চয়নিকা (১৯৪১)/নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের ’পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত পাখির গান।
না জানি কেন রে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।
থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
মহা উল্লাসে ছুটিতে চায়,
ভূধরের হিয়া টুটিতে চায়,
প্রভাত-কিরণে পাগল হইয়া
জগৎ-মাঝারে লুটিতে চায়।
কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,
চারিদিকে তা’র বাঁধন কেন।
ভাঙ্ রে হৃদয় ভাঙ্ রে বাঁধন,
সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন,
লহরীর পরে লহরী তুলিয়া
আঘাতের পরে আঘাত কর্!
মাতিয়া যখন উঠেছে পরান,
কিসের আঁধার কিসের পাষাণ,
উথলি যখন উঠেছে বাসনা,
জগতে তখন কিসের ডর।
আমি ঢালিব করুণা-ধারা,
আমি ভাঙিব পাষাণ-কারা,
আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পারা।
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া,
দিব রে পরান ঢালি’।
শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব,
হেসে খল খল, গেয়ে কল কল,
তালে তালে দিব তালি।
তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া—
নব নব দেশে বারতা লইয়া,
হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া,
গাহিয়া গাহিয়া গান,
যত দেব প্রাণ বহে যাবে প্রাণ,
ফুরাবে না আর প্রাণ।
এত কথা আছে, এত গান আছে,
এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে, এত সাধ আছে,
প্রাণ হয়ে আছে ভোর।
মেঘ-গরঙ্গনে বরষা আসিবে,
মদির নয়নে বসন্ত হাসিবে,
কূলে কূলে মোর ফুটিবে হাসি,
বিকশিত কাশ-কুসুম-রাশি।
দূরে দূরে কভু বাজিবে বাঁশি,
মুরছি পড়িবে মলয় বায়।
দুরু দুরু মোর দুলিবে হিয়া
শিহরিয়া মোর উঠিবে কায়।
ওরে অগাধ বাসনা, অসীম আশা
জগৎ দেখিতে চাই,
জাগিয়াছে সাধ চরাচরময়,
প্লাবিয়া বহিয়া যাই।
যত প্রাণ আছে ঢালিতে পারি,
যত কাল আছে বহিতে পারি,
যত দেশ আছে ডুবাতে পারি,
তবে আর কী-বা চাই,
পরানের সাধ তাই।
কী জানি কী হোলো আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ,
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
ডাকে যেন—ডাকে যেন—সিন্ধু মোরে ডাকে যেন।
আজি চারিদিকে মোর কেন কারাগার হেন।
ওই-যে হৃদয় মোর আহ্বান শুনিতে পায়,
কে আসিবি, কে আসিবি, তোরা কে আসিবি আয়।
পাষাণ বাঁধন টুটি’, ভিজায়ে কঠিন ধরা,
বনেরে শ্যামল করি’, ফুলেরে ফুটায়ে ত্বরা,
সারা প্রাণ ঢালি’ দিয়া, জুড়ায়ে জগৎ-হিয়া
আমার প্রাণের মাঝে কে আসিবি আয় তোরা।
আমি যাব—আমি যাব—কোথায় সে, কোন্ দেশ—
জগতে ঢালিব প্রাণ, গাহিব করুণা গান
উদ্বেগ-অধীর হিয়া
সুদূর সমুদ্রে গিয়া
সে প্রাণ মিশাব, আর সে-গান করিব শেষ।
ওরে চারিদিকে মোর,
এ কী কারাগার ঘোর,
ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এসেছে রবীর কর।