ঘর-পোড়া লোক (শেষ অংশ)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া হোসেন সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, অর্থ ব্যয় করিয়া দারোগা সাহেব কিরূপে ইহাদিগের প্রাণ রক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন? আপীল করিলে যখন বলিতেছেন, কিছুই হইবে না, লাট সাহেবের নিকট কোন রূপ চেষ্টা করিবার ক্ষমতা যখন আমাদিগের বা দারোগা সাহেবের নাই, তখন কিরূপে ইনি ইহাদিগের জীবন বাঁচাইতে সমর্থ হইবেন? তবে কি ইহারও ইচ্ছা, অনুসন্ধানকারী দারোগা সাহেবের সদৃশ আমাদিগের নিকট হইতে ফাঁকি দিয়া কিছু অর্থ গ্রহণ করা? অনুসন্ধানকারী দারোগা সাহেব কেবলমাত্র সহস্র মুদ্রা গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহার, দেখিতেছি, আশা অতিরিক্ত। ইতিপূর্ব্বে ইনি আমাদিগকে অনেক মোকদ্দমায় সাহায্য করিয়াছেন ও আমাদিগের নিকট হইতে সময় সময় অনেক অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু এ পর্য্যন্তু কখনও বিশ্বাসঘাতকের কার্য্য করেন নাই। যখন যাহা করিবেন বলিয়াছেন, কার্য্যে ঠিক তাহাই করিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় ইহার কথায় একবারে অবিশ্বাসও করিতে পারি না। আর অনেক টাকা দিয়া একবারেই বা বিশ্বাস করি কি প্রকারে? এতদিবস সদভাবে কার্য্য করিয়াছেন বলিয়াই যে, এখন অসদভাবে কার্য্য না করিবেন, তাহারই বা প্রমাণ কি? গোফুর ও ওসমান উভয়েই জীবন পরিত্যাগ করিতে বসিয়াছেন, তাঁহাদিগের নিকট হইতে শেষ অবস্থায় এইরূপ অর্থ গ্রহণ করিলে, উহার প্রতিবিধানের আর কোন উপায়ও থাকিবে না। উহাদিগের উভয়েরই জীবন শেষ হইলে উহাদিগের পরিবারবর্গ যে অর্থ সাহায্যে অনায়াসেই জীবনযাপন করিতে সমর্থ হইতেন, সেই অর্থও কি অতঃপর এইরূপে নষ্ট করিব? বড়ই গোলযোগের কথা!
মনে মনে এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যে স্থানে গোফুর খাঁ ও ওসমান খাঁ আবদ্ধ অবস্থায় ছিলেন, সেই স্থানে গমন করিলেন; কিন্তু সেই হাজত-গৃহের আসামীদ্বয়কে যে ব্যক্তি পাহারা দিতেছিল, সে তাহাকে উহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে, বা কথা কহিতে দিল না। তখন হোসেন অনন্যোপায় হইয়া পুনরায় দারোগা সাহেবের নিকট আগমন করিলেন ও তাহাকে কহিলেন, “যাহার পাহারা আছে, সেই প্রহরী আমার মনিবদ্বয়ের সহিত আমাকে কোনরূপে কথা কহিতে, বা তাঁহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে কোনরূপেই দিল না।”
হোসেনের এই কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব সেই প্রহরীকে ডাকাইলেন ও তাহাকে বলিয়া দিলেন, “আসামীদ্বয়ের সহিত এই ব্যক্তিকে সাক্ষাৎ করিতে দেও, এবং বাহির হইতে যদি কোন কথা উহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে চাহে, তাহাও করিতে দেও; কিন্তু ইহাকে ফটকের ভিতর প্রবেশ করিতে দিও না।”
প্রহরী দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালন করিল। হোসেন হাজতের নিকট গমন করিলে, সে হাজতের দরজা খুলিয়া দিল; কিন্তু হোসেনকে তাহার ভিতর প্রবেশ করিতে দিল না। নিজেও সেই স্থানে দণ্ডায়মান রহিল।
উভয়কেই সম্বোধন করিয়া হোসেন কহিল, “আমি এখন একটা কোন সবিশেষ প্রয়োজনের নিমিত্ত আপনাদিগের নিকট আগমন করিয়াছি, সবিশেষরূপে মনঃস্থির করিয়া কথাগুলি শুনিতে হইবে।
“পূর্ব্বে যে একটী মুসলমান দারোগা অনেক সময় আমাদিগের উপকার করিয়াছিলেন, এবং অনেক সময় যিনি আমাদিগের বাড়ীতে গমন করিয়া সময় সময় দুই তিনদিবস পর্যন্ত অতিবাহিত করিতেন, তাঁহাকে এখন আপনাদের মনে হয় কি?”
গোফুর। তাঁহাকে বেশ মনে হয়। তিনি অতি ভদ্রলোক। যখন যাহা করিবেন বলিয়াছেন, তখনই ঠিক তাহাই করিয়াছেন। তাঁহার কথা এ সময়ে জিজ্ঞাসা করিতেছ কেন?
হোসেন। যে থানায় এখন আপনারা আবদ্ধ, তিনি সেই থানার দারোগ।
গোফুর। তিনি এই থানার দারোগা! তাহার সহিত এই শেষ সময় একবার সাক্ষাৎ হয় না কি? হোসেন। আমার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছে। আপনাদিগের সম্বন্ধে অনেক কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করিয়া, অনেক দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন, এবং অনেক কথা আমাকে বলিয়াছেন। তাঁহারই কথা মত এখন আমি আপনাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি।
গোফুর। তিনি কি বলেন?
