গ্রাম্য উপাখ্যান/ষষ্ঠী ন্যায়লঙ্কার

ষষ্ঠী ন্যায়লঙ্কার।

 আমরা উপরে যে কতকগুলি প্রকৃত বিদ্বান ব্যক্তির বিবরণ দিলাম ষষ্ঠী ন্যায়লঙ্কার তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন। তিনি একটা নিরেট মূর্খ ও মানবীয় সামান্য জ্ঞান বর্জ্জিত ছিলেন, কিন্তু তাঁহার কপালের দীর্ঘ ফোঁটা ও অন্যান্য আড়ম্বর দেখিলে বোধ হইত যেন তিনি একজন প্রকাণ্ড পণ্ডিত। তিনি নিরেট মূর্খ হইয়া কি প্রকারে ন্যায়লঙ্কার উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন তাহা আমরা বলিতে পারি না। ন্যায়লঙ্কার মহাশয় ছেলেবেলা অত্যন্ত আব্দারে ছেলে ছিলেন। ছেলেবেলা তিনি একদিন রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় চিনির পানা খাইবার বায়না করেন। ঘরে চিনি ছিল না, ষষ্ঠীর পিতা কি করেন ঠন্‌ঠনের হাটে গিয়া চিনি আনিয়া পানা করিয়া ষষ্ঠীকে তাহার কিয়দংশ দেন। আর অবশিষ্ট আপনি পরদিন পান করিবেন বলিয়া রাখিয়া দেন। ষষ্ঠী তখন আবার বায়না করিলেন যে বাবা ঐ চিনি শুকিয়ে খাব। ষষ্ঠীর বাপের মহা বিপদ উপস্থিত হইল, রাত্রে চিনির পানা কি প্রকারে শুকাইয়া দিবেন, তখন প্রকারান্তরে যষ্ঠীকে কিছু শুকনা চিনি দিয়া সে রাত্রের মত ছেলেকে থামাইলেন। আর একদিন অনেক রাত্রিতে ষষ্ঠী আব্দার করিলেন যে বাবা ঘোড়া চড়িব। যষ্ঠীর বাপ মহাবিপদে পড়িলেন, একে ভট্টাচার্য্য মানুষ ঘোড়াতো নাই, তাহাতে আবার অতরাত্রে ঘোড়া কোথায় পান। যখন ষষ্ঠীর মাতা বলিল যে ছেলে যদি বায়না করিয়াছে তা তুমি একবার কেন ঘোড়া হওনা, তখন ষষ্ঠীর পিতা নিজে ঘোড়া হইলেন। আবার ষষ্ঠী আব্দার করিলেন যে ঘোড়ার সিং কই। ষষ্ঠীর বাপ ছেলেকে বুঝাইতে লাগিলেন যে ঘোড়ার কখন সিং হয় না। ছেলে কিছুতেই বুঝবে না, অত্যন্ত কাঁদিতে লাগিল, তখন ষষ্ঠীর মাতা রাগ করিয়া বলিলেন যে ছেলে যখন আব্দার করিয়াছে তুমি কেন আপনার দুটা সিং কর না। তখন ষষ্ঠীর পিতা অগত্যা সেই রাত্রে বাবুদের পুকুর হতে কাঁকড়ার মাটি আনিয়া আপনার দুইটা সিং করিলেন, তখন ষষ্ঠীর কান্না থামিল। এই ষষ্ঠী বড় হইলে তাহার পিতা একদিন জিজ্ঞাসা করিলেন যে বাপু ষষ্ঠী তুমি এত বড় হইলে লেখাপড়া কি শিখিলে? রামায়ণ মহাভারত পড়িয়াছ তাহা কিছু বলিতে পার? ষষ্ঠ সগর্ব্বে বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ, জানি, তবে শুনুন। (কথকের সুরে কিন্তু কিছু সানুনাসিক সুরে) এক যে রামচন্দ্র ছিলেন তাঁর চৌদ্দটী হনুমান। শ্রী রামচন্দ্র বলিলেন “হে জানকি! আমি কল্য প্রত্যুষে হনুমান চারণে যাব।” জানকী তৎপর দিন অতি প্রত্যুষে রামচন্দ্রকে পান্তাভাত ও বড়ি পোড়া দিয়া অন্ন দিলেন। শ্রী রামচন্দ্র রোদে পিট দিয়া পান্তাভাত ও বড়িপোড়া ভক্ষণ করিলেন। তৎপরে (টানাসুরে) শ্রীরামচন্দ্র হনুমান চারণে গমন করিলেন। মাঠের মধ্যে রামচন্দ্র বৃক্ষোপরি আরূঢ় হইয়া হনুমান চারণ করিতে লাগিলেন। এখন (টানাসুরে) রামচন্দ্রের তেরটি হনু ঘাস খায়, আর একটা হনু ঘাস খায় না। শ্রী রামচন্দ্র সেই হনুটাকে বলিলেন যে ‘ওরে হোনো! ঘাস খা।’ হোনো কোন প্রকারে ঘাস খায় না, তখন শ্রী রামচন্দ্র বৃক্ষ হইতে অবতরণ পূর্ব্বক বলিলেন যে ‘ওরে হোনো! ঘাস খা।’ হোনো তথাপি ঘাস খায় না। তখন শ্রী রামচন্দ্র ক্রুদ্ধ হইয়া গালি দিতে লাগিলেন, ‘ওরে দুর্ব্বৃত্ত দশানন! ওরে লম্বোদর গজানন! ওরে মলিম্লচ! ওরে জরদ্গব! ওরে পাষণ্ড! ঘাস খা।” হোনো তথাপি শুনিল না, তখন শ্রীরামচন্দ্র চপেটাঘাতে মুষ্ট্যাঘাতে, হোনোকে পপাত ধরণীতলে করিলেন। ইতি কংসবধঃ।” ইতি কংসবধঃ বলাতে ষষ্ঠীর মহাভারতে যে বুৎপত্তি আছে তাহাও তিনি জানাইলেন। ইটালীয় ভাষাতে “Extra vagaza.” আখ্যাধারী যত প্রকার অদ্ভূত প্রবন্ধ আছে ন্যায়লাঙ্কার মহাশয়ের উপরে বিবৃত কথকতা তৎসমুদায়কে জিতিয়াছে সন্দেহ নাই।