্য্যে নিযুক্ত মজুরদিগকে খাটাইতেন। তাঁহার ধাতু স্বভাবতঃ গরম ছিল, এই জন্য তিনি উক্ত তৈল সর্ব্বদা ব্যবহার করিতেন। তাঁহার এমনি গরম ধাতু ছিল যে শীতকালে একটি ফিন্ফিনে চাদর গায়ে দিয়া শীত কাটাইতেন। তিনি বলিতেন উষ্ণ পরিচ্ছদ তাহার সহ্য হয় না। গরম ধাতুর লোক হইয়াও তিনি পরের হিতার্থে গ্রীষ্মকালে এরূপ কষ্ট স্বীকার করিতে পরাঙ্মুখ হইতেন না। তাহার একটী নিত্য কর্ম্ম ছিল, প্রত্যহ প্রাতে একটী ছাতা হাতে করিয়া প্রত্যেক বাটীর কাহার কি অভাব আছে তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতেন, তৎপরে কাহাকে চাউল, কাহাকে ডাইল, কাহাকেও বা বস্ত্র পঠাইয়া দিতেন। গ্রামস্থ লোকের ক্রিয়া কলাপে উপস্থিত থাকিয়া নিজের বাটীর কার্য্যের মত তাহার তত্ত্বাবধান করিতেন। তিনি পাণ্ডুরোগের পৈতৃক ঔষধ বিনামূল্যে বিতরণ করিতেন। ইহাতে বাটীতে অনেক রোগীর সমাগম হইত। সেই সকল রোগী যে কয়দিন বাটীতে থাকিত তিনি সে কয়দিন প্রাণপণে তাহাদিগের শুশ্রূষা করিতেন এমন কি স্বহস্তে শয্যাগত রোগীদিগের মলমূত্রাদি পরিষ্কার করিতেন। আমরা জানি এক্ষণকার অনেক ইংরাজী সভ্যতাভিমানী ব্যক্তি এই কথা শুনিয়া নাক সিঁটকাইবেন, এমন কি নিজের পিতা মাতা পীড়িত হইলে তাঁহারা তাঁহাদের এরূপ সেবা করিতে ঘৃণা বোধ করেন, কিন্তু তাঁহাদিগের আদর্শ স্থল ইংরাজ জাতির সম্ভ্রান্ত রমণীরা পর্য্যন্ত এরূপ শুশ্রূষাকে (Nursing the Sick) অতি পবিত্র কার্য্য জ্ঞান করেন। সেই সকল সভ্যতাভিমানী ব্যক্তিরা দেখুন যে সেকালের তাঁহাদিগের হিসাবে অশিক্ষিত পাড়াগেঁয়ে ব্যক্তি এ বিষয় তাঁহাদিগের অপেক্ষা কত শ্রেষ্ঠ ছিল। যদি সভ্যতা মনুষ্যহৃদয়ের এরূপ উচ্চগুণ সকলের বিলোপ সাধন করে তবে সে সভ্যতায় আবশ্যক কি? রামসুন্দর বসু অতি পুত্রবৎসল ছিলেন। তিনি নিজে স্বহস্তে পাক করিয়া পুত্রদিগকে খাওয়াইতে বিশেষ আমোদ অনুভব করিতেন। ইংরাজেরা যখন প্রথমে এই দেশ অধিকার করেন তখন পাগলা গারদ ছিল না। স্বগ্রাম হইতে গ্রামান্তরে যাইবার সময় রাস্তায় কোন ক্ষিপ্ত ব্যক্তি দেখিলে রামসুন্দর বসু তাঁহাকে ভুলাইয়া ভালাইয়া নিজ বাটীতে আনিয়া রাখিয়া দিতেন। তাঁহার এক ক্ষমতা ছিল—তিনি পাগল বড় বশ করিতে পারিতেন। এই কার্য্যে তাঁহার সৌম্যমূর্ত্তি সহকারিতা করিত। তিনি পাগল পাইলে বিশেষ আহ্লাদ অনুভব করিতেন। এক দিন তাঁহার সৌভাগ্যক্রমে তিনি একটী পাগল পাইয়াছিলেন। তাহার গা খোলা, কেবল একটী ধুতি পরা। তাহার মাথায় একটী লাল টুপি ছিল এবং তাহাতে গুটি কতক ছোট ছোট ঘুঙুর বাঁধা ছিল। সে বলিত যে “আমার পূর্ব্ব নাম রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় ছিল, এক্ষণকার নাম জন এণ্টোনিও পিডো (John Antonio Pedro) আমি লিসবোয়াতে (Lisbon) গিয়াছিলাম।” ইংরাজেরা পোর্তুগালের রাজধানীকে লিস্বন্ বলে, কিন্তু পোর্তুগালের লোকেরা লিসবোয়া বলে। বোধ হয় এই ব্যক্তি কোন পোর্তুগিজ বণিকের সঙ্গে সৌহার্দ্দ্য সংস্থাপন করিয়া তাহার জাহাজে লিসবন্ নগরে গিয়াছিল। রামমোহন রায়ের বিলাত যাইবার পূর্ব্বে কোন কোন বাঙ্গালী এইরূপে তথায় গিয়াছিলেন। ইয়োরোপীয় জাতিগণের মধ্যে পোর্তুগিজেরাই বঙ্গদেশের সহিত প্রথম বাণিজ্য সম্বন্ধ সংস্থাপন করে। কালীঘাটের পাশ দিয়া যে গঙ্গা গিয়াছে তাহাকে আদ্য গঙ্গা বলে। ঐ আদ্য গঙ্গা এক সময়ে অতি প্রশস্ত নদী ছিল। ঐ নদী দিয়া