গ্রাম্য উপাখ্যান/কমলাকান্ত সার্ব্বভৌম
কমলাকান্ত সার্ব্বভৌম।
ইনি গ্রামের তপস্বী বংশীয় ব্যক্তি ছিলেন। ইহাঁর উপাধি সার্ব্বভৌম ছিল। ইনি বাহুলীন গ্রামের সাবর্ণ বংশীয় জমীদার সন্তোষ রায়ের সভাপণ্ডিত ছিলেন। সন্তোষ রায় একবার বাকি খাজনা জন্য মুর্শিদাবাদের নবাবের সৈন্য দ্বারা গ্রেপ্তার হইয়া দিন কতক তথায় বন্দী অবস্থায় থাকেন। এই অবস্থাতে তিনি এক দিন একটী প্রকাণ্ড খাসি একাকী আহার করেন। নবাব বাহাদুর ইহা অবগত হইয়া বলিলেন, “এ সক্স আপকা জমিদারীকা আমদানি সব খা ডালতা হায়, সদর মালগুজারি কেস্তরে করেগা এসকো ছোড় দেও। আর কভি এস্কো পাসসে খাজনা মৎ আদায় করো।” তৎপরে তিনি কারামুক্ত হইয়া রাজকর হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়া নিষ্কণ্টকে আপনার জমিদারী উপভোগ করিতে লাগিলেন। কমলাকান্ত সার্ব্বভৌম মহাশয় অতি বিদ্বান, উদার স্বভাব ও বদান্য ব্যক্তি ছিলেন। ইনি একদিন বাদলগ্রাম হইতে বেলা দুই প্রহরের সময় বাহুলীন গ্রামে যাইতেছিলেন। গ্রাম হইতে অর্দ্ধ ক্রোশ আসিয়া দেখেন যে কক্ষে কলসধারিণী গুটি কতক বাগ্দি স্ত্রীলোক সূর্য্যের উত্তাপে ক্লিষ্ট হইয়া একটী গাছের ছায়ায় বসিয়া কথোপকথন করিতেছে। তিনি তথায় উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,“বাছারা! তোমরা কি বলিতেছ?” তাহারা তাঁহাকে বলিল, “ভট্টাচার্য্য মহাশয়, আমাদিগকে দীঘি হইতে জল লইয়া যাইতে হয়, ইহা আমাদিগের গ্রাম হইতে দুই ক্রোশের কম নহে। এই বাদল গ্রামে এতগুলি ভদ্রলোক আছেন, তাঁহারা যদি এখানে একটা পুকুর কাটাইয়া দেন তাহা হইলে আমা— দিগকে আর অতদূর কষ্ট করিয়া জল আনিতে হয় না। নিকটে জল পাইয়া বাঁচি।” ইহাতে সার্ব্বভৌম মহাশয় আর তাহাদিগকে কিছু না বলিয়া বেহালায় গিয়া সন্তোষ রায়ের নিকট বাদল গ্রামের উত্তরাংশে একটুকু জমী ভিক্ষা করেন। কিন্তু ক্ষুদ্রমনা উদরপরায়ণ জমীদার মালজমী বলিয়া দিতে অস্বীকৃত হওয়ায় সার্ব্বভৌম মহাশয় নিজের জয়রামপুর গ্রামের ব্রহ্মোত্তর জমীর সহিত এওজ দোয়জ করিয়া সেই নিরূপিত জমীর উপর একটি বৃহৎ পুষ্করিণী খনন করেন। অদ্যাবধি সেই পুষ্করিণী তপস্বী পুকুর নামে অভিহিত আছে। এতদ্ব্যতীত উক্ত সার্ব্বভৌম মহাশয় গ্রামের অপর তিন দিকে তিনটী পুষ্করিণী খনন করান, তাহাও অদ্যাপি “তপস্বী পুকুর” নামে খ্যাত আছে।
