গ্রাম্য উপাখ্যান/চল্লিশ বৎসর পূর্ব্বে বঙ্গদেশে ভ্রমণ-বৃত্তান্ত

চল্লিশ বৎসর পূর্ব্বে বঙ্গদেশে ভ্রমণ-বৃত্তান্ত।

 এক্ষণে বাঙ্গালীরা কত দেশদেশান্তর যাইতেছে, সাত সমুদ্র তের নদী পার বিলাত যাইতেছে, কেহ কেহ আট সমুদ্র চৌদ্দ নদী পার আমেরিকায় যাইতেছে। কিন্তু চব্বিশ বৎসর পূর্ব্বে কেহ যদি (Landour) লেণ্ডোর বা মসূরী পর্য্যন্ত যাইত, তাহা হইলে তাহাকে লোকে বীর পুরুষ জ্ঞান করিত। স্বর্গীয় রামগোপাল ঘোষ ততদূর গিয়াছিলেন। তজ্জন্য তাঁহার বীরত্ব আমরা কতদূর প্রশংসনীয় জ্ঞান করিতাম তাহা বলিতে পারি না। উক্ত ঘোষজা মহাশয় তাঁহার সময়ে ইংরাজীওয়ালাদিগের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি ছিন্দু কলেজের উত্তীর্ণ এবং উক্ত কলেজে পঠনশীল যুবকদিগের অধিনায়ক ছিলেন। তাঁহারা সকলে রামগোপাল বাবুর বাটীতে একত্রিত হইয়া তাঁহার সহিত ইংরাজীতে কথোপকথন করিতেন এবং ইংরাজী বিদ্যাবিষয়ক আলাপ করিয়া তৃপ্তিসুখ উপভোগ করিতেন। এই জন্য তিনি “এজুরাজ” বলিয়া খ্যাত ছিলেন। এই এজু শব্দ এডুকেটেড শব্দের অপভ্রংশ। ১৮৪৩ সালে যখন আমরা কলেজের প্রথম শ্রেণীতে পাঠ করি, তখন এক দিন রামগোপাল বাবুর সহিত আমাদের পরামর্শ হইল যে তাঁহার Lotus ষ্টীমারে আরোহণ করিয়া পূজার ছুটী বঙ্গদেশভ্রমণে অতিবাহিত করা যাইবে। তাঁহার লোটস ষ্টীমারটী ক্ষুদ্র, কিন্তু দেখিতে অতি সুন্দর, যথার্থই তাহা তাহার নামের উপযুক্ত ছিল। সেটাকে যথার্থ পদ্মের ন্যায় দেখাইত। বাষ্পীয় পোত আরোহণ করিয়া বঙ্গদেশের দূরস্থ স্থান ভ্রমণ করা তখন দুঃসাহসিক কার্য্য বলিয়া লোকে মনে করিত। এরূপ দুঃসাহসিক কার্য্যে আমি প্রবৃত্ত হইব, পূর্ব্বে মাতা ঠাকুরাণী তাহা জানিতে পারিলে ভ্রমণে যাইতে দিবেন না, অতএব তিনি যাহাতে টের না পান অথচ কার্য্যটী সমাধা করিতে হইবে এই জন্য একটি ষড়যন্ত্র করিলাম। সে ষড়যন্ত্রের ভিতর কেবল আমি ও আমার স্বর্গীয় পিতাঠাকুর মহাশয় ছিলেন। স্থির হইল, মাতা ঠাকুরাণীকে বলা হইবে যে, আমি রামগোপাল বাবুর স্বগ্রাম বাঘাটী যাইতেছি, তাহার পর ক্রমে ক্রমে পিতা ঠাকুর যথার্থ কথা ব্যক্ত করিবেন। যে দিন আমরা বাষ্পীয় পোত আরোহণ করিব সে দিন উৎসাহের সীমা কি? সকাল সকাল আহারাদি করিয়া আমরা কয়জনে রামগোপাল বাবুর বাটীতে উপস্থিত হইলাম। তখন ব্যাগ নামক পদার্থ —যাহা এক্ষণে কাপড়, তরকারী, ফল, হুঁকা, তামাক প্রভৃতি জাতের জিনিসে পরিপূর্ণ হইয়া ভদ্রলোককে ভদ্র মুটিয়াতে পরিণত করে-তাহার ব্যবহার ছিল না। আমরা প্রত্যেকে এক একটি কাপড়ের মোট লইয়া ষ্টীমার আরোহণ করিয়া ত্রিবেণী পৌঁছিলাম। পূর্ব্বে ত্রিবেণী, বলাগড়, শান্তিপুর প্রভৃতি স্থান কি স্বাস্থ্যকর স্থানই ছিল! লোকে কলিকাতা হইতে জল বায়ু পরিবর্ত্তন জন্য তথায় যাইত। এক্ষণে ঐ সকল স্থান মেলেরিয়ার আকর হইয়াছে। বাঘাটী ত্রিবেণীর নিকটস্থ গ্রাম। আমরা তথায় রামগোপাল বাবুর গ্রাম্য বাটিতে পূজার কয়েক দিন যাপন করিলাম। রামগোপাল বাবু নিজে পূজার কার্য্যে লিপ্ত থাকিতেন না; তাঁহার সম্পর্কীয় একটি বৃদ্ধ লোক পূজার সকল কার্য্যের তত্ত্বাবধারণ করিতেন, কেবল শান্তিজল লইবার দিনে রামগোপাল বাবুকে শান্তিজল নিতে দেখিয়াছিলাম। এ কয়েক দিবস কেবল মেকলের রচনাবলী (Macaulay’s Essays) পাঠ করি। তখন আমরা মেকলে-খোর ছিলাম। তাঁহাকে ইংলণ্ডের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থকর্ত্তা বলিয়া বোধ হইত। এক্ষণে তাঁহার শত শত মহদ্‌গুণ সত্ত্বেও তাঁহাকে কবিওয়ালা ও তাঁহার এক একটি রচনা (Essay) এক এক তান কবির ন্যায় জ্ঞান হয়। অমন পক্ষপাতী, একবগ্‌গা ও অত্যুক্তিপ্রিয় গ্রন্থকার অতি অল্পই আছে। তৎপরে ত্রিবেণীতে পুনরায় ষ্টীমার আরোহণ করিয়া আমরা মুরশিদাবাদাভিমুখে যাত্রা করিলাম। দিনগুলি অতি আমোদে কাটান হইত। প্রাতে উঠিয়া চা, বিস্কুট ও ডিম খাওয়া হইত। মধ্যাহ্নকালে বাঙ্গালীতর ভাত, ডাল, মাছের ঝোল; রাত্রিতে ইংরাজীতর অথবা হিন্দুস্থানীতর আহার হইত। সকাল বিকাল দুই বেলা তীরে নামিয়া আমরা পাখী মারিতে যাইতাম। সেই পক্ষীর মাংস ভক্ষণ করা যাইত। একদিন রামগোপাল বাবু আমাকে একটি পিস্তল ছুঁড়িতে দিলেন। আমি বলিলাম “আমি পিস্তল কখন ছুঁড়ি নাই, ভয় হইতেছে পাছে হাতটা উড়িয়া যায়।” রামগোপাল বাবু বলিলেন “গেলই বা।” তখন ঐ কথা কঠোর বলিয়া বোধ হইয়াছিল, এক্ষণে তাহার অর্থ বুঝিতে পারিতেছি। আমরা ক্রমে, বঙ্গদেশের অক্সফোর্ড নবদ্বীপ পার হইয়া বিল্বগ্রাম হইতে শ্রীযুক্ত মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়কে ষ্টীমারে উঠাইয়া লইয়া যাইবার জন্য তথায় ষ্টীমার নোঙর করিলাম। মদনমোহন তর্কালঙ্কার সে সময়ের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বঙ্গভাষায় একজন বলিয়া খ্যাত ছিলেন। তাঁহার প্রণীত প্রধান কবিতার সুকবি নাম বাসবদত্তা। তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। বিটন স্কুল যখন প্রথম স্থাপিত হয়, তখন আপনার কন্যাকে উক্ত বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি করাইয়া এবং অন্যান্য প্রকারে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তাররূপ মহৎ কার্য্যে বিটন সাহেবকে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিলেন। বিটন সাহেব এজন্য তাঁহাকে বড় ভাল বাসিতেন এবং “My dear Madan” (প্রিয় মদন) বলিয়া পত্র লিখিতেন। ইনি ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় “সর্ব্ব শুভকরী” নামে পত্রিকা বাহির করেন। এই পত্রিকাতে স্ত্রিশিক্ষার আবশ্যকতা বিষয়ে একটা প্রস্তাব তর্কালঙ্কার মহাশয় লিখিয়াছিলেন। স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক ঐরূপ উৎকৃষ্ট প্রস্তাব অদ্যাপি বঙ্গভাষায় প্রকাশিত হয় নাই। তর্কালঙ্কার মহাশয় বিল্ল গ্রামের একজন ভট্টাচার্য্য হইয়া সমাজ-সংস্কার কার্য্যে যেরূপ উৎসাহ প্রকাশ করিয়াছিলেন, তজ্জন্য তিনি সহস্র সাধুবাদের উপযুক্ত। আমরা তর্কালঙ্কার মহাশয়কে সঙ্গে লইয়া মুরশিদাবাদাভিমুখে গমন করিলাম। আমরা মুরশিদাবাদের ঘাটে নোঙর করিয়াছি, এমন সময়ে নবাবের মাল বোঝাই করা একটি লম্বোদর ভড় কৃশাঙ্গী “লোটসের” উপর আসিয়া জোরে পতিত হয়। তাহাতে লোটসের বিলক্ষণ অঙ্গতানি হয়, লোটসের আরোহী কয়েকজন বীর পুরুষ ভড়ের উপর উঠিয়া মাঝিদিগকে উত্তম মধ্যম দেন। এইরূপ উত্তম মধ্যম দিয়া মুরশিদাবাদ সম্মুখে আর থাকা বিধেয় নহে জ্ঞান করিয়া ভাগীরথী ও পদ্মার সঙ্গম স্থলাভিমুখে ষ্টীমার চালান হয়। তৎপরে উক্ত সঙ্গমস্থল হইতে আমরা রাজমহলাভিমুখে যাত্রা করি। রাজমহলে পৌঁছিয়া তথায় মুসলমান নবাবদিগের নির্ম্মিত অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ দর্শন করি। তন্মধ্যে কৃষ্ণ প্রস্তরনির্ম্মিত সিংহ-দালান প্রধান। এই দালানে বসিয়া নবাব প্রত্যহ দরবার করিতেন। ভূতপূর্ব্ব হিন্দু কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ইংরাজী সুকবি ও কাব্য-শাস্ত্রবিশারদ, সেক্স পিয়র প্রণীত নাটকের বিখ্যাত আবৃত্তিকারী আমাদিগের শিক্ষক সুপ্রসিদ্ধ কাপ্তেন রিচার্ডসন এই সকল ভগ্নাবশেষ সম্বন্ধে যে একটি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন, তাহার বাঙ্গালা অনুবাদ নিম্নে উদ্ধৃত করা গেল।

এস হে, পথিক! হেথা এস এই স্থানে,
কালের নাশিনী গতি হের এই খানে।
যখন নিশীথ কালে পেচকের রব,
শ্রবণবিবরে আসি পশিবেক তব,
সুতীক্ষ্ন চীৎকার ধ্বনি উঠিবে সঘনে
কৃশতনু শিবা হতে নির্জ্জন গগনে;
যদি হে! তোমার চিত্ত হয় হে তেমন
পবিত্র উৎসাহে পূর্ণ, কবিত্বে মগন,
কিম্বা জ্ঞান-চিন্তারত হয় তব মন,
এ ভগ্ন প্রাচীর তোমা বলিবে তখন,—
কি অনিত্য হয়, হায়! পার্থিব গৌরব,
মানব কীরিতি সহ গত হয় সব,
