চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প/ভূষণ পাল
ভূষণ পাল
ভূষণ পাল তার এককালের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও প্রতিবেশী নবীন সাঁতরাকে খুন করেছিল, সেসন্স জজ তার ফাঁসির হুকুম দিয়েছেন। আসামীকে যারা চেনে তারা সকলেই ক্ষুণ্ণ হয়েছে, তাদের আশা ছিল বড় জোর আট-দশ বছর জেল হবে। কিন্তু ভূষণের উকিলের কোনও যুক্তি হাকিম শুনলেন না। বললেন, আসামী ঝোঁকের মাথায় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে খুন করে নি, অনেকদিন থেকে মতলব এঁটে মারবার চেষ্টায় ছিল, অবশেষে সুযোগ পেয়ে ছোরা বসিয়েছে। আসামীর আক্রোশের যতই কারণ থাক তাতে তার অপরাধের গুরুত্ব কমে না। জুরি একমত হয়ে ভূষণকে দোষী সাব্যস্ত করলেও একটু দয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু হাকিম দয়া করলেন না, চরম দণ্ডই দিলেন।
ভূষণ পাল হিন্দুস্থান মোটর ওআর্ক্স্-এ মিস্ত্রীর কাজ করত। ফাটা তোবড়া মডগার্ড বেমালুম মেরামত করতে তার জুড়ী ছিল না, সেজন্য মাইনে ভালই পেত। সেখানে তার গুরুস্থানীয় হেডমিস্ত্রী ছিল সাগর সামন্ত। কারখানার লোকে তাকে সামন্ত মশাই বলে ডাকে, কিন্তু একটা দূর সম্পর্ক থাকায় ভূষণ তাকে সাগর কাকা বলে।
রায় বেরুবার পরদিন বিকাল বেলা সাগর সামন্ত অলীপুর জেলে তার প্রিয় শাগরেদ ভূষণের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দু হাতে মসুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে সাগর বলল, কি করে তোকে বাঁচাব রে ভূষণ।
ভূষণ বলল, অমন করে তুমি কেঁদো না সাগর কাকা, তাহলে আমার মাথা বিগড়ে যাবে।
চোখ মুছতে মুছতে সাগর বলল, উকিল বাবু এখনও আশা ছাড়েন নি, শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবেন। বললেন, আপীল করবেন।
—আপীল আবার কেন। যা হবার হয়ে গেছে, আর কিছুই করবার দরকার নেই, মিথ্যে টাকা বরবাদ হবে।
—বরবাদ নয় রে, তোকে বাঁচাবার জন্যে খরচ হবে। পোষ্টাপিসে তোর যে পঁয়ত্রিশ শ টাকা ছিল তোর কথামত তার সবটাই তুলে নিয়ে আমার কাছে রেখেছি। তা থেকে দু শ আন্দাজ খরচ হয়েছে, বাকী সবই তো রয়েছে। তাতে না কুলয় তো আমরা সবাই চাঁদা তুলে অপীলের খরচ যোগাব।
—উকিল আদিত্যবাবু কত টাকা নিয়েছেন?
