চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প/দাঁড়কাগ

দাঁড়কাগ

কাঞ্চন মজুমদার অনেক কাল পরে তার বন্ধু যতীশ মিত্রের অড্ডায় এসেছে। তাকে দেখে সকলে উৎসুক হয়ে নানারকম সম্ভাষণ করতে লাগল।—আরে এস এস, এত দিন কোথায় ডুব মেরে ছিলে? বিদেশে বেড়াতে গিয়েছিলে নাকি? ব্যারিস্টারিতে খুব রোজগার হচ্ছে বুঝি, তাই গরিবদের আর মনে পড়ে না?

 প্রবীণ পিনাকী সর্বজ্ঞ বললেন, বে-থা করলে, না এখনও আইবুড় কার্তিক হয়ে আছ?

 কাঞ্চন বলল, কই আর বিয়ে হল সর্বজ্ঞ মশাই, পাত্রীই জুটছে না।

 উপেন দত্ত বলল, আমাদের মতন চুনো পুঁঠি সকলেরই কোন্ কালে জুটে গেছে, শুধু তোমারই জোটে না কেন? অমন মদনমোহন চেহারা, উদীয়মান ব্যারিস্টার, দেদার পৈতৃক টাকা, তবু বিয়ে হয় না? ধনকেভাঙা পণ কিছু আছে বুঝি? এদিকে বয়স তো হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে, চুল উঠে গিয়ে ডিউক অভ এডিনবরোর মতন প্রশস্ত ললাট দেখা দিচ্ছে, খুঁজলে দু-চারটে পাকা চুলও বেরুবে। পাত্রীরা তোমাকে বয়কট করেছে নাকি?

 —বয়কট করলে তো বেঁচে যেতুম। ষোল থেকে বত্রিশ যেখানে যিনি আছেন সবাই ছেঁকে ধরেছেন। গণ্ডা গণ্ডা রূপসী যদি আমার প্রেমে পড়তে চান তবে বেছে নেব কাকে?

 উপেন বলল, উঃ, দেমাকের ঘটাখানা দেখ! তুমি কি বলতে চাও গণ্ডা গণ্ডা রূপসীর মধ্যে তোমার উপযুক্ত কেউ নেই? আসল কথা, তুমি ভীষণ খুঁতখুঁতে মানুষ। নিশ্চয় তোমার মনের মধ্যে কেনও গণ্ডগোল আছে, নিজেকে অদ্বিতীয় রূপবান গুণনিধি মনে কর তাই পছন্দ মত মেয়ে কিছুতেই খুঁজে পাও না। হয়তো মেয়েরাই তোমার কথা শুনে ভড়কে যায়।

 —মিছিমিছি আমার দোষ দিও না উপেন। বিয়ের জন্যে আমি সত্যিই চেষ্টা করছি, কিন্তু যাকে তাকে তো চিরকালের সঙ্গিনী করতে পারি না। হঠাৎ প্রেমে পড়ার লোক আমি নই, আমার একটা আদর্শ একটা মিনিমম স্ট্যাণ্ডার্ড আছে। রূপ অবশ্যই চাই, কিন্তু বিদ্যা বুদ্ধি কলচারও বাদ দিতে পারি না। সুশিক্ষিত অথচ শান্ত নম্র মেয়ে হবে, বিলাসিনী উড়নচণ্ডী বা উগ্রচণ্ডা খাণ্ডারনী হলে চলবে না। একটু আধটু নাচুক তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু হরদম নাচিয়ে মেয়ে আমার পছন্দ হয়। মনের মতন স্ত্রী আবিষ্কার করা কি সোজা কথা? এ পর্যন্ত তো খুঁজে পাই নি।

 —পাবার কোনও আশা আছে কি?

 —তা আছে, সেই জন্যেই তো যতীশের কাছে এসেছি। আচ্ছা যতীশ, গণেশমুণ্ডা জায়গাটা কেমন? তুমি তো মাঝে মাঝে সেখানে যেতে। শুনেছি এখন আর নিতান্ত দেহাতী পল্লী নয়, অনেকটা শহরের মতন হয়েছে।

 যতীশ বলল, তোমার নির্বাচিতা প্রিয়া ওখানেই আছেন নাকি?

