ঘর-পোড়া লোক (প্রথম অংশ)/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
গোফুর খাঁর একজন অতি বিশ্বাসী কর্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহার নাম হোসেন। পুলিস যখন প্রথম অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করেন, বা যে সময় গোফুরের গৃহে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেই সময় হোসেন সেই স্থানে উপস্থিত ছিল না; জমিদারীর কার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার মনিবের এইরূপ বিপদ উপস্থিত হইয়াছে জানিতে পারিয়া, জমিদারী হইতে তিনি আপনার মনিবের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, মনিব ও মনিব-পুত্ত্র উভয়েই হত্যাপরাধে ধৃত হইয়াছেন। তাঁহাদিগের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা জানিতে পারিয়া, তিনি অতিশয় ভাবিত হইলেন। তখন এই বিপদ হইতে তাঁহার মনিবকে কোনরূপে উদ্ধার করিবার উপায় দেখিতে না পাইয়া, নির্জ্জনে গিয়া তিনি একদিবস রাত্রিকালে দারোগা সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।
দারোগা সাহেব তাঁহাকে পূর্ব্ব হইতেই চিনিতেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্রই কহিলেন, “কি হে হোসেনজি! কি মনে করিয়া?”
হোসেন। আর মহাশয়! কি মনে করিয়া! কি মনে করিয়া আমি আপনার নিকট আসিয়াছি, তাহা আর আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না কি?
দারোগা। আপনি কি মনে করিয়া আসিয়াছেন, তাহা আমি কিরূপে বুঝিতে পারিব? আপনার অন্তরের কথা আমি কিরূপে জানিব?
হোসেন। সে যাহা হউক, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন আপনি কোনরূপে উঁহাদিগকে না বাঁচাইলে, আর বাঁচিবার উপায় নাই।
দারোগা। কাহাদিগকে বাঁচাইতে হইবে? তোমার মনিব ও মনিব-পুত্ত্রকে?
হোসেন। তদ্ভিন্ন আমি এই সময় আর কাহার জন্য আপনার নিকট আসিব?
দারোগা। আগে যদি আপনি আসিতেন, তাহা হইলে উহাদিগকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতে পারিতাম, কিন্তু এখন সে চেষ্টা বৃথা। এখন আমার ক্ষমতার অতীত হইয়া পড়িয়াছে।
হোসেন। যে পর্য্যন্ত মোকদ্দমার চূড়ান্ত বিচার শেষ হইয়া না যায়, সে পর্য্যন্ত আপনার ক্ষমতার সীমা এড়াইতে পারে না। এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন। আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিতে, বা যাহা চাহিবেন, তাহাই প্রদান করিতে প্রস্তুত। এখন যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া হউক, উঁহাদিগের প্রাণ আপনাকে রক্ষা করিতেই হইবে।
দারোগা। দেখুন হোসেন সাহেব, এ পর্য্যন্ত ওস্মান যেরূপ অত্যাচার করিয়া আসিতেছে, তাহাতে উহার প্রতি কাহার দয়া হইতে পারে? আপনি ত অনেক দিবস হইতে গোফুর খাঁর নিকট কর্ম্ম করিয়া আসিতেছেন; বলুন দেখি, তাঁহার প্রজাগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি ওস মানের অত্যাচারে প্রপীড়িত হইতে বাকী আছে। বলুন দেখি, কয়জন লোক আপনার জাতি-ধর্ম্ম বজায় রাখিয়া, তাঁহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিতে সমর্থ হইয়াছে। বলুন দেখি, কতগুলি স্ত্রীলোক তাঁহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিয়া তাহাদিগের সর্ব্বপ্রধান-ধর্ম্ম সতীত্ব রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে। যাহার এই সকল কার্য্য, তাহাকে আপনি এই বিপদ হইতে রক্ষা করিতে চাহেন। স্ত্রীলোকের ধর্ম্ম নষ্ট করা ব্যতীত যাহার অপর আর কোন চিন্তা নাই, সুন্দরী স্ত্রীলোককে কোন গতিতে তাহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা বা স্বামীর নিকট হইতে অপহরণ করিবার যাহার সর্ব্বদা মানস, আপনার পাশব বৃত্তি চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত যে ব্যক্তি সকল কার্য্যই অনায়াসে করিতে পারে, আপনি তাহার প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিবেন না। তাহাকে এই মোকদ্দমা হইতে বাঁচাইবার কথা দূরে থাকুক, তাহাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত অতি সামান্য মাত্র চেষ্টা করিলেও, তাহাতে মহাপাতক হয়। তাই বলি, আপনি আমাকে এরূপ অনুরোধ করিবেন না। সহস্র সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেও, এ কার্য্য আমার দ্বারা কোনরূপেই হইবে না।
হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! ওস্মানই যেন মহাপাতকী, কিন্তু তাহার বৃদ্ধ পিতার অপরাধ কি? পুত্ত্রের অপরাধে পিতাকে দণ্ড দিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন কেন?
