ঘর-পোড়া লোক (প্রথম অংশ)/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 পাঠকগণ পূর্ব্ব হইতেই অবগত আছেন যে, গোফুর খাঁ একজন নিতান্ত সামান্য লোক নহেন। দেশের মধ্যে তাঁহার মান-সম্ভ্রম যেরূপ থাকা আবশ্যক, তাহার কিছুরই অভাব নাই। অর্থও যথষ্ট আছে। কিন্তু এই সকল থাকা স্বত্বেও প্রজাগণ কেহই তাঁহার উপর সন্তুষ্ট নহে; সকলেই তাঁহার বিপক্ষ। প্রজাগণ গোফুর খাঁর বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইবার একমাত্র কারণ, তাঁহার পুত্ত্র ওস্‌মান। ওস্‌মানের অত্যাচারে সকলেই সবিশেষরূপ জ্বালাতন হইয়া পড়িয়াছে। যখন ওস্‌মানের অত্যাচার তাহারা সময় সময় সহ্য করিয়া উঠিতে সমর্থ হয় নাই, তখন তাহারা তাহার পিতা গোফুর খাঁর নিকট পর্য্যন্ত গমন করিয়া, ওস্‌মানের অত্যাচারের সমস্ত কথা তাহার নিকট বিবৃত করিয়াছে। তথাপি গোফুর তাহাদিগের কথায় কোনরূপ কর্ণপাত করেন নাই, তাহার প্রতিবিধানের কোনরূপ চেষ্টাও করেন নাই। এই সকল কারণে প্রজামাত্রেই পিতা-পুত্ত্রের উপর অসন্তুষ্ট। সুতরাং আজ তাহারা যে সুযোগ পাইয়াছে, সেই সুযোগ পরিত্যাগ করিবে কেন? তাহার উপর দারোগা সাহেব সহায়।

 প্রজাগণ এক বাক্যে গোফুর খাঁ ও তাঁহার পুত্ত্র ওস্‌মানের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতে লাগিল। অনুসন্ধান সমাপ্ত হইলে, দারোগা সাহেব দেখিলেন, নিম্নলিখিত বিষয় সম্বন্ধে উপস্থিত মোকদ্দমায় উত্তমরূপে প্রমাণ হইয়াছে।

 ১ম। সেখ হেদায়েতের যে গ্রামে বাড়ী, সেই গ্রামের প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, গোফুর খাঁ ও ওস্‌মান বকেয়া খাজানা আদায় করিতে সেই গ্রামে গমন করেন। হেদায়েতের নিকট কয়েক বৎসরের খাজানা বাকী পড়ায়, এবং হেদায়েৎ সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত না থাকায়, ওস্‌মান গোফুর খাঁর আদেশমত কয়েকজন পাইকের সাহায্যে, হেদায়েতের একমাত্র যুবতী কন্যাকে বলপূর্ব্বক তাহার বাড়ী হইতে সর্ব্বসমক্ষে ধরিয়া আনে, এবং তাহার নিকট হইতে খাজানা আদায় করিবার মানসে গোফুর খাঁর আদেশমত সর্ব্বসমক্ষে তাহাকে সবিশেষরূপে অবমানিত করে। তাহার নিকট হইতে খাজানা আদায় না হওয়ায়, গোফুর খাঁ ও ওস্‌মান অপরাপর লোকের সাহায্যে তাহাকে সেই স্থান হইতে বলপূর্ব্বক ধরিয়া আপন গৃহাভিমুখে লইয়া যান।

 ২য়। অপরাপর গ্রামের কতকগুলি প্রজার দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, হেদায়েতের কন্যাকে হেদায়েতের গ্রাম হইতে ধৃত অবস্থায় গোফুর খাঁর গ্রামে গোফুর খাঁ ও তাঁহার পুত্ত্র কর্ত্তৃক লইয়া যাইতে অনেকেই দেখিয়াছে।

 ৩য়। গোফুর খাঁর গ্রামের প্রত্যক্ষ-দর্শী প্রজাবর্গের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, হেদায়েতের কন্যাকে গোফুর খাঁ ও ওস্‌মান তাঁহাদিগের বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়াছে।

 ৪র্থ। গোফুর খাঁর কয়েকজন ভৃত্য ও তাঁহার সেই পূর্ব্ববর্ণিত দ্বারবানের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, গোফুর খাঁর আদেশমত ওস্‌মান হেদায়েতের সেই কন্যাকে আপনাদের গৃহের ভিতর আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, এবং যে পর্য্যন্ত সে জীবিত ছিল, তাহার মধ্যে ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় সে নিতান্ত অস্থির হইলেও, তাহাকে একমুষ্টি অন্ন বা এক গণ্ডুষ জল প্রদান করিতে বারণ করিয়াছিল। এমন কি, সাক্ষিগণের মধ্যে কেহ দয়াপরবশ হইয়া উহাকে এক গণ্ডুষ পানীয় প্রদান করিতে উদ্যত হইলে, গোফুর ও তাঁহার পুত্র ওস্‌মান খাঁ তাহাকেও উহা প্রদান করিতে দেন নাই।

