গ্রাম্য উপাখ্যান/শিবচন্দ্র ঘোষ

শিবচন্দ্র ঘোষ।

 শিবচন্দ্র ঘোষ বাদল গ্রামের জমীদার ঘোষ বংশের অন্যতর ব্যক্তি। তিনি উক্ত গ্রামের বাজারীয়া দলের অধিনায়ক ছিলেন। এই সময়ে বাদলগ্রামনিবাসীরা দুই দলে বিভক্ত ছিল, বাজারীয়া দল ও ব্রহ্মজ্ঞানীর দল। একদা গ্রামের মাঝের-পাড়ানিবাসী হরিহর বসু ধোবা পুষ্করিণীর ধারে বসিয়া নূতন ধর্ম্মসংস্কারক রামমোহন রায়ের গ্রন্থ পাঠ করিতেছিলেন, এমন সময়ে গ্রামের প্রধান পণ্ডিত রামধন তর্কবাগীশ সেই পথ দিয়া যাইতেছিলেন। হরিহর বসু রামমোহন রায়ের গ্রন্থ পড়িতেছেন দেখিয়া “ছোঁড়া! তুই রামমোহন রায়ের গ্রন্থ পড়ছিস্” এই বলিয়া তাঁহার হাত হইতে তাহা কাড়িয়া লইয়া পুকুরের মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছিলেন। হরিহর বসু ও তাঁহার সঙ্গীগণ বেদান্ত শাস্ত্রের ও রামমোহন রায় প্রবর্ত্তিত ব্রাহ্মধর্ম্মের আলোচনা সর্ব্বদাই করিতেন বলিয়া গ্রামে তাহাদিগের নাম ব্রহ্মজ্ঞানীর দল হইয়াছিল। বাজারীয়া দলের লোকেরা গ্রামের ঠনঠনিয়া বাজারে বসিয়া গাঁজা খাইতেন ও বাজারের লোকের নিকট হইতে তোলা তুলিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করিতেন। এই কথা ব্রহ্মজ্ঞানীর দলের লোকেরা শ্রীরামপুরের মার্শমান সাহেবের সম্পাদিত “সমাচার-দর্পণে” ছাপাইয়া দেন। এই সমাচারদর্পণ বাঙ্গালা ভাষায় সম্পাদিত দ্বিতীয় সংবাদপত্র। সর্ব্ব প্রথমে বাঙ্গালা ভাষায় যে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় তাহার নাম “বেঙ্গল গেজেট”; গঙ্গাধর ভট্টাচার্য্য তাহার সম্পাদক ছিলেন। সমাচার-দর্পণে ঐ সংবাদ প্রকাশিত হওয়াতে দারগা গ্রামে আসিয়া সুরথাল করে। বাজারীয়া দলের লোকেরা অতি ন্যায়বান ছিলেন। বর্গীরা অধীনস্থ রাজাদিগের নিকট হইতে “চৌত” অর্থাৎ তাঁহাদিগের আয়ের চতুর্থাংশ লইত। কিন্তু ইহারা বাজারে যে সকল লোক আসিত তাহাদিগের নিকট হইতে তাহাদিগের দ্বারা বিক্রীত দ্রব্যের যে অংশ লইতেন তাহা চৌতের সহিত তুলনা করিলে অতি অল্প। তাঁহারা বাজারের লোকদিগকে বলিতেন, “তোরা মজা করিয়া খাইবি, আর আমরা ভদ্র লোকের ছেলে কিছু খাইতে পাইব না, ইহা কি ভাল দেখায়? তোরা অধিকাংশ নে, আমাদের কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ দে তাহা হইলেই আমাদিগের হইবে।” ইহা অপেক্ষা ন্যায়সঙ্গত কথা আর কি হইতে পারে? তাঁহারা এরূপ ন্যায়সঙ্গত কার্য্যের সহিত দারগার কোন সম্বন্ধ আছে ইহা স্বপ্নের অগোচর মনে করিয়া ত্বরিতানন্দের দম মারত (পাঠকবর্গ “মারত” শব্দের রত অংশটুকু “রত” শব্দের ন্যায় উচ্চারণ করিবেন) নির্ব্বাণ-সুখ উপভোগ করিতেন। এক দিন প্রাতে দারগা সুরথাল করিতে আসিয়াছে ইহা হঠাৎ শুনিয়া তাঁহারা নির্ব্বাণ-নিদ্রা হইতে জাগরিত হন। ইহাঁরা যোগ সাধনে অন্যান্য স্থানের যোগী অপেক্ষা অধিক অগ্রসর হইয়াছিলেন। কলিকাতার কোন যোগাশ্রমে একটী নরহত্যা হইয়াছিল, কিন্তু যোগীরা সে হত্যাকার্য্যে লিপ্ত ছিলেন না। তাঁহারা শুনিলেন যে মাজিষ্ট্রেট সাহেব তাহাদিগের আড্ডায় সুরথাল করিতে আসিবেন। তাঁহারা মনে করিলেন যে সুরথালের অর্থ সুর ও তালে মাজিষ্ট্রেটের নিকট সাক্ষী দেওয়া। এই মনে করিয়া তাঁহারা ঘুঙ্গুর পায়ে দিয়া ও মন্দিরা হাতে করিয়া সজ্জিত হইয়া রহিলেন। সাহেব আসিয়া যখন জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা জগবন্ধু বোসের হত্যার বিষয় কিছু জান?” তখন তাঁহারা দণ্ডায়মান হইয়া

