ঘর-পোড়া লোক (শেষ অংশ)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
দারোগা সাহেবের নিকট হোসেন গমন করিলে, তিনি হোসেনকে সেই স্থানে বসিতে বলিলেন। হোসেন তাহার সন্নিকটবর্তী এক স্থানে উপবেশন করিলে, তিনি কহিলেন, “আপনি আমাকে চিনিতে পারেন নাই?” হোসেন। আপনাকে আর চিনিতে পারি না, খুব চিনিতে পারিয়াছি। কিন্তু প্রথমতঃ আপনাকে চিনিতে পারি নাই বলিয়া, ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি, মাফ করিবেন।
দারোগা। আপনার মনিব ও মনিব-পুত্র যে একটা মোকদ্দমায় পড়িয়াছেন, এ কথা আমি পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম; কিন্তু তাহাদিগের যে এই অবস্থা ঘটিবে, তাহা আমি একবারের নিমিত্তও মনে করি নাই।
হোসেন। মনে না করিবারই কথা। ইহারা যে একবারে চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন, তাহা আমরা একবারের নিমিত্তও মনে করি নাই, বা আমাদিগের উকীল কৌশলীগণও কথন এরূপ ভাবেন নাই।
দারোগা। আপনি বহুদর্শী ও একজন পুরাতন কর্ম্মচারী। জমার নিমিত্ত যদি একটু চেষ্টা করিতেন, তাহা হইলে বোধ হয়, এরূপ অবস্থা কখনই ঘটিত না।
হোসেন। আমার সাধ্যমত চেষ্টা করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করি নাই; কিন্তু সেই সকল চেষ্টাতেও কোন ফলই দর্শিল না।
দারোগা। প্রথমে কি চেষ্টা করিয়াছিলেন। অনুসন্ধানকারী দারোগার সহিত সাক্ষাত করিয়াছিলেন কি?
হোসেন। এই মোকদ্দমা প্রথমে যে সময় রুজু হয়, সেই সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না; জমিদারীর কার্য্য উপলক্ষে মফস্বলে গমন করিয়াছিলাম। মোকদ্দমার সংবাদ যেমন আমি শুনিতে পাইলাম, অমনি আমি চলিয়া আসিলাম। আসিয়াই অনুসন্ধানকারী দারোগাকে কিঞ্চিৎ প্রণামী দিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সেই সাক্ষাতের ফল আপনি এই দেখিতেই পাইতেছেন।
দারোগা। প্রণামীর পরিমাণটা, বোধ হয়, কম হইয়াছিল; তাই তাহার দ্বারা সবিশেষরূপ উপকার প্রাপ্ত হন নাই।
হোসেন। তাহার পক্ষে সামান্য হইতে পারে, কিন্তু আমার পক্ষে কম নহে। আমি তাঁহাকে সহস্র মুদ্রা প্রদান করিয়াছিলাম।
দারোগা। তাহা হইলে তিনি কোনরূপ তোমাদিগের সাহায্য করিলেন না কেন?
হোসেন। সে অনেক কথা। এই মোকদ্দমা যেরূপ ভাবে সাজান হইয়াছিল, প্রকৃত পক্ষে তাহার কিছুই ঘটে নাই, সমস্তই মিথ্যা।
দারোগা। দারোগা তোমাদিগের নিকট হইতে সহস্র মুদ্রা গ্রহণ করিলেন, এবং তোমাদিগের উপরই মিথ্যা মোকদ্দমা সাজাইলেন, এ কথা শুনিতে কেমন কেমন বোধ হয়।
হোসেন। তাহার কারণ আছে।
দারোগা। এমন কি কারণ হইতে পারে?
