ঘরোয়া/১
আমার প্রায়ই মনে পড়ে, সে অনেক দিনের কথা, রবিকাকার অনেক কাল আগেকার একটা ছড়া। তখন নীচে ছিল কাছারিঘর, সেখানে ছিল এক কর্মচারী, মহানন্দ নাম, সাদা চুল, সাদা লম্বা দাড়ি। তারই নামে তার সব বর্ণনা দিয়ে মুখে মুখে ছড়া তৈরি করে দিয়েছিলেন, সোমকা প্রায়ই সেটা আওড়াতেন—
মহানন্দ নামে এ কাছারিধামে
আছেন এক কর্মচারী,
ধরিয়া লেখনী লেখেন পত্রখানি
সদা ঘাড় হেঁট করি।
আরো সব নানা বর্ণনা ছিল—মনে আসছে না, সেই খাতাটা খুঁজে পেলে বেশ হত। কী সব মজার কথা ছিল সেই ছড়াটিতে—
হস্তেতে ব্যজনী ন্যস্ত,
মশা মাছি ব্যতিব্যস্ত—
তাকিয়াতে দিয়ে ঠেস—
ভুলে গেছি কথাগুলো। মহানন্দ দিনরাত পিঠের কাছে এক গির্দা নিয়ে খাতাপত্রে হিসাবনিকেশ লিখতেন, আর এক হাতে একটা তালপাতার পাখা নিয়ে অনবরত হাওয়া করতেন। রবিকাকাকে বোলো এই ছড়াটির কথা, বেশ মজা লাগবে, হয়তো তাঁর মনেও পড়বে।
দেখো, শিল্প জিনিসটা কী, তা বুঝিয়ে বলা বড়ো শক্ত। শিল্প হচ্ছে শখ। যার সেই শখ ভিতর থেকে এল সেই পারে শিল্প সৃষ্টি করতে, ছবি আঁকতে, বাজনা বাজাতে, নাচতে, গাইতে, নাটক লিখতে— যা’ই বলো।
একালে যেন শখ নেই, শখ বলে কোনো পদার্থই নেই। একালে সব কিছুকেই বলে ‘শিক্ষা’। সব জিনিসের সঙ্গে শিক্ষা জুড়ে দিয়েছে। ছেলেদের জন্য গল্প লিখবে তাতেও থাকবে শিক্ষার গন্ধ। আমাদের কালে ছিল ছেড়েবুড়োর শখ বলে একটা জিনিস, সবাই ছিল শৌখিন সেকালে, মেয়েরা পর্যন্ত—তাদেরও শখ ছিল। এই শৌখিনতার গল্প আছে অনেক, হবে আর-এক দিন। কতরকমের শখ ছিল এ বাড়িতেই, খানিক দেখেছি, খানিক শুনেছি। যাঁরা গল্প বলেছেন তারা গল্প বলার মধ্যে যেন সেকালটাকে জীবন্ত করে এনে সামনে ধরতেন। এখন গল্প কেউ বলে না, বলতে জানেই না। এখনকার লোকেরা লেখে ইতিহাস। শখের আবার ঠিক রাস্তা বা ভুল রাস্তা কী। এর কি আর নিয়মকানুন আছে। এ হচ্ছে ভিতরকার জিনিস, আপনিই সে বেরিয়ে আসে, পথ করে নেয়। তার জন্য ভাবতে হয় না। যার ভিতরে শখ নেই, তাকে এ কথা বুঝিয়ে বলা যায় না।
ছবিও তাই—টেকনিক, স্টাইল, ও-সব কিছু নয়, আসল হচ্ছে এই ভিতরের শখ। আমার বাজনার বেলায়ও হয়েছিল তাই। শোনো তবে, তোমায় বলি গল্পটা গোড়া থেকে।
ইচ্ছে হল পাকা বাজিয়ে হব, যাকে বলে ওস্তাদ। এসরাজ বাজাতে শুরু করলুম ওস্তাদ কানাইলাল ঢেরীর কাছে, আমি সুরেন ও অরুদা। শিমলের ও দিকে বাসাবাড়ি নিয়ে ছিল, আমরা রোজ যেতুম সেখানে বাজনা শিখতে। সুরেনের বিলিতি মিউজিক পিয়োনো সব জানা ছিল, ভালো করে শিখেছিল, সে তো তিন টপকায় মেরে দিলে। অরুদাও কিছুকালের মধ্যে কায়দাগুলো কস্ত করে নিলেন। আমার আর, যাকে বলে এসরাজের টিপ, সে টিপ আর দোরস্ত হয় না। আঙুলে কড়া পড়ে গেল, তার টেনে ধরে ধরে। বারে বারে চেষ্টা করছি টিপ দিতে, তার টেনে ধরে কান পেতে আছি কতক্ষণে ঠিক যে-সুরটি দরকার সেইটি বেরিয়ে আসবে, হঠাৎ এক সময়ে অ্যাঁ—ও করে শব্দ বেরিয়ে এল। ওস্তাদ হেসে বলত, হাঁ, এইবারে হল। আবার ঠিক না হলে মাঝে মাঝে ছড়ের বাড়ি পড়ত আমার আঙুলে। প্রথম প্রথম আমি তো চমকে উঠতুম, এ কী রে বাবা। এমনি করে আমার এসরাজ শেখা চলছে, রীতিমত হাতে নাড়া বেঁধে। ওস্তাদও পুরোদমে গুরুগিরি ফলাচ্ছে আমার উপরে। দেখতে দেখতে বেশ হাত খুলে গেল, বেশ সুর ধরতে পারি এখন, যা বলে ওস্তাদ তাই বাজাতে পারি, টিপও এখন ঠিকই হয়। ওস্তাদ তো ভারি খুশি আমার উপর। তার উপর বড়োলোকের ছেলে, মাঝে মাঝে পেন্নামি দেই, একটু ভক্তিটক্তি দেখাই—এমন শাগরেদের উপর নজর তো একটু থাকবেই। এই পেন্নামি দেবার দস্তুরমত একটা উৎসবের দিনও ছিল। শ্রীপঞ্চমীর দিন একটা বড়ো রকমের জলসা হত ওস্তাদের বাড়িতে। তাতে তার ছাত্ররা সবাই জড়ো হত, বাইরের অনেক ওস্তাদ শিল্পীরাও আসতেন। সেদিন ছাত্রদের ওস্তাদকে পেন্নামি দিয়ে পেন্নাম করতে হত। আমিও যাবার সময় পকেটে টাকাকড়ি নিয়ে যেতুম। অরুদা সুরেন ওরা এসব মানত না।
এসরাজ বাজাতে একেবারে পাকা হয়ে গেলুম। চমৎকার টিপ দিতে পারি এখন। শখ আমাকে এই পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেল। আমরা যখন ছোটো ছিলুম মহর্ষিদেব আমাদের কাছে গল্প করেছেন—একবার তাঁরও গান শেখবার শখ হয়েছিল। বিডন ষ্ট্রটে একটা বাড়ি ভাড়া করে ওস্তাদ রেখে কালোয়াতি গান শিখতেন, গলা সাধতেন। কিন্তু তাঁর গলা তো আমরা শুনেছি—সে আর-এক রকমের ছিল, যেন মন্ত্র আওড়াবার গলা, গানের গলা তাঁর ছিল বলে বোধ হয় না।
