ঘর-পোড়া লোক (প্রথম অংশ)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
যে গ্রামে রামসেবকের বাড়ী, সেই গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ। গোফর খাঁ যে একজন খুব বড় জমিদার, তাহা নহে; কিন্তু নিতান্ত ক্ষুদ্র জমিদার ও নহেন। ইঁহার জমিদারীর আয়, সালিয়ানা পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা হইবে। গোফুর খাঁ জমিদার, কিন্তু জমিদার-পুত্র নহেন। তাঁহার পিতা একজন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ছিলেন। তিনি যাহা কিছু উপার্জ্জন করিতেন, তাহার দ্বারা কোন গতিতে পরিবার প্রতিপালন করিতেন মাত্র; কিন্তু তাহা হইতে একটী কপর্দ্দকও সঞ্চয় করিয়া রাখিতে পারিতেন না। গোফুর খাঁ তাঁহার পিতার প্রথম বা একমাত্র পুত্র। যে সময় তাঁহার পিতা পরলোক গমন করেন, সেই সময় গেফুরের বয়ঃক্রম পনর বৎসরের অধিক ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর অনন্যোপায় হইয়া গোফুর সামান্য চাকরীর উমেদারীতে প্রবৃত্ত হন, এবং আপন দেশ ছাড়িয়া কানপুরে গমন করেন। সেই সময় কানপুরে একজন মুসলমান বাস করিতেন। চামড়ার দালালী করিয়া তিনি দশটাকার সংস্থান করিয়াছিলেন, এবং দেশের মধ্যে মান-সম্ভ্রম ও একটু সবিশেষ প্রতিপত্তিও স্থাপন করিতে পারিয়াছিলেন। গোফুর খাঁ কানপুরে আসিয়া প্রথমে তাঁহারই আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং তাঁহারই নিকট অতি সামান্য বেতনে একটা চাকরী সংগ্রহ করিয়া লন। গোফুর খাঁ অতিশয় বুদ্ধিমান্ ও সবিশেষ কার্য্যক্ষম ছিলেন; সুতরাং অতি অল্পদিবসের মধ্যেই তিনি আপন মনিবের প্রিয়পাত্র হইয়া পড়েন, এবং ক্রমে তিনি তাঁহার মনিবের কার্য্যে সবিশেষরূপে সাহায্য করিতে সমর্থ হন্। দিন দিন যেমন তিনি তাঁহার মনিবের প্রিয়পাত্র হইতে ছিলেন, সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বেতনও ক্রমে বর্দ্ধিত হইতেছিল।
সে যাহা হউক, যে সকল কার্য্য করিয়া তাঁহার মনিব সেই দেশের মধ্যে প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, পরিশেষে সেই সমস্ত কার্য্য গোফুর খাঁ নিজে সম্পাদন করিতে লাগিলেন। ইদানীং তাঁহার মনিবকে আর কোন কার্য্যই দেখিতে হইত না, সকল কার্য্য গোফুরের উপরেই নির্ভর করিত। গোফুরও প্রাণপণে এরূপ ভাবে কার্য্য সম্পন্ন করিয়া আসিতে লাগিলেন যে, তাঁহার মনিবের কার্য্য পূর্ব্ব অপেক্ষা আরও অতি উত্তমরূপে চলিতে লাগিল। সর্ব্বসাধারণে গোফুরের মনিবকে যেরূপ ভাবে বিশ্বাস করিতেন, গোফুরকে তাহা অপেক্ষা আরও অধিক বিশ্বাস করিতে লাগিলেন। এমন কি, সেই সময় গোফুরের মনিবকে পরিত্যাগ করিয়া ব্যবসায়ী মাত্রেই গোফুরকে চাহিতে লাগিলেন, ও গোফুরের হস্ত হইতে সমস্ত দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে লাগিল। এই ব্যাপার দেখিয়া গোফুরের মনিব নিজে আর কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ না করিয়া সমস্ত কার্য্যভারই গোফুরের উপর অর্পণ করিলেন, এবং পরিশেষে গোফুরকে একজন অংশীদার করিয়া লইলেন। গোফুরও সবিশেষ পারদর্শিতার সহিত কার্য্য করিয়া ক্রমে যথেষ্ট উপার্জ্জন করিতে আরম্ভ করিলেন।
এইরূপে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হইবার পর গোফুরের মনিব বা অংশীদার ইহলীলা সম্বরণ করিলেন; সুতরাং এখন সেই কার্য্যের সমস্ত অংশই গোফুরের হইল। গোফুরও সবিশেষ মনোযোগের সহিত আপন কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া যথেষ্ট অর্থ উপার্জ্জন করিতে লাগিলেন। এইরূপে দুই একখানি করিয়া ক্রমে জমিদারী ক্রয় করিতে লাগিলেন। এইরূপে তিনি যে সকল জমিদারী ক্রমে ক্রয় করিয়াছিলেন, সেই সকল জমিদারীর আয় পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকায় দাঁড়াইল। সেই সময় গোফুর খাঁও ক্রমে বৃদ্ধ হইয়া পড়ায় আপনার ব্যবসা পরিত্যাগ করিলেন, এবং কেবলমাত্র তাঁহার জমিদারীতেই আপনার মন নিয়োগ করিবার মানস করিলেন।