হোসেন। লজ্জার কথা বলিব কি! দারোগা সাহেব কোথা হইতে একটী সুরূপা স্ত্রীলোককে বাহির করিয়া আনিয়াছিলেন, এবং তাহার সমস্ত খরচ-পত্র দিয়া একখানি বাড়ীতে তাহাকে রাখিয়াছিলেন। আমার মনিব-পুত্র ওসমানের চরিত্র নিতান্ত মন্দ হইয়া পড়ে। এমন কি, কোন সুশ্রী রমণীর প্রতি লোভ হইলে তাহাকে তাহা হইতে নিবৃত্ত করিবার ক্ষমতা কাহারও ছিল না। এই নিমিত্তই প্রজাদের মধ্যে সকলেই তাহার শত্রু হইয়া পড়ে। যে রমণীকে দারোগা সাহেব রাখিয়াছিলেন, সেই রমণীর কথা ওসমান কিরূপে জানিতে পারে। পরিশেষে কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া তাহাকে আয়ত্ব করে। দারোগা সাহেব এই কথা জানিতে পারিয়া, প্রথমতঃ ওসমানের নিকট সংবাদ পাঠাইয়া সেই রমণীকে যথাস্থানে পুনরায় রাখিয়া আসিতে কহেন; কিন্তু ওসমান তাহার এই অনুরোধে কর্ণপাতও করেন না। তখন দারোগা সাহেব তাহার উপর সবিশেষরূপ অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহার চরিত্রের কথা তাহার পিতা গোফুর খাঁর নিকট গিয়া বলেন। গোফুর খাঁন পুত্র-স্নেহ বশতঃ তাহার প্রতিবিধানের কোনরূপ চেষ্টাও করেন না। কাজেই দারোগা সাহেব উভয়ের প্রতি অন্তরের সহিত চটিয়া যান, এবং কিরূপে উভয়কেই সবিশেষরূপে বিপদাপন্ন করিতে সমর্থ হইবেন, কেবল তাহারই ছিদ্র অনুসন্ধান করিতে থাকেন। সেই সময় একটা সুযোেগ উপস্থিত হয়। হেদায়েৎ নামক এক ব্যক্তি আসিয়া নালিশ করে যে, সে তাহার যুবতী কন্যাকে পাইতেছে না, এবং শুনিতেছে যে, ওসমান তাহার কন্যাকে লইয়া গিয়াছে। এই। সংবাদ পাইয়া দারোগা সাহেব তিলকে তাল করিয়া ফেলিলেন। পিতা-পুত্র উভয়কেই জড়াইয়া তাহার নিকট হইতে এজাহার লইলেন, ও যেরূপ ভাবে সাক্ষি-সাবুদের সংগ্রহ করিবার প্রয়োজন, তাহার সমস্তই ঠিক করিয়া আপনার প্রতিহিংসা সাধুন পূর্ব্বক মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিলেন। লাভের মধ্যে আমাদিগের আরও সহস্র মুদ্রা নিরর্থক নষ্ট হইল। দারোগা। এতদূর ঘটিয়াছিল, এ কথা আমাকে পূর্বে বলেন নাই কেন? অনুসন্ধানকারী দারোগা সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কোন না কোনরূপে আমি ইহার প্রতিবিধানের চেষ্টা করিতাম। আপনার কি মনে নাই যে, অনেক সময়। গোফুর খাঁর নিকট আমি অনেক উপকার প্রাপ্ত হইয়াছি।
হোসেন। আপনার কথা সেই সময় আমাদিগের মনে একবারেই পড়ে নাই। বিশেষতঃ মনে পড়িলেই বা কি হইত? আপনি যে এই থানায় আছেন, তাহা আমরা কেহ অবগত ছিলাম না। আপনি গোফুর খাঁর নিকট অনেক সময় উপকার পাইয়াছেন বলিতেছেন বটে; কিন্তু এখন আপনার নিকটেই বা কিরূপে উপকারের প্রত্যাশা করা যাইতে পারে?
দারোগা। আপনার এ কথার অর্থ কি?
হোসেন। অর্থ যে কি, তাহা আর আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না? আজ কালকার যেরূপ নিয়ম হইয়া পড়িতেছে, তাহা ত আপনি বেশ জানেন। আপনি যাহার উপকার করিবেন, সে কিসে সেই উপকারকারীর অনিষ্ট করিতে সমর্থ হইবে, তাহারই চেষ্টা সর্ব্বদা করিয়া থাকে।
দারোগা। আপনার কি বিশ্বাস যে, জগতের সকলেই সেই চরিত্রের লোক?
হোসেন। সকলে না হইতে পারেন; কিন্তু পনর আনা লোকের চরিত্র যে সেইরূপ, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
দারোগা। আমি যদি পূর্ব্বে ইহার অণুমাত্রও জানিতে পারিতাম, তাহা হইলে বোধ হয়, আমি সবিশেষরূপে আপনাদিগের উপকার করিতে পারিতাম। হোসেন। যাহার সময় উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাহার আর উপায় নাই। এখন বলুন দেখি, আপীলে কোনরূপ ফল পাইবার উপায় আছে কি?
দারোগা। আমার বোধ হয়, আপীলে এ মোকদ্দমার কিছু হইবে না।
হোসেন। এই মোকদ্দমার কাগজ-পত্র ত আপনি কিছুই দেখেন নাই, তবে আপনি কিরূপে বলিতেছেন যে, আপীলে কোনরূপ ফল পাওয়া যাইবে না?
দারোগা। কাগজ-পত্র না দেখিলেও আমার জানিবার বিশেষ কারণ আছে। যে জজসাহেব এই মোকদ্দমার বিচার করিয়াছেন, তাঁহাকে আমি অনেক দিবস হইতে উত্তমরূপে অবগত আছি। তাঁহার মত বুদ্ধিমান কর্ম্মচারী অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার উপর মোকদ্দমার রায় লিখিবার ক্ষমতা তাঁহার যেরূপ আছে, সেরূপ ক্ষমতা এই প্রদেশীয় বর্তমান কর্ম্মচারীগণের মধ্যে আর কাহারও আছে কি না সন্দেহ। এ পর্যন্ত তাহার বিচারিত যত মোকদ্দমার আপীল হইয়াছে, হাইকোর্ট হইতে তাহার একটীও মোকদ্দমার রায় পরিবর্তিত হয় নাই। বরং তাঁহার রায় দেখিয়া, সকলেই তাঁহার প্রশংসা করিয়াছেন।
হোসেন। যে আশায় আমি উঁহাদিগকে এতক্ষণ পর্যন্তু জীবিত রাখিয়াছি, তবে কি আমাদিগের সে আশা নাই?
