চয়নিকা (১৯৪১)/রাহুর প্রেম
রাহুর প্রেম
শুনেছি আমারে ভালো লাগে না,
নাই বা লাগিল তোর,
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া,
চিরকাল তোরে রবো আঁকড়িয়া,
কঠিন লৌহ-ডোর।
তুই তো আমার বন্দী অভাগী,
বাঁধিয়াছি কারাগারে,
প্রাণের বাঁধন দিয়েছি প্রাণেতে
দেখি কে খুলিতে পারে।
জগৎ মাঝারে যেথায় বেড়াবি,
যেথায় বসিবি, যেথায় দাঁড়াবি,
বসন্তে শীতে, দিবসে নিশীথে,
সাথে সাথে তোর থাকিবে বাজিতে
কঠিন কামনা চির শৃঙ্খল
চরণ জড়ায়ে ধরে,
একবার তোরে দেখেছি যখন
কেমনে এড়াবি মোরে।
চাও নাহি চাও, ডাকো নাহি ডাকো,
কাছেতে আমার থাকো নাই থাকো,
যাব সাথে সাথে রবো পায় পায়,
রবো গায় গায় মিশি।
এ বিষাদ ঘোর, এ আঁধার মুখ,
এই নৈরাশ, এই ভাঙা বুক,
ভাঙা বাদ্যের মতন বাজিবে
সাথে সাথে দিবানিশি।
নিত্য কালের সঙ্গী আমি যে
আমি-যে রে তোর ছায়া,
কিবা সে-রোদনে, কিবা সে হাসিতে,
দেখিতে পাইবি কখনো পাশেতে,
কভু সম্মুখে, কভু পশ্চাতে,
আমার আঁধার কায়া।
গভীর নিশীথে, একাকী যখন
বসিয়া মলিন প্রাণে,
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে
আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখ পানে।
যে-দিকেই তুই ফিরাবি বয়ান,
সেই দিকে আমি ফিরাব নয়ান,
যেদিকে চাহিবি, আকাশে আমার
আঁধার মুরতি আঁকা,
সকলি পড়িবে আমার আড়ালে,
জগৎ পড়িবে ঢাকা।
দুর্ভাবনার মতন নিয়ত,
তোমারে রহিব ঘিরে,
দিবস রাত্রি এ মুখ দেখিব
তোমার অশ্রু-নীরে।
যেন রে অকূল সাগর মাঝারে
ডুবেছে জগৎ-তরী;
তারি মাঝে শুধু মোরা দুটি প্রাণী,
রয়েছি জড়ায়ে তোর বাহুখানি,
যুঝিস ছাড়াতে ছাড়িব না তবু,
মহাসমুদ্র ’পরি।
এ অন্ধকার মরুময় নিশা,
আমার পরান হারায়েছে দিশা,
অনন্ত ক্ষুধা অনন্ত তৃষা
করিতেছে হাহাকার,
আজিকে যখন পেয়েছি রে তোরে,
এ চির যামিনী ছাড়িব কী ক’রে।
এ ঘোর পিপাসা যুগ যুগ ধরে
মিটিবে কি কভু আর।
জীবনের পিছে মরণ দাঁড়ায়ে
আশার পিছনে ভয়,
ডাকিনীর মতো রজনী ভ্রমিছে
চিরদিন ধরে দিবসের পিছে
বিশ্বধরণীময়।
যেথায় আলোক সেইখানে ছায়া
এই তো নিয়ম ভবে,
ও রূপের কাছে তৃপ্তিবিহীন
এ ক্ষুধা জাগিয়া র’বে।