যে কথা বলছিলুম। দেখি সেই মামুলি গৎ, সেই মামুলি সুর বাজাতে হবে বারে বারে। একটু এদিক-ওদিক যাবার জো নেই—গেলেই তো মুশকিল। কারণ, ঐ-যে বললুম, ভিতরের থেকে শখ আসা চাই। আমার তা ছিল না, নতুন সুর বাজাতে পারতুম না, তৈরি করবার ক্ষমতা ছিল না। অথচ বারে বারে ধরাবাঁধা একই জিনিসে মন ভরে না। সেই ফাঁকটা নেই যা দিয়ে গলে যেতে পারি, কিছু সৃষ্টি করে আনন্দ পেতে পারি। হবে কী করে—আমার ভিতরে নেই, তাই ভিতর থেকে এল না সে জিনিস। ভাবলুম কী হবে ওস্তাদ হয়ে, কালোয়াতি সুর বাজিয়ে। আমার চেয়ে আরো বড়ো ওস্তাদ আছেন সব—যাঁরা আমার চেয়ে ভালো কালোয়াতি সুর বাজাতে পারেন। কিন্তু ছবির বেলা আমার তা হয় নি। বড়ো ওস্তাদ হয়ে গেছি এ কথা ভাবি নি—আমি ও তাদের সঙ্গে পাল্লা দেব, ছবির বেলায় হয়েছিল আমার এই শখ। ছবির বেলায় এই শখ নিয়ে আমি পিছিয়ে যাই নি কখনো। বড়োজ্যাঠামশায় একবার আমার ছবি দেখে বললেন, হ্যাঁ, হচ্ছে ভালো, বেশ, তবে গোটাকতক মাস্টারপিস প্রডিউস করো। তা নইলে কী হল। এই-সব লোকের কাছ থেকে আমি এইরকম সার্টিফিকেট পেয়েছি। এখন বুঝি ‘মাস্টার’ হতে হলে কতটা সাধনার দরকার। এখনো সেরকম মাস্টারপিস প্রডিউস করবার মতো উপযুক্ত হয়েছি কিনা আমি নিজেই জানি নে। বাজনাটা একেবারে ছেড়ে দিলুম না অবিশ্যি—কিন্তু উৎসাহও আর তেমন রইল না। বাড়িতে অনেকদিন অবধি সংগীতচর্চা করেছি। রাধিকা গোঁসাই নিয়মমত আসত। শ্যামসুন্দরও এসে যোগ দিলে। শ্যামসুন্দর ছিল কর্তাদের আমলের। মা বললেন, আবার ও কেন, তোমাদের মদ-টদ খাওয়ানো শেখাবে। ওকে তোমরা বাদ দাও। আমি বললুম, না মা, ও থাক্, গানবাজনা করবে। মদ খাব আমরা সে ভয় কোরো না। শ্যামসুন্দরও থেকে গেল। রোজ জলস হত বাড়িতে। রবিকাকা গান করতেন, আমি তখন তাঁর সঙ্গে বসে তাঁর গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এসরাজ বাজাতুম। ঐটাই আমার হত, কারো গানের সঙ্গে যে-কোনো সুর হোক-না কেন, সহজেই বাজিয়ে যেতে পারতুম। তখন ‘খামখেয়ালি’ হচ্ছে। একখানা ছোট্ট বই ছিল, লালরঙের মলাট, গানের ছোটো সংস্করণ, বেশ পকেটে করে নেওয়া যায়—দাদা সেটিকে যত্ন করে বাঁধিয়েছিলেন প্রত্যেক পাতাতে একখানা করে সাদা পাতা জুড়ে, রবিকাকা গান লিখবেন বলে—কোথায় যে গেল সেই খাতাখানা, তাতে অনেক গান তখনকার দিনের লেখা পাওয়া যেত। এ দিকে রবিকাকা গান লিখছেন নতুন নতুন, তাতে তখুনি সুর বসাচ্ছেন, আর আমি এসরাজে সুর ধরছি। দিনুরা তখন সব ছোটো—গানে নতুন সুর দিলে আমারই ডাক পড়ত। একদিন হয়েছে কী, একটা নতুন গান লিখেছেন, তাতে তখনি সুর দিয়েছেন—আমি যেমন সঙ্গে সঙ্গে বাজিয়ে যাই, বাজিয়ে গেছি। সুর-টুর মনে রাখতে হবে, ও সব আমার আসে না, তা ছাড়া তা খেয়ালই হয় নি তখন। পরের দিনে যখন আমায় সেই গানের সুরটি বাজাতে বললেন, আমি তো একেবারে ভুলে বসে আছি—ভৈরবী, কি, কী রাগিণী, কিছুই মনে আসছে না, মহা বিপদ। আমার ভিতরে তো সুর নেই, সুর মনে করে রাখব কী করে। কান তৈরি হয়েছে, হাত পেকেছে, যা শুনি সঙ্গে সঙ্গে বাজনায় ধরতে পারি, এই যা। এ দিকে রবিকাকাও গানে সুর বসিয়ে দিয়েই পরে ভুলে যান। অন্য কেউ সুরটি মনে ধরে রাখে। রবিকাকাকে বললুম, কী যেন সুরটি ছিল একটু একটু মনে আসছে। রবিকাকা বললেন, বেশ করেছ, তুমিও ভুলেছ আমিও ভুলেছি। আবার আমাকে নতুন করে খাটাবে দেখছি। তার পর থেকে বাজনাতে সুর ধরে রাখতে অভ্যেস করে নিয়েছিলুম, আর ভুলে যেতুম না। কিন্তু ঐ একটি সুর রবিকাকার আমি হারিয়েছি—কেউ আর পেলে না কোনোদিন, তিনিও পেলেন না।
গানটা আর আমার হল না। এই সেদিন কিছুকাল আগেই আমি রবিকাকাকে বললুম, দেখো, আমি তো তোমার গান গাইতে পারি না, তোমার সুর আমার গলায় আসে না, কিন্তু আমার সুরে যদি তোমার গান গাই, তোমার তাতে আপত্তি আছে? যেমন অ্যাক্টিং—উনি কথা দেন, আমি অ্যাক্টিং করি। তাই ভাবলুম, কথা যদি ওঁর থাকে আর আমার সুরে আমি গাই তাতে ক্ষতি কী। রবিকাকা বললেন, না, তা আর আপত্তি কী। তবে দেখো গানগুলো আমি লিখেছিলেম, সুরগুলোও দিয়েছি, সেগুলির উপর আমার মমতা আছে, তা নেহাত গাওই যদি তবে তার উপর একটু মায়াদয়া রেখে গেয়ো।
