হরিহর বসু।

 হরিহর বসু আনন্দ কিশোর বসুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা। আনন্দ কিশোর বসু অধিকাংশ জীবন নগরে যাপন করিয়াছিলেন, মধ্যে মধ্যে বাদল গ্রামে আসিতেন মাত্র। কিন্তু হরিহর বসু সমস্ত জীবন পল্লীগ্রামে কাটাইয়াছিলেন। বাল্যকালে কখন কখন নগরে আসিতেন। আমাদিগের লিখিবার বিষয় গ্রাম্য ব্যাপার ও ঘটনা। কিন্তু আনন্দ কিশোর বাবুর বেলায় আমরা নাগরিক ব্যাপার ও ঘটনা বিবৃত করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। আমরা এক্ষণে ধর্ম্মসংস্কার, সমাজসংস্কার, খানা খাওয়া মদ খাওয়া ইত্যাদি বিপ্লাবক ব্যাপার পরিত্যাগ করিয়া এমন এক ব্যক্তির জীবনবৃত্ত লিখিতে প্রবৃত্ত হইতেছি যিনি শান্ত ভাবে শাস্ত্র চর্চ্চায়, পরোপকারে, তাঁহার সমস্ত জীবন অতিবাহিত করিয়া ছিলেন। আমরা এক্ষণে কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া প্রান্তর, উপবন ও উদ্যান মধ্যে সংস্থিত পল্লীগ্রামে প্রত্যাগমন করিলাম। হরিহর বসু বাল্যকালে অতি অল্পই ইংরাজী পড়িয়াছিলেন। কিন্তু সংস্কৃত উহার মধ্যে উত্তমরূপে শিখিয়াছিলেন। আমরা পূর্ব্বে অন্য এক ব্যক্তির জীবন চরিতে উল্লেখ করিয়াছি যে হরিহর বসু নবযৌবন সময়ে রামমোহন রায়ের গ্রন্থ পড়িয়াছিলেন, কিন্তু তাহা তাঁহার ধর্ম্মবিষয়ক মত বিশেষরূপে বিচলিত করিতে পারে নাই। হরিহর বসুর যখন তেইশ বৎসর বয়ঃক্রম তখন তিনি বায়ু অর্থাৎ স্নায়ুদৌর্ব্বল্য রোগ কর্ত্তৃক আক্রান্ত হয়েন। তদবধি তাঁহার মৃত্যুকাল চৌষট্টি বৎসর বয়স পর্য্যন্ত তিনি আদৌ কলিকাতায় আসেন নাই। ইংরাজী ১৮৬৭ শালে তাঁহার মৃত্যু হয়।। তিনি বাল্যকালে কলিকাতা যেরূপ দেখিয়াছিলেন তাহা অপেক্ষা তাঁহার মৃত্যুকালে নগরের যে কত শোভা ও উন্নতি সাধিত হইয়াছিল তাহা বলা যায় না, কিন্তু তিনি সে সকল উন্নতি কখন চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেন নাই, বাদল গ্রামে চিরকাল কাটাইয়াছিলেন। স্নায়ুদৌর্ব্বল্য প্রযুক্ত তিনি পালকী চড়িতে পারিতেন না। পালকীর নাড়া চাড়াতে তাঁহার এমনি কষ্ট হইত যে তিনি তাহাতে মৃত্যুযাতনা বোধ করিতেন। তিনি আয়ুর্ব্বেদ শাস্ত্র বিলক্ষণ অবগত ছিলেন। তিনি গ্রামে চিকিৎসা করিয়া বেড়াইতেন, কিন্তু কাহার নিকট হইতে কিছু লইতেন না। একদা গড়াই গ্রামে একটী রোগী দেখিতে তাঁহাকে পালকী করিয়া তথায় যাইতে হইয়াছিল। পালকীর নাড়া চাড়ায় তিনি রাস্তায় এমনি কষ্ট অনুভব করিয়াছিলেন যে গড়াই গ্রামে পৌঁছিয়া স্নান করিয়া, ডাব খাইয়া ধড়ে প্রাণ আসিল এমন বোধ করিলেন! তেইশ বৎসর বয়ঃক্রম সময়ে যখন তাঁহার বায়ুরোগ উপস্থিত হয়, তখন বাটীমধ্যে ও গ্রাম মধ্যে হুলস্থূল পড়িয়া গেল। মহাযোগেন্দ্র রস ঔষধ, মধ্যম নারায়ণ তৈল, মিছরির পানা, চিনির পানা, পেঁপে, ডাবের নেয়াপাতি, তালের ফোঁফল, রুইমাছের মুড়ো প্রভৃতি বায়ু রোগের সেবার জন্য যত উপকরণ আবশ্যক তাহা আহরণে বাটীর সমস্ত লোক ও গ্রামের বন্ধুবান্ধব প্রবৃত্ত হইলেন। বায়ুরোগ নিবন্ধন তিনি একাকী থাকিতে পারিতেন না, গ্রামের লোকে পালা করিয়া দিন রাত তাহার নিকট বসিয়া থাকিয়া তাঁহার সহিত গল্প করিত। পুষ্করিণীতে কাহার জালে বৃহৎ রুই মাছ পড়িলে তাহা তাঁহাকে আনিয়া দিত। সেকালে পল্লীগ্রামে এখন অপেক্ষা পরস্পর সহানুভূতি অধিক ছিল। চৈতন্য–চরিতামৃতে লেখা আছে,“দেবসম্বন্ধ হতে গ্রাম সম্বন্ধ সাঁচা।” ইংরাজী সভ্যতা ও জিনিস পত্রের দুর্ম্মূল্যতা প্রভাবে স্বার্থপরতা বৃদ্ধি জন্য উক্ত গ্রাম্য সহানুভূতি ক্রমে হ্রাস হইয়া আসিতেছে। গ্রামে হরিহর বসুর বিলক্ষণ আধিপত্য ছিল। সে আধিপত্যের দুইটী কারণ ছিল। প্রথম কারণ, তাহার অসংখ্য সংস্কৃত শ্লোক মুখস্ত ছিল; দ্বিতীয় কারণ, তিনি আয়ুর্ব্বেদ জানিতেন এবং অর্থ না লইয়া লোকের চিকিৎসা করিতেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাম নারায়ণ বাবু আমাদিগকে বলেন যে তাঁহার খুড়া মহাশয় তাঁহাকে অনেক সংস্কৃত শ্লোক মুখস্থ করাইয়া ছিলেন, তাহার মধ্যে দুই চারিটি এস্থলে উদ্ধৃত করা যাইতেছে;—