“জগবন্ধু বোসকে জানিনে ও সাহেব জানিনে
জানিনে, শুনিনে, চিনিনে ও সাহেব চিনিনে॥”

এই গান গাহিয়া সাহেবের চতুর্দ্দিকে নৃত্য আরম্ভ করিয়া দিলেন। সাহেব অবাক হইয়া রহিলেন। এই সকল যোগীদিগের অপেক্ষাকৃত অধিকতর চালাকি ছিল। বাজারীয়া দলের লোকদিগের এত অধিক চালাকি ছিল না। যোগসাধনে লোকে যত অগ্রসর হয় ততই নিম্পন্দতা বৃদ্ধি হয়। বাজারীয়া দলের লোকদিগের তোলা তুলিবার ও আহার করিবার সময় বাহ্য জ্ঞান হইত, অন্য সময় তাঁহারা নির্ব্বিকল্প সমাধির অবস্থাতেই থাকিতেন। আহা! এরূপ ন্যায়বান উদারস্বভাব যোগসাধনকারীদিগের প্রতি খবরের কাগজে বদনাম ছাপান ও দারগার দ্বারা সুরথাল করান রূপ নৃশংস ব্যবহার করা কি উচিত ছিল? এই কার্য্য জন্য ব্রহ্মজ্ঞানীর দলের লোকের আত্মা এক্ষণে রৌরব নরকে পচিতেছে সন্দেহ নাই। পাঠক! (আমরা কোন কোন বাঙ্গালা সংবাদ পত্র সম্পাদকের ন্যায় সর্ব্বদা পাঠককে সম্বোধন করিতে ভালবাসি) কে না জগতে গাঁজাখোর? বণিক যিনি হাজার টাকার মূলধন খাটাইয়া বাণিজ্য আরম্ভ করেন, এবং অতি অল্পদিনের মধ্যেই ক্রোরপতি হইবেন এমৎ দিবা-স্বপ্ন দেখেন তিনি কি গাঁজাখোর নহেন? বিজেতা যিনি এক সামান্য দেশ জয় করিয়া মনে করেন যে ক্রমে ক্রমে আমি সসাগর পৃথিবীর রাজা হইব, তিনি কি গাঁজাখোর নহেন? গ্রীসের অন্তর্গত ইপাইরাস (Epirus) নামক প্রদেশের রাজা পিরাস (Pyrrhus) এইরূপ গাঁজা খোর ছিলেন। ইহাকে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বড় জব্দ করিয়াছিলেন। পিরস একদিন সেই জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট অমুক দেশের পর অমুক দেশ এইরূপ দশ বারটা দেশ ক্রমে জয় করিব এমন মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করিলেন। জ্ঞানী ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিলেন “এই সকল দেশ জয় করিয়া তৎপরে আপনি কি করিবেন?” পিরস উত্তর করিলেন “এই সকল দেশ জয় করিয়া বাটী ফিরিয়া আসিয়া বন্ধুবান্ধব সহিত আমোদ আহ্লাদ করিব।” জ্ঞানী ব্যক্তি বলিলেন, “তাই যদি আপনার অভিপ্রায় হয় তাহা হইলে এত আয়াস স্বীকার না করিয়া এখনই ত তাহা করিতে পারেন।” গাঁজাখোরকে গাঁজার নেশার সময় বাড়ী মারিলে তাহার যেমন চৈতন্যের উদয় হয় তেমনি জ্ঞানী ব্যক্তির ঐ কথায় পিরসের চৈতন্যের উদয় হওয়াতে তিনি বলিলেন, “তাই ত বটে।” যে সকল ব্যক্তিরা কেবল বৈষয়িক উন্নতি সম্বন্ধে অমূলক আশা করে কেবল যে তাহারাই গাঁজাখের এমত নহে। গ্রন্থকার ও বিদ্বান ব্যক্তিরাও গাঁজাখোর। কবি ও উপন্যাসলেখকেরা যে সম্পূর্ণরূপে গাঁজাখোর তাহা আর প্রমাণ করিতে হইবে না। পুরাবৃত্তলেখকও গাঁজাখোর। পুরাবৃত্ত বিশেষতঃ প্রাচীনকালের পুরাবৃত্তের চৌদ্দ আনা গাঁজা ও দুই আনা প্রকৃত পদার্থ। ইংরাজী কবি লর্ড বায়রাণ বলিয়াছেন, “That grand liar history”

