ঘর-পোড়া লোক (শেষ অংশ)/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 গোফুর খাঁ প্রভৃতি সকলে সেই স্থান হইতে গমন করিলে পর, যে পাঁচজন প্রহরী আসামীদ্বয়কে আনয়ন করিয়াছিল, দাবোগা সাহেব তাহাদিগকে ডাকাইলেন। তাহারা তাঁহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলে, তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, “তোমরা যে খুনী মোকদ্দমার আসামীদ্বয়কে আমার থানায়, আনিয়াছ, তাহাৱা কি সমস্ত রাত্রি এই থানায় থাকিবে?”

 প্রহরী। হাঁ। কল্য প্রত্যুষে আমরা উহাদিগকে লইয়া যাইব।

 দারোগা। তোমরা আসামীদ্বয়কে নিজ জিম্মায় হাজতে রাখিয়াছ, কি আমাদিগের জিম্মা করিয়া দিয়াছ?

 প্রহরী। আপনাদিগের জিম্মা করিয়া দিয়াছি।

 দারোগা। যে সময় তোমরা আসামীদ্বয়কে এখানে আনিয়াছিলে, সেই সময় আমি থানায় উপস্থিত ছিলাম না। জমাদার সাহেব ছিলেন। তিনি আসামীদ্বয়কে থানার ডায়েরী ভুক্ত করিয়া লইয়াছেন কি?

 প্রহরী। বোধ হয়, লইয়া থাকিবেন।

 দারোগা। আসামীদ্বয়কে ভোমরা যে আমাদিগের জিম্মা করিয়া দিয়াছ, তাহার নিমিত্ত তোমরা রসিদ পাইয়াছ কি?

 প্রহরী। না।

 প্রহরীর এই কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব জমাদার সাহেবকে ডাকাইলেন, এবং তাহাকে কহিলেন, “খুনী মোকদ্দমার আসামীদ্বয়কে ডায়েরীভূক্ত করিয়া লইয়াছ কি?”

 জমাদার। লইয়াছি।

 দাবোগা। তবে সেই আসামীদ্বয়ের নিমিত্ত উহাদিগকে রসিদ দাও নাই কেন?

 জমাদার সাহেব “এখনই রসিদ দিতেছি।” এই বলিয়া দারোগা সাহেবের সম্মুখেই একখানি রসিদ লিখিয়া প্রহরী গণকে প্রদান করিলেন।

 রসিদ প্রদান করিবার পর দারোগা সাহেব প্রহরীগণকে কহিলেন, “তোমরা এখন আসামীর রসিদ পাইয়াছ, আসামীদ্বয়ের নিমিত্ত এখন আর তোমাদিগের জবাবদিহি নাই। এখন তোমরা সন্নিকটবর্তী বাজারে বা সরাইয়ে গমন করিয়া অনায়াসেই সেই স্থানে আহারাদি ও বিশ্রাম লাভ করিতে পার। কল্য প্রাতঃকালে আগমন করিয়া এই রসিদ আমাকে প্রত্যর্পণ পূর্ব্বক তোমাদিগের আসামীদ্বয়কে লইয়া যাইও।”

 প্রহরী। থানার ভিতর আমাদিগের থাকিতে কোন আপত্তি আছে কি?

 দাবোগা। আপত্তি কিছুই নাই। তবে আমার থানায় স্থান অতি সঙ্কীর্ণ, নিরর্থক কষ্ট সহ্য করিয়া এই স্থানে থাকিবার কোন প্রয়োজন নাই। বাজারে থাকিবার উত্তম স্থান আছে। এই থানায় একজন প্রহরীকে সঙ্গে লইয়া যাও। সে তোমাদিগকে উৎকৃষ্ট স্থানে রাখিয়া আসিবে। ইহাতে তোমাদিগের কোনরূপ ব্যয় হইবে না, অথচ সুখে থাকিতে পারিবে।