ধনাগামো নিত্যং আরোগিতাচ প্রিয়াচ ভার্য্যা প্রিয়বাদিনী চ |
বশস্য পুত্র অর্থকরী চ বিদ্যা ষটজীবলোকেষু সুখানি রাজন।
বিনা ধনেন সংসারঃ নয়নেন বিনা বপুর্ধীয়া
বিনা বৃথা জন্ম বিনা কৃষ্ণেণ জীবতু॥

 রাম নারায়ণ বাবু বলেন যে তাঁহার খুড়া মহাশয় তাঁহাকে যে সকল শ্লোক মুখস্থ করাইয়া ছিলেন তাহার মধ্যে কোন কোন শ্লোকের তাঁহার শেষ দুই পাদ স্মরণ আছে, আবার কোন কোন শ্লোকের শেষ পাদমাত্র স্মরণ আছে। প্রথমোক্ত প্রকার শ্লোকের দৃষ্টান্ত;

আকর্ণয়ন্তি কিল কোকিলকুজিতানি সন্ধ্যা
তুমেবনিজসপ্তনলিং কিরাতাঃ॥

শেষোক্ত প্রকার শ্লোকের দৃষ্টান্ত; কিতামারণ্যমৌষধম্।

 রাম নারায়ণ বাবু হিন্দু কালেজে পড়িবার সময় তিনি তাহার সমাধ্যায়িগণ বাঙ্গালার প্রতি কিছু মনোযোগ দিতেন এবং না। তখন তাঁহাদিগের পণ্ডিত পূর্ব্বে বিখ্যাত রামকমল সেনের পাচক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁহার অনুরোধে তিনি কালেজে পণ্ডিতী কর্ম্ম পান। বাঙ্গালা পাঠের সময় উপস্থিত হইলে তাঁহারা পণ্ডিত মহাশয়ের সঙ্গে পাকক্রিয়া ঘটিত এক প্রসঙ্গ পাড়িতেন, তাহাতেই সময় কাটিয়া যাইত, আর বাঙ্গালা পড়িতে হইত না। সংস্কৃত শ্লোকের মধ্যে যাহা তাঁহার খুড়া মহাশয় ও জেঠা মহাশয় মুখস্থ করাইয়াছিলেন তিনি তাহাই জানেন, আর কিছু জানেন না। বাঙ্গালা ও সংস্কৃতের প্রতি যাঁহার এরূপ অনাদর তিনি যে তাঁহার খুড়া মহাশয় কর্ত্তৃক মুখস্থ করান শ্লোকের দুই পাদ কি তিন পাদ ভুলিয়া যাইবেন ইহা আশ্চর্য্য নহে। কিন্তু তিনি যাহা ভুলিয়া গিয়াছেন তাহাতে সংসারের বিশেষ ক্ষতি হইতেছে না যেহেতু ঐ সকল পাদ যে সকল শ্লোকের অংশ তাহা অতি প্রসিদ্ধ শ্লোক।

 হরিহর বসু বিলক্ষণ আয়ুর্ব্বেদ জানিতেন। নিজের জন্য যে মধ্যম নারায়ণ তৈল আবশ্যক হইত তাহা তিনি নিজে প্রস্তুত করিতেন, এবং গ্রামের লোকদিগের জন্য সোমনাথ রস, মন্মথ রস, এবং বসন্তকুসুমাকর রস প্রভৃতি প্রধান প্রধান ঔষধ পরিশ্রমের পারিতোষিক না লইয়া কেবল উপাদানের ব্যয় লইয়া প্রস্তুত করিয়া দিতেন। তাহাতে ব্যবসায়ী বৈদ্যের নিকট হইতে ঐ সকল ঔষধ লইলে লোকের যে ব্যয় পড়িত তাঁহার নিকট হইতে লইলে অনেক অল্প ব্যয় পড়িত। তিনি বলিতেন মন্মথ রসের ঔষধ গুণবর্ণনাতে এই সকল কথা আছে; “বৃদ্ধ যোড়শবদ্ভবেৎ” অর্থাৎ ঐ ঔষধ সেবন করিলে বৃদ্ধ ষোড়শবর্ষীয় যুবকের ন্যায় হয়। রোগীকে কখন গঙ্গা যাত্রা করিতে হইবে হরিহর বসু তাহা নাড়ী পরীক্ষা করিয়া বলিয়া দিতেন এই জন্য তাঁহার গ্রামে অসীম প্রতিপত্তি ছিল। নাড়ী-প্রকাশ গ্রন্থ তাঁহার বিলক্ষণ দেখা ছিল। সেই নাড়ী প্রকাশ গ্রন্থে নাড়ীর গতি সর্পের ন্যায় হইলে কিম্বা ভেকের ন্যায় হইলে রোগী কতক্ষণ পরে মরিবে তাহা লিখিত আছে। হরিহর বসু গ্রামের বাটীতেই বসিয়া থাকিতেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আনন্দকিশোর বসু তাঁহাকে প্রতিপালন করিতেন। আনন্দকিশোর বসুর মৃত্যুর পর তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র রামনারায়ণ বাবু তাঁহাকে প্রতিপালন করিতেন। বাদলগ্রাম হইতে নড়িতে হইলে হরিহর বুসুর মহাবিপদ জ্ঞান হইত। একবার আলিপুরের আদালত হইতে তাঁহার প্রতি সমন জারী হয়। রামনারায়ণ বাবু বলেন যে তাঁহার খুড়া মহাশয় ইহাতে আপনাকে যে কতদূর বিপদাপন্ন বোধ করিয়াছিলেন তাহা বর্ণনাতীত। রামনারায়ণ বাবু অনেক টাকা ব্যয় করিয়া তাঁহাকে সেই বিপদ হইতে উদ্ধার করেন। শাস্ত্রচর্চ্চা ব্যতীত তিনি অন্য সময়ে গ্রাম্য দলাদলিতে ও বন্ধুদিগের সহিত তাস খেলাতে যাপন করিতেন। হরিহর বসু উদ্যান-পালনকার্য্যে বিশেষ মনোযোগ প্রদান করিতেন। তিনি স্বহস্তে উদ্যানের ঘাস নিড়াইতেন, এবং বৃক্ষসকলের পরিবর্দ্ধনের উপায় করিয়া দিতেন। এবিষয়ে তিনি অনেকের আদর্শ স্থল হইতে পারেন। গ্রামের সকল লোকে তাঁহাকে হরিখুড়া বলিয়া ডাকিত, অতএব তিনি আমাদিগেরও খুড়া। আমাদিগের সেদিন বিলক্ষণ স্মরণ হয় যেদিন তিনি তাঁহার স্বহস্তে রোপিত বোম্বাই আমের গাছের প্রথম ফল আমাদিগকে খাওয়াইলেন। আমরা তাহাতে অত্যন্ত আহ্লাদ প্রকাশ করাতে তিনি বলিলেন, “অদ্য আমার পরিশ্রম সার্থক হইল।” ১২৭৪ সালে ম্যালেরিয়া জ্বরে তাঁহার মৃত্যু হয়। এই সময় হইতে বাদলগ্রামের মাঝের পাড়ার বসুরা আপনাদিগের পৈতৃক বাটী পরিত্যাগ করেন। তখন পৈতৃক বাটীতে যে কুলুপ পড়ে সে কুলুপ অনেক দিন খোলা হয় নাই। কয়েক বৎসর পরে রামনারায়ণ বাবু পৈতৃক বাটী দর্শন করিতে যান। সেই সময়ে তাঁহার মনে যে সকল ভাব উপস্থিত হয় তাহা বর্ণনা করিয়া তিনি একটী ক্ষুদ্র প্রবন্ধ লেখেন, সেই প্রবন্ধ আমরা পরে প্রকাশ করিব।