 —নির্বাচন এখনও করি নি। শম্পা সেন এখানকার নতুন গার্ল স্কুলের নতুন হেডমিস্ট্রেস। মাস চার-পাঁচ আগে নিউ আলীপুরে আমার ভাগনীর বিয়ের প্রীতিভোজে একটু পরিচয় হয়েছিল। খুব লাইকলি পার্টি মনে হয়, তাই আলাপ করে বাজিয়ে দেখতে চাই।

 পিনাকী সর্বজ্ঞ বললেন, শম্পা সেনও তো তোমাকে বাজিয়ে দেখবেন। তিনি তোমাকে পছন্দ করবেন এমন আশা আছে?

 —কি বলছেন সর্বজ্ঞ মশাই! আমি প্রোপোজ করলে রাজী হবে না এমন মেরে এদেশে নেই।

 উপেন বলল, তবে অবিলম্বে যাত্রা কর বন্ধু, তোমার পদার্পণে তুচ্ছ গণেশমুণ্ডা ধন্য হবে। গিয়ে হয়তো দেখবে তোমাকে পাবার জন্যে শম্পা দেবী পার্বতীর মতন কৃচ্ছ সাধনা করছেন।

 —ঠাট্টা রাখ, কাজের কথা হক। ওখানে শুনেছি হোটেল নেই, ডাকবাঙলাও নেই। যতীশ, তুমি নিশ্চয় ওখানকার খবর রাখ। একটা বাসা যোগাড় করে দিতে পার?

 যতীশ বলল, তা বোধ হয় পারি, তবে তোমার পছন্দ হবে কিন। জানি না। আমার দূর সম্পর্কের এক খুড়শাশুড়ী তাঁর মেয়েকে নিয়ে ওখানে থাকেন, মেয়ে কি একটা সরকারী নারী উদ্যোগশালা না সর্বাত্মক শিল্পাশ্রমের ইন চার্জ। নিজের বাড়ি আছে, মা আর মেয়ে দোতলায় থাকেন, একতলাটা যদি খালি থাকে তো তোমাকে ভাড়া দিতে পারেন।

 —তবে আজই একটা প্রিপেড টেলিগ্রাম কর, আমি তিন-চার দিনের মধ্যেই যেতে চাই। একটা চাকর সঙ্গে নেব, সেই রান্না আর সব কাজ করবে। উত্তর এলেই আমাকে টেলিফোনে জানিও। আচ্ছা, সর্বজ্ঞ মশাই, আজ উঠলুম, যাবার আগে আবার দেখা করব।

 উপেন বলল, তার জন্যে ব্যস্ত হয়ো না, তবে ফিরে এসে অবশ্যই ফলাফল জানিও, আমরা উদগ্রীব হয়ে রইলুম। কিন্তু শুধু হাতে যদি এস তো দুও দেব।


কাঞ্চন মজুমদার চলে যাবার পর পিনাকী সর্বজ্ঞ বললেন, ওর মতন দাম্ভিক লোকের বিয়ে কোনও কালে হবে না, হলেও ভেঙে যাবে। কাঞ্চনের জোড়া ভুরু, সুলক্ষণ নয়। বিষবৃক্ষের হীরা, চোখের বালির বিনোদ বোঠান, ঘরে বাইরের সন্দীপ, গৃহদাহর সুরেশ, সব জোড়া ভুরু। তারা কেউ সংসারী হতে পারে নি।

 উপেন বলল, সন্দীপ আর সুরেশের জোড়া ভুরু কোথায় পেলেন?

 —বই খুঁজলেই পাবে, না যদি পাও তো ধরে নিতে হবে। শম্পা সেনের যদি বুদ্ধি থাকে তবে নিশ্চয় কাঞ্চনকে হাঁকিয়ে দেবে।

 যতীশ বলল, শম্পা সেনকে চিনি না, সে কি করবে তাও জানি না। তবে অনুমান করছি, গণেশমুণ্ডায় দাঁড়কাগের ঠোকর খেয়ে কাঞ্চন নাজেহাল হবে।

 উপেন প্রশ্ন করল, দাঁড়কাগটি কে?

 —সম্পর্কে আমার শালী, যে খুড়শাশুড়ীর বাড়িতে কাঞ্চন উঠতে চায় তাঁরই কন্যা। তারও জোড়া ভুরু। আগে নাম ছিল শ্যামা, ম্যাট্রিক দেবার সময় নিজেই নাম বদলে তমিস্রা করে। কালো আর শ্রীহীন সেজন্যে লোকে আড়ালে তাকে দাঁড়কাগ বলে।

 উপেন বলল, তা হলে কাঞ্চন নাজেহাল হবে কেন? কোনও সুন্দরী মেয়েই এপর্যন্ত তাকে বাঁধতে পারে নি, তোমার কুৎসিত শালীকে সে গ্রাহ্যই করবে না। এই দাঁড়কাগ তমিস্রার হিস্টরি একটু শুনতে পাই না? অবশ্য তোমার যদি বলতে আপত্তি না থাকে।

 —আপত্তি কিছুই নেই। ছেলেবেলায় বাপ মারা যান। অবস্থা ভাল, বীডন স্ট্রীটে একটা বাড়ি আছে। মায়ের সঙ্গে সেখানে থাকত আর স্কটিশ চার্চে পড়ত। স্কুল কলেজের আর পাড়ার বজ্জাত ছোকরারা তাকে দাঁড়কাগ বলে খেপাত, কেউ কেউ সংস্কৃত ভাষায় বলত, দণ্ডবায়স হুশ। এখানে সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, আই-এস-সি পাস করেই মায়ের সঙ্গে মাদ্রাজে চলে যায়। সেখানে ওর চেহারা কেউ লক্ষ্য করত না, খেপাতও না। মাদ্রাজ থেকে বি-এস-সি আর এম-এস-সি পাস করে, তার পর তার পিতৃবন্ধু এক বিহারী মন্ত্রীর অনুগ্রহে গণেশমুণ্ডায় নারী-উদ্যোগশালায় চাকরি পায়। খুব কাজের মেয়ে, তমিস্রা নাগের বেশ খ্যাতি হয়েছে। মিষ্টি গলা, চমৎকার গান গায়, সুন্দর বক্তৃতা দেয়, কথাবার্তায় অতি ব্রিলিয়াণ্ট। ওর দাঁড়কাগ উপাধিটা ওখানেও পৌঁছেছে, হিন্দীতে হয়েছে কৌআদিদি। গণগ্রাহী অ্যাডমায়ারারও দু-চার জন আছে, কিন্তু কেউ বেশী দূর এগুতে পারে নি। নিজের রূপ নেই বলে পুরুষ জাতটার ওপর ওর একটা আক্রোশ আছে, খোঁচা দিতে ভালবাসে।


কাঞ্চনকে স্বাগত জানিয়ে তমিস্রা বলল, কোনও ভাল জায়গায় না গিয়ে এই তুচ্ছ গণেশমুণ্ডায় হাওয়া বদলাতে এলেন কেন? আমাদের এই বাড়ি অতি ছোট, আসবাবও সামান্য, অনেক অসুবিধা অপনাকে সইতে হবে।

 কাঞ্চন বলল, ঠিক হাওয়া বদলাতে নয়, একটু কাজে এসেছি। আমার অসুবিধা কিছুই হবে না। একটা রান্নার জায়গা আমার চাকরকে দেখিয়ে দেবেন, আর দয়া করে কিছু বাসন দেবেন। যতীশকে যে টেলিগ্রাম করেছিলেন তাতে তো ভাড়ার রেট জানান নি।

 —যতীশবাব, আমাদের কুটুম্ব, আপনি তাঁর বন্ধু, অতএব আপনিও কুটুম্ব। ভাড়া নেব কেন? রান্নার ব্যবস্থাও আপনাকে করতে হবে না, আমাদের হেঁসেলেই খাবেন। অবশ্য বিলাতের রিৎস-কার্লটন বা দিল্লির অশোকা হোটেলের মতন সার্ভিস পাবেন না, সামান্য ভাত ডাল তরকারিতেই তুষ্ট হতে হবে। মাছ এখানে দুর্লভ, তবে চিকেন পাওয়া যায়।

 — না না, এ বড়ই অন্যায় হবে মিস নাগ। বাড়ি ভাড়া নেবেন না, আবার বিনা খরচে খাওয়াবেন, এ হতেই পারে না।

 তমিস্রা স্মিতমুখে বলল, ও, বিনামূল্যে অতিথি হলে আপনার মর্যাদার হানি হবে? বেশ তো, থাকা আর খাওয়ার জন্যে রোজ তিন টাকা দেবেন।

 —তিন টাকায় থাকা আর খাওয়ার খরচ কুলোয় না, আমার চাকরও তো আছে।

 —আচ্ছা আচ্ছা, পাঁচ সাত দশ যাতে আপনার সংকোচ দূর হয় তাই দেবেন। টাকা খরচ করে যদি তৃপ্তি পান তাতে আমি বাধা দেব কেন। দেখুন, আমার মায়ের কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে, নামতে পারবেন না। আপনি চা খেয়ে বিশ্রাম করে একবার উপরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন, কেমন?

