গ্রাম্য উপাখ্যান।

সূচনা।

 উনপঞ্চাশ পরগণার বাদলগ্রাম[] একটী প্রসিদ্ধ গ্রাম। কায়স্থকৌস্তুভ-প্রণেতা রাজনারায়ণ মিত্র, যিনি কায়স্ত ক্ষত্রিয় বর্ণ এই মত প্রথম উদ্ভাবন করেন, তিনি উক্ত গ্রন্থে বাদলগ্রামের প্রতি অচলা ভক্তি প্রকাশ করিয়াছেন। তিনি ঐ গ্রন্থে বলিয়াছেন যে বাদল গ্রাম অতি পুণ্যভূমি; সেখানে কোন ব্যক্তিকে বিসূচিকা ব্যাধিগ্রস্ত হইতে দেখা যায় না। তিনি বলেন বাদলগ্রামের ভূমি স্বর্ণভূমি, উহা যেমন উর্ব্বরা এমন আর কোন স্থান নহে। বাদলগ্রাম সেনবংশীয় রাজাদিগের মধ্যে শ্রীমান সুযোগ্য সেনের (মিত্রজা মহাশয় শ্রীমান্ শব্দ ঐ রাজার নামের পূর্ব্বে ব্যবহার করিয়াছেন) রাজধানী ছিল। এই রাজধানীতে তিনি একটী মহা-যজ্ঞ করেন। ইতিহাসে এই যজ্ঞের কথা উল্লিখিত আছে। বাদলগ্রাম যে উক্ত রাজার রাজধানী ছিল তাহার অকাট্য প্রমাণ স্বরূপ মিত্র মহাশয় বলেন যে যখন বন কাটিয়া ঐ গ্রামের পুনরায় নূতন পত্তন হয় তখন যে স্থান এক্ষণে দিঘির আড়া বলিয়া আখ্যাত এবং যাহা এক বিস্তীর্ণ সরোবরের উপকূল সেই দিঘির আড়ায় রাশীকৃত ভস্মীভূত বিল্বপত্র পাওয়া গিয়াছিল। গ্রামের ঘোষবংশীয়দিগের আদি পুরুষ জঙ্গল কাটিয়া যখন পুনরায় ঐ গ্রামের পত্তন করেন তখন সেই জঙ্গলের মধ্যে এক ঘর মানুষ পাওয়া যায়। তাহারা বাদল গ্রামের সরকার বংশ। এই সরকারবংশীয় লোকেরা দূরস্থ অন্য গ্রাম হইতে তাহাদের আহার-দ্রব্য আহরণ করিয়া ঐ বনেতেই বাস করিত। পুনঃপত্তনের পর গ্রামটি ক্রমে ক্রমে অতি সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠিল। অনেক ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ আসিয়া তথায় বসতি করিল। তাহাদের বাসস্থান হওয়াতে উহা ক্রমে সমাজ স্থান বলিয়া গণ্য হইল। যে গ্রামে অনেক ব্রাহ্মণ বসতি করে তাহা সমাজ স্থান পদবীতে আরোহণ করে। এক সময়ে বাদলগ্রাম নিত্য উৎসব ও আনন্দের স্থান ছিল; এক্ষণে উহা মেলেরিয়া প্রপীড়িত এবং নিরানন্দ ও বিষাদের আলয়। এক্ষণে উহা ক্রমে পুনরায় জঙ্গলে পরিণত হইতেছে। এত জঙ্গল বৃদ্ধি হইয়াছে যে বহুসংখ্যক বন্যশূকর তন্মধ্যে আশ্রয় লইয়াছে এবং শকুনি সকল নারিকেল বৃক্ষোপরি তাহাদের নীড় নির্ম্মাণ করিয়াছে। গ্রামে দুপুর বেলা অন্ধকার কুপ কুপ করিতেছে; কত বাস্তুভূমি যে জনশূন্য হইয়াছে তাহা বলা যায় না। আমরা বাল্যকালে উহাকে হৃষ্ট পুষ্ট জন পূর্ণ এবং নিত্য উৎসব ও আনন্দযুক্ত দেখিয়াছিলাম, কিন্তু এক্ষণে সেরূপ নাই। এক্ষণে বাদল গ্রামে যে কয় জন লোক আছেন তাঁহারা মেলেরিয়া প্রপীড়িত এবং তাঁহাদের শরীর কঙ্কালাবশিষ্ট; আবার সেই সকল কঙ্কলাবশিষ্ট লোক দিবা রাত্রি উপজীবিকা চিন্তায় জর্জ্জরিত। আমাদের বাল্যকালে প্রত্যহ সন্ধ্যার পূর্ব্বে গ্রামের প্রবীন ব্যক্তিরা এক একটা পাগড়ি মাথায় বাঁধিয়া প্রকাণ্ড বৃক্ষতলে শপে বসিয়া যেরূপ গল্প করিতেন, বাদল গ্রামে সেরূপ দৃশ্য এক্ষণে আর দেখা যায় না। পূর্ব্বে জিনিস পত্র অল্প—মূল্য ছিল, তজ্জন্য লোকের এত উদ্বেগ ছিল না। আমরা শুনিয়াছি পূর্ব্বে জামাই বাটী আসিলে লোকে এক পণ কড়ি লইয়া বাজার করিতে যাইত, তাহাতেই কুলান হইত। এক্ষণে স্বাধীন বাণিজ্যের উৎপাতে দ্রব্যাদি সেরূপ অল্প-মূল্য নাই, তাহার উপর আবার মেলেরিয়ার উৎপাত; আর কি রক্ষা আছে? হে বাদল! তোমার বর্ত্তমান দুর্দ্দশা দর্শন করিলে চক্ষে জল আইসে। আহা! কোথায় সে আনন্দোৎসব? কোথায় সে আমোদ প্রমোদ! কোথায় সে বালকদিগের ক্রীড়া কৌতুক! সকলই স্বপ্নের ন্যায় অন্তর্হিত হইয়াছে।

 আমরা প্রস্তাবান্তরে প্রথমে বাদলগ্রামের ভৌগোলিক বিবরণ দিয়া সে কালের কথা স্মরণ পূর্ব্বক ক্রমান্বয়ে ঐ গ্রামবাসী মানুষ্যের এক একটা চিত্র পাঠকবর্গকে উপহার দিবার মানস করি।

  1. বোড়াল গ্রাম।