চরিতাবলী/উইলিয়ম হটন
উইলিয়ম হটন
ইংলণ্ডের অন্তঃপাতী ডর্বি নগরে হটনের জন্ম হয়। হটনের পিতা অতি দুঃখী ছিলেন। তিনি পশম পরিষ্করণকর্ম্ম করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেন; সুতরাং অতি কষ্টে বৃহৎ পরিবারের ভরণ পোষণ নির্বাহ হইত। কষ্টের কথা অধিক কি বলিব, অনেক দিন এরূপ ঘটিত যে, হটনের জননীকে, সমুদয় ছোট ছোট ছেলেগুলির সহিত, সমস্ত দিন উপবাসী থাকিতে হইত, ছেলেগুলি, ক্ষুধায় কাতর ও আহারের নিমিত্ত লালায়িত হইয়া, জননীকে নিতান্ত ব্যাকুল করিত। সায়ংকালে কিছু আহারের সামগ্রী উপস্থিত হইলে, তাহারা ক্ষুধার জ্বালায় কাড়াকড়ি করিয়া জননীর ভাগ পর্য্যন্ত খাইয়া ফেলিত; জননী সজল নয়নে হাত তুলিয়া বসিয়া থাকিতেন। সুতরাং তাঁহাকে অনেক দিন অনাহারেই থাকিতে হইত।
হটনের পিতা যাহা উপার্জ্জন করিতেন, তাহাতে অতি কষ্টেও তাঁহার স্ত্রী ও পুত্র কন্যা দিগের ভরণ পোষণ নির্বাহ হইত না। আবার, দুর্ভাগ্যক্রমে, তিনি সুরাপানে আসক্ত হইয়া উঠিলেন। সর্ব্বদা শুঁড়ির দোকানে পড়িয়া থাকিতেন; যাহা উপার্জ্জন করিতেন, তাঁহার অধিকাংশই সুরাপানে ব্যয়িত হইত। সুতরাং তাঁহার স্ত্রী ও পুত্র কন্যা দিগের আহারের ক্লেশ আরও অধিক হইয়া উঠিল। হটন কহিয়াছেন, “আমি এক দিন দিবারাত্রি উপবাসী ছিলাম; পর দিন বেলা দুই প্রহরের সময় ময়দা ও জল ফুটাইয়া কিঞ্চিৎ মাত্র আহার করিয়াছিলাম।”
এরূপ দুরবস্থায় যেরূপ লেখা পড়া হইতে পারে, তাহা অনায়াসে বোধগম্য হইতেছে। যাহা হউক, হটনের পিতা হটনকে, তাঁহার পাঁচ বৎসর বয়সের সময়, এক পাঠশালায় পাঠাইয়া দেন। ঐ পাঠশালার শিক্ষক আপন ছাত্রদিগকে লেখা পড়া যত শিখাইতে পারুন না পারুন, তাহাদিগকে বিলক্ষণ প্রহার করিতে পারিতেন। হটন কহিয়াছেন, “আমার শিক্ষক লেখা পড়া কিছুই শিখাইতেন না, সর্ব্বদা কেবল চুল ধরিয়া দিয়ালে মাথা ঠুকিয়া দিতেন।” তিনি, দুই বৎসর, এই পাঠশালায় ছিলেন; পরে তাঁহার পিতা তাঁহাকে সাত বৎসর বয়সের সময়, পাঠশালা ছাড়াইয়া, এক রেশমের বানকে নিযুক্ত করিয়া দিলেন।