 —অবশ্যই করব। আচ্ছা, আপনাদের এই গণেশমুণ্ডায় দেখবার জিনিস কি কি আছে?

 —লাল কেল্লা নেই, তাজমহল নেই, কাঞ্চনজঙ্ঘাও নেই। মাইল দেড়েক দূরে একটা ঝরনা আছে, ঝম্পাঝোরা। কাছকাছি একটা পাহাড় আছে, পঞ্চাশ বছর আগে বিপ্লবীরা সেখানে বোমার ট্রায়াল দিত। তাদের দলের একটি ছেলে তাতেই মারা যায়, তার কঙ্কাল নাকি এখনও একটা গভীর খাদের নীচে দেখা যায়। ওই যে মাঠ দেখছেন ওখানে প্রতি সোমবারে একটা হাট বসে, তাতে ময়ূর হরিণ ভালুকের বাচ্চা থেকে মধু মোম ধামা চুবড়ি পর্যন্ত কিনতে পারেন।

 —আর আপনার নিজের কীর্তি, মহিলা-উদ্যোগশালা না কি, তাও তো দেখতে হবে। গাড়িটা আনতে পারি নি, হেঁটেই সব দেখব। আপনি সঙ্গে থেকে দেখাবেন তো?

 —দেখাব বইকি। আপনার মতন সম্ভ্রান্ত পর্যটক এখানে ক জন আসে। বিকাল বেলায় আমার সুবিধে, সকালে দুপরে কাজ থাকে। যেদিন বলবেন সঙ্গে যাব।


তিন রকম লোক ডায়ারি লেখে— কর্মবীর, ভাবুক আর হামবড়া। কাঞ্চনেরও সে অভ্যাস আছে। রাত্রে শোবার আগে সে ডায়ারিতে লিখল—পুওর তমিস্রা নাগ, তোমার জন্যে আমি রিয়ালি সরি। যেরকম সতৃষ্ণ নয়নে আমাকে দেখছিলে তাতে বুঝেছি তুমি শরাহত হয়েছ। কথাবার্তায় মনে হয় তুমি অসাধারণ বুদ্ধিমতী। দেখতে বিশ্রী হলেও তোমার একটা চার্ম আছে তা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু আমার কাছে তোমার কোনও চান্সই নেই, এই সোজা কথাটা তোমার অবিলম্বে বোঝা দরকার, নয়তো বৃথা কষ্ট পাবে। কালই আমি তোমাকে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেব।

 পরদিন সকালে কাঞ্চন বলল, আপনাকে এখনই বুঝি কাজে যেতে হবে? যদি সুবিধা হয় তো বিকেলে আমার সঙ্গে বেরুবেন। এখন আমি একটু একাই ঘুরে আসি। আচ্ছা, শম্পা সেনকে চেনেন, গার্ল স্কুলের হেডমিস্ট্রেস?

 তমিস্রা বলল, খুব চিনি, চমৎকার মেয়ে। আপনার সঙ্গে আলাপ আছে?

 —কিছু আছে। যখন এসেছি তখন একবার দেখা করে আসা যাক। বেশ সুন্দরী, নয়? আর চার্মিং। শুনেছি এখনও হার্টহোল আছে, জড়িয়ে পড়ে নি।

 —হাঁ, রূপে গণে খাসা মেয়ে। ভাল করে আলাপ করে ফেলুন, ঠকবেন না।

 স্কুলের কাছেই একটা ছোট বাড়িতে শম্পা বাস করে। কাঞ্চন সেখানে গিয়ে তাকে বলল, গুডমর্নিং মিস সেন, চিনতে পারেন? আমি কাঞ্চন মজুমদার, সেই যে নিউ আলীপুরে আমার ভগিনীপতি রাঘব দত্তর বাড়িতে আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। মনে আছে তো?

