গনৎকার

লোকটির নাম হয়তো আপনাদের মনে আছে। কয়েক বৎসর আগে খবরের কাগজে তাঁর বড় বড় বিজ্ঞাপন ছাপা হত— ডক্টর মিনাণ্ডার দ মাইটি, জগদ্‌বিখ্যাত গ্রীক অ্যাস্ট্রোপামিস্ট, ত্রিকালজ্ঞ জ্যোতিষী, হস্তরেখাবিশারদ, ললাটলিপিপাঠক, গ্রহরত্নবিধায়ক, হিপনটিস্ট, টেলিপ্যাথিস্ট, ক্লেয়ারভয়াণ্ট ইত্যাদি। ইনি ইজিপ্টে বহু দিন গবেষণা করে হার্মেটিক গুপ্তবিদ্যা আয়ত্ত করেছেন, দমস্কসে কালডীয় জ্যোতিষের রহস্য ভেদ করেছেন, কামরূপ-কামাখ্যায় তন্ত্রমন্ত্র শিখেছেন, কাশীতে ভৃগুসংহিতার হাড়হদ্দ জেনে নিয়েছেন। কিছুই জানতে এঁর বাকী নেই।

 আমার ভাগনে বঙ্কার মুখে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনলুম।— ওঃ, এমন মহাপুরুষ দেখা যায় না, কলকাতার সমস্ত রাজজ্যোতিষীর অন্ন মেরে দিয়েছেন। বড় বড় ব্যারিস্টার উকিল ডাক্তার মন্ত্রী দেশনেতা প্রফেসর সাহিত্যিক সবাই দলে দলে তাঁর কাছে যাচ্ছেন আর থ হয়ে ফিরে আসছেন। মামা, তোমার তো সময়টা ভাল যাচ্ছে না, একবার এই গ্রীক গৎকার ডক্টর মিনাণ্ডারের কাছে যাও না। ফী মোটে কুড়ি টাকা। আট নম্বর পিটারকিন লেন, দেখা করবার সময় সকাল আটটা থেকে দশটা, বিকেলে তিনটে থেকে সন্ধ্যে সাতটা।

 গনৎকারের কাছে যাবার কিছুমাত্র আগ্রহ আমার ছিল না। একদিন কাগজে মিনাণ্ডার দ মাইটির ছবি দেখলাম। মাথায় মকুটের মতন টুপি, উজ্জল তীক্ষ দৃষ্টি, দু ইঞ্চি ঝোলা গোঁফ, ছ ইঞ্চি লম্বা দাড়ি, গায়ে একটা নকশাদার উত্তরীয়, সেকালের গ্রীকদের মতন ডান হাতের নীচ দিয়ে কাঁধের উপরে পড়েছে। গলায় কোমর পর্যন্ত ঝোলা রাশীচক্র মার্কা হার। মুখখানা যেন চেনা চেনা মনে হল। টুপি আর গোঁফদাড়ি চাপা দিয়ে পব ঠাউরে দেখলাম। আরে! এ যে আমাদের ওল্ড ফ্রেণ্ড মীনেন্দ্র মাইতি, ভোল ফিরিয়ে মিনাণ্ডার দ মাইটি হয়েছে। তিন বছর আগেও আমার কাছে মাঝে মাঝে আসত, তার কিছু উপকারও আমি করেছিলাম। কিন্তু তার পরেই সে গা ঢাকা দিল। আমাকে এড়িয়ে চলত, চিঠি লিখলে উত্তর দিত না। স্থির করলাম, এনগেজমেণ্ট না করেই দেখা করব।

 ভাগ্যজিজ্ঞাসুদের ভিড় এড়াবার জন্যে আটটার দু-চার মিনিট আগেই গেলাম। চৌরঙ্গী রোড থেকে একটি গলি বেরিয়েছে পিটারকিন লেন। আট নম্বরের দরজায় একটি বড় নেমপ্লেট আঁটা—ডক্টর মিনাণ্ডার দ মাইটি, নীচে ইংরেজী বাঙলা হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় লেখা আছে—সোজা দোতলায় চলে আসুন। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। সামনের দরজায় নোটিস আছে—ওয়েলকম, ভিতরে এসে বসুন।