হোসেন। তিনি বলেন, উপযুক্ত পরিমিত অর্থ ব্যয় করিতে পারিলে, তিনি আপনাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারেন।
গোফুর। কিরূপে? আপীল করিয়া?
হোসেন। না। তিনি বলেন, আপীলে কিছু হইবে না। তবে লাট সাহেবের নিকট কোনরূপ চেষ্টা করিতে পারিলে, যদি তিনি দয়া করেন, তাহা হইলেই জীবনের পুনরায় আশা করা যাইতে পারে।
গোফুর। টাকায় লাট সাহেবের নিকট কোনরূপ চেষ্টা হইবে না, অপর কোন উপায়ও আমাদিগের নাই॥
হোসেন। সে কথা আমি পূর্ব্বেই তাহাকে বলিয়াছি। তাহা শুনিয়াও তিনি বলেন, যদি অধিক পরিমাণে টাকা ব্যয় করিতে সমর্থ হন, তাহা হইলে তিনি জীবনদানের উপায় করিবার চেষ্টা করেন।
গোফুর। কত টাকার আবশ্যক, তাহা তিনি কিছু বলিয়াছেন কি?
হোসেন। প্রথম বলিয়াছিলেন, পাঁচ লক্ষ টাকার আবশ্যক; কিন্তু আমি যখন তাঁহাকে কহিলাম, এত টাকা কোনরূপেই সংগ্রহ হইবার সম্ভাবনা নাই। তখন তিনি কহিলেন, দুই লক্ষ টাকার কম এ কার্য কোনরূপেই হইতে পারে না।
গোফুর। কিরূপ উপায়ে তিনি আমাদিগের প্রাণ বাঁচাইতে সমর্থ হইবেন, তাহা কিছু বলিয়াছেন কি?
হোসেন। কি উপায়ে বাঁচাইবেন, তাহার কোন কথা বলেন নাই। কেবল বলিয়াছেন, “টাকার যোগাড় করিতে পারিবে কি না দেখ।”
গোফুর। দেখ হোসেন! আমার জীবনের আশা নাই, বাঁচিবারও আর সাধ নাই। তবে যদি ওসমানকে কোন রূপে বাঁচাইতে পার, তাহার চেষ্টা কর। আমার জন্য কোনরূপ চেষ্টা করিবার প্রয়োজন নাই।
হোসেন। তবে আমি দুই লক্ষ টাকা দিতে স্বীকার করিব?
গোফুর। পুত্র-স্নেহ যে কি, তাহা তুমি যে না জান, তাহা নহে। আমার পুত্রের জীবনের নিকট দুই লক্ষ টাকা অতি অল্প!
হোসেন। এত টাকা এখন আমি সংগ্রহ করি কি প্রকারে? এ পর্যন্ত যোগাড় করিয়া অনেক কষ্টে প্রায় দুই লক্ষ টাকা সংগ্রহ করিয়াছিলাম, মোকদ্দমায় এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয় হইয়া গিয়াছে, অবশিষ্ট এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা আমার নিকট আছে। ভাবিয়াছিলাম যে, এই মোকদ্দমায় আপনাদিগের যতই অর্থদণ্ড হউক না কেন, সেই টাকা হইতে তাহা প্রদান করিয়া আপনাদিগকে বাড়ীতে লইয়া যাইব। কিন্তু যাহা ভাবিয়াছিলাম তাহা হইল না। গোফুর। দুইটা জীবনের জন্য যখন তিনি দুই লক্ষ টাকা চাহিতেছেন, তখন একটী জীবনের জন্য যে টাকা তোমার নিকট আছে, তাহা তাহাকে প্রদান কর, তাহাতে যদি তিনি সম্মত না হন, তাহা হইলে অবশিষ্ট টাকা পরে সংগ্রহ করিয়া তাঁহাকে প্রদান করিও।
হোসেন। এই সময় এত টাকা উহার হস্তে প্রদান করিব, আর উনি যদি কিছু না বলিয়া, কেবলমাত্র টাকাগুলি হস্তগত করেন, তাহা হইলে উপায়?
গোফুর। উপায় কিছুই নাই। আমার পুত্রের জীবনের সঙ্গে না হয়, সেই টাকাও নষ্ট হইবে।
দারোগা যেরূপ চরিত্রের লোকই হউক না কেন, আমাদিগের এরূপ অবস্থায় প্রতারিত করিয়া, এইরূপ ভাবে আমাদিগের জীবনের সহিত এত অর্থ গ্রহণ করিতে পারে, এরূপ বিশ্বাসঘাতক বোধ হয়, আজও জন্মগ্রহণ করে নাই। বিশেষতঃ যে দারোগার কথা তুমি বলিতেছ, সেই দারোগা আমার সহিত কখনও অবিশ্বাসের কার্য করেন নাই।
হোসেন। আচ্ছা, তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিয়া দেখি, ইহাতে আমাদিগের অদৃষ্টে যাহাই কেন হউক না।
এই বলিয়া হোসেন সেই স্থান হইতে উঠিয়া পুনরায় দারোগা সাহেবের নিকট গমন করিলেন। প্রহরী হাজতের দরজা পুনরায় বন্ধ করিয়া দিল।