চয়নিকা (১৯৪১)/মেঘদূত

মেঘদূত

কবিবর কবে কোন্‌ বিস্মৃত বরষে
কোন্‌ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত। মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
সঘন সংগীত মাঝে পুঞ্জীভূত ক’রে।

সে-দিন সে উজ্জয়িনী-প্রাসাদ-শিখরে
কী না জানি ঘনঘটা, বিদ্যুৎ-উৎসব,
উদ্দাম পবন-বেগ গুরুগুরু রব।
গম্ভীর নির্ঘোষ সেই মেঘ-সংঘর্ষের
জাগায়ে তুলিয়াছিল সহজ বর্ষের

অন্তর্গূঢ় বাষ্পাকুল বিচ্ছেদ-ক্রন্দন
এক দিনে। ছিন্ন করি’ কালের বন্ধন
সেই দিন ঝরে পড়েছিল অবিরল
চিরদিবসের যেন রুদ্ধ অশ্রুজল
আর্দ্র করি’ তোমার উদার শ্লোকরাশি।

সে-দিন কি জগতের যতেক প্রবাসী
জোড়হস্তে মেঘপানে শূন্যে তুলি মাথা
গেয়েছিল সমস্বরে বিরহের গাথা
ফিরি’ প্রিয়-গৃহপানে। বন্ধন-বিহীন
নবমেঘ-পক্ষ-’পরে করিয়া আসীন
পাঠাতে চাহিয়াছিল প্রেমের বারতা
অশ্রুবাষ্পভরা,—দূর বাতায়নে যথা
বিরহিণী ছিল শুয়ে ভূতল-শয়নে
মুক্তকেশে, ম্লানবেশে, সজল নয়নে?

তাঁদের সবার গান তোমার সংগীতে
পাঠায়ে কি দিলে, কবি, দিবসে নিশীথে
দেশে দেশান্তরে, খুঁজি’ বিরহিণী প্রিয়া।
শ্রাবণে জাহ্নবী যথা যায় প্রবাহিয়া
টানি লয়ে দিশ দিশান্তের বারিধারা
মহাসমুদ্রের মাঝে হোতে দিশাহারা।
পাষাণ-শৃঙ্খলে যথা বন্দী হিমাচল
আষাঢ়ে অনন্ত শূন্যে হেরি’ মেঘদল
স্বাধীন গগন-চারী, কাতরে নিশ্বাসি’
সহস্র কন্দর হতে বাষ্প রাশি রাশি
পাঠায় গগন পানে; ধায় তা’রা ছুটি’
উধাও কামনা সম; শিখরেতে উঠি’

সকলে মিলিয়া শেষে হয় একাকার
সমস্ত গগনতল করে অধিকার।

সেদিনের পরে গেছে কত শতবার
প্রথম দিবস, স্নিগ্ধ নব বরষার।
প্রতিবর্ষা দিয়ে গেছে নবীন জীবন
তোমার কাব্যের ’পরে, করি বরিষন
নববৃষ্টিবারিধারা; করিয়া বিস্তার
নবঘনস্নিগ্ধচ্ছায়া; করিয়া সঞ্চার
নব নব প্রতিধ্বনি জলদ-মন্দ্রের
স্ফীত করি’ স্রোতোবেগ তোমার ছন্দের
বর্ষা-তরঙ্গিণী-সম।

কতকাল ধ’রে
কত সঙ্গীহীন জন, প্রিয়াহীন ঘরে,
বৃষ্টিক্লান্ত বহুদীর্ঘ লুপ্ত-তারাশশী
আষাঢ় সন্ধ্যায়, ক্ষীণ দীপালোকে বসি’
ওই ছন্দ মন্দ মন্দ করি’ উচ্চারণ
নিমগ্ন করেছে নিজ বিজন-বেদন।
সে-সবার কণ্ঠস্বর কর্ণে আসে মম
সমুদ্রের তরঙ্গের কলধ্বনি সম
তব কাব্য হতে।

ভারতের পূর্বশেষে
আমি ব’সে আজি; যে শ্যামল বঙ্গদেশে
জয়দেব কবি, আর এক বর্ষাদিনে
দেখেছিলা দিগন্তের তমাল বিপিনে
শ্যামচ্ছায়া, পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর।

আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর,
দুরন্ত পবন অতি, আক্রমণে তার
অরণ্য উদ্যবাহু করে হাহাকার।
বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি’ মেঘভার
খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া।
অন্ধকার রুদ্ধগৃহে একেলা বসিয়া
পড়িতেছি মেঘদুত; গৃহত্যাগী মন
মুক্তগতি মেঘপৃষ্ঠে লয়েছে আসন,
উড়িয়াছে দেশদেশান্তরে। কোথা আছে
সানুমান আম্রকূট; কোথা বহিয়াছে
বিমল বিশীর্ণ রেবা বিন্ধা-পদমুলে
উপল ব্যথিত-গতি; বেত্রবতীকূলে
পরিণত-ফল-শ্যাম জম্বুবনচ্ছায়ে
কোথায় দশার্ণ গ্রাম রয়েছে লুকায়ে
প্রস্ফুটিত কেতকীর বেড়া দিয়ে ঘেরা;
পথ-তরু-শাখে কোথা গ্রাম-বিহঙ্গেরা
বর্ষায় বাঁধিছে নীড়, কলরবে ঘিরে’
বনস্পতি; না জানি সে কোন্ নদীতীরে
যুথীবনবিহারিণী বনাঙ্গনা ফিরে,
তপ্ত কপোলের তাপে ক্লান্ত কর্ণোৎপল
মেঘের ছায়ার লাগি’ হতেছে বিকল;
ভ্রূবিলাস শেখে নাই কা’রা সেই নারী
জনপদ-বধূজন, গগনে নেহারি’
ঘনঘটা, ঊর্ধ্ব নেত্রে চাহে মেঘপানে,
ঘননীল ছায়া পড়ে স‍ুনীল নয়ানে;
কোন্ মেঘশ্যামশৈলে মুগ্ধ সিদ্ধাঙ্গনা
স্নিগ্ধ নবঘন হেরি’ আছিল উন্মনা
শিলাতলে, সহসা আসিতে মহা ঝড়
চকিতে চকিত হয়ে ভয়ে জড়সড়

সম্বরি’ বসন, ফিরে গুহাশ্রয় খুঁজি’,
বলে, “মাগো, গিরিশৃঙ্গ উড়াইল বুঝি।”
কোথায় অবস্তীপুরী; নির্বিন্ধ্যা তটিনী;
কোথা শিপ্রানদীনীরে হেরে উজ্জয়িনী
স্বমহিমচ্ছায়া; সেথা নিশি দ্বিপ্রহরে
প্রণয়-চাঞ্চল্য ভুলি’ ভবন শিখরে
শুপ্ত পারাবত; শুধু বিরহ-বিকারে
রমণী বাহির হয় প্রেম-অভিসারে
সূচিভেদ্য অন্ধকারে রাজপথ মাঝে
ক্বচিৎ-বিদুতালোকে; কোথা সে বিরাজে
ব্রহ্মাবর্তে কুরুক্ষেত্র; কোথা কনথল,
কোথা সেই জহ্ন-কন্য। যৌবন-চঞ্চল,
গৌরীর ভ্রূকুটি-ভঙ্গি করি’ অবহেলা
ফেন-পরিহাসচ্ছলে করিতেছে খেলা
লয়ে ধূর্জটির জটা চন্দ্রকরোজ্জ্বল।

এই মতো মেঘরূপে ফিরি’ দেশে দেশে
হৃদয় ভাসিয়া চলে, উত্তরিতে শেষে
কামনার মোক্ষধাম অলকার মাঝে,
বিরহিণী প্রিয়তমা যেথায় বিরাজে
সৌন্দর্যের আদি সৃষ্টি; সেথা কে পারিত
লয়ে যেতে, তুমি ছাড়া, করি’ অবারিত
লক্ষ্মীর বিলাসপুরী—অমর ভূবনে।
অনন্ত বসন্তে যেথা নিত্য পুষ্পবনে
নিত্য চন্দ্রালোকে ইন্দ্রনীল শৈলমূলে
সুবর্ণসরোজফুল্ল সরোবরকূলে
মণিহর্ম্যে অসীম-সম্পদে নিমগনা
কাঁদিতেছে একাকিনী বিরহ-বেদনা।

মুক্ত বাতায়ন হতে যায় তারে দেখা
শয্যা প্রান্তে লীন-তনু ক্ষীণ শশী-রেখা
পূর্ব গগনের মূলে যেন অন্তপ্রায়।
কবি, তব মন্ত্রে আজি মুক্ত হয়ে যায়
রুদ্ধ এই হৃদয়ের বন্ধনের ব্যথা;
লভিয়াছি বিরহের স্বর্গলোক, যেথা
চিরনিশি যাপিতেছে বিরহিণী প্রিয়া
অনন্ত সৌন্দর্যমাঝে একাকী জাগিয়া।

আবার হারায়ে যায়; —হেরি চারিধার
বৃষ্টি পড়ে অবিশ্রাম, ঘনায়ে আঁধার
আসিছে নির্জন নিশা; প্রান্তরের শেষে
কেঁদে চলিয়াছে বায়ু অকুল উদ্দেশে।
ভাবিতেছি অর্ধরাত্রি অনিদ্র নয়ান,
কে দিয়েছে হেন শাপ, কেন ব্যবধান।
কেন ঊর্ধ্বে´ চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ।
কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ।
সশরীরে কোন্ নর গেছে সেইখানে,
মানস-সরসী-তীরে বিরহ-শয়ানে,
রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে
জগতের নদী গিরি সকলের শেষে।

—মানসী

শান্তিনিকেতন

৭৷৮ জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৭

অপরাহ্ণে, ঘনবর্ষায়