 আমরা পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি যে গ্রামে হরিহর বসুর আধিপত্যের প্রধান কারণ তাঁহার অসংখ্য সংস্কৃত শ্লোক মুখস্থ থাকা। এক্ষণে ভারতবর্ষের গ্রাম সকলে যেমন পাশ্চাত্য-আলোকবিস্তারকারী লোক থাকা চাই, তেমনি সংস্কৃতজ্ঞ লোকও থাকা চাই। তাহা না হইলে হিন্দু গ্রাম হিন্দু গ্রাম বলিয়া বোধ হইবে না। বড় দুঃখের বিষয় যে এক্ষণে পল্লীগ্রাম হইতে ভট্টাচার্য্য দিগের টোল ক্রমে উঠিয়া যাইতেছে। ভট্টাচার্য্য মহাশয়েরা নিঃস্বার্থভাবে ছাত্রাদিগকে যে সংস্কৃত শিক্ষা প্রদান করেন তাহা অতি মহাদ্দর্শন। সে দর্শন এত মহৎ যে সভ্যাভিমানী দেশের লোকেরাও তাহা হইতে উপদেশ গ্রহণ করিতে পারেন। এই সকল টোল যাহাতে বজায় থাকে এরূপ কোন উপায় নির্দ্ধারণ করা আমাদিগের ধনাঢ্য ব্যক্তিদিগের কর্ত্তব্য। রাইন নদীতীরে সংস্কৃতের মহা আদর, আর গঙ্গাতীরে যাঁহারা তাহার চর্চ্চা করেন তাঁহাদিগকে অনাহারে কাল যাপন করিতে হয়।