চয়নিকা (১৯৪১)/প্রভাত-উৎসব
প্রভাত-উৎসব
হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি’।
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।
ধরায় আছে যত মানুষ শত শত
আসিছে প্রাণে মম, হাসিছে গলাগলি।
এসেছে সখা সখী বসিয়া চোখোচোখি,
দাঁড়ায়ে মুখোমুখি হাসিছে শিশুগুলি,
এসেছে ভাই বোন পুলকে ভরা মন,
ডাকিছে ‘ভাই ভাই’ আঁখিতে আঁখি তুলি’।
পুলকে পুরে প্রাণ, শিহরে কলেবর,
প্রেমের ডাক শুনি’ এসেছে চরাচর।
এসেছে রবি শশী, এসেছে কোটি তারা
ঘুমের শিয়রেতে জাগিয়া থাকে যারা।
পরান পুরে গেল, হরষে হোলো ভোর,
জগতে কেহ নাই, সবাই প্রাণে মোর।
প্রভাত হোলো যেই, কী জানি হোলো এ কী,
আকাশ পানে চাই, কী জানি কারে দেখি।
পুরব মেঘ মুখে পড়েছে রবি-রেখা,
অরুণ-রথ-চূড়া আধেক যায় দেখা।
তরুণ আলো দেখে পাখির কলরব,
মধুর আহা কী-বা মধুর মধু সব।
মধুর মধু আলো মধুর মধু বায়,
মধুর মধু গানে তটিনী বহে যায়;
যেদিকে আঁখি যায় সেদিকে চেয়ে থাকে,
যাহারি দেখা পায় তারেই কাছে ডাকে,
নয়ন ডুবে যায় শিশির আঁধি-ধারে,
হৃদয় ডুবে যায় হরষ-পারাবারে।
আয় রে আয় বায়ু যা রে যা প্রাণ নিয়ে,
জগৎ মাঝারেতে দে রে তা প্রসারিয়ে।
পেয়েছি এত প্রাণ যতই করি দান
কিছুতে যেন আর ফুরাতে নারি তারে।
আয় রে মেঘ, আয় বারেক নেমে আয়,
কোমল কোলে তুলে আমারে নিয়ে যা রে।
কনক-পাল তুলে’ বাতাসে দুলে’ দুলে’
ভাসিতে গেছে সাধ আকাশ পারাবারে।
আকাশ, এসো এসো, ডাকিছ বুঝি ভাই,
গেছি তো তোরি বুকে আমি তো হেথা নাই।
প্রভাত আলো সাথে ছড়ায় প্রাণ মোর,
আমার প্রাণ দিয়ে ভরিব প্রাণ তোর।
ওঠো হে ওঠো রবি, আমারে তুলে লও,
অরুণ-তরী তব পুরবে ছেড়ে দাও।
আকাশ-পারাবার বুঝি হে পার হবে—
আমারে লও তবে—আমারে লও তবে।
কে তুমি মহাজ্ঞানী, কে তুমি মহারাজ,
গরবে হেলা করি’ হেলো না তুমি আজ।
বারেক চেয়ে দেখো আমার মুখপানে,
উঠেছে মাথা মোর মেঘের মাঝখানে।
আপনি আসি ঊষা শিয়রে বসি’ ধীরে,
অরুণ-কর দিয়ে মুকুট দেন শিরে,
নিজের গলা হতে কিরণমালা খুলি’,
দিতেছে রবি-দেব আমার গলে তুলি।
ধূলির ধুলি আমি রয়েছি ধূলি ’পরে,
জেনেছি ভাই ব’লে জগৎ চরাচরে।