 শম্পা বলল, মনে আছে বইকি। আপনি হঠাৎ এদেশে এলেন যে? এখন তো চেঞ্জের সময় নয়।

 —এখানে একটা দরকারে এসেছি। ভাবলুম, যখন এসে পড়েছি তখন আপনার সঙ্গে দেখা না করাটা অন্যায় হবে। মনে আছে, সেদিন আমাদের তর্ক হচ্ছিল, গেটে বড় না রবীন্দ্রনাথ বড়? আমি বলেছিলুম, গেটের কাছে রবীন্দ্রনাথ দাঁড়াতে পারেন না, আপনি তা মানেন নি। ডিনারের ঘণ্টা পড়ায় আমাদের তর্ক সেদিন শেষ হয় নি।

 —এখানে তারই জের টানতে চান নাকি? তর্ক আমি ভালবাসি না, আপনার বিশ্বাস আপনার থাকুক, আমারটা আমার থাকুক, তাতে গেটে কি রবীন্দ্রনাথের ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।

 — আচ্ছা, তর্ক থাকুক। আমি এখানে নতুন এসেছি, দ্রষ্টব্য যা আছে সব দেখতে চাই। আপনি আমার গাইড হবেন?

 —এখানে দেখবার বিশেষ কিছু নেই। আপনি উঠেছেন কোথায়?

 — তমিস্রা নাগকে চেনেন? তাঁদেরই বাড়িতে আছি।

 —তমিস্রাকে খুব চিনি। সেই তো আপনাকে দেখাতে পারবে, আমার চাইতে ঢের বেশী দিন এখানে বাস করছে, সব খবরও রাখে। আমার সময়ও কম, বেলা দশটার সময় স্কুলে যেতে হয়।

 —সকালে ঘণ্টা খানিক সময় হবে না?

 —আচ্ছা, চেষ্টা করব, কিন্তু সব দিন আপনার সঙ্গে যেতে পারব না। কাল সকালে আসতে পারেন।

 আরও কিছুক্ষণ থেকে কাঞ্চন চলে গেল। দুপুর বেলা ডায়ারিতে লিখল—মিস শম্পা সেন, তোমাকে ঠিক বুঝতে পারছি না। এখানে আসবার আগে ভাল করেই খোঁজ নিয়েছিলাম, সবাই বলেছে এখনও তুমি কারও সঙ্গে প্রেমে পড় নি। আমি এখানে এসে দেরি না করে তোমার কাছে গিয়েছি, এতে তোমার খুব ফ্ল্যাটার্ড আর রীতিমত উৎফুল্ল হবার কথা। তুমি সুন্দরী, বিদুষীও বটে, কিন্তু আমার চাইতে তোমার মূল্য ঢের কম। রূপে গুণে বিত্তে আমার মতন পাত্র তুমি কটা পাবে? মনে হচ্ছে তুমি একটু অহংকেরে, মানুষ চেনবার শক্তিও তোমার কম।


কাঞ্চন প্রায় প্রতিদিন সকালে শম্পার সঙ্গে আর বিকালে তমিস্রার সঙ্গে বেড়াতে লাগল। গণেশুমণ্ডায় একটি মাত্র বড় রাস্তা, তারই ওপর তমিস্রাদের বাড়ি। একটু এগিয়ে গেলেই গোটাকতক দোকান পড়ে, তার মধ্যে বড় হচ্ছে রামসেবক পাঁড়ের মুদীখানা আর কহেলিয়াম বজাজের কাপড়ের দোকান। এইসব দোকানের সামনে দিয়েই কাঞ্চন আর তার সঙ্গিনী শম্পা বা তমিস্রার যাতায়াতের পথ। দোকানদাররা খুব নিরীক্ষণ করে ওদের দেখে।

 একদিন বেড়িয়ে ফেরবার সময় তমিত্রা রামসেবকের দোকনে এসে বলল পাঁড়েজী, এই ফর্দটা নাও, সব জিনিস কাল পাঠিয়ে দিও। চিনিতে যেন পিঁপড়ে না থাকে।

 রামসেবক বলল, আপনি কিছু ভাববেন না দিদিমণি, সব খাঁটী মাল দিব। এই বাবু সাহেবকে তো চিনছি না, আপনাদের মেহমান (অতিথি)?