সে সময়ে রবিকাকার গানের সঙ্গে আমাদের বাজনা ইত্যাদি খুব জমত। এই একতলার বড়ো ঘরটিতেই আমাদের জলসা হত রোজ। ঘণ্টার জ্ঞান থাকত না, এক-একদিন প্রায় সারারাত কেটে যেত। আমি এসরাজ বাজাতুম, নাটোর বাজাতেন পাখোয়াজ। ঐ সময়ে একটা ড্রামাটিক ক্লাব হয়েছিল, তাতে রবিকাকা আমরা অনেকগুলি প্লে করেছিলুম। সে সব পরে এক সময় বলব। তবে বিসর্জন নাটক লেখার ইতিহাসটা বলি শোনো। তখন বর্ষাকাল, রবিকাকা আছেন পরগনায়। দাদা অরুদা আমরা কয়জনে, একটা কী নাটক হয়ে গেছে, আর-একটা নাটক করব তার আয়োজন করছি। ‘বউঠাকুরানীর হাট’এর বর্ণনাগুলি বাদ দিয়ে কেবল কথাটুকু নিয়ে খাড়া করে তুলেছি নাটক করব। ঝুপ্ ঝুপ্ বৃষ্টি পড়ছে, আমরা সব তাকিয়া বুকে নিয়ে এই-সব ঠিক করছি—এমন সময় রবিকাকা কী একটা কাজে ফিরে এসেছেন। তিনি বললেন, দেখি কী হচ্ছে! খাতাটা নিয়ে নিলেন,দেখে বললেন, না, এ চলবে না—আমি নিয়ে যাচ্ছি খাতাটা, শিলাইদহে বসে লিখে আনব, তোমরা এখন আর-কিছু কোরো না। যাক, আমরা নিশ্চিন্ত হলুম। এর কিছুদিন বাদেই রবিকাকা শিলাইদহে গেলেন, আট-দশ দিন বাদে ফিরে এলেন, ‘বিসর্জন’ নাটক তৈরি। এই রথীর ঘরেই প্রথম নাটকটি পড়া হল, আমরা সব জড়ো হলুম—তখনই সব ঠিক হল, কে কী পার্ট নেবে, রবিকাকা কী সাজবেন। হ. চ. হ.র উপর ভার পড়ল স্টেজ সাজাবার, সীন আঁকবার। আমিও তার সঙ্গে লেগে গেলুম। এক সাহেব পেণ্টার জোগাড় করে আনা গেল, সে ভালো সীন আঁকতে পারত, ইলোরা কেভ থেকে থাম-টাম নিয়ে কালীমন্দির হল। মোগল পেণ্টিং থেকে রাজসভা হল। কোনো কারণে ড্রামাটিক ক্লাব উঠে গেল, পরে শুনবে। তবে অনেক চাঁদার টাকা জমা রেখে গেল। এখন এই টাকাগুলো নিয়ে কী করা যাবে পরামর্শ হচ্ছে। আমি বললুম, কী আর হবে, ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধ করা যাক—এই টাকা দিয়ে একটা ভোজ লাগাও। ধুমধামে ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধ সুসম্পন্ন করা গেল—এ হচ্ছে ‘খামখেয়ালি’র অনেক আগে। ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধে রীতিমত ভোজের ব্যবস্থা হল, হোটেলের খানা। ‘বিনি পয়সার ভোজ’এর মধ্যে আমাদের সেইদিনটার মনের ভাব কিছু ধরা পড়েছে। এই শ্রাদ্ধবাসরে দ্বিজুবাবু নতুন গান রচনা করে আনলেন ‘আমরা তিনটি ইয়ার’ এবং ‘নতুন কিছু করো’। দ্বিজুবাবু আমাদের দলে সেই দিন থেকে ভরতি হলেন। এই শ্রাদ্ধের ভোজে ‘নিয়াপোলিটান ক্রীম্’ এমন উপাদেয় লেগেছিল যে আজও তা ভুলতে পারি নি—ঘটনাগুলো কিন্তু প্রায় মুছে গেছে মন থেকে। ঐ বিনি পয়সার ভোজের মতোই কাঁচের বাসনগুলো হয়ে গিয়েছিল চকচকে আয়না, মাটনচপের হাড়গুলো হয়েছিল হাতির দাঁতের চুষিকাঠি, এ আমি ঠিকই বলছি। এই সভাতেই খামখেয়ালি সভার প্রস্তাব করেন রবিকাকা। সভার সভ্য যাকে-তাকে নেওয়া নিয়ম ছিল না, কিংবা সভাপতি প্রভৃতির ভেজাল ছিল না। ভালো কতক পাক্কা খামখেয়ালি তারাই হল মজলিশী সভ্য, বাকি সবাই আসতেন নিমন্ত্রিত হিসেবে। প্রত্যেক মজলিশী সভোর বাড়িতে একটা করে মাসে মাসে অধিবেশন হত। নতুন লেখা, অভিনয়, কত কী হত তার ঠিক নেই, সঠিক বিবরণও নেই কোথাও। কেবল চোঁতা কাগজে ঘটনাবলীর একটু একটু ইতিহাস টোকা আছে।
বাজনার চর্চা আমি অনেকদিন অবধি রেখেছিলুম। এক সময়ে দেখি ভেঙে গেল। স্পষ্ট মনে পড়ছে না কেন। শ্যামসুন্দর চলে গেল, রাধিকা গোঁসাই সমাজে কাজ নিলে, আর আসে না কেউ, দিনু তখন গানবাজনা করে, কলকাতায় প্লেগ, মহামারী, তার পরে এল স্বদেশী হুজুগ। ঠিক কিসে যে আমার বাজনাটা বন্ধ হল তা মনে পড়ছে না।
তখন এক সময়ে হঠাৎ দেখি সবাই স্বদেশী হুজুগে মেতে উঠেছে। এই স্বদেশী হুজুগটা যে কোথা থেকে এল কেউ আমরা তা বলতে পারি নে। এল এইমাত্র জানি, আর তাতে ছেলে বুড়ো মেয়ে, বড়োলোক মুটে মজুর, সবাই মেতে উঠেছিল। সবার ভিতরেই যেন একটা তাগিদ এসেছিল। কিন্তু কে দিলে এই তাগিদ। সবাই বলে, হুকুম আয়া। আরে, এই হুকুমই বা দিলে কে, কেন। তা জানে না কেউ, জানে কেবল—হুকুম আয়া। তাই মনে হয় এটা সবার ভিতর থেকে এসেছিল—রবিকাকাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারে, তিনিও বোধ হয় বলতে পারবেন না। কে দিল এই তাগিদ, কোত্থেকে এল এই স্বদেশী হুজুগ! আমি এখনো ভাবি, এ একটা রহস্য। বোধ হয় ভূমিকম্পের পরে একটা বিষম নাড়াচাড়া—সব ওলোটপালোট হয়ে গেল। বড়ো-ছোটো মুটে মজুর সব যেন এক ধাক্কায় জেগে উঠল। তখনকার স্বদেশী যুগে এখনকার মতো মারামারি