—নিজের জন্য একপয়সও নেন নি, শুধু আদালতের খরচ বাবদ কিছু নিয়েছেন। বলেছেন, ভূষণকে যদি বাঁচাতে পারতুম তবেই ফী নিতুম। তিনি আর তাঁর বন্ধু উকিলরা সবাই বলেছেন, আপীল করলে নিশ্চয় রায় পালটে যাবে—লম্বা জেল হলেও তোর প্রাণটা তো রক্ষা পাবে।
—খবরদার আপীল করবে না। দশ-বিশ বছর জেলে থাকার চাইতে চটপট মরা ঢের ভাল।
—নবীনকে ছোরা মেরে খুন করলি কেন রে হতভাগা? তার ঢাইতে যদি পাঁচসেরী হম্বর দিয়ে হাঁটুতে এক ঘা লাগাতিস তা হলে নব্নে মরত না, চিরটা কাল খোঁড়া হয়ে বেঁচে থাকত আর ভাবত— হাঁ, ভূষণ পাল সাজা দিতে জানে বটে। তোরও বড় জোর দু-চার বছর জেল হত।
—নব্নেকে একবারে সাবড়ে দিয়েছি বেশ করেছি। তার ভূতটা যদি আমার কাছে আসে তাকেও গলা টিপে মারব।
—রাম রাম, এসব কথা মুখে আনিস নি ভূষণ, যা হয়ে গেছে একদম ভুলে যা। শুধু হরিনাম কর, মা-কালীকে ডাক, যাতে পরকালে কষ্ট না পাস। এখন বল তোর টাকার বিলি ব্যবস্থা কি করবি। টাকা তো কম নয়, তোর বদখেয়াল ছিল না তাই এত জমাতে পেরেছিল। উইল করতে চাস তো উকিল বাবুকে বলব।
—উইল আবার কি করতে। আমার যা পুঁজি সবই তো তোমার জিম্মেয় রয়েছে। তুমিই তো বিলি করবে। আন্দাজ তেত্রিশ শ আছে তো? তুমিই বল না সাগর কাকা কি করা উচিত।
—সব টাকা তোর পরিবারকে দিবি।
সজোরে মাথা নেড়ে ভূষণ বলল, এক পয়সাও নয়।
—আচ্ছা বউকে না হয় না দিলি, তোর এক বছরের ছেলেটা কি দোষ করল; তাকে তো মানুষ করতে হবে।
—সে আমার ছেলে নয়, সবাই তা জানে। দেখ নি, তার চোখ ঠিক নব্নের মতন ট্যারা? তারা এখন আছে কোথায়?
—যে দিন তুই গ্রেপতার হলি তার পরদিনই তোর বউ ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে।
—বাপের তো অবস্থা ভালই। বেটী আর বেটীর পো-কে খুব পুষতে পারবে।
—তোর বাসায় কেউ নেই খবর পেয়েই আমি তালা লাগিয়েছি। পাশে যে ঘুঁটেওয়ালী যশোদা বুড়ী থাকে তাকে দিয়ে মাঝে মাঝে ঘর-দোর সাফ করাই।
—ও বাসা রেখে কি হবে, ভাড়া চুকিয়ে দাও। দেখ সাগর কাকা, ভুলো বলে একটা বুড়ো কুকুর রোজ আমার কাছে ভাত খেতে আসত। সে বেচারা হয়তো উপোস করছে।
—না না, যশোদাই তাকে খাওয়াচ্ছে।
—বুড়ী নিজেই তো খেতে পয় না। সাগর কাকা, যশোদাকে দু শ টাকা দিও।
—বলিস কিরে, কুকুরের জন্য অত টাকা কেন?
—যশোদা বড় গরিব, ভুলোকে খাওয়াবে নিজেও খাবে। আর একটা কথা—ভটচাজ মশাইকে জিজ্ঞেস করে আমার শ্রদ্ধের খরচটা তাঁকে দিও। তিনিই যা হয় ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু পঞ্চাশ টাকার বেশী খরচ না হয়।
বিষণ্ণ মুখে সাগর বলল, শ্রাদ্ধ হবার জো নেই রে ভূষণ। ভটচাজ বলেছে, অপঘাত মৃত্যুতে শ্রাদ্ধ হয় না, ফাঁসি যে অপঘাত। তবে একটা প্রাশ্চিত্তির করা খুব দরকার বলেছেন, আর বারোটি ব্রাহ্মণ ভোজন।
—না, প্রাশ্চিত্তির আর ভূত ভোজন করাতে হবে না। আর শোন সাগর কাকা, নব্নের বউকে দেড় হাজার টাকা দেবে। তার খুকী গোপালীকে মানুষ করবার জন্যে।
—অবাক করলি ভূষণ! নিজের পরিবারকে কিছু দিবি নি, যাকে মেরেছিস সেই নব্নের মেয়ের জন্যেই দেড় হাজার দিবি? ও বুঝেছি, এই হচ্ছে তোর প্রাশ্চিত্তির।
—কিচ্ছু বোঝ নি, প্রাশ্চিত্তির করবার কোনও গরজ আমার নেই। ওই গোপালীটা ছিল আমার বড্ড ন্যাওটো, কাকা বলতে পারত না, আআ বলে হাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে কোলে উঠত।
—বেশ, গোপালীর মাকে দেড় হাজার টাকা দেব। তের ওপর তার মর্মান্তিক রাগ থাকার কথা, তবে খুব কষ্টে আছে, টাকাটা নিতে আপত্তি করবে না। এটা ভালই করলি ভূষণ, এতে তোর পাপ অনেকটা ক্ষয় হয়ে যাবে। তার পর আর কাকে কি দিতে চাস?
