চয়নিকা (১৯৪১)/নারীর উক্তি

নারীর উক্তি

মিছে তর্ক—থাক্ তবে থাক্।
কেন কাঁদি বুঝিতে পারো না?
তর্কেতে বুঝিবে তাকি। এই মুছিলাম আঁখি;
এ শুধু চোখের জল, এ নহে ভর্ৎসনা।

আমি কি চেয়েছি পায়ে ধরে
ওই তব আঁখি-তুলে-চাওয়া,
ওই কথা ওই হাসি, ওই কাছে-আসা-আসি,
অলক দুলায়ে দিয়ে হেসে চলে যাওয়া।

কেন আনো বসম্ভ-নিশীথে
আঁখি ভরা আবেশ বিহ্বল,
যদি বসন্তের শেষে শ্রান্ত মনে ম্লান হেসে
কাতরে খুঁজিতে হয় বিদায়ের ছল।

আছি যেন সোনার খাঁচায়
একখানি পোষ-মানা প্রাণ।
এও কি বুঝাতে হয় প্রেম যদি নাহি রয়
হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান।

মনে আছে সেই একদিন
প্রথম প্রণয় সে তখন।
বিমল শরতকাল, শুভ্র ক্ষীণ মেঘজাল,
শীতের পরশে মৃদু রবির কিরণ।

কাননে ফুটিত শেফালিকা,
ফুলে ছেয়ে যেত তরুমূল,
পরিপূর্ণ সুরধুনী, কুলুকুলু ধ্বনি শুনি’,
পরপারে বনশ্রেণী কুয়াশা-আকুল।

আমা-পানে চাহিয়ে, তোমার
আঁখিতে কাঁপিত প্রাণখানি।
আনন্দে বিষাদে মেশা সেই নয়নের নেশা
তুমি তো জানো না তাহা—আমি তাহা জানি।

সে কি মনে পড়িবে তোমার—
সহস্র লোকের মাঝখানে
যেমনি দেখিতে মোরে, কোন আকর্ষণ-ডোরে
আপনি আসিতে কাছে জ্ঞানে কি অজ্ঞানে।

ক্ষণিক বিরহ-অবসানে
নিবিড় মিলন-ব্যাকুলতা
মাঝে মাঝে সব ফেলি রহিতে নয়ন মেলি’
আঁখিতে শুনিতে যেন হৃদয়ের কথা।

কোনো কথা না রহিলে তবু
শুধাইতে নিকটে আসিয়া।
নীরবে চরণ ফেলে চুপি-চুপি কাছে এলে
কেমনে জানিতে পেতে, ফিরিতে হাসিয়া।

আজ তুমি দেখেও দেখো না,
সব কথা শুনিতে না পাও।

কাছে আসো আশা ক’রে আছি সারাদিন ধরে,
আনমনে পাশ দিয়ে তুমি চলে যাও।

দীপ জ্বেলে দীর্ঘ ছায়া লয়ে
বসে আছি সন্ধ্যায় ক-জনা,
হয়তো বা কাছে এসো হয়তো বা দূরে বসো,
সে সকলি ইচ্ছাহীন দৈবের ঘটনা।

এখন হয়েছে বহু কাজ,
সতত রয়েছ অন্যমনে;
সর্বত্র ছিলাম আমি, এখন এসেছি নামি’
হৃদয়ের প্রান্তদেশে, ক্ষুদ্র গৃহকোণে।

দিয়েছিলে হৃদয় যখন,
পেয়েছিলে প্রাণ মন দেহ,
আজ সে হৃদয় নাই, যতই সোহাগ পাই।
শুধু তাই অবিশ্বাস, বিষাদ, সন্দেহ।

জীবনের বসন্তে যাহারে
ভালোবেসেছিলে একদিন,
হায় হায় কী কুগ্রহ, আজ তারে অনুগ্রহ!
মিষ্ট কথা দিবে তারে গুটি দুই তিন!

অপবিত্র ও কর-পরশ
সঙ্গে ওর হৃদয় নহিলে।
মনে কি করেছ, বঁধু,  ও-হাসি এতই মধু,
প্রেম না দিলেও চলে শুধু হাসি দিলে।

তুমিই তো দেখালে আমায়
(স্বপ্নেও ছিল না এত আশা,)
প্রেম দেয় কতখানি, কোন্ হাসি কোন্ বাণী
হৃদয় বাসিতে পারে কত ভালোবাসা।

তোমারি সে ভালোবাসা দিয়ে
বুঝেছি আজি এ ভালোবাসা,
আজি এই দৃষ্টি হাসি এ আদর রাশি রাশি,
এই দূরে চলে যাওয়া, এই কাছে আসা।

বুক ফেটে কেন অশ্রু পড়ে
তবুও কি বুঝিতে পারো না।
তর্কেতে বুঝিবে তা কি। এই মুছিলাম আঁখি,
এ শুধু চোখের জল, এ নহে ভর্ৎসনা।

২১শে অগ্রহায়ণ, ১২৯৪
—মানসী