দারোগা। বৃদ্ধ পাপী নহে? আমার বিবেচনায় ওস্মান অপেক্ষা বৃদ্ধ শতগুণ অধিক পাপী। যে পিতা পুত্ত্রের দুষ্কার্য্য সকল জানিতে পারিয়া, তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা না করেন, যাঁহার নিকট তাঁহার পুত্ত্রের বিপক্ষে শত সহস্র নালিশ উপস্থিত হইলেও, তিনি তাহার প্রতি কর্ণপাতও করেন না, সেরূপ পিতাকে সেই অত্যাচারকারী পুত্র অপেক্ষা শতগুণ অধিক পাপী বলিয়া আমার বিশ্বাস। এরূপ অবস্থায় যুবক বালকের বরং মাফ আছে, কিন্তু বৃদ্ধ পিতা কোনরূপেই ক্ষমার্হ নহে।
হোসেন। ওস্মান যে অত্যাচারী, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার অত্যাচারের সকল কথা যে গোফুর খাঁর কর্ণগোচর হয়, তাহা আমার বোধ হয় না। পুত্ত্রের অত্যাচারের কথা শুনিতে পাইলে, তাহার নিবারণের চেষ্টা না করিবেন, সেরূপ পিতা গোফুর খাঁ নহেন। আমার বিশ্বাস যে, এই সকল অত্যাচারের কথা কখনই তাঁহার কর্ণগোচর হয় নাই। তিনি জানিতে পারিলে, ওস্মান এতদূর অত্যাচার করিতে কখনই সমর্থ হইত না।
দারোগা। মিথ্যা কথা, বৃদ্ধ সমস্ত কথা অবগত আছে। জানিয়া শুনিয়া, সে তাহার পুত্ত্রকে কোন কথা বলে না; বরং তাহার অত্যাচারের সাহায্য করে। ওস্মান কর্ত্তৃক এমন কোন ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব ছিল। তাহার প্রতিবিধানের নিমিত্ত আমি নিজে কানপুর পর্য্যন্ত গমন করিয়া, সমস্ত কথা বৃদ্ধের কর্ণগোচর করি। কিন্তু কৈ, তিনি তাহার কি প্রতিবিধান করিয়াছিলেন?
হোসেন। আমি বুঝিতে পারিতেছি, যে কার্য্যের সহিত আপনার নিজের সংস্রব ছিল, সেই কার্য্য তাঁহার কর্ণগোচর হইলেও, তিনি তাহার প্রতিবিধানের কোন চেষ্টা করেন নাই বলিয়া, আপনি অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু আমার অনুরোধে এখন আপনাকে সেই ক্রোধ পরিত্যাগ করিতে হইবে। আপনার যে কার্য্য তখন ওস্মান বা তাহার পিতার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, সেই কার্য্য এখন আমি সম্পন্ন করিয়া দিব। তদ্ব্যতীত আপনি আর যাহা প্রার্থনা করেন, তাহাও আমি প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। এখন আপনি একটু অনুগ্রহ করিলেই, আমাদিগের অনেক মঙ্গল হইতে পারিবে।
দারোগা। যে কার্য্যের সহিত আমার সংস্রব আছে, সে কার্য্য আপনি সম্পন্ন করিয়া দিবেন কি প্রকারে? আপনি কি সেই ঘটনার বিষয় কিছু অবগত আছেন?
হোসেন। সেই সময় ছিলাম না; কিন্তু এখন সমস্তই জানিতে পারিয়াছি, এবং ওস্মান তাহাকে কোথায় রাখিয়াছে, তাহাও আমি অনুসন্ধানে অবগত হইতে পারিয়াছি। ইচ্ছা করিলে, এখন তাহাকে অনায়াসেই আপনি পাইতে পারেন।
দারোগা। এই মোকদ্দমা সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণ হইয়া গিয়াছে, তাহা বোধ হয়, আপনি জানিতে পারিয়াছেন। সমস্তই এখন কাগজ-পত্র হইয়া গিয়াছে। ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীগণ পর্য্যন্ত সকলেই এখন ইহার সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়াছেন। এখন আর আমার দ্বারা আপনাদিগের কি উপকার হইতে পারে?