 ঘরটিতে আলো কম। একটা টেবিলের চার দিকে কতকগুলো চেয়ার আছে, আর কেউ সেখানে নেই। পাশের ঘরের পর্দা ভেদ করে মৃদু কণ্ঠস্বর আসছে। বুঝলুম, আমার আগেই অন্য মক্কেল এসে গেছে। হঠাৎ দেওয়ালে একটা ফ্রেমের ভিতর আলোকিত অক্ষর ফুটে উঠল—ওয়েট প্লীজ, একটু পরেই আপনার পালা আসবে। টেবিলে গোটাকতক পুরনো সচিত্র মার্কিন পত্রিকা ছিল, তারই পাতা ওলটাতে লাগলাম।

 কিছুক্ষণ পরে আরও দুজন এসে আমার পাশের চেয়ারে বসলেন। একজনের বয়স ত্রিশ-বত্রিশ, অন্য জনের পঁচিশ-ছাব্বিশ। প্রথম লোকটি আমাকে প্রশ্ন করলেন, অনেকক্ষণ বসে আছেন নাকি মশাই?

 উত্তর দিলুম, তা প্রায় দশ মিনিট হবে।

 —তবেই সেরেছে, আমাকে হয়তো ঘণ্টা খানিক ওয়েট করতে হবে। এই রতন, তুই শুধু শুধু এখানে থেকে কি করবি, বাড়ি যা।

 রতন বলল, কেন, আমি তো বাগড়া দিচ্ছি না গোষ্ঠ-দা। গনৎকার সায়েব তোমাকে কি বলে না জেনে আমি নড়ছি না।

 গোষ্ঠ-দা আমার দিকে চেয়ে বললেন, দেখুন তে। মশাই রতনার আক্কেল। আমি এসেছি নিজের ভাগ্যি জানতে, তুই কি করতে থাকবি?

 আমি বললুম, আপনার ভাগ্যফল উনিও জানতে চান। আপনার আত্মীয় তো?

 —আত্মীয় না হাতি। এ শালা আমার জোঁক, কেবল চুষে খাবার মতলব।

 রতন বলল, আগে থাকতে শালা শলো বলো না মাইরি। আগে বিজির সঙ্গে তোমার বে হয়ে যাক তার পর যত খুশি বলো।

 —আরে গেল যা। বিজিকেই যে বে করব তার ঠিক কি? গুলুরাণীও তো নিন্দের সম্বন্ধ হয়। কি বলেন সার?

 আমি বললাম, আপনাদের তর্কের বিষয়টা আমি তো কিছুই জানি না।

 —তা হলে ব্যাপারটা খুলে বলি শুনুন। আমি হলুম শ্রীগোষ্ঠ বিহারী সাঁতরা, শ্যামবাজারের মোড়ে সেই যে ইম্পিরিয়াল টি-শপ আছে তারই সোল প্রোপাইটার। তা আপনার আশীর্বাদে দোকানটি ভালই চলছে। এখন আমার বয়স হল গে ত্রিশ পেরিয়ে একত্রিশ, এখনও যদি সংসার ধর্ম না করি তবে কবে করব? বুড়ো বয়সে বে করে লাভ কি? কি বলেন আপনি, অ্যাঁ? এখন সমিস্যে হয়েছে পাত্রী নিয়ে, দুটি আমার হাতে আছে। এক নম্বর হল, নফর দাসের মেয়ে গুলুরানী, ভাল নাম গোলাপসুন্দরী। দেখতে তেমন সুবিধের নয়, একটু কুঁদুলীও বটে। কিন্তু বাপের টাকা আছে, বিয়ে করলে কিছু পাওয়া যাবে। তার পর ধরুন, যদি কারবারটি বাড়াতে চাই তবে শ্বশুরের কাছ থেকে কোন না আরও হাজার খানিক টাকা বাগাতে পারব। দু নম্বর পাত্রী হচ্ছে বিজনবালা, ডাক নাম বিজি, এই রতন শালার বোন। বাপ নেই, শুধু বুড়ী মা আর এই ভাগাবণ্ড ভাইটা আছে, অবস্থা খারাপ, বরপণ নবডঙ্কা। কিন্তু মেয়েটা দেখতে অতি খাসা, নানা রকম রান্না জানে, এক পো মাংসের সঙ্গে দেদার মোচা এঁচড় ডুমরের কিমা মিশিয়ে শ-খানিক এমন চপ বানাবে যে আপনি ধরতেই পারবেন না যে তার চোদ্দ আনা নিরিমিষ। বিজিকে বে করলে সে আমার সত্যিকার পার্টনার হবে। শ্বশুরের টাকা নাই বা পেলাম, আপনার আশীর্বাদে আমার পুঁজি নেহাত মন্দ নেই। ইচ্ছে আছে টি-শপটির বোম্বাই প্যাটার্ন নাম দেব, নিখিল ভারত বিশ্রান্তি গৃহ। চপ কাটলেট ডেভিল মামলেট এই সব তৈরি করব, খদ্দেরের অভাব হবে না মশাই। আমার খুব ঝোঁক বিজির ওপর, কিন্তু মুশকিল হয়েছে তার মা আর বাউণ্ডুলে ভাইটা আমার ঘাড়ে পড়বে। বুড়ী শ্বাশুড়ীকে পুষতে আপত্তি নেই, কিন্তু এই রতনা আমার কাঁধে চাপবে আর বোনের কাছ থেকে হরদম টাকা আদায় করবে তা আমি চাই না।