 এই বলিয়া দারোগা সাহেব তাহার থানার একজন প্রহরীকে ডাকিলেন, এবং তাহার সমভিব্যাহারে সেই প্রহরী পাঁচজনকে বাজারে পাঠাইয়া দিলেন ও বলিয়া দিলেন, “ইহাদিগের আহারাদি করিতে যাহা কিছু ব্যয় হইবে, তাহা যেন দোকানদার প্রহরীগণের নিকট হইতে গ্রহণ না করিয়া আমার নিকট হইতে লইয়া যায়।”

 প্রহরীগণ সেই স্থান হইতে গমন করিলে পর, দারোগা সাহেব জমাদার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাদিগের এই থানার প্রহরীর সংখ্যা দশজন, তাহারা সকলেই থানায় উপস্থিত আছে কি?

 জমাদার। না; তিনজন আজ দুইদিবস হইল, দুইজন আসামী লইয়া সদরে গমন করিয়াছে।

 দারোগা। তাহাদিগের ফিরিয়া আসিতে কয় দিবস হইবে?

 জমাদার। চারি পাঁচদিবসের কম তাহারা ফিরিয়া আসিতে পারিবে না।

 দারোগা। আর সাতজন?

 জমাদার। তাহাদিগের মধ্যে তিনজন উপস্থিত আছে। একজন আপনার সহিত গমন করিয়াছিল, সেও এখন থানায় উপস্থিত আছে; কিন্তু উপস্থিত বলিতে পারিতেছি না। কারণ, আপনি বা আপনার সমভিব্যাহারী সেই প্রহরী ফিরিয়া আসিয়াছেন, তাহা এখনও ডায়েরীভুক্ত হয় নাই।’

 দারোগা। আমি প্রহরীর সহিত সফল হইতে ফিরিয়া আসিয়াছি, ইহা ডায়েরীভুক্ত করিয়া লও, এবং তোমার নিকট থানার চার্জ ছিল, তাহা আমাকে দেওয়া হইল, ইহাও ডায়েরীতে লিখিয়া লও। আজও লিখি রাখ যে, থানায় যে দুইজন খুনী মোকদ্দমার আসামী আছে, তাহাও থানার চার্জ্জের সহিত আমার জিম্মায় দেওয়া হইল।”

 দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া জমাদার সাহেব তাহাই লিখিয়া ডায়েরী পুস্তক আনিয়া তাহাকে দেখাইলেন। তিনিও দেখিয়া আসামীর সহিত থানার চার্জ পুনঃ প্রাপ্তি-স্বীকার লিখিয়া দিলেন; এবং জমাদার সাহেবকে কহিলেন, “তিনজন কনষ্টেবলের সহিত তুমি রোঁদগন্তে গমন কর। ইহা ষ্টেশন ডায়েরীতে লিখিয়া রাখিয়া তোমরা এই খানা হইতে বহির্গত হইয়া যাও। অবশিষ্ট চারিজন প্রহরী কেবল মাত্র থানায় আমার সহিত অবস্থিতি করুক।”

 দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হইল। জমাদার সাহেব তিনজন কনষ্টেবলের সহিত আপনাকে ষ্টেশন ডায়েরীতে খরচ লিখিয়া থানা হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন।

 জমাদার সাহেব থানা হইতে বহির্গত হইয়া যাইবার কিয়ৎক্ষণ পরেই, দারোগা সাহেব, যে প্রহরী চারিজন থানায় উপস্থিত ছিল, তাহাদিগকে ডাকাইলেন, তাহাদিগের মধ্যে যে অল্পদিবসের চাকর, তাহাকে কহিলেন, “তোমার কয় বৎসর চাকরী হইয়াছে?  ১ম প্রহরী। বার বৎসর হইবে।

 দারোগা। তােমার বয়স এখন কত হইয়াছে?

