গ্রাম্য উপাখ্যান/রামপ্রসাদ বসু
রামপ্রসাদ বসু।
রামপ্রসাদ বসু শুকদেব বসুর জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি ঢাকার পরমিটের দেওয়ান ছিলেন। ঢাকার বস্ত্র বাণিজ্য নষ্ট হইয়া মেঞ্চেষ্টারের কাপড় যাহাতে অধিক বিক্রীত হয় এই অভিপ্রায়ে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ঢাকায় পরমিট বসাইয়াছিলেন। ফাঁসুড়ে যেমন গলায় ফাঁস দিয়া লোককে হত্যা করে তাহারা ঐরূপ পরমিট বসাইয়া ঢাকাই কাপড়ের বাণিজ্যের শ্বাসরুদ্ধ করিয়া তাহাকে মারিয়া ফেলিয়া ছিলেন। যে ঢাকা প্রাচীন রোমকদিগকে স্বীয় অতুল্য বস্ত্র জোগাইয়াছিল, যাহার বস্ত্র লইয়া যাইবার জন্য রোমক জাহাজ ঢাকায় আসিয়া লাগিত, যে বস্তু পারিস নগরে ধনশালিনী বিলাসিনী রমণীদিগের লোভের বস্তু ছিল, যাহার শিশির সম সূক্ষ্মতা সমস্ত জগতে প্রসিদ্ধ ছিল, ঢাকার সেই গৌরব উক্ত পরমিট দ্বারা একেবারে বিনষ্ট হইয়াছিল। রাম প্রসাদ বসু এই পরমিটের দেওয়ান ছিলেন। তিনি বেতনভুক্ চাকর ছিলেন মাত্র, ঢাকাই বস্ত্রবাণিজ্য নাশের কলঙ্ক তাঁহাকে স্পর্শিতে পারে না। রামপ্রসাদ বসু যাহা উপার্জ্জন করিতেন তাহা সমস্তই দান ধ্যানে ব্যয় করিতেন। বাদলগ্রামের ব্রাহ্মণেরা ঢাকায় গিয়া তাঁহার নিকট হইতে বিলক্ষণ হাত মারিয়া লইয়া আসিতেন। রামপ্রসাদ বসু স্বর্ণদানে অধিক পুণ্য আছে শাস্ত্রীয় এই বাক্যানুসারে বাহ্মণদিগকে স্বর্ণ অর্থাৎ মোহর দান করিতে বড় ভাল বাসিতেন। খড়ো বাড়ী; স্ত্রীর হাতে রূপার পৈচে, কিন্তু প্রত্যহ বাদলগ্রামের বাটীতে ও ঢাকার বাসায় অনেক লোককে অন্নদান করা হইত। যাহাতে কেবল বাড়ীর লোকে ঘি না খাইয়া সকল লোকে ঘি খাইতে পারে এই জন্য পাক করা রাশীকৃত অন্নের উপর একেবারে ঘি ঢালিয়া দেওয়া হইত। সে কালের লোকের বদান্যতা অপরিমিত আকার ধারণ করিত, এবং পাত্রাপত্র বিবেচনা করিয়া নিয়োজিত হইত না বটে তথাপি তাহা যে তাঁহাদিগের ঔদার্য্য প্রকাশ করে তাহার সন্দেহ নাই। রামপ্রসাদ বসুর দেওয়ান হইবার অনেক অগ্রে ঢাকার পরমিট সংস্থাপিত হইয়াছিল। তাঁহার সময়ে তদ্দ্বারা গবর্ণমেণ্টের উপরে বর্ণিত অভিপ্রায় সংসাধিত হইলে তাহা উঠাইয়া দেওয়া হয়। পরমিট উঠিয়া গেলে কর্ম্ম যাওয়াতে রামপ্রসাদ বসু বাটীতে বসিয়া থাকিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। কর্ম্ম যাইবার পর তিনি যখন বাদলগ্রামের বাটীতে থাকিতেন তখন সর্ব্বদাই ঢিলে পাজামা, মেরজাই ও কাবা পরিয়া বসিয়া থাকিতেন। এক্ষণে যেমন ইংরাজী আচার ব্যবহার ও পরিচ্ছদের অনুকরণ প্রবল, সে কালে সেইরূপ মুসলমানদিগের আচার ব্যবহার ও পরিচ্ছদের অনুকরণ প্রবল ছিল। তখন ঢিলা পাজামা, মেরাজাই ও কাবা ব্যবহারের রীতি প্রচলিত ছিল। ঠিক মুসলমান প্রণালীতে প্রস্তুত আহার্য্য বস্তু আহার করা রীতি ও প্রচলিত ছিল। বড় মানুষদিগের পাকশালার ঘরের দ্বারে একজন দেড়ে অভিজ্ঞ বাবুর্চি টুলের উপর উপবিষ্ট থাকিয়া ঘরের অভ্যন্তরস্থ ব্রাহ্মণ পাচককে পোলাও, কালিয়া, কাবাব, দম্পোক্ত প্রভৃতি কি প্রকারে প্রস্তুত করিতে হয় তাহা বলিয়া দিত। রামপ্রসাদ বসুর মুসলমানী পরিচ্ছদের অনুকরণ তাঁহার স্বগ্রামবাসীদিগের ভাল লাগিত ন। যেমন অন্য সময়ে তেমনি এই সময়েও বাদলগ্রামে দলাদলির বিলক্ষণ প্রাদুর্ভাব ছিল। তাঁহার স্বগ্রামবাসী কোন ব্যক্তি তাঁহাকে বলিয়াছিলেন “আপনি মুসলমানী পোষাক পরিয়া হিন্দুসমাজের দলাদলি করিবেন তাহা হইতে পারে না, ঢিলে পাজামা