এই স্থানে হটনের ক্লেশের সীমা ছিল না। তিনি কহিয়াছেন, “এই সময়ে আমাকে প্রতিদিন অতি প্রত্যুষে উঠতে হইত; বিশেষ ক্রটি হউক না হউক, মধ্যে মধ্যে প্রভুর বেত্রপ্রহার সহ করিতে হইত; আর, যত ছোট লোকের ছেলের সহিত বাস করিতে হইত। তাহারা লেখা পড়া কিছুই জানিত না, এবং লেখা পড়া শিখিতেও তাহদের ইচ্ছা ছিল না। এক দিনের বেত্রাঘাতে পৃষ্ঠের এক স্থান ক্ষত হইয়া গিয়াছিল। পরে, আর এক দিন প্রহারকালে, বেত্রের অগ্রভাগ লাগিয়া, ঐ ক্ষত এমন প্রবল হইয়া লঠিল যে, তদ্দৃষ্টে সকলে এই আশঙ্কা করিতে লাগিলেন, ঘা ভাল হওয়া কঠিন হইয়া উঠিবেক, আর, হয় ত, ক্রমে ক্রমে সমুদয় পীঠ পচিয়া যাইবেক।”
হটন, এই রূপে এই স্থানে সাত বৎসর কাটাইলেন। পরে, তাঁহার চৌদ্দ বৎসর বয়সের সময়, তাহার পিতা তাঁহাকে, তথা হইতে আনিয়া, আপন এক ভ্রাতার নিকট রাখিয়া দিলেন। এই ব্যক্তি নটিংহম নগরে মোজা বোনা ব্যবসায় করিতেন। হটন, পিতৃব্যের নিকট থাকিয়া, মোজা বোনা শিখিতে লাগিলেন। তাঁহার পিতৃব্য নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না; কিন্তু পিতৃব্যপত্নী অতিশয় দুৰ্বৃত্তা। তিনি আপন স্বামীকে, ও স্বামীর নিকট যাহারা কর্ম্ম করিত, তাহাদিগকে, অত্যন্ত আহারের ক্লেশ দিতেন।
এইরূপ ক্লেশ পাইয়াও, হটন পিতৃব্যের নিকট তিন বৎসর অবস্থিতি করিলেন। এক দিবস, তাঁহার পিতৃব্য তাঁহাকে কহিলেন, আজি তোমায় এই কর্ম্ম সমাপন করিতে হইবেক। সে দিবস, সেই কর্ম্ম সমাপ্ত হইয়া উঠিল না। এজন্য, তাঁহার পিতৃব্য, তাঁহাকে অলস ও অমনোযোগী স্থির করিয়া, প্রথমতঃ, যথোচিত তিরস্কার করিলেন; পরিশেষে, ক্রোধে অন্ধ ও নিতান্ত নিদয় হইয়া, অতিশয় প্রহার করিলেন। হটনের মনে অত্যন্ত ঘৃণা ও অপমান বোধ হইল। তখন, তিনি তথা হইতে পলায়ন করা স্থির করিলেন, এবং এক দিন সুযোগ পাইয়া আপনার কাপড়গুলি ও পিতৃব্যের বাক্স হইতে একটি টাকা পথখরচ লইয়া, পলায়ন করিলেন।
এই স্থান হইতে পলায়ন করিয়া, হটন যেরূপ কষ্ট পাইয়াছিলেন, তাহা শুনিলে, অত্যন্ত দুঃখ উপস্থিত হয়। তিনি, কোন আশ্রয় না পাইয়া, প্রথম রাত্রি এক মাঠে শয়ন করিয়া কাটাইলেন, এবং প্রভাত হইবামাত্র, পুনরায় প্রস্থান করিলেন। কিন্তু কোন দিকে যান, কি জন্যেই বা যান, যাইয়াই বা কি করিবেন, তাহার কিছুই ঠিকানা ছিল না।
তিনি কহিয়াছেন, “এই রূপে সমস্ত দিন ভ্রমণ করিয়া, সায়ংকালে লিচ্ফিল্ডের নিকট উপস্থিত হইলাম; নিকটে এক খামার দেখিয়া মনে করিলাম, আজি উহার মধ্যে থাকিয়া রাত্রি কাটাইব। কিন্তু খামারের দ্বার রুদ্ধ করা ছিল, সুতরাং উহার ভিতরে যাইতে পারিলাম না। তখন, পুটলী খুলিয়া কাপড় পরিলাম, এবং অবশিষ্ট কাপড় প্রভৃতি