ঘর-পোড়া লোক (প্রথম অংশ)/প্রথম পরিচ্ছেদ
ঘর-পোড়া লোক।
(প্রথম অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।
অদ্য যে বিষয় আমি পাঠকগণকে উপহার দিতে প্রস্তুত হইয়াছি, তাহা অতি ভয়ানক ও লোমহর্ষণ-জনক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব নাই, অর্থাৎ আমি নিজে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করি নাই; কিন্তু এই মোকদ্দমার সহিত যে পুলিস কর্ম্মচারীর সংস্রব ছিল, তিনি আমার পরিচিত। এই ঘটনার মধ্যে যেরূপ অস্বাভাবিক দুর্বুদ্ধির পরিচয় আছে, তাহা পাঠ করিয়া অনেক পাঠকেই মনে করিতে পারেন যে, এরূপ দুঃসাহসিক কার্য্য মনুষ্য-বুদ্ধির অগোচর। কিন্তু যখন আমি এই ঘটনার আনুপূর্ব্বিক সমস্ত ব্যাপার জানি, এবং অনুসন্ধানকারী পুলিসকর্ম্মচারীও আমার পরিচিত, তখন এই ঘটনার সত্যাসত্য সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। পাঠকগণও ইহা সম্পূর্ণরূপ সত্য ঘটনা বলিয়া অনায়াসে বিশ্বাস করিতে পারেন।
এই ঘটনা আমাদিগের এই প্রদেশীয় ঘটনা নহে, পশ্চিমদেশীয় ঘটনা। হিন্দু পাঠকগণের মধ্যে সকলেই অবগত আছেন যে, নৈমিষারণ্য নামে একটী স্থান আছে, উহা আমাদিগের একটী প্রধান তীর্থ স্থান। পশ্চিমদেশ-বাসীগণ সেই স্থানকে নিম্সারণ কহিয়া থাকে।
কথিত আছে, ভগবান্ বেদব্যাস এই স্থানে বসিয়া ভগবদ্বাক্য সর্ব্বপ্রথমে মর্ত্ত্যলোকে প্রকাশ করেন। যে বেদীর উপর উপবেশন করিয়া তিনি ভগবদ্বাক্য পাঠ করিয়াছিলেন, নিবিড় ও নিস্তব্ধ আম্র কাননের ভিতর সেই বেদী এখন পর্য্যন্ত বর্ত্তমান। সেই বেদীর কিছু দুর অন্তরে চক্রপাণি নামক প্রসিদ্ধ স্থান। প্রসিদ্ধি আছে যে, যে সময় ভগবান্ বেদব্যাস ভগবদ্বাক্য প্রকাশ করিতেন, সেই সময় দেবতাগণ ও ঋষিগণের আবির্ভাব হইত। সেই স্থানে তখন একটী সামান্য শ্রোতস্বতী থাকা স্বত্বেও সেই স্থানে যাঁহারা আগমন করিতেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেককেই অল্পাধিক জল-কষ্ট সহ্য করিতে হইত। ভগবান্ বিষ্ণু এই ব্যাপার দেখিয়া জল-কষ্ট নিবারণ করিবার মানসে আপনার চক্র দ্বারা পৃথিবী ভেদ করিয়া দেন, সেই স্থান হইতে সতেজে অনবরত জল উত্থিত হইয়া সকলের জল-কষ্ট নিবারণ করে। সেই সময় পৃথিবী ভেদ করিয়া যে স্থান হইতে জল উঠিয়াছিল, এবং এখন পর্য্যন্ত যে স্থান হইতে অনবরত জল উত্থিত হইয়া সন্নিকটবর্ত্তী সেই ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীতে গিয়া মিলিতেছে, সেই স্থানকে চক্রপাণি কহে। নৈমিষারণ্য তীর্থে যাঁহারা গমন করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগকে চক্রপাণি জলে স্নান করিতে হয়।
দশ বার বৎসর পূর্ব্বে কোন সরকারী কার্য্য উপলক্ষে আমাকে সেই নৈমিষারণ্যে গমন করিতে হইয়াছিল। যে কার্য্যে আমি গমন করিয়াছিলাম, সেই কার্য্য শেষ হইবার পর, একদিবস আমি সেই চক্রপাণি জলে স্নান করিতে যাই। সেই স্থানে আমি স্নান করিতেছি, এরূপ সময় একজন লোক আসিয়া স্নান করিবার মানসে সেই চক্রপাণি জলে অবতরণ করেন। কথায় কথায় তাঁহার সহিত আমার পরিচয় হয়। ইঁহার নাম আমি পূর্ব্ব হইতেই জানিতাম; কিন্তু ইঁহার সহিত আমার কখন চাক্ষুষ আলাপ পরিচয় ছিল না। ইঁহার নাম শুনিয়াই আমি কহিলাম, “আপনি এই প্রদেশীয় পুলিশ বিভাগে কর্ম্ম করিতেন না?”
উত্তরে তিনি কহিলেন, “হাঁ মহাশয়!”
তখন আমি তাঁহার সম্বন্ধে যাহা যাহা অবগত ছিলাম, তাহা তাঁহাকে কহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন মহাশয়! এই অপরাধের জন্য পুলিশ বিভাগ হইতে আপনার চাকরী গিয়াছে না?”