“সেই প্রকাণ্ড মিথ্যা বাদী যাহাকে পুরাবৃত্ত বলা যায়।” ইংলণ্ড দেশের বিখ্যাত কবি পুরাবৃত্তলেখক ও রাজনীতিজ্ঞ সার ওয়াল্‌টার রেলে (Sir Walter Raleigh) কারারুদ্ধাবস্থায় পৃথিবীর ইতিহাস রচনা কার্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন। এক দিন তাঁহার কারাগৃহের একতলাতে একটী কলহ উপস্থিত হয়। কলহ শেষ হইলে যখন যে ব্যক্তি রেলের দ্বিতলস্থ গৃহে আগমন করিল, তাঁহাকে তিনি ঐ কলহের বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ দিল। রেলে বলিলেন, “যে ঘটনা প্রায় আমার সম্মুখে ঘটিল তাহার প্রকৃত বৃত্তান্ত যখন আমি পাইলাম না। তখন হানিবল, সিপিয়ো ও সিজারের প্রকৃত বৃত্তান্ত পাওয়া যাইতেছে তাহা কি করিয়া বলা যাইতে পারে?” কবি, উপন্যাস লেখক ও পুরাবৃত্তরচয়িতার ত এই কথা গেল। দার্শনিক ও গাঁজাখোর। তিনি সৃষ্টিকর্ত্তার ন্যায় আপনাকে সর্বজ্ঞ মনে করিয়া সৃষ্টির নিগূঢ় তত্ত্ব বিষয়ে স্বীয় কুলকুণ্ডলিনী হইতে কত মত উদ্ভাবন করেন, পরকালে যখন তাঁহার জ্ঞান অনেক উন্নত আকার ধারণ করিবে ও গাঁজার ঝোঁক ভাঙ্গিবে তখন ঐ সকল মত অনেক পরিমাণে গাঁজামূলক ইহা তিনি বুঝিতে পারিয়া আপনা আপনি হাসিবেন এবং সে সকল ভ্রমাত্মক মত পৃথিবীতে প্রচার করিয়াছেন বলিয়া লজ্জিত হইবেন। এইরূপে জগতের সকল ব্যক্তিই যে গাঁজাখোর তাহা প্রমাণ করা যাইতে পারে। পানাসক্ত গ্রীক কবি এনাক্রিয়ণ (Anacreon) বলিয়াছেন যে জগতের সকল পদার্থ পান কার্য্যে নিযুক্ত রহিয়াছে, বৃক্ষ সকল পৃথিবীর রস পান করিতেছে, পৃথিবী বৃষ্টি পান করিতেছে, সুর্য্য বাষ্পরূপে জল পান করিতেছে। সেইরূপ আমরা প্রমাণ করিতে পারি যে সমস্ত জগত গাঁজা খাইতেছে। যখন সমস্ত জগৎ গাঁজা খাইতেছে তখন বাদল গ্রামের বাজারীয়া দলের লোককে আমরা দোষ দিই কেন? বাজারীয়া দলের অধিনায়ক শিবচন্দ্র ঘোষ কিন্তু নিজে গাঁজা খাইতেন না। তিনি এ বিষয়ে তাঁহার সখা (সমান আখ্যা অর্থাৎ সমান নামধারী ব্যক্তিকে সখা বলা যায়) কৈলাসবাসী দেবতার ন্যায় গাঁজাখোর ছিলেন না। যেমন চতুর রাজনীতিজ্ঞ কিম্বা সেনাপতি নিজে ধর্ম্মোন্মত্ত না হইয়া অনুবর্ত্তীদিগের ধর্ম্মোন্মত্ততা দ্বারা আপনার কার্য্য সাধন করিয়া লয়েন তেমনি শিবচন্দ্র ঘোষজা মহাশয় নিজে গাঁজা না খাইয়া গাঁজাখোরদিগের দ্বারা আপনার কার্য্য সাধন করিয়া লইতেন। তিনি এ বিষয়ে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের ন্যায় ব্যবহার করিতেন। নেপোলিয়ান যেমন মিসর দেশে গিয়া দাড়ী রাখিয়া ও কলমা পড়িয়া মুসলমানধর্ম্মাবলম্বী হইয়াছেন দেখাইয়াছিলেন কিন্তু বাস্তবিক মুসলমান হয়েন নাই, সেইরূপ শিবচন্দ্র ঘোষজা মহাশয়ের ধরণ ধারণ গাঁজাখোরের ন্যায় ছিল, কিন্তু তিনি নিজে গাঁজাখোর ছিলেন না। শিবচন্দ্র ঘোষ কৃশকায় ও অতি বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। কৃশকায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি প্রকাণ্ডকায় বলবান অথচ নির্ব্বোধ ব্যক্তি অপেক্ষা যে কত শ্রেষ্ঠ তাহা তিনি একটা সুন্দর উপমা দ্বারা দেখাইতেন। তিনি বলিতেন যে প্রকাণ্ডকায় বলবান অথচ নির্ব্বোধ ব্যক্তি পাঁড়কুমড়ো ও ছিপ্ ছিপে বুদ্ধিমান ব্যক্তি একটা ছোট ছুরী। যেমন একটা ছোট ছুরী দ্বারা পাঁড়কুমাডো অনায়াসে কাটা যায় তেমনি কৃশকায় ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি প্রকাণ্ডকায় বলবান। অথচ নির্ব্বোধ ব্যক্তিকে সকল বিষয়েই হারাইয়া দিতে পারে। শিবচন্দ্র ঘোষজা মহাশয় সৌর-ধর্ম্মাবলম্বী ছিলেন। সূর্য্য মেঘাচ্ছন্ন হইলে তাঁহার খাওয়া হইত না। সূর্য্য প্রকাশ হইলে খাইতেন। কখন কখন এই জন্য এক দিন দুদিন তাঁহাকে উপবাস করিতে হইত। শিবচন্দ্র ঘোষজা মহাশয়ের প্রধান দোসর কারালী চরণ নাগ ছিলেন।