যাহা ছিল, সমুদয় বাঁধিয়া বেড়ার আড়ালে লুকাইয়া রাখিয়া, নগর দেখিতে গেলাম। দুই ঘণ্টা পরে ফিরিয়া আসিয়া কাপড় ছাড়িলাম। অল্প দূরে আর একটি খামার ছিল, হয় ত, ঐ খানে থাকিবার জায়গা পাইব, এই মনে করিয়া, সেখানে গিয়া দেখিলাম, সেখানেও থাকিবার উপায় নাই; সুতরাং ফিরিয়া আসিলাম; ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, আমার কাপড়ের পুটলী নাই। তখন, হতবুদ্ধি হইয়া, বিস্তর খেদ ও রোদন করিলাম। আমার খেদ ও রোদন শুনিয়া, কতকগুলি লোক সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা, দেখিয়া শুনিয়া, একে একে সকলে চলিয়া গেলেন। আমি একাকী সেই স্থানে বসিয়া রোদন করিতে লাগিলাম।
“কোন ব্যক্তি কখন এমন বিপদে পড়ে না। বিদেশে আসিয়া সর্ব্বস্ব হারাইয়া, রাত্রি দুই প্রহরের সময়ে, একাকী মাঠে বসিয়া, গালে হাত দিয়া, কতই ভাবিতে লাগিলাম। এক কপর্দ্দক সম্বল নাই, কাহার সহিত আলাপ নাই, লাভের কোন উপায় নাই, শীঘ্র লাভের কোন উপায় হইবেক তাঁহারও সম্ভাবনা নাই, কালি কি খাইব তাহার সংস্থান নাই; কোথায় যাইব, কি করিব, কাহাকে কহিব, তাহার কোন ঠিকানা নাই। অনেক ক্ষণ ভাবিতে ভাবিতে নিদ্রাকর্ষণ হইল। তখন ভূতলে শয়ন করিয়া, রাত্রিযাপন করিলাম।”
পর দিন প্রভাত হইবামাত্র, হটন পুনরায় প্রস্থান করিয়া বরমিংহম্ নগরে উপস্থিত হইলেন। এই দিন অন্য কোন আহারসামগ্রী জুটিয়া উঠিল না, কেবল পথের ধারে যে সকল ক্ষেত্র ছিল, তাহা হইতে কিছু ফল মূল লইয়া, তিনি সে দিনের ক্ষুধানিবৃত্তি করিলেন। পরিশেষে, নিতান্ত নিরুপায় দেখিয়া, তিনি এই স্থির করিলেন, পুনরায় পিতার শরণাপন্ন হই, তিনি যা করেন। পিতার নিকট উপস্থিত হইলে, তিনি তাঁহাকে পুনরায় তাহার সেই নির্দয় পিতৃব্যের নিকটে পাঠাইয়া দিলেন। তাঁহাকে অগত্যা, তথায় গিয়া, ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে হইল। পিতৃব্যও, ক্ষমা করিয়া, তাঁহাকে পূর্ববৎ কর্ম্ম করিতে দিলেন।
পিতৃব্যের আবাসে আসিয়া থাকিতে থাকিতে, তাঁহার ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিতে অতিশয় ইচ্ছা হইল। তিনি অবসরকালে মন দিয়া লেখা পড়া করিতে লাগিলেন, এবং যত্ন ও পরিশ্রমের গুণে, অল্প দিনেই, বিলক্ষণ শিখিতে পারলেন। কিছু দিন পরেই, তিনি শ্লোকরচনা করিতে আরম্ভ করিলেন।