হোসেন। প্রথম অবস্থায় আমি এখানে থাকিলে এই মোকদ্দমার অবস্থা কখনই এতদূর হইতে পারিত না। কিন্তু এখন যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার আর উপায় নাই। যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন ইহা অপেক্ষা আর যেন অধিক না ঘটে; আর সাক্ষি-সাবুদের যেন সংগ্রহ না হয়। আমি আপাততঃ আপনার নজর স্বরূপ এই সহস্র মুদ্রা প্রদান করিতেছি। ঈশ্বর যদি অনুগ্রহ করেন, মোকদ্দমা হইয়া গেলে পুনরায় আপনার সহিত নির্জ্জনে সাক্ষাৎ করিব। আর যাহার নিমিত্ত আপনি এতদুর ক্রোধান্বিত হইয়াছেন, আমার সহিত আপনি যখন গমন করিবেন, তখনই আমি তাহার নিকট আপনাকে লইয়া যাইব। তাহার পরে আপনি আপনার ইচ্ছানুযায়ী কর্ম্ম করিবেন। এখন আমাকে বিদায় দিন, আমাকে অনেক কার্য্য সম্পন্ন করিতে হইবে। এখন আপনি আমাদিগের উপর প্রসন্ন হইলেন, কি না, বলুন।
দাবোগা। প্রসন্ন না হইলেও, যখন আপনি এতদূর বলিতেছেন, তখন কাজেই আমাকে প্রসন্ন হইতেই হইবে। আমি ক্রোধের বশবর্ত্তী হইয়া যতদূর করিবার, তাহা করিয়া ফেলিয়াছি। যাহা করিয়াছি, তাহার আর উপায় নাই। এখন আর অধিক কিছু করিব না।
হোসেন। ওস্মান সহস্র দোষে দোষী, তাহার আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। গোফুরও পুত্র-স্নেহ বশতঃ সেই সকল দোষের প্রতিবিধান করিয়া উঠিতে পারেন নাই সত্য। কিন্তু মহাশয়! এখন যেরূপ ভাবের মোকদ্দমা উপস্থিত হইয়াছে, সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণিত হইয়াছে, তাহার কণা মাত্রও প্রকৃত নহে। ইহা আপনি মুখে না বলুন, কিন্তু অন্তরে তাহা আপনাকে স্বীকার করিতে হইবে।
দারোগা। তোমার কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে গোফুর খাঁর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ কিরূপে আসিল?
হোসেন। উহার প্রকৃত ব্যাপার আমি সমস্তই শুনিয়াছি। যদি জানিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি গোপনে আপনাকে সকল কথা বলিতে পারি।
দারোগা। গোপনে বলিতে চাহেন কেন?
হোসেন। মোকদ্দমার সময় আমরা সেই কথা স্বীকার করিব কি না, তাহা উপযুক্ত উকীল কৌন্সলির পরামর্শ ব্যতীত বলিতে পারি না। সুতরাং আপনার নিকট গোপনে সেই সকল কথা না বলিলে যে কিরূপ দোষ ঘটিতে পারে, তাহা আপনিই কেন বিবেচনা করিয়া দেখুন না।
দারোগা। আমি ত কোন দোষ দেখিতেছি না।
হোসেন। মনে করুন, যে সকল কথা আমি প্রকৃত বলিয়া এখন বিশ্বাস করিতেছি, ও আপনি জানিতে চাহেন বলিয়া, আপনাকে যাহা বলিতে প্রবৃত্ত হইতেছি, সে সকল কথা আবশ্যকমত অস্বীকার করিলেও, আমি নিষ্কৃতি পাইব না।
দারোগা। আপনার নিষ্কৃতি না পাইবার কারণ কি?
হোসেন। আমি যদি অস্বীকার করি, তাহা হইলে যে সকল লোকের সম্মুখে আমি এখন সেই সকল কথা বলিতেছি, আবশ্যক হইলে সেই সকল লোকের দ্বারা আপনি উহা অনায়াসেই প্রমাণ করিতে সমর্থ হইবেন।
দারোগা। সেই সকল কথা আইনমত ওরূপে প্রমাণ হইতে পারে না।
হোসেন। প্রমাণ হউক, বা না হউক, যদি আপনি নিতান্তই অবগত হইতে চাহেন, তাহা হইলে কাহারও সম্মুখে আমি সেই সকল কথা কহিব না। একাকী শুনিতে চাহেন, ত’ আমি বলিতে প্রস্তুত আছি।
দারোগা। আর যদি আমি আবশ্যকমত আপনাকে সাক্ষী স্থির করি, তাহা হইলে আপনি কি করিবেন? আপনি এখন আমাকে যাহা বলিবেন, তখনও আপনাকে তাহাই বলিতে হইবে।
হোসেন। তাহা বলিব কেন? আবশ্যক হয়, সমস্ত কথা আমি অনায়াসেই অস্বীকার করিতে পারিব।
সম্পূর্ণ।
• আষাঢ় মাসের সংখ্যা,
“ঘর-পোড়া লোক।”
(মধ্যম অংশ)
(অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত!)
যন্ত্রস্থ।