 —হাঁ, ইনি এখানে বেড়াতে এসেছেন।

 —রাম রাম বাবুজী। আমার কাছে সব ভাল ভাল জিনিস পারেন, মহীন বাসমতী চাউল, খাঁটী ঘিউ, পোলাওএর সব মসালা, কাশ্মীরী জাফরান, পিস্তা বাদাম কিশমিশ। আসেটিলীন বাত্তি ভি আমি রাখি।

 কাঞ্চন বলল, ও সবের দরকার আমার নেই।

 —না হুজুর, ভোজের দরকার তো হতে পারে, তখন আমার বাত ইয়াদ রাখবেন।

 দোকান থেকে বেরিয়ে কাঞ্চন বলল, লোকটা আমাকে ভোজনবিলাসী ঠাউরেছে।

 তমিস্রা হেসে বলল, তা নয়। ডিকেন্স-এর সারা গ্যাম্প-কে মনে আছে? তার পেশা ধাইগিরি আর রোগী আগলানো। সদ্য বিবাহিত বর-কনে গির্জা থেকে বেরুচ্ছে দেখলেই সারা গ্যাম্প তাদের হাতে নিজের একটা কার্ড দিত। তার মানে, প্রসবের সময় আমাকে খবর দেবেন। গণেশমুণ্ডার দোকানদাররাও সেই রকম। কুমারী মেয়ে কোনও জোয়ান পুরুষের সঙ্গে বেড়াচ্ছে দেখলেই মনে করে বিবাহ আসন্ন, তাই নিজের আর্জি আগে থাকতেই জানিয়ে রাখে।

 —এদের আক্কেল কিছুমাত্র নেই। আমার সঙ্গে অপনাকে দেখে—

 —অমন ভুল বোঝা ওদের উচিত হয় নি, তাই না? কি জানেন, এরা হচ্ছে ব্যবসাদার, সরূপ কুরূপ গ্রাহ্য করে না, শুধু লাভ-লোকসান বোঝে। আপনি যে মস্ত ধনী লোক তা এরা জানে না। ভেবেছে, আমার মায়ের বাড়ি আছে, অন্য সম্পত্তিও আছে, আমি একমাত্র সন্তান, রোজগারও করি, অতএব বিশ্রী হলেও আমি সুপাত্রী।

 —এরা অতি অসভ্য, এদের ভুল ভেঙে দেওয়া দরকার।

 —আপনি শম্পাকে নিয়ে ওদের দোকানে গেলেই ভুল ভাঙবে।

 পরদিন সকালে শম্পার সঙ্গে যেতে যেতে কাঞ্চন বলল, আমার এক জোড়া স স দরকার।

 শম্পা বলল, চলুন কহেলিরামের দোকানে।

 কহেলিরাম সসম্ভ্রমে বলল, নমস্তে বাবু সাহেব, আসেন সেনমিসিবাবা। মোজা চাহি? নাইলন, সিল্ক, পশমী, সুতী—

 কাঞ্চন বলল, দশ ইঞ্চ গ্লে উল ন একজোড়া দাও।

 মোজা দিয়ে কহেলিরাম বলল, যা দরকার হবে সব এখানে পাবেন হুজুর। হাওআই বুশশার্ট আছে, লিবার্টি আছে, ট্রাউজার ভি আছে। জর্জেট ভয়েল নাইলন শাড়ি আছে, বনারসী ভি আমি রাখি, ভেলভেট সাটিন কিংখাব ভি। ভাল ভাল বিলাতী এসেন্স ভি রাখি। দেখবেন হুজুর?

 দোকান থেকে বেরিয়ে কাঞ্চন সহাস্যে বলল, বর-কনের পোশাক সবই আছে, এরা একবারে স্থির করে ফেলেছে দেখছি।

 বিকালে কাঞ্চনের সঙ্গে তমিস্রা রামসেবকের দোকানে এসে এক বাণ্ডিল বাতি কিনল। রামসেবক বলল, দিদিমণি, একঠো ছোকরা চাকর রাখবেন? খুব কাজের লোক, আপনার বাজার করবে, চা বানাবে, বিছানা করবে, বাবুসাহেবের জুতি ভি বুরুশ করবে। দরমাহা বহুত কম, দশ টাকা দিবেন। আমি ওর জামিন থাকব। এ মুন্নালাল, ইধর আ।

 তমিস্রার একটা চাকরের দরকার ছিল, মুন্নালালকে পেয়ে খুশী হল। বয়স আন্দাজ ষোল, খুব চালাক আর কাজের লোক।

 রাত্রে কাঞ্চন তার ডায়ারিতে লিখল, শম্পা, তোমার কি উচ্চাশা নেই, নিজের ভাল মন্দ বোঝবার শক্তি নেই? আমাকে তো কদিন ধরে দেখলে, কিন্তু তোমার তরফ থেকে কোনও সাড়া পাচ্ছি না কেন? তমিস্রা তো আমাকে খুশী করবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। যাই হক, আর দুদিন দেখে তোমার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করব।

 তিন দিন পরে বিকালে তমিস্রা চায়ের ট্রে আনল দেখে কাঞ্চন বলল, আপনি আনলেন কেন, মুন্নালাল কোথায়?