“—Next himself in power, next in crime.”

Milton. 

“গণনীয় তাঁর পরেই পদে ও দোষে।”

 শিবচন্দ্র ঘোষজা মহাশয়ের আর এক দোসরের নাম ছিল বাই শম্ভু। লোকে তাঁহাকে বাই শোম্ভো বলিয়া ডাকিত। ছেলে বেলা যখন আমরা বাই-শোম্ভোকে দেখি নাই তখন এই বাই-শোম্ভো নাম শুনিলে ভয়ে বুক গুর গুর করিত। তাঁহাকে ঊনপঞ্চাশ বাই মূর্ত্তিমান অতি উগ্রচণ্ডা লোক বলিয়া বোধ হইত। বস্তুতঃ তিনি এরূপ ছিলেন না। তিনি একজন সদানিমীলিতনেত্র ধ্যাননিরত পরমযোগী ছিলেন। কিন্তু যোগী হইয়াও যুদ্ধ সময়ে বীরত্ব প্রকাশ করিতে ত্রুটি করিতেন না। তিনি অমিতবলশালী ছিলেন। তিনি দাঙ্গার সময় বিলক্ষণ লাঠি চালাইতে পারিতেন। স্কটের আইবানহোর ক্লার্ক অব্ কোপম্যানহার্ষ্ট’ (Ĉlerk of Copmanhurst) যেমন পাদ্রীও ছিলেন এবং লাঠিয়ালও ছিলেন ইনি সেইরূপ যোগী ও ছিলেন ও লাঠিয়ালও ছিলেন। এই বাজারীয়া দল ও ব্রহ্মজ্ঞানীর দল অনেক দিন হইল বাদল গ্রাম হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে। ঐ দুই দলের লোকেরা স্বপ্নেও মনে করেন নাই যে কোন ভাবী পুরাবৃত্তলেখক তাঁহাদিগকে অমরতা প্রদান করিতে চেষ্টা করিবেন। সে চেষ্টা সফল হইবে কিনা তাহা বিধাতাই জানেন।