 ১ম প্রহরী। চলিশ বৎসর হইবে।

 দারোগা। তবে তুমি আরও পনর বৎসর চাকরী করিবে।

 ১ম প্রহরী। যদি শরীর ভাল থাকে, বা আপনারা যদি অনুগ্রহ করেন।

 দারোগা। তােমার বেতন এখন কত?

 ১ম প্রহরী। সাত টাকা।

 দারোগা। আর কত বাড়িতে পারে, আশা কর?

 ১ম প্রহরী। আর কতই বাড়িবে, জোর আট টাকা হইবে।

 দারোগা। আট টাকার হিসাবে, তােমার এক বৎসরের বেতন হইতেছে—ছিয়ানব্বই টাকা।

 ১ম প্রহরী। যাহা হয়।

 দারােগা। তাহা হইলে তােমার পনর বৎসরের বেতন। হইতেছে, এক হাজার চারি শত চল্লিশ টাকা।

 ১ম প্রহরী। হিসাবে যাহা হয়।

 দারােগা। আর পনর বৎসর পরে যদি তুমি পেন্শন নাও, এবং সেই সময় যদি তােমার বেতন আট টাকা হয়, তাহ হইলে তুমি মাসিক চারি টাকা হিসাবে পেনসন পাইতে পারিবে।

 ১ম প্রহরী। তাহাই হইবে।

 দারোগা। তাহা হইলে বৎসরে তােমার পেনসন হইবে আটচল্লিশ টাকা কেমন?

 ১ম প্রহরী। হাঁ মহাশয়!

 দারােগা। যখন তােমার বয়স পঞ্চান্ন বৎসর হইবে, সেই সময় তোমার পেনসন হইবে। পেনসন হইবার পর, তুমি আর কতদিবস বাঁচিরে।

 ১ম প্রহরী। তাহা কে বলিতে পারে। দশ বৎসরও বাঁচিতে পারি।

 দারোগা। দশ বৎসৱ কেন, যদি তুমি নয় বৎসরও বাঁচ, তাহা হইলে পেনসন-বাবুদ তুমি সাত শত কুড়ি টাকা পাইতে পার। কেমন না।

 ১ম প্রহরী। হাঁ মহাশয়।

 দারোগা। তাহা হইলে আজ হইতে, তুমি যে পর্যন্ত বাঁচিবে, তাহাতে তুমি দুই হাজার এক শত ষাট টাকা বেতন বা পেনসন পাইবে।

 ১ম প্রহরী। হাঁ। দারোগা। এখন তোমাদিগকে একটা কার্য্য করিতে হইবে। সেই কার্য্য করিলে হয় ত তোমাদিগের চাকরী যাইলেও যাইতে পারে; কিন্তু আমি যেরূপ তারে কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহাতে চাকরী না যাইবারই সম্ভাবনা। তথাপি তাহা অগ্রেই ধরিয়া লও। ধরিয়া লও, এই কার্যে তোমাদিগের চাকরী গেলে, তোমাদিগের প্রত্যেকের দুই হাজার এক শত ষাট টাকার অধিক ক্ষতি হইবে না, কেমন?

 সকল প্রহরী। উহার অধিক আর কি করিয়া ক্ষতি হইবে?

 দারোগা। সেই টাকা আমি তোমাদিগকে এখনই একবারে প্রদান করিতেছি, প্রহণ কর। তদ্ব্যতীত আমার কার্য্যের নিমিত্ত তোমাদিগকে আরও কিছু আমি প্রদান করিতেছি, অর্থাৎ তোমাদিগের প্রত্যেককে আমি তিন হাজার করিয়া টাকা প্রদান করিতেছি, গ্রহণ করিয়া আমার কার্য্যে হস্তার্পণ কর।

 এই বলিয়া দারোগা সাহেব প্রত্যেককে তিন হাজার করিয়া চারিজনকে মোট বার হাজার টাকা প্রদান করিলেন এবং কহিলেন, “কেমন, এখন তোমরা আমার কার্য্য করিতে প্রস্তুত আছ?”