 তমিস্রা সহাস্যে বলল, সে শম্পার বাড়ি বদলী হয়েছে।

 —আপনিই তাকে পাঠিয়েছেন?

 —আমি নয়, তার আসল মনিব রামসেবক পাঁড়ে, সেই মান্নাকে ট্রান্সফার করেছে, এখানে তাকে রেখে আর লাভ নেই।

 —কিছুই বুঝলাম না।

 —আপনি একবারে চক্ষুকর্ণহীন। শম্পা, আমি, আর আপনি— এই তিনজনকে নিয়ে গণেশমুণ্ডার বাজারে কি তুমল কাণ্ড হচ্ছে তার কোনও খবরই রাখেন না। শুনুন।— মুন্নালাল হচ্ছে রামসেবকের স্পাই, গপ্তচর। ওর ডিউটি ছিল আপনার আর আমার প্রেম কতটা অগ্রসর হচ্ছে তার দৈনিক রিপোর্ট দেওয়া। যখন সে জানাল যে কুছ ভি নহি, নথিং ডুইং, তখন তার মনিব তাকে শম্পার বাড়ি পাঠাল, শম্পা আর আপনার ওপর নজর রাখবার জন্যে।

 —কিন্তু তাতে ওদের লাভ কি?

 —আপনি হচ্ছেন রেসের গোল-পোস্ট, শম্পা আর আমি দুই ঘোড়া। কে আপনাকে দখল করে তাই নিয়ে বাজি চলছে। রামসেবক বুক-মেকার হয়েছে। প্রথম কদিন আমারই দর বেশী ছিল, থ্রী-টু-ওআন কৌআ-দিদি। কিন্তু কাল থেকে শম্পা এগিয়ে চলছে, ফাইভ-টু-ওআন সেন-মিসিবাবা। আমার এখন কোনও দরই নেই।

 —উঃ, এখানকার লোকরা একবারে হার্টলেস, মানুষের হৃদয় নিয়ে জুয়া খেলে! নাঃ, চটপট এর প্রতিকার করা দরকার।

 —সে তো আপনারই হাতে, কালই শম্পার কাছে আপনার হৃদয় উদ ঘাটন করুন আর তাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যান।

 পরদিন সকাল বেলা শম্পা বলল, আজ আর বেড়াতে পারব না, শুধু কহেলিরামের দোকানে একবার খাব।

 কাঞ্চন বলল, বেশ তো, চলুন না, সেখানেই যাওয়া যাক।

 শম্পার ওপর কহেলিরাম অনেক টাকার বাজি ধরেছিল। দুজনকে দেখে মহা সমাদরে বলল, আসেন আসেন বাবুসাহেব, আসেন সেন মিসিবাবা। হুকুম করুন কি দিব।

 শম্পা বলল, একটা তাঞ্জোর শাড়ি চাই, কিন্তু দাম বেশী হলে চলবে না, কুড়ি টাকার মধ্যে।

 —আরে দামের কথা ছোড়িয়ে দেন, আপনার কাছে আবার দাম! এই দেখুন, অচ্ছা জরিপাড়, পঁয়ত্রিশ টাকা। আর এই দেখুন, নয়া আমদানি চিদম্বরম সিল্ক শাড়ি, আসমানী রঙ, নকশাদার জরিপাড়, চওড়া আঁচলা, বহুত উমদা। এর অসলী দাম তো দো শও রুপেয়া, লেকিন আপনার কাছে দেড় শও লিব।

 শম্পা মাথা নেড়ে বলল, কোনওটাই চলবে না, অত টাকা খরচ করতে পারব না। থাক, এখন শাড়ি চাই না, আসছে মাসে দেখা যাবে।

 কাঞ্চন বলল, এই চিদম্বরম শাড়িটা কেমন মনে করেন?