ছাড়ুন।” রামপ্রসাদ বসু বিলক্ষণ সাহসী ছিলেন। একবার বাদলগ্রামে বাঘ আইসে। তিনি ও গ্রামের একজন নাপিত দুই জনে লাঠি হাতে করিয়া ঐ বাঘ মারিতে যান। কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য্য হয়েন নাই। বাঘ তাহার পিঠে এক থাবা মারে তাহাতে ঘা হয়। সেই ঘায়ে রামপ্রসাদ বসু ছয় মাস কষ্ট পান এবং বাঘের ঘায়ের যে কুৎসিত ঔষধ প্রসিদ্ধ আছে তাহা লাগাইতেন। পাঠক দেখুন এক্ষণকার লোকে একটা শ্যাল তাড়াইতে সক্ষম হয় না। আর সে কালের লোক কেমন সাহসী ছিল। ছেলেবেলা আমাদিগের বাটীতে দেখিয়াছি লাঠি, সোটা, তলওয়ার, টাঙ্গি ঘরের দেওয়ালের উপর ঝোলান থাকিত, অস্ত্র ব্যবহার নিষেধের সঙ্গে সঙ্গে আমাদিগের জাতির যাহা কিছু বীর্য্য ছিল, তাহা আমরা হারাইতেছি। ইদানীন্তন রামপ্রসাদ বসুর বিলক্ষণ অর্থ কষ্ট হইয়াছিল। তিনি পাণ্ডুরোগের ঔষধ বিক্রয় করিতে বাধ্য হন। ঐ সময়ে পাণ্ডুরোগের ঔষধ বিক্রয়ের দরুণ টাকা মাত্র তাঁহার জীবনোপায় ছিল। এক দিন একটী মাত্র টাকা হাতে আছে এমন সময়ে গ্রামের কোন ব্রাহ্মণ আসিয়া বলিলেন, “কল্য আমাদিগের আহার হয় নাই। হাতে কিছু নাই।” তিনি বলিলেন, “আমার হাতে একটী টাকা মাত্র আছে তাহা তুমি লইয়া যাও।” ব্রাহ্মণ তাহা লইতে কোন মতে সন্মত হইলেন না। তিনি জোর করিয়া তাঁহাকে সেই টাকাটী দিলেন। কিন্তু বলিয়া দিলেন, “ছোট গিন্নি (তাহার দ্বিতীয় স্ত্রী) যাহাতে তাহা টের না পান এমন করিয়া লইয়া যাও। সে জানিতে পারিলে আমাকে গালি দিয়া ভূত ছাড়া করিবে। আমার নিজের জন্য কোন ভাবনা করি না, ঈশ্বর আছেন।” এই স্বার্থপরতাপূর্ণ ধর্ম্মশূন্য সভ্যতার কালে এরূপ দানশক্তি ও ঈশ্বরের প্রতি নির্ভর ভাব কয়টা লোকে প্রকাশ করিতে সক্ষম হয়? রামপ্রসাদ বসু কলিকাতার এক জন ধনাঢ্য ব্যক্তির চিকিৎসা করিয়াছিলেন, কয়েক ঘণ্টা পরে তাহার হরকরা আসিয়া তাঁহাকে ষোলটী টাকা দিয়া গেল। আমাদিগের দেশে যাঁহারা ধর্ম্ম-সমাজ ও রাজনীতিসংস্কার-কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেছেন তাঁহাদিগের সন্ন্যাসী হওয়া কর্ত্তব্য, অর্থাৎ জীবনোপায় জন্য ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করা কর্ত্তব্য। নানকের আদি গ্রন্থে একটী কবিতা আছে। তাহা এক্ষণে আমাদিগের সম্পূর্ণরূপে স্মরণ হইতেছে না, তাহার প্রারম্ভে এই কয়েকটা কথা আছে, “কাহারে মন বিতয়ে উদম্।” ঐ কবিতার অর্থ এই যে “কেন হে মন! উপজীবিকা জন্য উদ্বিগ্ন হইতেছ। এই সকল জন্তুদিগকে কে আহার পান দিতেছেন? তাঁহার প্রতি নির্ভর কর।” এ বিষয়ে মহাত্মা খ্রীষ্টের উপদেশ প্রসিদ্ধই আছে। যাহারা ঈশ্বরের প্রতি নির্ভর করেন ঈশ্বর তাঁহাদিগকে আহার হইতে বঞ্চিত করেন না। আমরা একটী প্রকৃত ধার্ম্মিক বাঙ্গালী পাদ্রীর কথা জানি। তিনি খ্রীষ্টীয় প্রচার-সভা হইতে অতি অল্পই বেতন পান, অর্থকষ্ট বিলক্ষণ কিন্তু তিনি তাঁহার বন্ধুদিগকে বলেন যে যখনই তাঁহার নিতান্ত অর্থকষ্ট উপস্থিত হয় তখনই বিলাত হইতে কোন সাহেবের নিকট হইতে তাঁহার জন্য হুণ্ডি সম্বলিত পত্র আইসে। এইরূপ শত শত দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পাৱে। ভারতবর্ষের জন্য এক্ষণে উপরে উল্লিখিত কতক– গুলি ত্যাগাস্বীকারকারী ঈশ্বরনিষ্ঠ ধর্ম্ম প্রচারকারী সন্ন্যাসী, সমাজ-সংস্কারক সন্ন্যাসী ও রাজনৈতিক সন্ন্যাসী আবশ্যক হইয়াছে। ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা তিনি এই অভাব শীঘ্র দূর করুন।