ঘর-পোড়া লোক (শেষ অংশ)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
হােসেনের সহিত থানার সেই উপস্থিত কর্ম্মচারীর এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময়ে থানার দারােগা, যিনি অপর কার্য্য উপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন, তিনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও কর্ম্মচারীকে কহিলেন, “কি হে। কিসের গােলযােগ?”
কর্ম্মচারী। গােলযােগ অপর কিছুই নহে। খুনী মােকদ্দমায় প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, এইরূপ দুইটী আসামী এখানে আসিয়াছে। আমি তাহাদিগকে হাজত-গৃহে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি। আসামীদ্বয়ের সমভিব্যাহারে প্রহরীগণ ব্যতীত অপর আরও তিনজন লােক আসিয়াছে। তাহারা কে, এবং কি চরিত্রের নােক, তাহা আমরা অবগত নহি। কিন্তু তাহারা এই থানার ভিতর রাত্রিবাস করিতে চাহে। তাই আমি তাহাদিগকে এখান হইতে তাড়াইয়া দিতেছি। অপর গােলযােগ আর কিছুই নহে।
দারোগা। অপর যে সকল শােক আসিয়াছে, তাহারা কোথায়?
কর্ম্মচারী। তাহারা এই শয়ন করিয়া আছে।
দারােগা। উহাদিগকে আমার নিকট ডাক দেখি।
দারােগা সাহেবের এই কথা শুনিবামাত্র হােসেন এবং তাহার সমভিব্যাহারী দুই ব্যক্তি আসিয়া দারােগা সাহেবের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। তাহাদিগকে দেখিয়াই দারোগা সাহেব কহিলেন, “আপনি হোসেন মিঞা নহেন?
হোসেন। আজ্ঞা, আমি হোসেন।
দারোগা। আপনি এখানে কেন?
হোসেন। মনিবদিগের সঙ্গে।
দারোগা। মনিবদিগের সঙ্গে? আপনার মনিব ত একজন ছিলেন, আপনি গোফুর খাঁর নিকট কর্ম্ম করিতেন না?
হোসেন। আজ্ঞা হাঁ, এখনও আমি তাঁহার কর্ম করিতেছি।
দারোগা। তবে মনিবগণ পাইলেন কোথায়?
হোসেন। গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র।
দারোগা। তাহারা কোথায়?
হোসেন। তাহারা আপনার হাজতেই আছেন।
দারোগা। তাহারা একটী মোকদ্দমায় পড়িয়াছেন, এ কথা আমি পূর্বেই শুনিয়াছিলাম। তাহাদিগের সেই মোকদমার বিচার কি শেষ হইয়া গিয়াছে?
হোসেন। আজ্ঞা হাঁ, জজসাহেবের বিচার শেষ হইয়া গিয়াছে।
দারোগা। বিচারে কি হইয়াছে?
হোসেন। তা আমাদিগের সর্বনাশ হইয়াছে। বিচারে জজসাহেব উভয়কেই চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইবার আদেশ প্রদান করিয়াছেন।
দারোগা। কি সর্বনাশ! উভয়কেই ফাঁসির আদেশ দিয়াছেন তাঁহারাই কি এখন আমার এই থানার হাজতে আছেন? হোসেন। হাঁ মহাশয়! তাঁহাদিগের সহিতই আমরা আসিয়াছি।
দারোগা। আচ্ছা, আপনারা থানাতেই থাকুন, আপনাদিগের এখান হইতে গমন করিবার প্রয়োজন নাই।
হোসেন। মহাশয়! আমাকে মাপ করিবেন। আপনি দেখিতেছি, আমাদিগের সমস্ত অবস্থা অবগত আছেন; কিন্তু আমি এ পর্যন্ত চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
দারোগা। আমি আমার পোষাক-আদি পরিবর্ত্তন করিয়া এখনই আসিতেছি, আমাকে ভাল করিয়া দেখিলেই চিনিতে পারিবেন। আপনাদিগের জমিদারীর ভিতর গাজিনগর নামক একখানি গ্রাম আছে না?