ঝগড়াঝাঁটি ছিল না। তখন স্বদেশীর একটা চমৎকার ঢেউ বয়ে গিয়েছিল দেশের উপর দিয়ে। এমন একটা ঢেউ যাতে দেশ উর্বরা হতে পারত, ভাঙত না কিছু। সবাই দেশের জন্য ভাবতে শুরু করলে—দেশকে নিজস্ব কিছু দিতে হবে, দেশের জন্য কিছু করতে হবে। আমাদের দলের পাণ্ডা ছিলেন রবিকাকা। আমরা সব একদিন জুতোর দোকান খুলে বসলুম। বাড়ির বুড়ো সরকার খুঁতখুঁত করতে লাগল, বলে, বাবুরা ওটা বাদ দিয়ে স্বদেশী করুন-না—জুতোর দোকান খোলা, ও-সব কেন আবার। মস্ত সাইনবোর্ড টাঙানো হল দোকানের সামনে—‘স্বদেশী ভাণ্ডার’। ঠিক হল স্বদেশী জিনিস ছাড়া আর কিছু থাকবে না দোকানে। বলু খুব খেটেছিল—নানা দেশ ঘুরে যেখানে যা স্বদেশী জিনিস পাওয়া যায়—মায় পায়ের আলতা থেকে মেয়েদের পায়ের জুতো সব-কিছু জোগাড় করেছিল, তার ঐ শখ ছিল। পুরোদমে দোকান চলছে। শুধু কি দোকান—জায়গায় জায়গায় পল্লীসমিতি গঠন হচ্ছে। প্লেগ এল, সেবাসমিতি হল, তাতে সিস্টার নিবেদিতা এসে যোগ দিলেন। চারি দিক থেকে একটা সেল্ফ স্যাকরিফাইসের ও একটা আত্মীয়তার ভাব এসেছিল সবার মনে।
পশুপতিবাবুর বাড়ি যাচ্ছি, মাতৃভাণ্ডার স্মৃষ্টি হবে—ন্যাশনাল ফণ্ড—টাকা তুলতে হবে। ঘোড়ার গাড়ির ছাদের উপর মস্ত টিনের ট্রাঙ্ক, তাতে সাদা রঙে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা—মাতৃভাণ্ডার। সবাই চাঁদা দিলে—একদিনে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা উঠে গিয়েছিল মায়ের ভাণ্ডারে। অনেক সাহেবসুবোও ব্যাপার দেখতে ছুটেছিল, তারাও টুপি উড়িয়ে বন্দেমাতরম্ রব তুলেছিল থেকে থেকে। তারা পুলিসের লোক কি খবরের কাগজের রিপোর্টার তা কে জানে।
রামকেষ্টপুরের রেলের কুলির খবর দিলে, বাবুরা যদি আসেন আমাদের কাছে তবে আমরাও টাকা দেব। আমরা রবিকাকা সবাই ছুটলুম। তখন বর্ষাকাল—একটা টিনের ঘরে আমাদের আড্ডা হল। এক মুহুরি টাকা গুণে নিলে। অতটুকু টিনের ঘরে তো মিটিং হতে পারে না। ঝুপ্ ঝুপ্ বৃষ্টি পড়ছে—বাইরে সারি সারি রেলগাড়ির নীচে শতরঞ্জি বিছিয়ে বক্তৃতা হচ্ছে আর আমি ভাবছি—এই সময়েই যদি ইঞ্জিন এসে মালগাড়ি টানতে শুরু করে তবেই গেছি আর কি। এই ভাবতে ভাবতে একটা কুলি এসে খবর দিলে সত্যিই একটা ইঞ্জিন আসছে। সবাই দুড়দাড় করে উঠে পড়লুম। শ-খানেক টাকা সেই কুলিদের কাছ থেকে পেয়েছিলুম।
ভূমিকম্পের বছর সেটা, নাটোর গেলুম সবাই মিলে, প্রোভিন্সিয়াল কন্ফারেন্স হবে। নাটোর ছিলেন রিসেপশন কমিটির প্রেসিডেণ্ট। সেখানে রবিকাকা প্রস্তাব করলেন, প্রোভিন্সিয়াল কন্ফারেন্স বাংলা ভাষায় হবে—বুঝবে সবাই। আমরা ছোকরারা ছিলুম রবিকাকার দলে। বললুম, হ্যাঁ, এটা হওয়া চাই যে করে হোক। তাই নিয়ে চাঁইদের সঙ্গে বাধল—তাঁরা কিছুতেই ঘাড় পাতেন না। চাঁইরা বললেন, যেমন কংগ্রেসে হয় সব বক্তৃতা-টক্তৃতা ইংরেজিতে তেমনিই হবে প্রোভিন্সিয়াল কন্ফারেন্সে। পাণ্ডেলে গেলুম, এখন যে’ই বক্তৃতা দিতে উঠে দাঁড়ায় আমরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠি, বাংলা, বাংলা। কাউকে আর মুখ খুলতে দিই না। ইংরেজিতে মুখ খুললেই ‘বাংলা ‘বাংলা’ বলে চেঁচাই। শেষটায় চাঁইদের মধ্যে অনেকেই বাগ মানলেন। লালমোহন ঘোষ এমন ঘোরতর সাহেব, তিনি ইংরেজি ছাড়া কখনো বলতেন না বাংলাতে, বাংলা কইবেন এ কেউ বিশ্বাস করতে পারত না—তিনিও শেষে বাংলাতেই উঠে বক্তৃতা করলেন। কী সুন্দর বাংলায় বক্তৃতা করলেন তিনি, যেমন ইংরেজিতে চমৎকার বলতে পারতেন বাংলা ভাষায়ও তেমনি। অমন আর শুনি নি কখনো। যাক, আমাদের তো জয়জয়কার। বাংলা ভাষার প্রচলন হল কন্ফারেন্সে। সেই প্রথম আমরা বাংলা ভাষার জন্য লড়লুম। ভূমিকম্পের যে গল্প বলব তাতে এসব কথা আরো খোলসা করে শুনবে।
আমি আঁকলুম ভারতমাতার ছবি। হাতে অন্নবস্ত্র বরাভয়—এক জাপানি আর্টিস্ট সেটিকে বড়ো করে একটা পতাকা বানিয়ে দিলে। কোথায় যে গেল পরে পতাকাটা, জানি নে। যাক—রবিকাকা গান তৈরি করলেন, দিনুর উপর ভার পড়ল, সে দলবল নিয়ে সেই পতাকা ঘাড়ে করে সেই গান গেয়ে গেয়ে চোরবাগান ঘুরে চাঁদা তুলে নিয়ে এল। তখন সব স্বদেশের কাজ স্বদেশী ভাব এই ছাড়া আর কথা নেই। নিজেদের সাজসজ্জাও বদলে ফেললুম। এই সাজসজ্জার একটা মজার গল্প বলি শোনো।