 রতন বলল, আমি কথা দিচ্ছি তোমার কাঁধে চাপব না। আমার ভাবনা কি, ইলেকট্রিকের সব কাজ জানি, আর্মেচারের তার পর্যন্ত জড়াতে পারি। একটা ভাল চাকরি জোগাড় করতে পারি না মনে কর?

 —যোগাড় করতে পারিস তো করিস না কেন রে হতভাগা? এ পর্যন্ত অনেক কাজ তো পেয়েছিলি, একটাতেও লেগে থাকতে পারলি নি কেন? এই কিরণ চক্কোত্তি তোর মাথা খেয়েছে, দিনরাত তার তরুণ অপেরা পার্টিতে আড্ডা দিস, হয়তো নেশা-ভাঙও করিস।

 —মাইরি বলছি গোষ্ঠ-দা, খারাপ নেশা অমি করি না। মাঝে মাঝে একটু সিদ্ধির শরবত খাই বটে, কিন্তু খুব মাইল্ড।

 আমি বললুম, গোষ্ঠবাবু আপনার সমস্যাটি তো তেমন কঠিন নয়। যখন শ্রীমতী বিজনবালাকে মনে ধরেছে, তখন তাঁকে বিয়ে করাই তো ভাল। একটু রিস্ক না হয় নিলেন।

 —আপনি জানেন না মশাই, এই রতনা সোজা রিস্ক নয়। সেই জন্যেই তো এই সায়েব জ্যোতিষীর কাছে এসেছি, আমার ঠিকুজিটাও এনেছি। ইনি সব কথা শুনে আমার হাত দেখে আর আঁক করে যার নাম বলবেন, বিজনবালা কি গোলাপসুন্দরী, তাকেই প্রজাপতির নির্বন্ধ মনে করে বে করব। কুড়ি টাকা লাগে লাগুক, একটা তো হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।

 —আচ্ছা, এই রতন যদি কলকাতার বাইরে একটা ভাল কাজ পায়, তা হলে তো আপনার সুরাহা হতে পারে?

 —সুরাহা নিশ্চয় হয়, আমি তা হলে নিশ্চিন্দি হয়ে বিজিকে যে করতে পারি। কিন্তু তেমন চাকরি ওকে দিচ্ছে কে?

 —রতনবাবু, তোমার লাইসেন্স আছে?

 রতন বলল, আছে বইকি, ভাল ভাল সাট্টিফিকিটও আছে। দয়া করে একটি কাজ যোগাড় করে দিন না সার, গোষ্ঠ-দার গঞ্জনা আর সইতে পারি না।

 আমি বললুম, শোন রতন। একটি এঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের সঙ্গে আমার যোগ আছে, শিলিগুড়ি ব্রাঞ্চের জন্যে একজন ফিটার মিস্ত্রী দরকার। তোমাকে কাজটি দিতে পারি, প্রথমে এক শ টাকা মাইনে পাবে, তিন মাস প্রোবেশনের পর দেড় শ। কিন্তু শর্ত এই, একটি বৎসর শিলিগুড়ি থেকে নড়বে না, তবে বোনের বিয়ের সময় চার-পাঁচ দিন ছুটি পেতে পার। রাজী আছ?

 —এক্ষুনি। দিন, পায়ের ধুলো দিন সার। অপেরা পার্টি ছেড়ে দেব, কিরণ চক্কোত্তির সঙ্গে আমার বনছে না, আজ পর্যন্ত আমাকে একটি টাকাও দেয় নি।

 —তা হলে তুমি আজই বেলা তিনটের সময় আমাদের অফিসে গিয়ে দেখা করো। ঠিকানাটা লিখে নাও।

 ঠিকানা লিখে নিয়ে রতন বলল, গোষ্ঠ-দা, তোমার সমিস্যে তো মিটে গেল, মিছিমিছি গনৎকার সায়েবকে কুড়ি টাকা দেবে কেন। চল, বাড়ি ফেরা যাক।

 গোষ্ঠ সাঁতরা বললেন, কোথাকার নিমকহারম তুই! এই ভদ্রলোকের হাত দেখে জ্যোতিষী কি বলেন তা না জেনেই যাবি?