হোসেন। আছে।
দারোগা। সেই গ্রামের কতকগুলি জমী লইয়া অপর একজন জমিদারের যে সময় বিবাদ হয়, সেই সময় আমাকে দেখিয়াছেন।
এই বলিয়া দারোগা সাহেব আপনার পোষাক পরিচ্ছদ পরিবর্তন করিবার মানসে আপনার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন।
দারোগা সাহেব সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে পর, দাবোগা সাহেব সম্বন্ধীয় সমস্ত কথা হোসেনের মনে হইল। তখন মনে হইল, যে সময় গাজিনগর লইয়া গোফুর খাঁর সহিত অপর একজন জমিদারের বিবাদ উপস্থিত হয়, এবং পরিশেষে উভয় পক্ষে ভয়ানক দাঙ্গা হইয়া যায়, সেই সময় ইনিই সেই স্থানের দারোগা ছিলেন। দাঙ্গার সংবাদ ইহার নিকট প্রেরিত হইলে, ইনিই আসিয়া তাহার অনুসন্ধান করেন। সেই সময় ইনি গোফুর খাঁর বাড়ীতে গিয়াও কয় দিবসকাল অতিবাহিত করেন। ইনি সেই সময় গোফুর খাঁর নিকট হইতে সহস্র মুদ্রা গ্রহণ করিয়াছিলেন। সে সময় ইহারই সাহায্যে সেই মোকদ্দমায় গোফুর খাঁ জয়লাভ করেন, ও গাজিনগর গ্রাম সেই সময় হইতে সুচারুরূপে শাসন লইয়া আর কোনরূপ গোলযোগ ঘটে নাই। এই সময় হইতে দারোগা সাহেব সর্বদা গোফুরের নিকট গমন করিতেন, এবং আবশ্যক হইলে দুই একদিবস তথায় অবস্থানও করিতেন। কিন্তু যে পর্য্যন্ত তিনি সেই থানা হইতে বদলি হইয়া গিয়াছেন, সেই পর্যন্ত তিনি আর গোফুর খাঁর নিকট গমন করেন নাই, বা তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ হন নাই। গাজিনগর উপলক্ষে যে সময় দারোগা সাহেবের সহিত গোফুর খাঁর আলাপ পরিচয় হয়, হোসেনও সেই সময় হইতে তাহার নিকট পরিচিত। ইহার পর অনেক দিবস পর্য্যন্ত হোসেনের সহিত তাহার সাক্ষাৎ না হওয়ায়, প্রথমেই হোসেন দারোগা সাহেবকে চিনিয়া উঠিতে পারেন নাই। সেই কারণে তিনি মনে মনে একটু লজ্জিত হইলেন। যাহা হউক, তখন তিনি মনে করিলেন, থানার বাহিরে গিয়া আর তাহাকে রাত্রিযাপন করিতে হইবে না।
হোসেন সেই স্থানে বসিয়া বসিয়া দারোগা সাহেব সম্বন্ধীয় পুরাতন কথা সকল মনে করিতেছেন, এমন সময়ে একজন প্রহরী আসিয়া কহিল, “দারোগা সাহেব আপনাকে সেলাম দিয়াছেন।” হোসেন। দারোগা সাহেব কোথায়?
প্রহরী। তিনি তাঁহার বাসায়।
হোসেন। তাহা হইলে আমাকে এখন কোথায় যাইতে হইবে? কোথায় গমন করিলে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে?
প্রহরী। তাঁহার বাসায় আপনাকে ডাকিয়াছেন, সেই স্থানে গমন করিলেই, তাঁহার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইবে।
হোসেন। কোন্ সময় আমাকে সেই স্থানে গমন করিতে হইবে।
প্রহরী। এখনই। আপনি আমার সহিত আনুন, তিনি তাঁহার বাহিরের গৃহে আপনার প্রতীক্ষায় বসিয়া আছেন।
হোসেন। চল।
এই বলিয়া হোসেন সেই স্থান হইতে গাত্রাখান করিয়া সেই প্রহরীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। যাইরার সময় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এই থানায় কতদিবস পর্য্যন্ত আছ?”
প্রহরী। প্রায় আট নয় বৎসর।
হোসেন। দারোগা সাহেব এখানে কতদিবস আসিয়াছেন?
প্রহরী। এক বৎসরের কম হইবে না, বরং কিছু বেশী হইবে।
হোসেন। তোমাদিগের দারোগা সাহেব কেমন লোক?
প্রহরী। খুব ভাল লোক; গরিবের মা-বাপ। আমরা। সবিশেষ সুখ-সচ্ছলে তাহার নিকট কর্ম্ম করিতেছি।
হোসেন। দারোগা সাহেবের বাসায় তাহার পরিবারগণ কেহ আছেন, কি তিনি একাকীই এই স্থানে বাস করিতেছেন? প্রহরী। তাঁহার পরিবার ও পুত্র কন্যাগণ এই স্থানেই ছিলেন; অদ্য আন্দাজ একমাস হইল, কোন কার্য্য উপলক্ষে তিনি তাঁহাদিগকে আপনার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিয়াছেন। এখন কেহই এখানে নাই, কেবল দারোগা সাহেব একাকী এখানে আছেন।
প্রহরীর সহিত এইরূপ নানাপ্রকার কথা কহিতে কহিতে হোসেন দারোগা সাহেবের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, দাবোগা সাহেব একাকী হোসেনের অপেক্ষায় তাঁহার বাহিরের গৃহে বসিয়া রহিয়াছেন।
এইরূপ অবস্থায় দাবোগা সাহেবকে একাকী বসিয়া থাকিতে দেখিয়া, হোসেন একটু বিস্মিত হইলেন। কারণ, ইতিপূর্বে অনেকবার তিনি দারোগা সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন, কিন্তু কখনই তাঁহাকে একাকী দেখিতে পান নাই। অপর কেহ উপস্থিত না থাকিলেও, অভাবপক্ষে দুই চারিজন পরিচারকও সর্ব্বদা তাহার নিকট থাকি।