তখনকার কালে ইঙ্গবঙ্গসমাজের চাঁই ছিলেন সব—নাম বলব না তাঁদের, মিছেমিছি বন্ধুমানুষদের চটিয়ে দিয়ে লাভ কী বলে। তখনকার কালে ইঙ্গবঙ্গসমাজ কী রকমের ছিল ধারণা করতে পারবে খানিকটা। একদিন সেই ইঙ্গবঙ্গসমাজে একটা পার্টি হবে, আমাদেরও নেমন্তন্ন। কী সাজে যাওয়া যায়। রবিকাকা বললেন, সব ধুতি-চাদরে চলো। পরলুম ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে দিলুম শুঁড়তোলা পাঞ্জাবী চটি। এখন খালি পায়ে কী করে যাই। চেয়ে দেখি রবিকাকার পায়ে মোজা, আমরাও চটপট মোজা পরে নিলুম। যাক, মোজা পরে যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, তখনকার দিনে মোজা ছাড়া চলা, সে একটা ভয়ানক অসভ্যতা। আমি, দাদা, সমরদা ও রবিকাকা সেজেগুজে রওনা হলাম, সবাই আমরা মনে মনে ভাবছি, ইঙ্গবঙ্গের কেল্লায় কী রকম অভ্যর্থনা হবে, ভেবে একটু একটু হৎকম্পও হচ্ছে। কিছু দূর গেছি, দেখি রবিকাকা হঠাৎ এক-এক টানে দু-পায়ের মোজাদুটো খুলে গাড়ির পাদানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আমাদের বললেন, আর মোজা কেন, ও খুলে ফেলো; আগাগোড়া দেশী সাজে যেতে হবে। আমরাও তাই করলুম, সেই গাড়িতে বসেই যার যার পা থেকে মোজা খুলে ফেলে দিলুম। পার্টি বেশ জমে উঠেছে, এমন সময়ে আমরা চার মূর্তি গিয়ে উপস্থিত। আমাদের সাজসজ্জা দেখে সবার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, কেউ আর কথা কয় না। অনেকে ছিলেন আমাদের বিশেষ বন্ধু—আমাদের পরিবারের বন্ধু। কিন্তু সবাই গম্ভীর মুখে ঘাড় সোজা করে রইলেন, আমাদের দিকে ফিরে চাইলেন না আর। রবিকাকা চুপ করে রইলেন, কিছু বললেন না। আমরা বলাবলি করলুম একটু চোখ টিপে, রেগেছে, এরা খুব রেগেছে দেখছি। রেগেছে তো রেগেছে, কী আর করা যাবে—আমরা চুপ, সবশেষের বেঞ্চিতে বসে রইলুম। পার্টির শেষে কী একটা অভিনয় ছিল, দিনু সেজেছিল বুদ্ধদেব; তা দেখে বাড়ি ফিরে এলুম। পরে শুনেছি ওঁরা নাকি খুব চটে গিয়েছিলেন, বলেছেন, এ কী রকম ব্যবহার, এ কী অসভ্যতা, লেডিজদের সামনে দেশী সাজে আসা, তার উপর খালি পায়ে, মোজা পর্যন্ত না, ইত্যাদি সব। সেই-যে আমাদের ন্যাশনাল ড্রেস নাম হল, তা আর ঘুচল না। কিছুকাল বাদে দেখি বাইরেও সবাই সেই সাজ ধরতে আরম্ভ করেছে। এমন-কি, বিলেত-ফেরতারা ক্রমে ক্রমে ধুতি পরতে শুরু করলে। আমাদের কালে বিলেত-ফেরতাদের নিয়ম ছিল ধুতি বর্জন করা। আমাদের তো আর-কিছু ছিল না, ছিল কেবল মোজা, তাও সেই যে মোজা বর্জন করলুম আর ধরি নি কখনো। দেখো দিকিনি, এখনো বোধ হয় রবিকাকা মোজা পরেন না। ন্যাশনাল ড্রেস নাম হল কংগ্রেস থেকে। রবিকাকাই বললেন, কংগ্রেসকে ন্যাশনালাইজ করতে হবে। কলকাতায় সেবার কংগ্রেস হয়, দেশ-বিদেশের নেতারা এসেছিলেন অনেকেই। কর্তাদের শখ হল, এইখানেই সেই অতিথি-অভ্যাগতদের একটা পার্টি দিতে হবে। ঠিক হল সবাই ন্যাশনাল ড্রেসে আসবে। আমি বলি, সে কী করে হবে। রবিকাকা বললেন, না, তা হতেই হবে। তিনি নিমন্ত্রণপত্রে ছাপিয়ে দেওয়ালেন: all must come in national dress। তাতে একটা বিষম হৈ-চৈ পড়ে গেল ইঙ্গবঙ্গসমাজের চাঁইদের মধ্যে।
তখনকার সেই স্বদেশী যুগে ঘরে ঘরে চরকা কাটা, তাঁত বোনা, বাড়ির গিন্নি থেকে চাকরবাকর দাসদাসী কেউ বাদ ছিল না। মা দেখি একদিন ঘড়ঘড় করে চরকা কাটতে বসে গেছেন। মার চরকা কাটা দেখে হ্যাভেল সাহেব তাঁর দেশ থেকে মাকে একটা চরকা আনিয়ে দিলেন। বাড়িতে তাঁত বসে গেল, খটখট শব্দে তাঁত চলতে লাগল। মনে পড়ে এই বাগানেই সুতো রোদে দেওয়া হত। ছোটো ছোটো গামছা ধুতি তৈরি করে মা আমাদের দিলেন—সেই ছোটো ধুতি, হাঁটুর উপর উঠে যাচ্ছে, তাই প’রে আমাদের উৎসাহ কত।
একদিন রাজেন মল্লিকের বাড়ি থেকে ফিরছি, পল্লীসমিতির মিটিঙের পর, রাস্তার মোড়ে একটা মুটে মাথা থেকে মোট নামিয়ে সেলাম করে হাতে পয়সা কিছু গুঁজে দিলে, বললে, আজকের রোজগার। একদিনের সব রোজগার স্বদেশের কাজে দিয়ে দিলে। মুটেমজুরদের মধ্যেও কেমন একটা ভাব এসেছিল স্বদেশের জন্য কিছু করবার, কিছু দেবার।