গোফুর খাঁর কেবল একটীমাত্র পুত্র জন্মিয়াছিল, তাহার নাম তিনি ওস্মান রাখিয়াছিলেন। আপন পুত্র ওস্মানকে প্রথমতঃ তিনি আপনার ব্যবসা কার্য্য শিখাইবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টা করেন; কিন্তু কোনরূপে আপন মনস্কামনা পূর্ণ করিতে পারেন নাই। বাল্যকালে গোফুর খাঁর যেরূপ প্রকৃতি ছিল, তাঁহার পুত্র ওস্মানের প্রকৃতি বাল্যকাল হইতেই তাহার বিপরীত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। গোফুর খাঁ সর্ব্বদা আপন কার্য্যে মন নিয়োগ করিতেন, ওস্মান কেবল অপরের সহিত মিলিয়া আমোদ-আহ্লাদ করিয়া দিন অতিবাহিত করিতে লাগিল।
গোফুরের চেষ্টা ছিল, কিরূপে আপনার কার্য্যে তিনি সবিশেষরূপে উন্নীত হইতে পারেন।
ওস্মান ভাবিতেন, অসৎ উপায় অবলম্বনে কিরূপে তিনি তাঁহার পিতার উপার্জ্জিত অর্থ ব্যয় করিতে সমর্থ হন।
গোফুর সর্ব্বদা সৎকার্য্যের দিকে দৃষ্টি রাখিতেন। কিরূপে দশজন প্রতিপালিত হয়, কিরূপে দশজনের উপকার করিতে পারেন, তাহার দিকে সর্ব্বদা তিনি লক্ষ্য রাখিতেন।
ওস্মানের লক্ষ্য হইয়াছিল, কেবল অসৎ কার্য্যের দিকে। আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রগণের প্রতিপালনের পরিবর্ত্তে কতকগুলি নীচজাতীয় বার-বনিতা তাহার দ্বারা প্রতিপালিতা হইত।
ওস্মানের এইরূপ অবস্থা সত্বেও একমাত্র সন্তান বলিয়া তাহার পিতা গোফুর খাঁ তাহাকে কিছু বলিতেন না। সুতরাং ওস্মানের অত্যাচার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস হইবার পরিবর্ত্তে ক্রমে আরও বর্দ্ধিত হইতে লাগিল।
গোফুর খাঁ নিতান্ত বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন বলিয়া, তিনি মনে করিয়াছিলেন, ব্যবসা কার্য্যের ভার তিনি তাঁহার পুত্র ওস্মান খাঁর হস্তে প্রদান করিবেন; কিন্তু তাহার চরিত্র দেখিয়া আপনার ইচ্ছাপূর্ণ করিতে পারিলেন না। অথচ ব্যবসায়ীগণের অনুরোধ রক্ষা করিতে গিয়া, তিনি আপন কার্য্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপন বাড়ীতে বসিয়া তাঁহার বৃদ্ধাবস্থায় যে কিছু দিবস বিশ্রাম করিবেন, তাহাতেও তিনি সমর্থ হইলেন না। তাঁহাকে সর্ব্বদা কানপুরেই থাকিতে হইত। এদিকে অবসর পাইয়া ওস্মান জমিদারীর ভিতর যথেচ্ছ ব্যবহার করিত। তাহার অত্যাচারে প্রজাগণের মধ্যে কেহই শান্তিলাভ করিতে পারিত না। কিরূপে ওস্মানের হস্ত হইতে আপনাপন স্ত্রী-কন্যার ধর্ম্ম রক্ষা করিতে সমর্থ হইবে, কেবল তাহার চিন্তাতেই তাহাদিগকে সর্ব্বদা দিন অতিবাহিত করিতে হইত।
ওস্মানের এই সকল অত্যাচারের কথা ক্রমে তাহার পিতা গোফুর খাঁর কর্ণগোচর হইতে লাগিল; কিন্তু গোফুর খাঁ তাহার প্রতিকারের কোনরূপ চেষ্টাও করিলেন না।
এইরূপ নানা কারণে, প্রজাগণ ক্রমে তাঁহাদিগের অবাধ্য হইয়া পড়িতে লাগিল। জমিদারীর খাজনা প্রায়ই তাহারা বাকী ফেলিতে লাগিল, বিনা-নালিশে খাজনা আদায় প্রায় একরূপ বন্ধ হইয়া গেল।
এই সকল অবস্থা দেখিয়াও ওস্মানের অত্যাচারের কিছু মাত্র নিবৃত্তি হইল না। তাহার কতকগুলি অশিক্ষিত ও দুষ্টমতি পরিষদের পরামর্শ-অনুযায়ী সেই সকল অত্যাচার ক্রমে বৃদ্ধিই হইতে লাগিল। তাহাদিগের অত্যাচারে অনেককেই তাহার জমিদারী পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে হইল। বিশেষতঃ যাহাদিগের গৃহে সুশ্রী যুবতী স্ত্রীলোক আছে, তাহাদিগের সেই স্থানে বাস করা একবারেই অসম্ভব হইয়া পড়িতে লাগিল।
এরূপ পাপে কতদিবস প্রজাগণ সন্তুষ্ট থাকে? বা ঈশ্বরই আর কতদিবস এ পাপ মার্জ্জনা করেন? ওস্মান একজন মধ্যবিদ্ জমিদারের পুত্র বইত নয়? এরূপ অত্যাচার করিয়া যখন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা প্রভৃতিও নিষ্কৃতি পান নাই, তখন এই সামান্য জমিদার-পুত্র যে অনায়াসেই নিষ্কৃতি পাইবেন, তা কিছুতেই হইতে পারে না। সমস্ত কার্য্যেরই সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করিলে যে অবস্থা ঘটিয়া থাকে, ওস মানের অদৃষ্টে যে সেই অবস্থা না ঘটবে, তাহা কে বলিতে পারে?