মোজা বোনা কর্ম্মে পরিশ্রম বিস্তর, লাভ তাদৃশ নাই, দেখিয়া, তিনি পিতৃব্যের আলয় পরিত্যাগ করলেন, এবং আপনি এক ভগিনীর বাটীতে গিয়া রহিলেন। এই ভগিনী আতিশয় সুশীল ছিলেন। তিনি ভ্রাতাকে অত্যন্ত স্নেহ করিলেন, এবং যাহাতে তিনি স্বচ্ছন্দে থাকেন, ও উত্তর কালে যাহাতে তাঁহার ভাল হয়, তদ্বিষয়ে বিশেষ যত্নবতী ছিলেন।
হটন পুস্তকবিক্রয়ের ব্যবসায় করিবার নিমিত্ত অত্যন্ত ইচ্ছুক হইলেন। নটিংহম্ নগরের সাত ক্রোশ দূরে, সৌথওএল নামে এক নগর আছে; তথায় তিনি পুস্তকের দোকান খুলিলেন। ইতিপূর্বে্ব, তিনি বই বাঁধা কর্ম্ম শিখিয়াছিলেন; সপ্তাহের মধ্যে, কেবল শনিবার সৌথওএলে গিয়া, বই বিক্রয় করিয়া আসিতেন, আর কয়েক দিন বই বাঁধিতেন। তিনি শনিবার প্রত্যুষে গাত্রোথ্থান করিতেন, পুস্তকের মোট মাথায় করিয়া, সৌথওএলে গিয়া, বেলা দশ ঘণ্টার সময় দোকান খুলিতেন, এবং সমস্ত দিন বিক্রয় করিয়া, রাত্রিতে নটিংহমে ফিরিয়া আসিতেন।
এই রূপে, হটন কিছু দিন অতি কষ্টে কাটাইলেন; পরে, অনেকগুলি পুরাণ পুস্তক শস্তা পাইয়া, সমুদয় ক্রয় করিলেন এবং সৌথওএলের দোকান এক বারে বন্ধ করিয়া, বরমিংহম্ নগরে আসিয়া, এক দোকান খুলিলেন। এই স্থানে কিছু দিন কর্ম্ম করিয়া, খরচ বাদে প্রায় দুইশত টাকা লাভ হইল। এই রূপে কিছু সংস্থান হওয়াতে, তিনি কর্মের বাহুল্য করিলেন। ন্যায়পথে চলিয়া, ও অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করিয়া, চারি পাঁচ বৎসরে, তিনি বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন হইয়া উঠিলেন এবং বিবাহ করিলেন।
ইতিপূর্ব্বে, তিনি নানা কর্ম্মে সবিশেষ ব্যস্ত থাকিয়াও, যত্ন ও পরিশ্রমের গুণে, বিলক্ষণ লেখা পড়া শিখিয়াছিলেন; এক্ষণে, নানা কর্ম্মে অতিশয় ব্যস্ত থাকিয়াও, গ্রন্থরচনা করিতে আরম্ভ করিলেন, এবং ক্রমে ক্রমে নানা গ্রন্থ রচনা করিয়া, পণ্ডিত সমাজে গণ্য ও আদরণীয় হইয়া উঠিলেন।
এই রূপে হটন, অশেষ কষ্ট ভোগ করিয়াও, আপন যত্নে ও পরিশ্রমে বিদ্যা, খ্যাতি ও সম্পত্তি লাভ করিয়া, নিরনব্বই বৎসর বয়সে দেহত্যাগ করেন।
দেখ! এই ব্যক্তি কেমন অদ্ভুত মনুষ্য; বিষম দুরবস্থায় পড়িয়াছিলেন, তথাপি আপন যত্নে ও পরিশ্রমে কেমন বিদ্যালাভ, কেমন খ্যাতিলাভ, কেমন সম্পত্তিলাভ করিয়া গিয়াছেন। ফলতঃ, যত্ন ও পরিশ্রম করিলে, সম্ভবমত বিদ্যা, খ্যাতি, সম্পত্তি, সকলই লাভ করা যাইতে পারে।