 এতদ্ব্যতীত আরও প্রমাণিত হইল যে, যে দিবস পুলিস কর্ত্তৃক লাস বাহির হইয়া পড়ে, তাহার দুই কি তিন দিবস পুর্ব্বে একজন ভৃত্য কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, ওস মান খাঁর নিকট হইতে সেই গৃহের চাবি অপহরণ করে, এবং ওস্‌মান ও গোফুর খাঁর অসাক্ষাতে সেই গৃহের চাবি খুলিয়া দেখিতে পায় যে, ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা এরূপ হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহার আর বাঁচিবার কিছুমাত্র আশা নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই সামান্য ভৃত্যেরও অন্তরে দয়ার উদ্রেক হইল, এবং দ্বারবানের সহিত পরামর্শ করিয়া, সে ইহা স্থির করিল যে, তাহার অদৃষ্টে যাহাই হউক, সে আজ সেই হতভাগিনীকে কিছু আহারীয় ও পানীয় প্রদান করিবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সে কিছু আহারীয় ও পানীয় আনয়ন করিবার নিমিত্ত গমন করে। কিন্তু উহা সংগ্রহ করিয়া পুনায় সেই স্থানে আসিয়া দেখিতে পায় যে, ওস্‌মান খাঁ সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ভৃত্যের অভিসন্ধির কথা জানিতে পারিয়া, ওস্‌মান তাহার উপর সবিশেষরূপ অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহার হস্ত হইতে আহারীয় ও পানীয় কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। তৎপরে, সেই স্ত্রীলোকটী আহারীয় ও পানীয় প্রার্থনা করিয়াছে, এই ভাবিয়া ওস্‌মান সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করেন, ও সেই মহা অপরাধের জন্য সেই সময় সেই স্থানে যে সকল ভৃত্যাদি উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের সম্মুখে সেই মৃত্যুশয্যা-শায়িত স্ত্রীলোকটীকে পদাঘাত করেন। সেই সময় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা এরূপ হইয়া পড়িয়াছিল যে, তাহার কথা কহিবার বা রোদন করিবার কিছুমাত্র ক্ষমতা ছিল না; সুতরাং সেই পদাঘাত সে বিনা-বাক্যব্যয়ে অনায়াসেই সহ্য করে। পরিশেষে ওস্‌মান সেইরূপ অবস্থাতেই সেই স্ত্রীলোকটীকে সেই গৃহের ভিতর রাখিয়া, পুনরায় সেই গৃহের দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দেন, এবং চাবি লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করেন। ভৃত্য গোফুর খাঁর নিকট গমন করিয়া তাঁহার নিকট এই সমস্ত ঘটনা বর্ণন করে। গোফুর খাঁ ইহার প্রতিবিধানের পরিবর্ত্তে, সেই ভৃত্যের উপরই বরং অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহাদিগের বিনা-অনুমতিতে সেই স্ত্রীলোকটীকে আহারীয় ও পানীয় দিতে উদ্যত হইয়াছিল বলিয়া, তাহাকে কটুক্তি করিয়া গালি প্রদান করেন, ও চাকরী হইতে তাহাকে বিতাড়িত করেন।

 ৫ম। পুলিসের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর সেই যুবতী কন্যার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। আরও প্রমাণিত হইল যে, যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই গৃহের তালার চাবি গোফুর খাঁর নিদর্শনমত ওস্‌মান খাঁ নিকট হইতে পাওয়া গিয়াছে।

 ৬ষ্ঠ। একজন পাইক,—যে গোফুর খাঁর পাইক বলিয়া পরিচয় প্রদান করিল,—তাহার দ্বারা এই ঘটনার আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা প্রমাণিত হইল; অর্থাৎ খাজানা আদায় করিবার নিমিত্ত হেদায়েতের বাড়ী হইতে সেই স্ত্রীলোককে আনয়ন হইতে, গোফুর খাঁর বাড়ীর ভিতর লাস পাওয়া পর্য্যন্ত যে সকল ঘটনা অপরাপর সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হইল, তাহার সমস্ত অংশেই এই পাইক সর্ব্বতোভাবে পোষকতা করিল।

 ৭ম। লাস পরীক্ষাকারী ডাক্তার সাহেবের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, অনাহারই সেই স্ত্রীলোকটীর মৃত্যুর কারণ।

 ৮ম। এই সকল প্রমাণ ব্যতীত অপর আর কোনরূপ প্রমাণের যাহা আবশ্যক হইল, তাহাও প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইতে বাকী রহিল না।

 এই মোকদ্দমায় গোফুর খাঁ ও তাঁহার পুত্ত্রের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইল, তাহা দেখিয়া গোফুর খাঁ বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, এই বৃদ্ধ বয়সে কোনরূপেই তাঁহার আর নিস্কৃতি নাই। আরও বুঝিতে পারিলেন যে, দারোগা সাহেবের পূর্ব্বোক্ত স্ত্রীলোকটীকে তাঁহার পুত্ত্র বাহির করিয়া আনায়, এবং দারোগা সাহেব তাঁহার নিকট তাহার পুত্ত্রের বিপক্ষে নালিশ করিলেও, তিনি তাহার কোনরূপ প্রতিবিধানের চেষ্টা করেন বলিয়াই, দারোগা সাহেবের সাহায্যে তাঁহার এই সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইল। কিন্তু তিনি বড়ই আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন যে, হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ তাঁহার বাড়ীর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিয়া উপস্থিত হইল। যখন প্রজামাত্রই বলিতেছে যে, গোফুর খাঁ তাঁহার পুত্ত্রের ন্যায়, সকলই অবগত আছেন, তখন গোফুর খাঁ এ সম্বন্ধে কিছুই অবগত নহেন, বা তাঁহার জ্ঞাতসারে এ কার্য্য ঘটে নাই, এ কথা বলিলেই বা কোন্ বিচারক তাহা বিশ্বাস করিবেন?