উত্তরে তিনি কহিলেন, “আপনি এ সকল বিষয় কিরূপে অবগত হইতে পারিলেন?”
আমি। আমি যেরূপেই অবগত হইতে পারি না কেন; কিন্তু ইহা প্রকৃত কি না?
“যখন অনুসন্ধান করিয়া আমার দোষ সাব্যস্ত হইয়াছিল, এবং সেই দোষের উপর নির্ভর করিয়া সরকারী চাকরী হইতে আমাকে তাড়িত করা হইয়াছে, তখন উহা যে সম্পূর্ণরূপ মিথ্যা কথা, তাহাই বা আমি বলি কি প্রকারে?”
আমি। সত্য হউক, আর মিথ্যা হউক, যে অপরাধের নিমিত্ত আপনার চাকরী গিয়াছে, সেই অপরাধ সম্বন্ধে আপনার কোন্ ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারী অনুসন্ধান করিয়াছিলেন?
যে ইন্স্পেক্টারের দ্বারা তাঁহার অপরাধের অনুসন্ধান করা হইয়াছিল, সেই ইন্স্পেক্টারের নাম তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে বলিয়া দিলেন, এবং তিনি আজ কাল যে স্থানে আছেন, তাহাও আমাকে জানাইয়া দিলেন। আমি দেখিলাম, যে সরকারী কার্য্যের নিমিত্ত আমি সেই প্রদেশে গমন করিয়াছি, তাহার কোন কোন বিষয়ে অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাকে তাঁহার নিকট গমন করিতেই হইবে। সুতরাং এই ঘটনার সমস্ত অবস্থা তাঁহার নিকট হইতে অনায়াসেই জানিয়া লইতে পারিব।
যে ভূত-পূর্ব্ব পুলিস-কর্ম্মচারীর সহিত আমার চক্রপাণিতে সাক্ষাৎ হইল, তিনিও আমার পরিচয় গ্রহণ করিলেন, এবং পরিশেষে তাঁহার বাসায় গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন। আমিও তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলাম; সেই দিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে তাঁহার বাসায় গিয়া আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সেই রাত্রি তাহার বাসায় অতিবাহিত করিবার নিমিত্ত তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন; কিন্তু জাতিভেদের প্রতিবন্ধকতা হেতু আমি কোনরূপেই তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিলাম না। তথাপি অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত তাঁহার বাসায় বসিয়া নানারূপ প্রসঙ্গে সময় অতিবাহিত করিলাম। ইহার মধ্যে যতদূর সম্ভব, তাঁহার নিকট হইতে তাঁহার মোকদ্দমার বিষয় সকল উত্তমরূপে জানিয়া লইলাম।
ইনি অসৎ উপায়ে যে সকল অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিলেন, তাহার অধিকাংশই প্রায় ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে। এই স্থানে বসিয়া এখন তিনি জমিদার-সরকারে যদি কোনরূপ একটা চাকরীর সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারই চেষ্টা দেখিতেছেন।
নৈমিষারণ্যে আমার যে সকল অনুসন্ধান-কার্য্য ছিল, তাহা শেষ করিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। দুর্গম ভয়ানক পথ অতিক্রম করিয়া, ও “হত্যা-হরণ” প্রভৃতি স্থান দর্শন করিয়া, ক্রমে আমি গিয়া সাণ্ডিলা ষ্টেশনে উপস্থিত হইলাম। পরে কয়েকটী ষ্টেশন অতিক্রম করিয়া যে স্থানে সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানকারী ইন্স্পেক্টার থাকিতেন, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহার নিকট আমি আমার পরিচয় প্রদান করিলাম, এবং যে সরকারী কার্য্যের নিমিত্ত আমি তাঁহার নিকট গমন করিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত ব্যাপার আমি তাঁহার নিকট কহিলাম। তিনি তাঁহার সাধ্যমত আমাকে সাহায্য করিয়া, সেই স্থানের আমার আবশ্যক কার্য্য সকল সম্পন্ন করিয়া দিলেন।
যে সময় তিনি আমার সাহায্যের নিমিত্ত আমার সহিত কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় একদিবস কথায় কথায় এই মোকদ্দমার বিষয় তাঁহার নিকট উত্থাপিত করিলাম। তিনিও সবিশেষ যত্নের সহিত ইহার সমস্ত ব্যাপার আমাকে বলিয়া দিলেন, এবং এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের যে সকল কাগজপত্র ছিল, তাহাও আমাকে দেখাইতে চাহিলেন। সময়মত অফিস হইতে সমস্ত নথি-পত্র আনিয়া, দেখিবার নিমিত্ত আমার হস্তে প্রদান করিলেন; কিন্তু উহার সমস্তই উর্দ্দূ ভাষায় লিখিত বলিয়া, আমি নিজে তাহা পড়িয়া উঠিতে পারিলাম না। উর্দ্দূভাষাবিদ্ একজন মুন্সির সাহায্যে সেই সকল কাগজ-পত্রে যাহা লিখিত ছিল, তাহা জানিয়া লইলাম, এবং আবশ্যকমত কতক কতক লিখিয়াও লইলাম। এইরূপে যে সকল বিষয় আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহাই অবলম্বন করিয়া এই বিবরণ লিখিত হইতেছে।