রবিকাকা একদিন বললেন, রাখীবন্ধন-উৎসব করতে হবে আমাদের, সবার হাতে রাখী পরাতে হবে। উৎসবের মন্ত্র অনুষ্ঠান সব জোগাড় করতে হবে, তখন তো তোমাদের মতো আমাদের আর বিধুশেখর শাস্ত্রীমশায় ছিলেন না, ক্ষিতিমোহনবাবুও ছিলেন না কিছু একটা হলেই মন্ত্র বাতলে দেবার। কী করি, থাকবার মধ্যে ছিলেন ক্ষেত্রমোহন কথক ঠাকুর, রোজ কথকতা করতেন আমাদের বাড়ি, কালো মোটাসোটা তিলভাণ্ডেশ্বরের মতে চেহারা। তাঁকে গিয়ে ধরলুম, রাখীবন্ধন-উৎসবের একটা অনুষ্ঠান বাতলে দিতে হবে। তিনি খুব খুশি ও উৎসাহী হয়ে উঠলেন, বললেন, এ আমি পাঁজিতে তুলে দেব, পাঁজির লোকদের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে, এই রাখীবন্ধন-উৎসব পাঁজিতে থেকে যাবে। ঠিক হল সকালবেলা সবাই গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখী পরাব। এই সামনেই জগন্নাথ ঘাট, সেখানে যাব—রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়িঘোড়া নয়। কী বিপদ, আমার আবার হাঁটাহাঁটি ভালো লাগে না। কিন্তু রবিকাকার পাল্লায় পড়েছি, তিনি তো কিছু শুনবেন না। কী আর করি—হেঁটে যেতেই যখন হবে, চাকরকে বললুম, নে সব কাপড়-জামা, নিয়ে চল্ সঙ্গে। তারাও নিজের নিজের গামছা নিয়ে চলল স্নানে, মনিব চাকর একসঙ্গে সব স্নান হবে। রওনা হলুম সবাই গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে, রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাথ অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে—মেয়েরা খৈ ছড়াচ্ছে, শাঁক বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম—যেন একটা শোভাযাত্রা। দিনুও ছিল সঙ্গে, গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে মিছিল চলল—
বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
এই গানটি সে সময়েই তৈরি হয়েছিল। ঘাটে সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য, রবিকাকাকে দেখবার জন্য আমাদের চার দিকে ভিড় জমে গেল। স্নান সারা হল—সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল এক গাদা রাখী, সবাই এ ওর হাতে রাখী পরালুম। অন্যরা যার কাছাকাছি ছিল তাদেরও রাখী পরানো হল। হাতের কাছে ছেলেমেয়ে যাকে পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বাদ পড়ছে না, সবাইকে রাখী পরানো হচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সে এক ব্যাপার। পাথুরেঘাটা দিয়ে আসছি, দেখি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতকগুলো সহিস ঘোড়া মলছে, হঠাৎ রবিকাকারা ধাঁ করে বেঁকে গিয়ে ওদের হাতে রাখী পরিয়ে দিলেন। ভাবলুম রবিকাকারা করলেন কী, ওরা যে মুসলমান, মুসলমানকে রাখী পরালে—এইবারে একটা মারপিট হবে। মারপিট আর হবে কী। রাখী পরিয়ে আবার কোলাকুলি, সহিসগুলো তে হতভম্ব, কাণ্ড দেখে। আসছি, হঠাৎ রবিকাকার খেয়াল গেল চিৎপুরের বড়ো মসজিদে গিয়ে সবাইকে রাখী পরাবেন। হুকুম হল, চলো সব। এইবারে বেগতিক—আমি ভাবলুম, গেলুম রে বাবা, মসজিদের ভিতরে গিয়ে মুসলমানদের রাখী পরালে একটা রক্তারক্তি ব্যাপার না হয়ে যায় না। তার উপর রবিকাকার খেয়াল, কোথা দিয়ে কোথায় যাবেন আর আমাকে হাঁটিয়ে মারবেন। আমি করলুম কী, আর উচ্চবাচ্য না করে যেই-না আমাদের গলির মোড়ে মিছিল পৌঁছানো, আমি সট্ করে একেবারে নিজের হাতার মধ্যে প্রবেশ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। রবিকাকার খেয়াল নেই—সোজা এগিয়েই চললেন মসজিদের দিকে, সঙ্গে ছিল দিনু, সুরেন, আরো সব ডাকাবুকো লোক।
এ দিকে দীপুদাকে বাড়িতে এসে এই খবর দিলুম, বললুম, কী একটা কাণ্ড দেখো। দীপুদা বললেন, এই রে, দিনুও গেছে, দারোয়ান দারোয়ান, যা শিগগির, দেখ্ কী হল— বলে মহা চেঁচামেচি লাগিয়ে দিলেন। আমরা সব বসে ভাবছি—এক ঘণ্টা কি দেড় ঘণ্টা বাদে রবিকাকারা সবাই ফিরে এলেন। আমরা সুরেনকে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কী, কী হল সব তোমাদের। সুরেন যেমন কেটে কেটে কথা বলে, বললে, কী আর হবে, গেলুম মসজিদের ভিতরে, মৌলবী-টৌলবী যাদের পেলুম হাতে রাখী পরিয়ে দিলুম। আমি বললুম, আর মারামারি! সুরেন বললে, মারামারি কেন হবে—ওরা একটু হাসলে মাত্র। যাক্, বাঁচা গেল। এখন হলে—এখন যাও তো দেখি, মসজিদের ভিতরে গিয়ে রাখী পরাও তো—একটা মাথা-ফাটাফাটি কাণ্ড হয়ে যাবে।
তখন পুলিসের নজর যে কিছুই নেই আমাদের উপরে, তা নয়। একবার আমাদের উপরের দোতলার হলে একটা মিটিং হচ্ছে, রাখীবন্ধনের আগের দিন রাত্তিরে, উৎসবের কী করা হবে তার আলোচনা চলছিল। সেদিন ছিল বাড়িতে অরন্ধন, শাস্ত্র থেকে সব নেওয়া হয়েছিল তো! মেয়েরা সেবারে দেশ-বিদেশ থেকে ফোঁটা রাখী পাঠিয়েছিল রবিকাকাকে। হ্যাঁ, মিটিং তো হচ্ছে—তাতে ছিলেন এক ডেপুটিবাবু। আমাদের সে-সব মিটিঙে কারো আসবার বাধা ছিল না। খুব জোর মিটিং চলছে, এমন সময়ে দারোয়ান খবর দিলে, পুলিস সাহেব উপর আনে মাঙ্তা।