—বাকী সবটা তুমি নিও।
আবার হাউ হাউ করে কেঁদে সাগর বলল, তোর টাকা আমি কোন প্রাণে নেব রে? সৎপাত্রে দান কর, পরকালে তোর ভাল হবে।
—তোমার চাইতে সৎপাত্র পাব কোথা। আমার বাবা মা ভাই বোন কেউ নেই, শুধু তুমিই আছ। আচ্ছা সাগর কাকা, মরবার পরে যমদূতে আমাকে সোজা নরকে নিয়ে যাবে তো?
—তা আমার মনে হয় না। আমাদের হাকিমদের চাইতে যমরাজ ঢের বেশী বোঝেন। অন্যায় সইতে না পেরে রাগের মাথায় একটা পাপ করে ফেলেছিস, তার সাজাও মাথা পেতে নিচ্ছিস, আপীল পর্যন্ত করতে চাস না। তোর পাপ বোধ হয় এখানেই খণ্ডে গেল। আদিত্য উকিল বাবু কি বলেছে জানিস? ইংরেজ বিদেয় হয়েছে, কিন্তু নিজেদের ফৌজদারী আইন আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে গেছে। ওদের দেশে নব্নের অপরাধটা কিছুই নয়, তার জন্যে কেউ খেপে গিয়ে মানুষ খুন করে না, বড় জোর খেসারত দাবি করে আর তালাকের দরখাস্ত করে। ওদের বিচারে নব্নের চাইতে তোর অপরাধ ঢের বেশী। কিন্তু যদি সেকালের হিঁদু রাজা কি মুসলমান বাদশার আমল হত তবে তুই বেকসুর খালাস পেতিস। দেখ ভূষণ, আমার মনে হয় তোর স্বর্গে ঠাঁই হবে না বটে, কিন্তু নরক ভোগ থেকে তুই রেহাই পারি।
—স্বর্গেও নয় নরকেও নয়, তবে ঠাঁই হবে কোথায়?
—তুই আবার জন্মাবি।
—সে তো খুব ভালই হবে। সাগর কাকা, কাকীকে বলো আমার জন্যে যেন খান কতক কাঁথা সেলাই করে রাখে।
—কাঁথা কি হবে রে?
—শুনেছি মরবার সময় মানুষের যে মনোবাঞ্ছা থাকে পরের জন্মে তাই ফলে। ফাঁসির সময় আমি কেবল তোমার আর কাকীর কথা ভাবব। দেখো, ঠিক তোমাদের ছেলে হয়ে জন্মাব। এমন বাপ মা পাব কোথায়? দাগী ছেলেকে ঘেন্না করে ফেলে দেবে না তো সাগর কাকা?
জেলের ওআর্ডার এসে জানাল, সময় হয়ে গেছে, ভিজিটারকে এখন চলে যেতে হবে।
সাগর সামন্ত ভূষণকে একবার জড়িয়ে ধরল, তার পর ফোঁপাতে ফোঁপাতে চলে গেল।