চয়নিকা (১৯৪১)/নিষ্ফল-কামনা

নিষ্ফল কামনা

বৃথা এ ক্রন্দন।
বৃথা এ অনল-ভরা দুরন্ত বাসনা।

রবি অস্ত যায়।
অরণ্যেতে অন্ধকার আকাশেতে আলো,
সন্ধ্যা নত-আঁখি
ধীরে আসে দিবার পশ্চাতে।
বহে কি না বহে
বিদায়-বিষাদ-শ্রান্ত সন্ধ্যার বাতাস।

দুটি হাতে হাত দিয়ে ক্ষুধার্ত নয়নে
চেয়ে আছি দুটি আঁখি মাঝে।
খুঁজিতেছি কোথা তুমি,
কোথা তুমি।
যে-অমৃত লুকানো তোমায়
সে কোথায়।

অন্ধকার সন্ধ্যার আকাশে
বিজন তারার মাঝে কাঁপিছে যেমন
স্বর্গের আলোকময় রহস্য অসীম,
ওই নয়নের
নিবিড় তিমির তলে, কাঁপিছে তেমনি
আত্মার রহস্য-শিখা।
তাই চেয়ে আছি।
প্রাণ মন সব লয়ে তাই ডুবিতেছি
অতল আকাঙ্ক্ষা-পারাবারে।
তোমার আঁখির মাঝে,
হাসির আড়ালে,
বচনের সুধাস্রোতে,
তোমার বদনব্যাপী
করুণ শান্তির তলে,
তোমারে কোথায় পাব
তাই এ ক্রন্দন।

বৃথা এ কন্দন।
হায় রে দুরাশা।
এ রহস্য, এ আনন্দ তোর তরে নয়।
যাহা পাস তাই ভালো,

হাসিটুকু, কথাটুকু
নয়নের দৃষ্টিটুকু,
প্রেমের আভাস।
সমগ্র মানব তুই পেতে চাস,
এ কী দুঃসাহস।
কী আছে বা তোর,
কী পারিবি দিতে।
আছে কি অনন্ত প্রেম।
পারিবি মিটাতে
জীবনের অনন্ত অভাব?
মহাকাশ-ভরা
এ অসীম জগৎ-জনতা
এ নিবিড় আলো অন্ধকার,
কোটি ছায়াপথ, মায়া পথ,
দুর্গম উদয়-অস্তাচল,
এরি মাঝে পথ করি’
পারিবি কি নিয়ে যেতে
চির-সহচরে
চির রাত্রি দিন
একা অসহায়।
যে-জন আপনি ভীত, কাতর দুর্বল,
ম্লান, ক্ষুধা-তৃষাতুর, অন্ধ, দিশাহারা
আপন হৃদয়-ভাৱে পীড়িত জর্জর,
সে কাহারে পেতে চায় চিরদিন তরে।


ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে-যে মানব,
কেহ নহে তোমার আমার।

অতি সযতনে,
অতি সংগোপনে,
সুখে দুঃখে নিশীথে দিবসে,
বিপদে সম্পদে,
জীবনে মরণে, শত ঋতু-আবর্তনে
বিশ্ব জগতের তরে বিশ্বপতি তরে
শতদল উঠিতেছে ফুটি’;
সুতীক্ষ্ণ বাসনা-ছুরি দিয়ে
তুমি তাহা চাও ছিঁড়ে নিতে?
লও তার মধুর সৌরভ,
দেখো তার সৌন্দর্য-বিকাশ,
মধু তার করো তুমি পান,
ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী,
চেয়ো না তাহারে।
আকাঙ্ক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।
শান্ত সন্ধ্যা, স্তব্ধ কোলাহল।
নিবাও বাসনা-বহ্নি নয়নের নীরে।
চলো ধীরে ঘরে ফিরে যাই।

১৩ অগ্রহায়ণ, ১২৯৪
—মানসী