আশা ভরসা যত যৌবনের সাথে
হৃদয় ভগ্নাবশেষ রাখিয়া পশ্চাতে।

 যখন রেলওয়ে রাজমহল পর্য্যন্ত হয়, তখন এই সকল ভগ্নাবশেষ রেলওয়ে এবং রেলওয়ে কর্ম্মচারীদিগের বাসস্থান নির্ম্মাণ জন্য একবারে বিধ্বস্ত করা হয়। যখন এই বিধ্বংস কার্য্য চলিতেছিল, তখন আমি এই ভ্রমণের ১৭ বৎসর পরে রাজমহলে পুনরায় একবার যাই। তখন গিয়া দেখি মজুরেরা অতি কষ্টে নবাবদিগের অট্টালিকা সকল ভাঙ্গিতেছে। সেকালে অট্টালিকা সকল খুব মজবুত ছিল, এক্ষণকার অট্টালিকা সকল আদৌ সেরূপ মজবুত নহে। ইংরাজনির্ম্মিত অট্টালিকা সকলে শীঘ্র ফাট ধরে। রাজমহলের উল্লিখিত ভগ্নাবশেষ দর্শন করিয়া আমরা ষ্টীমারে আরোহণ পূর্ব্বক রাজমহলের পর্বতের দিকে গঙ্গা নদীর যে খাড়ী গিয়াছে সেই খাড়ীর ভিতর দিয়া কিয়দ্দুর গমন করিয়া উক্ত পাহাড় সকল পর্য্যবেক্ষণ করি ও পাহাড়িয়াদিগের বন্য শ্রবণ ও বন্য নৃত্য দর্শন করি।

 তৎপরে রাজমহল হইতে মহানন্দা–পদ্মা নদীদ্বয়ের সঙ্গমস্থলাভিমুখে গমন করি। এই পথে জলদস্যুর ভয় থাকাতে আমরা রাত্রিতে ষ্টীমারের ডেকের উপর ভাল করিয়া পাহারা দিতাম। আমি মাথায় পাগড়ী বাঁধিয়া তলওয়ার হাতে করিয়া পাহারা দিতাম। যখন আমরা মহানন্দার ভিতর প্রবেশ করিলাম, তখন তাহার পুষ্করিণীর জলের ন্যায় আকাশবর্ণ জল ও তীরস্থ শ্যামল বন উপবন দর্শন করিয়া মনে মহানন্দ উপস্থিত হইল। যখন মহানন্দা নদীর ভিতর ষ্টীমার অগ্রসর হইতে লাগিল তখন গ্রাম্য লোকেরা “ধোঁয়া কলের লা এয়েছে রে” “ধোঁয়া কলের লা এয়েছেরে ” বালিয়া তীরে আসিয়া বাষ্পীয়পোত দর্শন করিতে লাগিল। ইহার পূর্ব্বে বাষ্পীয়পোত কখন মহানন্দার ভিতর প্রবেশ করে নাই। লোকে তাহা দেখিয়া বিস্ময়ান্বিত হইল এবং আমাদিগকে কোন শ্রেষ্ঠতর লোক হইতে সমাগত অদ্ভুত জীব মনে করিল। ষ্টীমার হইতে যখন গ্রামে কেহ দুধ কিনিতে যাইত, তখন সে গিয়া দেখিত, যে গ্রামের সমস্ত লোক পলায়ন করিয়াছে, গ্রাম শূন্য পড়িয়া আছে। একি ব্যাপার! আমরা ইহা দেখিয়া মনে করিলাম যে আমরা কলম্বস ও তাঁহার সঙ্গীর ন্যায় কোন একটা নূতন আমেরিকা আবিষ্কার করিয়াছি; ও সেই আমেরিকাবাসী ইণ্ডিয়ানগণ আমাদিগের সম্মুখ হইতে পলায়ন করিতেছে। ইহার মধ্যে এক দিন মহানন্দার তীরে আমরা রাত্রে নঙ্গর করিয়া আছি, এমন সময়ে বাঘের ডাক শুনা গেল। যখন আমরা ভোলাহাট নামক স্থানের সম্মুখে পৌঁছিলাম, তখন আমরা একটা “কড়কড়ে পানীতে” (Rapid) পড়িলাম। ষ্টীমার কোন মতে আর অগ্রসর হয় না। আমরা রামগোপাল বাবুকে বলিলাম, আর অগ্রসর হইবার আবশ্যক নাই, ঘরে ফিরিয়া যাওয়া যাক্। রামগোপাল বাবু