সব চুপ, কারো মুখে কোনো কথা নেই। রবিকাকা দারোয়ানকে বললেন, যাও, পুলিস সাহেবকে নিয়ে এসো উপরে।
ডেপুটিবাবুর অভোস ছিল, সব সময়ে তিনি হাতের আঙুলগুলি নাড়তেন আর এক দুই তিন করে জপতেন। তাঁর কর-জপা বেড়ে গেল পুলিস সাহেবের নাম শুনে। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললেন, আমার এখানে তো আর থাকা চলবে না। পালাবার চেষ্টা করতে লাগলেন, বেড়ালের নাম শুনে যেমন ইঁদুর পালাই-পালাই করে। আমি বললুম, কোথায় যাচ্ছেন আপনি, সিঁড়ি দিয়ে নামলে তো এখুনি সামনাসামনি ধরা পড়ে যাবেন। তিনি বললেন, তবে, তবে—করি কী, উপায়? আমি বললুম, এক উপায় আছে, এই ড্রেসিং-রুমে ঢুকে পড়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে থাকুন গে। ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি উঠে তাই করলেন—ড্রেসিংরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। রবিকাকা মুখ টিপে হাসলেন। দারোয়ান ফিরে এল—জিজ্ঞেস করলুম, পুলিস সাহেব কই। দারোয়ান বললে, পুলিস সাহেব সব পুছকে চলা গয়া। পুলিস জানত সব, আমাদের কোনো উপদ্রব করত না, যে যা মিটিং করতাম—পুলিস এসেই খোঁজখবর নিয়ে চলে যেত, ভিতরে আর আসত না কখনো।
বেশ চলছিল আমাদের কাজ। মনে হচ্ছিল এবারে যেন একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিভাইভাল হবে দেশে। দেশের লোক দেশের জন্য ভাবতে শুরু করেছে, সবার মনেই একটা তাগিদ এসেছে, দেশকে নতুন একটা কিছুদিতে হবে। এমন সময়ে সব মাটি হল যখন একদল নেতা বললেন, বিলিতি জিনিস বয়কট করো। দোকানে দোকানে তাদের চেলাদের দিয়ে ধন্না দেওয়ালেন, যেন কেউ না গিয়ে বিলিতি জিনিস কিনতে পারে। রবিকাকা বললেন, এ কী, যার ইচ্ছে হয় বিলিতি জিনিস ব্যবহার করবে, যার ইচ্ছে হয় করবে না। আমাদের কাজ ছিল লোকের মনে আস্তে আস্তে বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেওয়া—জোর জবরদস্তি করা নয়। মাড়োয়ারি দোকানদার এসে হাতে-পায়ে ধরে অনেক টাকা দিয়ে এ বছরের বিলিতি মালগুলো কাটাবার ছাড় চাইলে। নেতারা কিছুতেই মানলেন না। রবিকাকা বলেছিলেন এদের এক বছরের মতো ছেড়ে দিতে —মিছেমিছি দেশের লোকদের লোকসান করিয়ে কী হবে। নেতারা সে সুপরামর্শে কর্ণপাত করলেন না। বিলিতি বর্জন শুরু হল, বিলিতি কাপড় পোড়ানো হতে লাগল, পুলিসও ক্রমে নিজমূর্তি ধরল। টাউন হলে পাবলিক মিটিঙে যেদিন সুরেন বাঁড়ুজ্জে বয়কট ডিক্লেয়ার করলেন রবিকাকা তখন থেকেই স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন, তিনি এর মধ্যে নেই।
গেল আমাদের স্বদেশী যুগ ভেঙে। কিন্তু এই যে স্বদেশী যুগে ভাবতে শিখেছিলুম, দেশের জন্য নিজস্ব কিছু দিতে হবে, সেই ভাবটিই ফুটে বের হল আমার ছবির জগতে। তখন বাজনা করি, ছবিও আঁকি—গানবাজনাটা আমার ভিতরে ছিল না, সেটা গেল—ছবিটা রইল।
ছবি দেশীমতে ভাবতে হবে, দেশীমতে দেখতে হবে। রবিবৰ্মাও তো দেশীমতে ছবি এঁকেছিলেন, কিন্তু বিদেশী ভাব কাটাতে পারেন নি, সীতা দাঁড়িয়ে আছে ভিনাসের ভঙ্গিতে। সেইখানে হল আমার পালা। বিলিতি পোর্ট্রেট আঁকতুম, ছেড়েছুড়ে দিয়ে পট পটুয়া জোগাড় করলুম। যে দেশে যা-কিছু নিজের নিজের শিল্প আছে, সব জোগাড় করলুম। যতরকম পট আছে সব স্টাডি করলুম, সেই খাতাটি এখনো আমার কাছে।
তার পর দেশীমতে দেশী ছবি আঁকতে শুরু করলুম। এক-এক সময়ে এক-একটা হাওয়া আসে, ধীরে ধীরে আপনিই চালিয়ে নিয়ে যায়। দড়িদড়া ছিঁড়ে কাঁপিয়ে পড়লুম, নৌকো দিলুম খুলে স্রোতের মুখে। বিলিতি আর্ট দূর করে দিয়ে দেশী আর্ট ধরলুম। তার পর স্বদেশী যুগ, দেশের আবহাওয়া, এ-সব হচ্ছে সুবাতাস। সেই সুবাতাস ধীরে ধীরে নৌকো এগিয়ে নিয়ে চলল।
