চয়নিকা (১৯৪১)/পুরুষের উক্তি

পুরুষের উক্তি

যে-দিন সে প্রথম দেখিনু
সে তখন প্রথম যৌবন।
প্রথম জীবন-পথে বাহিরিয়া এ জগতে
কেমনে বাঁধিয়া গেল নয়নে নয়ন।

তখন উষার আধ আলো
পড়েছিল মুখে দু-জনার,
তখন কে জানে কারে, কে জানিত আপনারে
কে জানিত সংসারের বিচিত্র ব্যাপার।

আঁখি মেলি যারে ভালো লাগে
তাহারেই ভালো ব’লে জানি।
সব প্রেম প্রেম নয় ছিল না তো সে সংশয়,
যে আমারে কাছে টানে তারে কাছে টানি।

অনন্ত বাসর-সুখ যেন
নিত্য হাসি প্রকৃতি বধূর,
পুষ্প যেন চির প্রাণ পাখির অশান্ত গান,
বিশ্ব করেছিল ভান অনন্ত মধুর।

সেই গানে, সেই ফুল্ল ফুলে,
সেই প্রাতে, প্রথম যৌবনে,
ভেবেছিনু এ হৃদয় অনন্ত অমৃতময়
প্রেম চিরদিন রয় এ চির-জীবনে।

তাই সেই আশার উল্লাসে
মুখ তুলে চেয়েছিনু মুখে;
সুধাপাত্র লয়ে হাতে কিরণ-কিরীট মাথে
তরুণ দেবতা-সম দাঁড়ানু সম্মুখে।

পত্র-পুষ্প গ্রহ-তারা-ভরা
নীলাম্বরে মগ্ন চরাচর,

তুমি তারি মাঝখানে কী মূর্তি আঁকিলে প্রাণে,
কী ললাট, কী নয়ন, কী শান্ত অধর।

সুগভীর কলধ্বনিময়
এ বিশ্বের রহস্য অকূল,
মাঝে তুমি শতদল ফুটেছিলে ঢলঢল,
তীরে আমি দাঁড়াইয়া সৌরভে আকুল!

পরিপূর্ণ পূর্ণিমার মাঝে
ঊর্ধ্ব মুখে চকোর যেমন
আকাশের ধারে ধায়, ছিঁড়িয়া দেখিতে চায়
অগাধ স্বপন-ছাওয়া জ্যোৎস্না-আবরণ,

তেমনি সভয়ে প্রাণ মোর
তুলিতে যাইত কতবার
একান্ত নিকটে গিয়ে সমস্ত হৃদয় দিয়ে
মধুর রহস্যময় সৌন্দর্য তোমার।

হৃদয়ের কাছাকাছি সেই
প্রেমের প্রথম আনাগোনা,
সেই হাতে হাতে ঠেকা, সেই আধ-চোখে দেখা
চুপি চুপি প্রাণের প্রথম জানাশোনা।

অজানিত, সকলি নূতন
অবশ চরণ টলমল,
কোথা পথ, কোথা নাই কোথা যেতে কোথা যাই,
কোথা হতে উঠে হাসি, কোথা অশ্রুজল।

অতৃপ্ত বাসনা প্রাণে লয়ে
অবারিত প্রেমের ভবনে
যাহা পাই তাহা তুলি, খেলাই আপনা ভুলি’,
কী-যে রাখি কী যে ফেলি, বুঝিতে পারিনে।

ক্রমে আসে আনন্দ অলস,
কুসুমিত ছায়াতরুতলে;
জাগাই সরসীজল, ছিঁড়ি ব’সে ফুলদল,
ধূলি সে-ও ভালো লাগে খেলাবার ছলে।

অবশেষে সন্ধ্যা হয়ে আসে,
শ্রান্তি আসে হৃদয় ব্যাপিয়া,
থেকে থেকে সন্ধ্যাবায় ক’রে ওঠে হায় হায়,
অরণ্য মর্মরি ওঠে কাঁপিয়া কাঁপিয়া।

মনে হয় এ কি সব ফাঁকি,
এই বুঝি আর কিছু নাই।
অথবা যে-রত্ন তরে এসেছিনু আশা ক’রে
অনেক লইতে গিয়ে হারাইনু তাই।

সুখের কাননতলে বসি’
হৃদয়ের মাঝারে বেদনা,
নিরখি কোলের কাছে মৃৎপিণ্ড পড়িয়া আছে
দেবতারে ভেঙে ভেঙে করেছি খেলনা।

এরি মাঝে ক্লান্তি কেন আসে,
উঠিবারে করি প্রাণপণ,
হাসিতে আসে না হাসি, বাজাতে বাজে না বাঁশি,
শরমে তুলিতে নারি নয়নে নয়ন।

কেন তুমি মূর্তি হয়ে এলে,
রহিলে না ধ্যান ধারণার।
সেই মায়া উপবন কোথা হোলো অদর্শন
কেন হায় ঝাঁপ দিতে শুখাল পাথার।

স্বপ্নরাজ্য ছিল ও হৃদয়,
প্রবেশিয়া দেখিনু সেখানে
এই দিবা, এই নিশা, এই ক্ষুধা, এই তৃষা,
প্রাণপাখি কাঁদে এই বাসনার টানে।

আমি চাই তোমারে যেমন
তুমি চাও তেমনি আমারে,
কৃতার্থ হইব আশে গেলাম তোমার পাশে
তুমি এসে বসে আছ আমার দুয়ারে।

সৌন্দর্য-সম্পদ মাঝে বসি’
কে জানিত কাঁদিছে বাসনা।
ভিক্ষা, ভিক্ষা, সব ঠাঁই তবে আর কোথা যাই
ভিথারিনী হোলো যদি কমল-আসনা।

তাই আর পারি না সঁপিতে
সমস্ত এ বাহির অন্তর।
এ জগতে তোমা ছাড়া ছিল না তোমার বাড়া,
তোমারে ছেড়েও আজ আছে চরাচর।

কখনো বা চাঁদের আলোতে,
কখনো বসন্ত-সমীরণে,
সেই ত্রিভুবনজয়ী অপার রহস্যময়ী
আনন্দ-মুরতিখানি জেগে ওঠে মনে।

কাছে যাই, তেমনি হাসিয়া
নবীন যৌবনময় প্রাণে,
কেন হেরি অশ্রুজল, হৃদয়ের হলাহল,
রূপ কেন রাহুগ্রস্ত মানে-অভিমানে।

প্রাণ দিয়ে সেই দেবী-পূজা
চেয়ো না চেয়ো না তবে আর।
এসো থাকি দুই জনে সুখে দুঃখে গৃহকোণে,
দেবতার তরে থাক্ পুষ্পঅর্ঘ্যভার।

পার্ক স্ট্রীট
২৩ অগ্রহায়ণ, ১২৯৪
—মানসী