 লজ্জায় জিব কেটে রতন নিজের কান মলল। এমন সময় জ্যোতিষীর খাস কামরার পর্দা ঠেলে দুজন গুজরাটী ভদ্রলোক হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন, নিশ্চয় সুফল পেয়েছেন। এঁরা চলে গেলে জ্যোতিষীর কামরায় একটা ঘণ্টা বেজে উঠল। একটু পরে একজন মহিলা এলেন, কালো শাড়ি, নীল ব্লাউজ, কাঁধে রাশিচক্র মার্কা লাল ব্যাজ। ইনি বোধ হয় ডক্টর মিনাণ্ডারের সেক্রেটারি। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আগে এসেছেন?

 উত্তর দিলাম, আজ্ঞে হাঁ।

 —আপনার নাম অর ঠিকানা? জন্মস্থান আর জন্মদিন?

 সব বললাম, উনি নোট করে নিলেন।

 —কুড়ি টাকা ফী দিতে হবে জানেন তো?

 —জানি, টাকা সঙ্গে এনেছি।

 —কি জানবার জন্যে এসেছেন?

 —আসন্ন ভবিষ্যতে আমার অর্থপ্রাপ্তি-যোগ আছে কিনা।

 —বুঝলুম না, সোজা বাঙলায় বলুন।

 —জানতে চাই, ইমিডিয়েট ফিউচারে কিছু টাকা পাওয়া যাবে কিনা।

 সেক্রেটারি নোট করে নিলেন। তার পর গোষ্ঠ সাঁতরকে বললেন, আপনার কি প্রশ্ন?

 গোষ্ঠবাবু সহাস্যে বললেন, কিচ্ছু না, আমি আর রতন এই এনার সঙ্গে এসেছি।

 তিন মিনিট পরেই সেক্রেটারি ফিরে এসে আমাকে বললেন, ডক্টর মিনাণ্ডার আপনাকে জানাচ্ছেন, এখন আপনার বরাতে টাকার ঘরে শূন্য। বছর খানিক পরে আর একবার আসতে পারেন।

 গোষ্ঠবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, বা রে, এ কি রকম গোনা হল? আপনাকে না দেখেই ভাগ্যফল বললেন!

 আমি বললুম, বুঝলেন না গোষ্ঠবাবু এই মিনাণ্ডার সায়েবের দিব্যদৃষ্টি আছে, না দেখেই ভাগ্য বলে দিতে পারেন। চলুন, ফেরা থাক।

 নেমে এসে গোষ্ঠবাবু বললেন, ব্যাপারটা কি মশাই? জ্যোতিষী আপনার সঙ্গে দেখা করলেন না, ফীও নিলেন না, এ তো ভারি তাজ্জব!

 বললুম, ব্যাপার অতি সোজা। এই জ্যোতিষীটি হচ্ছেন আমার পুরনো বন্ধু মীনেন্দ্র মাইতি, ভোল ফিরিয়ে মিনাণ্ডার দ মাইটি হয়েছেন। তিন বছর আগে আমার কাছ থেকে কিছু মোটা রকম ধার নিয়েছিলেন, বার বার অগিদ দিয়েও আদায় করতে পারি নি। অনেক দিন নিখোঁজ ছিলেন, এখন গ্রীক গনৎকার সেজে আসরে নেমেছেন। তাই আমার পাওনা টাকাটা সম্বন্ধে এঁকে প্রশ্ন করেছিলাম।

 রতন বলল, আপনি ভাববেন না সার, জোচ্চোরটকে নির্ঘাত শায়েস্তা করে দেব। দয়া করে আমাকে তিনটি দিন ছুটি দিন, আমি দলবল নিয়ে এর দরজার সামনে পিকেটিং করব, আর গরম গরম স্লোগান আওড়াব। বাছাধন টাকা শোধ না করে রেহাই পাবেন না।


 রতনের পিকেটিংএ সুফল হয়েছিল। ডক্টর মিনাণ্ডার দ মাইটি আমার প্রাপ্য টাকার অর্ধেক দিয়ে জানালেন, পশার একটু বাড়লে বাকীটা শোধ করবেন। কিন্তু কলকাতায় তিনি টিকতে পারলেন না, এখানকার পাট তুলে দিয়ে ভাগ্যপরীক্ষার জন্যে দিল্লি চলে গেলেন।

১৮৮১