দেখি আমাদের দেশী দেবদেবীর ছবি নেই। নন্দলালদের দিয়ে আমি তাই নানান দেবদেবীর ছবি আঁকিয়েছি। আর্ট স্টুডিয়ো থেকে যা-সব দেবদেবীর ছবি বের হত তখন! আমি বললুম, নন্দলালকে, আঁকো যমরাজ, অগ্নিদেবতা, আরো-সব দেবতার ছবি, থাকুক এক-একটা ‘ক্যারেক্টার’ লোকের চোখের সামনে। আমার আবার দেবতার ছবি ভালো আসে না, যা কৃষ্ণচরিত্র করেছিলুম তাও ভিতর থেকে ওটা কী রকম খেলে গিয়েছিল ব’লে। নয়তো আমার ভালো দেবদেবীর ছবি নেই। তা, নন্দলালরা বেশ কতকগুলো দেবতার ছবি এঁকে গিয়েছে, লোকেরা নিয়েছেও তা। ছবি আঁকবার আমার আর-একটা মূল উদ্দেশ্য ছিল যে, ছবি আঁকা এমন সহজ করে দিতে হবে যাতে সব ছেলেমেয়ের নির্ভয়ে এঁকে যাবে। তখন আর্ট শেখা ছিল মহা ভয়ের ব্যাপার। সেটা আমার মনে লেগেছিল। তাই ভেবেছিলুম এই ভয় ঘোচাতে হবে, ছবি আঁকা এত সহজ করে দেব। কারণ এটা আমি নিজে অনুভব করেছি আমার ভাষার বেলায়। রবিকাকা আমাকে নির্ভয় করে দিয়েছিলেন। ত, আমিও ছবি আঁকার বেলায় নির্ভয় তো করে দিলুম, দিয়ে এখন আমার ভয় হয় যে কী করলুম। এখন যা-সব নির্ভয়ে ছবি আঁকা শুরু করেছে, ছবি এঁকে আনছে—এ যেন সেই ব্রহ্মার মতো। কী যেন একটা গল্প আছে যে ব্রহ্মা একবার কোনো একটি রাক্ষস তৈরি করে নিজেই প্রাণভয়ে অস্থির, রাক্ষস তাঁকে খেতে চায়। ভাবি, আমার বেলায়ও তাই হয় বা। আমার ছবির মূল কথা ছিল, ঐ আর্টকে নিজের করতে হবে, পার?—সহজ করতে হবে। আমি তো বলি যে আর্টের তিনটে স্তর তিনটে মহল আছে—একতলা, দোতলা, তেতলা। একতলার মহলে থাকে দাসদাসী তারা সব জিনিস তৈরি করে। তারা সার্ভিস দেয়, ভালো রান্না করে দেয়, ভালো আসবাব তৈরি করে দেয়। তারা হচ্ছে সার্ভার, মানে ক্র্যাফ্ট্স্ম্যান—তারা একতলা থেকে সব-কিছু করে দেয়। দোতলা হচ্ছে বৈঠকখানা। সেখানে থাকে ঝাড়লণ্ঠন, ভালো পর্দা, কিংখাবের গদি, চার দিকে সব-কিছু ভালো ভালো জিনিস, যা তৈরি হয়ে আসে একতলা থেকে, দোতলায় বৈঠকখানায় সে-সব সাজানো হয়। সেখানে হয় রসের বিচার, আসেন সব বড়ো বড়ো রসিক পণ্ডিত। সেখানে সব নটীর নাচ, ওস্তাদের কালোয়াতি গান, রসের ছড়াছড়ি—শিল্পদেবতার সেই হল খাস-দরবার। তেতলা হচ্ছে অন্দরমহল, মানে অন্তরমহল। সেখানে শিল্পী বিভোর, সেখানে সে মা হয়ে শিল্পকে পালন করছে, সেখানে সে মুক্ত, ইচ্ছেমত শিশু-শিল্পকে সে আদর করছে, সাজাচ্ছে।
আর্টের আছে এই তিনটে মহল। এই তিনটি মহলেরই দরকার আছে। নীচের তলার ক্র্যাফ্ট্স্ম্যানেরও দরকার, তারা সব জিনিস তৈরি করে দেবে দোতলার জন্য। ভালো রান্না করে দেবে, নয়তে দোতলায় তুমি রসিকজনদের ভালো জিনিস খাওয়াবে কী করে। দোতলায় হয় রসের বিচার। আর তেতলায় হচ্ছে মায়ের মতো শিশুকে পালন করা। গাছের শিকড় যেমন থাকে মাটির নীচে, আর ডালের ডগায় কচি পাতাটি যেমন হাত বাড়িয়ে থাকে আলোবাতাসের দিকে, তেতলা হচ্ছে তাই। এখন দেখতে হবে কাদের কোন্ তলায় ঠাঁই। সব মহলেই জিনিয়াস তৈরি হতে পারে, জিনিয়াসের ঠাঁই হতে পারে। এইভাবে যদি দেখতে শেখ তবেই সব সহজ হয়ে যাবে। এই যে রবিকাকা আজকাল ছোটো ছোটো গল্প লিখছেন, এ হচ্ছে ঐ তেতলার অন্তরমহলের ব্যাপার। উনি নিজেই বলেছেন সেদিন, এখন আমি খ্যাতিঅখ্যাতির বাইরে। তাই উনি অন্দরমহলে বসে আপন শিশুর সঙ্গে খেলা করছেন, তাকে আদর করে সাজিয়ে তুলছেন। সেখানে একটি মাটির প্রদীপ মিট্মিট্ করে জ্বলছে, দুটি রূপকথা—এ সবাই বুঝতে পারে না।
আমার এই যে এখনকার পুতুল গড়া, এও হচ্ছে ঐ অন্দরমহলেরই ব্যাপার। আমি তাই এক-এক সময়ে ভাবি, আগে যে যত্ন নিয়ে ছবি আঁকতুম এখন আমি সেই যত্ন নিয়েই পুতুল গড়ছি, সাজাচ্ছি, তাকে বসাচ্ছি কত সাবধানে। নন্দলালকে জিজ্ঞেস করলুম, এ কি আমি ঠিক করছি। সেদিন আমার পুরোনো চাকরটা এসে বললে, বাবু, আপনি এ-সব ফেলে দিন। দিনরাত কাঠকুটো নিয়ে কী যে করেন, সবাই বলে আপনার ভীমরতি হয়েছে। আমি বললুম, ভীমরতি নয়, বাহাত্তুরে বলতে পারিস, দু-দিন বাদে তো তাই হব। তাকে বোঝালুম, দেখ্, ছেলেবেলায় যখন প্রথম মায়ের কোলে এসেছিলুম তখন এই ইঁট কাঠ ঢেলা নিয়েই খেলেছি, আবার ঐ মায়ের কোলেই শেষে ফিরে যাবার বয়স হয়েছে কিনা, তাই আবার সেই ইঁট কাঠ ঢেলা নিয়েই খেলা করছি। নন্দলাল বললে, তা নয়, আপনি এখন দুরবীনের উল্টো দিক দিয়ে পৃথিবী দেখছেন। কথাটা আমিই একদিন ওকে বলেছিলুম, সবাই দুরবীনের সোজা দিক দিয়ে দেখে, কিন্তু উল্টো পিঠ দিয়ে দেখো দিকিনি, কেমন মজার খুদে খুদে সব দেখায়। ছেলেবেলায় আমি আর-এক কাণ্ড করতুম—হাতের উপর ভর দিয়ে মাথা নীচের দিকে পা দুটো উপরের দিকে তুলে পায়ের নীচে দিয়ে গাছপালা দেখতুম, বেড়ে মজা লাগত।
নন্দলাল তাই বললে, আপনিও এখন দুরবীনের উল্টো দিক দিয়েই সব-কিছু দেখছেন।
এই দুরবীনের উল্টো পিঠ দিয়ে দেখা, এও একটা শখ।