 প্রহরীগণ। আমরা সকল সময়েই আপনার কার্য্য করিতে প্রস্তুত। এখন আমাদিগকে কি করিতে হইবে বলুন।

 দারোগা। আর কিছুই করিতে হইবে না। এখন তোমরা গোরস্থানে গমন করিয়া আজ যে সকল মৃতদেহ মাটি দেওয়া হইয়াছে, তাহার মধ্য হইতে দুইটী দেহ উঠাইয়া আন। কেমন পারিবে ত? প্রহরীগণ। এই সামান্য কার্য্য আর পারিব না?

 দারোগা। এ কার্য্য সামান্য নহে। কারণ, এই কার্যের নিমিত্ত তোমরা অপর কাহারও সাহায্য গ্রহণ করিতে পারিবে না। নিজ হস্তে খনন করিয়া তোমাদিগকে সেই স্থান হইতে মৃতদেহ উঠাইতে হইবে, এবং নিজেই উহা বহন করিয়া আনিতে হইবে।

 প্রহরীগণ। আমরা চারিজন আছি। সুতরাং এ কার্য্যের নিমিত্ত আমাদিগকে আর কাহারও সাহায্য গ্রহণ করিতে হইবেনা; অনায়াসেই এ কার্য্য আমরা সম্পন্ন করিতে পারি। স্ত্রীলোকের মৃতদেহ না, পুরুষের মৃতদেহ আবশ্যক?

 দারোগা। স্ত্রীলোকের মৃতদেহ আবশ্যক নহে, পুরুষের মৃতদেহের প্রয়োজন।  ২য় প্রহরী। ইহার জন্য আর ভাবনা নাই। আজ দিবা ভাগে আমি একবার গোরস্থানে গিয়াছিলাম, আমার সখ চারিটী পুরুষের মৃতদেহ মাটি দেওয়া হইয়াছে। উহা হইতে অনায়াসেই আমরা দুইটা উঠাইয়া আনিতে পারি।

 দারোগা। যে কবর হইতে মৃতদেহ উঠাইয়া লইরে, মৃত্তিকা দিয়া সেই কবর পুনরায় পূর্ণ করিয়া দেওয়া আবশ্যক।

 ৩য় প্রহরী। এ কথা কি আর আমাদিগকে আপনার বলিয়া দিতে হইবে?

 দারোগা। তোমরা বুদ্ধিমান, তাহা আমি জানি। তথাপি যদি ভুলিয়া যাও, এই নিমিত্ত পূর্ব হইতেই তোমাদিগকে সতর্ক করিয়া দিতেছি।

 ৪র্থ প্রহরী। সেই মৃতদেহ আমরা কোথায় আনিব?

 দারোগা। এই স্থানেই আনিবে, এই থানার ভিতরেই আনিবে। এই কথা শুনিয়া সকলে টাকাগুলি আপন আপন বাক্সে বন্ধ করিয়া দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালনার্থ গমন করিল। যাইবার সময় দারোগা সাহেব কহিলেন, “তোমরা তোমাদিগের যে সকল টাকা আপনাপন বাক্সে বন্ধ করিয়া রাখিলে, মৃতদেহ আনিবার পর সেই টাকা সেই স্থানে রাখিও না; বাক্স হইতে বাহির করিয়া আপনাদিগের সঙ্গেই রাখিও। রাখিবার সুবিধা হইবে বলিয়াই, নগদ টাকার পরিবর্তে আমি তোমাদিগকে নোট প্রদান করিয়াছি।