পোর্তুগিজদিগের জাহাজ আসিয়া গঙ্গায় পড়িয়া শিবপুরের কাছ দিয়া যে সরস্বতী নদী প্রবাহিত আছে এবং যাহা এক্ষণে সাঁকরাইলের খাল নামে আখ্যাত এবং আঁদুল গ্রামের নিকট দিয়া গিয়াছে তাহার মধ্য দিয়া হুগলীর নিকটস্থিত সাতগা গ্রামে যাইত, উলুবেড়িয়ার গাঙ্ দিয়া সরস্বতী নদীর মুখ পর্য্যন্ত আসিতে পারিত না, যেহেতু খিদিরপুর হইতে রাজগঞ্জ পর্য্যন্ত ভূমি ছিল। একজন ধনাঢ্য মোগল খিদিরপুর হইতে রাজগঞ্জ পর্য্যন্ত একটী খাল কাটিয়া দিয়াছিল, সেই খাল ক্রমে প্রশস্ত হইয়া উলুবেড়িয়ার গাঙের সঙ্গে গঙ্গার সংযোগ করিয়া দিয়াছে। খিদিরপুর হইতে জয়নগর মজিলপুর পর্য্যন্ত আদ্যগঙ্গার দুই পার্শ্বের গ্রামের নাম প্রাচীন পোর্তুগিজ মানচিত্রে দৃষ্ট হয়। এক্ষণে আদ্যগঙ্গা বহুল স্থানে মজিয়া গিয়াছে। কলিকাতার দক্ষিণ দেশের লোকেরা “বসু পুষ্করিণী” “ঘোষের পুষ্করিণী” নামক পুষ্করিণী সকলে গঙ্গা ধরিয়া রাখিয়াছে। গঙ্গাকে লোকে যেমন পবিত্র জ্ঞান করে সেই সকল পুষ্করিণীকে তাহারা তদনুরূপ পবিত্র জ্ঞান করে। ইংরাজের আমলের প্রথম পর্য্যন্ত পোর্তুগিজদিগের জাহাজ বাণিজ্যার্থে কলিকাতায় আসিত। কলিকাতার শেঠেরা ঐ জাহাজের কাপ্তেনের কাজ করিয়া বড় মানুষ হইয়াছিলেন। যোড়াসাঁকোর কমল বসু নামক কোন ব্যক্তি পোর্তুগিজ কাপ্তেনের কাজ করাতে তাঁহাকে ফিরিঙ্গি কমল বসু বলিয়া লোকে ডাকিত। কামরা প্রভৃতি দুই একটী পোর্তুগিজ শব্দ বাঙ্গালা ভাষায় প্রবিষ্ট হইয়াছে।
রামসুন্দর বসু উল্লিখিত রূপে নিজে গ্রামের অনেক অনেক উপকার সাধন করিয়া ইংরাজী ১৮২৪ সালে গতাসু হয়েন। ঐ শালে বঙ্গদেশে ওলাউঠায় বড় মড়ক হয়। এই মড়কের সময় বাদল গ্রামের কতকগুলি ষণ্ডার প্রত্যহ খিচুড়ি ও পাঁঠা খাইবার ধুম লাগিয়াছিল। সে সকল ষণ্ডারা অক্ষতশরীরে মড়ক হইতে অব্যাহতি পাইয়াছিল। আর যাহারা পরিমিতাহারী ছিল তাহাদিগের মধ্যে অনেকে কালগ্রাসে পতিত হইল। কিন্তু তাহাদিগের ন্যায় ডাংপিঠে লোকের দৃষ্টান্ত সাধারণের অনুকরণীয় হইতে পারে না। রামসুন্দর বসু আহারের বিষয়ে অতি সাবধান ছিলেন। দুই বেলা মুগের ডাল ও মাছের ঝোল ব্যতীত তাঁহার অন্য কোন আহারীয় বস্তু সহ্য হইত না। গ্রামে ওলাউঠার মড়ক দুই এক মাস স্থগিত হইয়াছে এমন সময়ে বৃদ্ধের কিরূপ কুমতি গেল, তিনি অল্প পরিমাণে অরহর দাল ও কঁকড়া খাইলেন; তাহাতেই তাঁহার ঐ রোগের উৎপত্তি হইয়া তাঁহার মৃত্যু হয়। তিনি মরিবার সময় এই উপদেশ দিয়াছিলেন;- “আমাদিগের বংশে কেহ যেন অরহর দাল ও কাঁকড়া না খায়।” কিন্তু রামসুন্দর বসুর পৌত্ত্র ভূতপূর্ব্ব হিন্দু কলেজের ছাত্র রামনারায়ণ বসু বাল্যকালে আমাদিগের সঙ্গে পুষ্করিণী হইতে দশরথ ধরিয়া তাহা পোড়াইয়া তাহাতে নুন তেল মাখিয়া খাইয়া তাঁহার পিতামহের আদেশ কতবার লঙ্ঘন করিয়া বৃদ্ধের প্রেতাত্মাকে কষ্ট দিয়াছেন তাহা বলা যায় না। রামসুন্দর বসু ভগবদ্গীতা বাঙ্গলা গদ্যে অনুবাদ করেন। সংস্কৃত মূল সহ সেই অনুবাদ রামনারায়ণ বাবুর নিকট এখনও আছে। ইংরাজেরা যেমন বাইবেলে আপনার সন্তানদিগের জন্মদিবস লিখিয়া রাখেন, তিনি সেইরূপ ঐ ভগবদ্গীতাতে আপনার সন্তানদিগের জন্মদিবস লিখিয়া রাখিয়াছেন। রামপ্রসাদ বসু ও রামসুন্দর বসুর নাম এখন পর্য্যন্ত বাদল গ্রামে অতি প্রসিদ্ধ। বাদল গ্রামের লোকে ঐ দুই জনকে প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি জ্ঞান করে।