 শম্পা বলল, ভালই, তবে দাম বেশী বলেছে।

 —আচ্ছা, আপনি যখন কিনলেন না তখন আমিই নিই। কহেলিরাম দন্তবিকাশ করে শাড়িটা সযত্নে প্যাক করে দিল।

 শম্পা বলল, ককেও উপহার দেবেন বুঝি? তা কলকাতায় কিনলেন না কেন?

 শম্পার বাসায় এসে কাঞ্চন বলল, শম্পা, এই শাড়িটা তোমার জন্যেই কিনেছি, তুমি পরলে আমি কৃতার্থ হব।

 ভ্রূ কুঁচকে শম্পা বলল, আপনার দেওয়া শাড়ি আমি নেব কেন, আপনার সঙ্গে তো কোনও আত্মীয় সম্পর্ক নেই।

 —শম্পা, তুমি মত দিলেই চূড়ান্ত সম্পর্ক হবে, আমার সর্বস্ব নেবার অধিকার তুমি পাবে। বল, আমকে বিবাহ করবে? আমি ফেলনা পাত্র নই, আমার রূপ আছে, বিদ্যা আছে, বাড়ি গাড়ি টাকাও আছে। তোমাকে সুখে রাখতে পারব।

 —থামুন, ওসব কথা বলবেন না।

 —কেন, অন্যায় তো কিছু বলছি না। আমার প্রস্তাবটা বেশ করে ভেবে উত্তর দাও।

 —ভাববার কিছু নই, উত্তর যা দেখার দিয়েছি। ক্ষমা করবেন, আপনার প্রস্তাবে রাজী হতে পারব না।

 অত্যন্ত রেগে গিয়ে কাঞ্চন বলল, একবারে সরাসরি প্রত্যাখ্যান? মিস সেন, আপনি ঠকলেন, কি হারালেন তা এর পর বুঝতে পারবেন।


মস্ত পথ আপন মনে গজ গজ করতে করতে কাঞ্চন ফিরে এল। ডায়ারিতে লেখবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার সোনালী শার্পার কলম থেকে এক লাইনও বেরুল না। সমস্ত দুপুর সে অস্থির হয়ে ভাবতে লাগল।

 বিকাল বেলা তমিস্রা তার কর্মস্থান থেকে ফিরে এসে কাঞ্চনকে দেখে বলল, একি মিস্টার মজুমদার, চুল উষ্ক খুষ্ক, চোখ লাল, মুখ শুখনো, অসুখ করেছে নাকি?

 কাঞ্চন বলল, না, অসুখ করে নি। তমিস্রা, এই শাড়িটা তুমি নাও, আর বল যে আমাকে বিয়ে করতে রাজী আছ।

 তমিস্রা খিল খিল করে হাসল, যেন শূন্যে বলতির ওপর কেউ কল খুলে দিল। তার পর বলল, এই ফিকে নীল শাড়িটা নিশ্চয় আমার জন্যে কেনেন নি, শম্পাকে দিতে গিয়েছিলেন, সে হাঁকিয়ে দিয়েছে তাই আমাকে দিচ্ছেন। মাথা ঠাণ্ডা করুন, রাগের মাথায় বোকামি করবেন না।

 তমিস্রা, আমি কলকাতায় ফিরে গিয়ে মুখ দেখাব কি করে, বন্ধুদের কি বলব? তারা যে সবাই দুও দেবে। তুমি আমাকে বাঁচাও, বিয়েতে মত দাও। আমি যেন সবাইকে বলতে পারি, রূপ আমি গ্রাহ্য করি না, শুধু গুণ দেখেই বিয়ে করেছি।

 —আপনি যদি অন্ধ হতেন তা হলে না হয় রাজী হতুম। কিন্তু চোখ থাকতে কত দিন দাঁড়কাগকে সইতে পারবেন? শম্পা আর আমি ছাড়া কি মেয়ে নেই? যা বলছি শুনন। কাল সকালের ট্রেনে কলকাতায় ফিরে যান। আপনি হিসেবী লোক, প্রেমে পড়ে বিয়ে করা আপনার কাজ নয়, সেকেলে পদ্ধতিই আপনার পক্ষে ভাল। ঘটক লাগিয়ে পাত্রী স্থির করুন। বেশী যাচাই করবেন না, তবে একটু বোকা-সোকা মেয়ে হলেই ভাল হয়, অন্তত আপনার চাইতে একটু বেশী বোকা, তবেই আপনাকে বরদাস্ত করা তার পক্ষে সহজ হবে।

১৮৮১