দারোগা। আপীলের আশা ছাড়িয়া দিয়া যদি আর কোনরূপ উপায় থাকে, তাহার চেষ্টা দেখুন। আপীলে কিছু হইবে না। হোসেন। আর উপায় কি দেখিব? এমন উপায় আর কি হইতে পারে, যাহাতে উহাদিগের উভয়ের প্রাণরক্ষা হয়?
দারোগা। কোনরূপ যোগাড়যন্ত্র করিয়া যদি লাটসাহেবের নিকট হইতে উহাদিগের জীবন-ভিক্ষা লইতে পারেন, তাহা হইলেই হইতে পারে।
হোসেন। সেরূপ যোগাড় কিরূপে হইতে পারে? সে ক্ষমতা আমাদিগের নাই।
দারোগা। কেন থাকিবে না, যাহার প্রচুর অর্থ আছে, তাহার সমস্ত ক্ষমতাই আছে। তবে যোগাড় চাই, পরিশ্রম চাই, তাহার উপর অর্থ ব্যয় করিবার ইচ্ছা চাই।
হোসেন। আমাদিগের যতদূর সম্ভব, অর্থ সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি; কিন্তু যোগাড় করিবার ক্ষমতা আমাদিগের নাই। গোফুর খাঁর উপর যদি আপনার এতদূর দয়া হইয়াছে, তাহা হইলে অনুগ্রহ করিয়া বলিয়া দিন, কিরূপ ভাবে যোগাড় করিলে, বা কাহার সাহায্য গ্রহণ করিলে, আমার মনিবদ্বয়ের জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ হইব।
দারোগা। এখন আপনি উহাদিগের জীবনের নিমিত্ত কত অর্থ ব্যয় করিতে প্রস্তুত আছেন?
হোসেন। আমাদিগের যতদুর সাধ্য, তাহা অপেক্ষা আরও অধিক অর্থ ব্যয় করিতে আমি প্রস্তুত আছি।
দারোগা। আপনাদিগের কি ক্ষমতা আছে, তাই আমি জানি না। কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিতে পারিবেন, তাহা আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলুন, তাহা হইলে আমি বুঝিতে পারি যে, উহাদিগের জীবন রক্ষা হইতে পারিবে কি না! তাহা হইলে আমার যেরূপ বুদ্ধি, সেইরূপ একটা সামান্য উপায় বলিয়া দিব, বা আবশ্যক হয়, আমি নিজে উহাতে হস্তক্ষেপ করিব।
হােসেন। দেখুন দারােগা সাহেব! জীবনের অপেক্ষা অর্থ কিছু অধিক মুল্যবান্ নহে। যদি ইহারা জীবন প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে আমার বিশ্বাস, উঁহাদিগের নিকট যাহা কিছু সঞ্চিত অর্থ আছে, এবং চেষ্টা করিয়া আরও যতদূর অর্থের সাহায্য হইতে পারে, তাহার সমস্তই উহারা ব্যয় করিতে প্রস্তুত আছেন।
দারোগা। ওরূপ গােলযােগের কথা আমি বুঝি না। আমাকে পরিষ্কার করিয়া বলুন দেখি, পাঁচ লক্ষ টাকা উহারা ব্যয় করিতে প্রস্তুত আছেন কি?
হােসেন। পাঁচ লক্ষ টাকা এখন ব্যয় করিবার ক্ষমতা উঁহাদিগের নাই।
দারোগা। তবে কয় লক্ষ টাকা ব্যয় করিবার ক্ষমতা উহাদিগের আছে?
হােসেন। উঁহাদিগের সহিত পরামর্শ না করিয়া, আমি এ কথার ঠিক উত্তর দিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হয়, যদি উঁহাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারেন, তাহা হইলে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত উহারা ব্যয় করিতে সমর্থ হইবেন। তাহার অধিক যে পারিবেন, তাহা আমার বােধ হয় না।
দারোগা। আচ্ছা, আপনি গমন করুন, এবং হাজতগৃহের বাহির হইতে উহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসুন; দেখুন, উহারা কি বলেন। দুই লক্ষ মুদ্রার কম এ কার্য্য কখনই সম্পন্ন হইতে পারে না। যদি উঁহারা আমার প্রস্তাবে সম্মত হন, তাহা হইলে আপনি সময় নষ্ট না করিয়া, শীঘ্র আমার নিকট আগমন করিবেন। আমি আপনার অপেক্ষায় এই স্থানে বসিয়া রহিলাম।