অসমসাহসিক কার্য্য সকল করিতে বড় ভাল বাসিতেন। তিনি বলিলেন, “ফিরিয়া যাওয়া আমাদের অভিধানে লেখে না, ষ্টীমারের কলে সম্পূর্ণ জোর দিয়া অগ্রসর হইতেই হইবে। তাহাতে বইল (Boiler) ফাটিয়া আমরা যদি আকাশে উড়িয়া যাই, তাহাতে ক্ষতি নাই।” রামগোপাল বাবু বলিতেন যে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে যে, বন্দুকের গুলি তাঁহার শরীরের খুব নিকট দিয়া গিয়াছে, কিন্তু তাঁহাকে স্পর্শও করে নাই। তিনি বলিতেন “আমি মন্ত্রপূত জীবন ধারণ করি।” (I bear charmed life)। ষ্টীমারে পূর্ণ জোর দিবার পূর্ব্বে ষ্টীমার হালকি করিবার জন্য ষ্টীমারের অধিকাংশ জিনিষ পত্র জালিবোটে করিয়া তীরে নামান হইল। ষ্টীমার স্বকীয় কলে সম্পূর্ণ জোর পাইয়া ভয়ানক গাঢ় বাষ্পরাশি পুনঃ পুনঃ উদ্গিরণ করতঃ ঈশ্বরেচ্ছায় “কড়কড়ে পানী” কোন প্রকারে পার হইল। নদীর দুই তীরে লোকে লোকারণ্য; যেমন পার হইল অমনি রামগোপাল বাবু রামমোহন রায়ের গান ধরিলেন, “ভয় করিলে যারে না থাকে অন্যের ভয়,” কেবল “অন্যের” শব্দ পরিবর্ত্তন করিয়া “জলের” এই শব্দ ব্যবহার করিয়া গান গাইতে লাগিলেন, —“ভয় করিলে যাঁরে না থাকে জলেরই ভয়।” তৎপরে আমরা মালদহ নগরে উপস্থিত হইয়া তথাকার তদানীন্তন ডেপুটী কলেক্টর বাবুর বাসায় আতিথ্য স্বীকার করিলাম। তিনি আমাদিগকে সমাদরে তাঁহার বাসায় রাখিলেন। তথায় দুই এক দিন অবস্থিতি করিলে পরে গৌড়নগরের ভগ্নাবশেষ দেখিতে সঙ্কল্প হইল। ঐ ভগ্নাবশেষ মালদহনগর হইতে আট ক্রোশ দূরে অবস্থিত। উহা দেখিতে নিবিড় বনাকীর্ণ, আমাদিগের সঙ্গে যে কয়েকটি বন্দুক ছিল, তদ্ব্যতীত আর কয়েকটি বন্দুক ও কয়েকটি হস্তী সংগ্রহ করা গেল। আমাদিগের সঙ্গে মালদহের তদানীন্তন সিবিল সার্জ্জন সাহেব জুটিলেন, তাঁহার নাম এতদিন পরে স্মরণ হইতেছে না, বোধ হয় Dr. Elton হইবে। এক হস্তীর উপর রামগোপাল বাবু ও ডাক্তার সাহেব এবং অন্যান্য হস্তীর উপর আমরা সকলে চলিলাম। তর্কালঙ্কার মহাশয় একটি হস্তীতে উপবিষ্ট ছিলেন— কোট ও পেণ্টলুন পরা, হাতে বন্দুক, কিন্তু মাথায় টিকি ফর্‌ফর্‌ করিয়া বাতাসে উড়িতেছে। দৃশ্যটি দেখিতে অতি মনোহর হইয়াছিল। যাইতে যাইতে তর্কালঙ্কার হাতীর উপর হইতে পড়িয়া গেলেন। হাতীটি অতি সায়েস্তা ছিল, অমনি থমকিয়া দাঁড়াইল। আর এক পা নিক্ষেপ করিলে তর্কালঙ্কার মহাশয় চেপটিয়া যাইতেন। এইরূপে আমরা গৌড়ে উপস্থিত হইয়া কোতোয়ালি দরজা নামক সেকালের কোতোয়ালির ভগ্নাবশেষের মধ্যে বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। ঐ কোতোয়ালি