তপস্বী বংশের কতকগুলি ব্যক্তি বারুইপুরের জমীদারদিগের এলাকায় বাস করেন। এক সময়ে উক্ত জমীদারেরা তাঁহাদিগের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তিকে আদালতে সাক্ষ্য দিতে অনুরোধ করেন। তাঁহারা তাহা ধর্ম্মবিরুদ্ধ কাজ বলিয়া তাহা করিতে অসম্মত হয়েন। এইরূপে তাঁহারা উত্যক্ত হইয়া স্বগ্রাম ছাড়িয়া বাদল গ্রামে পলাইয়া আসেন। তপস্বীবংশীয় এই সকল ব্যক্তিকে ধর্ম্মবীর বলিয়া আমাদিগের গণ্য করা কর্ত্তব্য। ধর্ম্ম বিষয়ে যদি কোন লোকের কোন ভ্রমাত্মক মত থাকে, তথাপি সেই ভ্রমাত্মক মত জন্য তিনি উৎপীড়ন সহ্য করিলে তাঁহাকে ধর্ম্মবীর বলিয়া গণ্য করা কর্ত্তব্য, যেহেতু তিনি নিজে সেই মতকে সত্য বলিয়া মনে করেন। যিনি যাহা সত্য বলিয়া মনে করেন তাহার জন্য উৎপীড়ন সহ্য করিলে তাঁহাকে ধর্ম্মবীর বলিয়া গণ্য করা কর্ত্তব্য। প্রথমে যাঁহারা খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম অবলম্বন করেন, তাঁহাদিগের অনেক মত ভ্রমসঙ্গ্কুল ছিল, তথাপি তাঁহারা যে ভয়ানক উৎপীড়ন সহ্য করিয়াছিলেন, তজ্জন্য কি তাঁহাদিগকে ধর্ম্মবীর বলিয়া গণ্য করা যাইবে না? সেইরূপ আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া আমরা ধর্ম্মতঃ দুষ্য মনে না করিলেও তথাপি যখন উক্ত তপস্বী বংশীয় মহাত্মারা তাহা ধর্ম্মদূষ্য কার্য্য বোধ করিয়া তজ্জন্য পীড়ন সহ্য করিয়াছিলেন, এমন কি বাঙ্গালীর সম্বন্ধে সকল বস্তুর অপেক্ষা প্রিয় নিজের বাস্তুভূমি পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াছিলেন তখন তাঁহারা কি ধর্ম্মবীর বলিয়া গণ্য হইবেন না? তাঁহারা ধর্ম্মবিষয় উৎপীড়ন জন্য ইংলণ্ড পরিত্যাগ করিয়া আমেরিকায় গিয়া বসতি করেন। তাঁহাদিগকে ইংরাজেরা “pilgrim fathers” “সন্ন্যাসী পিতৃ-পুরুষ” এই উপাধি দিয়াছেন। যে সকল তপস্বীবংশীয় মহাত্মারা নিজের বাস্তুভূমি পরিত্যাগ করিয়া বাদল গ্রামে বসতি করেন তাঁহারা কি কিয়ৎ পরিমাণেও ঐ সম্ভ্রান্ত উপাধির যোগ্য নহেন? কমলাকান্ত সার্ব্বভৌম মহাশয় আদ্য গঙ্গায় প্রাতঃস্নান করিয়া বাটী প্রত্যাগমন করিতেছিলেন, পথিমধ্যে উক্ত তপস্বী-বংশীয় মহাত্মাদিগের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। তিনি উহাদিগকে সপরিবারে হঠাৎ বাদলগ্রামে আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তাঁহারা যাহা ঘটিয়াছে বর্ণনা করিলে তিনি তাঁহাদিগের ধর্ম্মবীরত্বে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাদিগকে যত্নের সহিত আপনার বাটীতে আনিয়া তাঁহাদিগকে নিজের ভদ্রাসন বাটী দান করিয়া গঙ্গাতীরে বাসের জন্য সস্ত্রীক গমন করেন। এই পাশ্চাত্য সভ্যতা-জনিত স্বার্থপরতার কালে এরূপ ঔদার্য্য অলীক বলিয়া বোধ হইবে কিন্তু বস্তুতঃ ইহা সত্য। গঙ্গাতীরে প্রয়াণ কালে পথিমধ্যে জমীদার ঘোষ বংশীয় কোন ব্যক্তির সহিত সার্ব্বভৌম মহাশয়ের সাক্ষাৎ হয়। কোথা যাইতেছেন তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করাতে সার্ব্বভৌম মহাশয় আনুপূর্ব্বিক সমুদায় বিবৃত করেন। ইহাতে উক্ত জমীদার মহাশয় আপনাদিগের চৌদ্দ বিঘা বাস্তু ভূমি হইতে তিন বিঘা জমী তাঁহাকে দান করিয়া পুনরায় বাদল গ্রামে তাঁহাকে বাস করান। এক্ষণে “বড় বাগান” বলিয়া একটী আকাট জঙ্গলময় স্থান বাদল গ্রাম মধ্যে আছে। সেই স্থান ঘোষবংশের প্রাচীন পরিত্যক্ত ভদ্রাসন। আর উহার দক্ষিণাংশে তিন বিঘা পরিমিত স্থানে তপস্বীবংশীয়ের অদ্যাপি বাস করিতেছেন।
কমলাকান্ত সার্ব্বভৌম মহাশয় সম্বন্ধে একটা অতি রহস্য-জনক কথা গ্রামে প্রচলিত আছে। সার্ব্বভৌম মহাশয় যাহা উপার্জ্জন করিতেন তাহার সামান্য ভাবে জীবন যাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া অধিকাংশ অতিথি সেবা ও অন্যান্য পরোপকারক কার্য্যে ব্যয় করিতেন। এইরূপ কার্য্যে ব্যয় করাতে তিনি স্ত্রীকে অলঙ্কার প্রদানে সক্ষম হইতেন না। একদিন উহার ব্রাহ্মণী কিছু গহনা চাহেন তাহাতে তিনি হাস্য করিয়া থলি হইতে কিছু টাকা বাহির করিয়া পাঁচনলী কণ্ঠ মালার বদলে এক পুটুলি টাকা তাঁহার কণ্ঠে এবং মলের পরিবর্ত্তে দুই পায়ে দুই পুঁটুলি টাকা বাধিয়া দিলেন এবং বলিলেন, গহনা পরা ঐশ্বর্য্য দেখাইবার জন্য বইত নহে। এইরূপ টাকার পুটুঁলি বাঁধিলে যথেষ্ট হইবে। মিছামিছি স্বর্ণকারকে বানি দিবার আবশ্যক কি? ইহাতে তাহার স্ত্রী এতদূর অপ্রতিভ হইয়াছিলেন যে আর কখন তিনি প্রাণান্তে গহনার কথা উত্থাপন করিতেন না। যাহাদিগের স্ত্রীরা গহনার জন্য তাঁহাদিগকে উত্যক্ত করেন তাঁহাদিগকে আমরা এই উপায় অবলম্বন করিতে পরামর্শ দিই। ইহা সত্য বটে যে আমাদিগের সহধর্ম্মিণীরা গহনার জন্য স্বামীর সৎকার্য্যে প্রতিবন্ধকতাচরণ করেন তথাপি তাঁহারা এ বিষয়ে বিলাতের সীমস্তিনীগণ অপেক্ষা অনেক ভাল। শেষোক্ত সীমন্তিনীগণ রাশীকৃত টাকা বস্ত্রে ব্যয় করিয়া স্বামীকে ফতুর করেন, কিন্তু সে বস্ত্র পরে কোন কাজে আসিবে না কিন্তু আমাদিগের স্ত্রীদিগের স্বর্ণালঙ্কার দুঃখ বিপদের সময় অনেক কাজে আইসে। স্ত্রীর অলঙ্কার ভারতবর্ষের সেবিংস ব্যাঙ্ক বলিলে অত্যুক্তি হয় না।
কমলাকান্ত সার্ব্বভৌম বাদল গ্রামের লোক দ্বারা প্রাতঃস্মরণীয় লোক বলিয়া গণ্য হইয়া থাকেন। এরূপ ব্যক্তি যে প্রাতঃস্মরণীয় বলিয়া গণ্য হইবেন তাহার বিচিত্র কি? বঙ্গদেশের সে কালের সামাজিক ইতিবৃত্তে, ঔদার্য্য ও বদান্যতার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত প্রাপ্ত হওয়া যায় তথাপি কমলাকান্ত সার্ব্বভৌমের অবস্থা বিবেচনা করিলে ইতিবৃত্ত্বেও তাঁহার ন্যায় বদান্যতা ও ঔদার্য্যের দৃষ্টান্ত বিরল।