 প্রহরীগণ থানা হইতে প্রস্থান করিলে পর, অনেকক্ষণ পর্যন্ত দারোগা সাহেব বসিয়া বসিয়া নানারূপ ভাবিতে লাগিলেন। পরিশেষে নিজেও থানা হইতে বহির্গত হইয়া সেই গোরন অভিমুখে গমন করিলেন।  সেই স্থানে গমন করিয়া দেখিলেন, তাঁহার প্রেরিত প্রহরী গণ প্রায় কার্য্য শেষ করিয়া আনিয়াছে। একটা মৃতদেহ কবর হইতে বাহির করিয়া উপরে রাখিয়াছে, অপরটী কবর ভিতরেই আছে। কিন্তু তাহার মৃত্তিকা খনন করা হইয়াছে।

 এই অবস্থা দেখিয়া দারোগা সাহেব পুনরায় থানায় প্রত্যাবর্তন করিলেন। তাহার আসিবার কিয়ৎক্ষণ পরেই প্রহরীগণ দুইটা মৃতদেহের সহিত উপস্থিত হইল। আসিয়া দারোগা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিল, “এই মৃতদেহ কোথায় রাখিয়া দিব?”

 উত্তরে দারোগা সাহেব কহিলেন, “উভয় মৃতদেহই হাজতের ভিতর রাখিয়া দেও!” প্রহরীগণ তাহাই করিল। তখন তিনি তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কবর হইতে মৃতদেহ উঠাইবার সময় বা উহা বহন করিয়া থানায় আনিবার সময়, অপর আর কেহ দেখিয়াছে কি?”

 উত্তরে প্রহরীগণ কহিল, “না মহাশয়। কেহই দেখে নাই। দেখিলেও, যেরূপ ভাবে আমরা উহাদিগকে আনিয়াছি, তাহাতে কেহই কোনরূপ সন্দেহ করিতে পারিবে না।”

 দারোগা। যাহা হউক, আমরা পাঁচজন ব্যতীত এই মৃতদেহের কথা আর কেহই অবগত নহে। সাবধান! এ কথা কোনরূপে যেন কেহই জানিতে না পারে। অপরে জানিতে পারিলে, আমারও চাকরী থাকিবে না, তোমাদিগেরও চাকরী থাকিবে না। অধিকন্তু জেলে যাইতে হইবে॥

  না মহাশয়! এ কথা কেহই জানিতে পারিবে না। আমাদিগের বুকে বাঁশ দিয়া ডলিলেও আমরা এ কথা কিছুতেই প্রকাশ করি না।

 ইহার পর দারোগা সাহেব গোফুর খাঁ ও ওসমানের হস্তে যে হাতকড়ি ছিল, এবং উহা প্রদান করিবার সময় তিনি যে হাতকড়ি খুলিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই হাতকড়ি লইয়া হাজত-গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন, এবং মৃতদেহদ্বয়ের দুই হন্তে সেই হাতকড়ি লাগাইয়া দিলেন। পরিশেষে হাজতের বাহিরে আসিয়া হাজত-গৃহের তালা বাহির হইতে বন্ধ করিয়া দিলেন। আসামীদ্বয় হাজত-গৃহে থাকিবার সময় সেই হাজতগৃহের বাহিরে যেরূপ ভাবে প্রহরীর পাহারা ছিল, সেই চারিজন প্রহরীকেই সেইরূপ ভাবে পাহারায় নিযুক্ত করিয়া রাখিলেন। এই সকল কার্য্য শেষ করিতে রাত্রি বারোটা বাজিয়া গেল।

 রাত্রি আন্দাজ তিনটার সময়, থানার বাটীর দুই তিন স্থানে একবারে ধু ধু করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠিল, হাজতগৃহ জ্বলিতে লাগিল। তিনজন প্রহরী সেই সময় থানার ভিতর শয়ন করিয়াছিল, কেবলমাত্র একজন প্রহরী হাজতের সম্মুখে পাহারায় নিযুক্ত ছিল। কিরূপে থানার চতুর্দিকে একবারে অগ্নিময় হইল, তাহা সেই প্রহরী কিছুমাত্র জানিতে পারিয়া যেমন চীৎকার করিয়া উঠিল, অমনি সম্মুখে দারোগা সাহেবকে দেখিতে পাইল।