দরজার খিলান অতি বৃহৎ। এ প্রকার খিলান, বোধ হয়, ভূমণ্ডলে অতি অল্প স্থানেই আছে। তৎপরে আহারের উদ্‌যোগ হইল। সাহেব ও রামগোপাল বাবু একত্রে আহার করিলেন, আমাদের বাঙ্গালীতর বন্দোবস্ত হইল। গৌড়ের জঙ্গলবাসী কতকগুলি লোক সেই স্থান দিয়া যাইতেছিল। তাহাদিগের নিকট হইতে আমরা মহিষের দুগ্ধ কিনিলাম এবং কয়জনে পড়িয়া খিচুড়ি রাঁধিলাম। ভোজন সমাধা করিয়া আমরা ভগ্নাবশেষ দর্শনে বহির্গত হইলাম। আমরা দেওয়ান-খানা নামক একটি ভগ্নাবশেষ দেখিলাম। এই খানে বাদসাহের প্রত্যহ দরবার হইত। প্রাচীরের উপরে অতীব সুক্ষ্ম কারুকার্য্য দেখিলাম। সেই কারুকার্য্যের মধ্যে কোরান হইতে উদ্ধৃত কয়েকটা আরবী বাক্য খোদিত দৃষ্ট হইল। আমি যেন আমার সম্মুখে দেখিতে পাইলাম যে, বাদসাহ সিংহাসনে আসীন আছেন, আর উজীর ও অন্যান্য রাজকর্ম্মচারিগণ তাহাকে বেষ্টন করিয়া অবনতজানু হইয়া উপবিষ্ট আছেন, অনতিদূরে সুবিচারপ্রার্থী অসংখ্য মুসলমান ও হিন্দু দণ্ডায়মান রহিয়াছে। তৎপরে চটকা ভাঙ্গিয়া গেলে বোধ হইল যেন আমি স্বপ্ন দেখিতেছিলাম। মানুষ্যের কীর্ত্তি কি অস্থায়ী! যে স্থান এরূপ জনতা ও লৌকিক কার্য্যের ব্যস্ততার আধার ছিল, তাহা এক্ষণে বিজন ও ভয়ানক হিংস্র জন্তুর আবাস হইয়াছে। তৎপরে আমরা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কয়েকটি পুষ্করিণী দেখিলাম। সে সকল পুষ্করিণী এক একটি হ্রদের ন্যায়। তাহাতে বৃহৎ বৃহৎ কুমীর ভাসিতে দেখা গেল। এক স্থানে আমরা কলিকাতার অক্টারলনী মনুমেণ্টের ন্যায় একটি অত্যুচ্চ স্তম্ভাকৃতি গৃহ দেখিলাম। শুনিলাম যে, তাহার উপর রাজ-জ্যোতির্ব্বেত্তা রাত্রে উঠিয়া নক্ষত্র পর্য্যবেক্ষণ করিতেন। আমার ক্ষণেকের জন্য স্বপ্নের ন্যায় বোধ হইল, যেন অদ্যাপি রাত্রে উষ্ণীষধারী ও আপাদলম্বিত আলখাল্লা পরিহিত রাজ-জ্যোতির্বেত্তা নভোমণ্ডলে দূরবীক্ষণ নিয়োগ করতঃ নক্ষত্রপর্য্যবেক্ষণ কার্য্য সম্পাদন করিয়া থাকেন। এইরূপ অন্যান্য অনেক ভগ্নাবশেষ দেখা গেল। এই সকল ভগ্নাবশেষের বিশেষ বৃত্তান্ত র‍্যাবেশা (Ravenshaw) সাহেব সম্প্রতি তাঁহার প্রণীত “রুইন্‌স্ অব্ গৌড়” (Ruins of Gour) নামক গ্রন্থে সবিশেষ বিবৃত করিয়াছেন। এই সকল ভগ্নাবশেষ দেখিয়া আমরা মালদহ নগরে প্রত্যাগমন করিলাম সে দিবস সাহসী রামগোপাল বাবু ও ডাক্তার সাহেব ব্যতীত আর সকলের সৌভাগ্যক্রমে ব্যাঘ্র কিংবা অন্য কোন হিংস্র জন্তুর সহিত মোলাকাৎ হয় নাই, তাহা হইলে আমাদিগের মধ্যে যে কয়জন অপদার্থ ভীরু বাঙ্গালী ছিল, তাহাদিগের দুর্দশা কি হইত বলা যায় না।

সম্পূর্ণ।