 দারোগা তাহাকে কহিলেন, “চুপ কর। অপর প্রহরী গণকে শীঘ্র উঠাইয়া দেও, এবং আফিসের কাগজপত্র যদি কি বাহির করিতে পার, তাহার চেষ্টা কর। হাজত-গৃহের চাবি আমাকে প্রদান কর। ইহার পর চাবিসম্বন্ধে যমি কোন কথা উঠে, তাহা হইলে এইমাত্র বলিও, থানা আগুন লাগিতে দেখিয়াই আমি দ্রুতপদে দারোগা সাহেবকে সংবাদ দিতে গিয়াছিলাম, সেই সময় হাতের চারি আমার হস্ত হইতে যে কোথায় পড়িয়া যায়, তাহার কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। পরিশেষে আমি ও দারোগা সাহেব হাজতের দরজা ভাঙ্গিয়া আসামীদ্বয়কে বাহির করিবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিলাম; কিন্তু কোনরূপেই সেই দরজা ভাঙ্গিয়া উঠিতে পারিলাম না। দেখিতে দেখিতে থানার সহিত হাজত গৃহ ভস্মে পরিণত হইয়া গেল। অপর প্রহরীগণ তাহাদিগের সাধ্যমত সরকারী কাগজ-পত্র অনেকগুলি বাহির করিয়াছিল, কিন্তু সমস্ত বাহির করিয়া উঠিতে পারে নাই।”

 থানা গ্রামের বাহিরে। গ্রাম হইতে লোকজন আসিতে আসিতে হাজত-গৃহের সহিত সেই থানা ভস্মে পরিণত হইয়া গেল। দশ পনর মিনিটের মধ্যে সেই থানার আর কিছু মাত্র চিহ্নও রহিল না।

 ‘থানায় হঠাৎ আগুন লাগিয়া, দুইজন আসামীর সহিত উহা ভন্মে পরিণত হইয়াছে এই সংবাদ উর্দ্ধতন কর্মচারী গণের কর্ণগোচর হওয়ায়, তাহারা আসিয়া ইহার অনুসন্ধান করিলেন। কিরূপে থানায় অগ্নি লাগিল, তাহার কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না। কিন্তু ইহা সাব্যস্ত হইল যে, কোন ব্যক্তি উহাতে অগ্নি প্রদান করিয়াছে। তাহারা সেই দগ্ধাবশিষ্ট মৃতদেহকে হাতকড়ির দ্বারা আবদ্ধ দেখিয়া, ইহাই স্থির করিলেন যে, গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র ওসমান অগ্নিদাহে প্রাণত্যাগ করিয়াছে। প্রমাণে আসল কথা কিছু বাহির হইল না। কেরল দারোগা সাহেব এবং সেই সময় যে সকল প্রহরী থানায় উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের অসারধানতা বশতঃ থানায় অগ্নি লাগিয়াছে, এই অপরাধে তাহা কর্ম্মচ্যুত হইল মাত্র। এদিকে গোফুর খাঁ ও ওসমান দূরদেশে লুক্কায়িত অবস্থায় কালযাপন করিতে লাগিলেন। কিন্তু কিছু দিবস পরে লোকমুখে প্রকাশ হইয়া পড়িল যে, তাঁহার পুড়িয়া মরেন নাই, এখনও জীবিত আছেন। অনুসন্ধানে তাহার কতক প্রমাণও হই, কিন্তু কর্মচারীগণ জেলে যাইতে পারে, এরূপ কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না।

সম্পূর্ণ


  • ভাদ্র মাসের সংখ্যা,

“দুইটা জুয়াচুরি।”


(অর্থাৎ কলিকাতার ভিতর নিত্য নিত্য যে সকল
জুয়াচুরি হইতেছে, তাহার দুইটা দৃষ্টান্ত!)
যন্ত্রস্থ।
______