চরিতাবলী/ওগিলবি
ওগিলবি
ওগিলবি বাল্যকালে অতি সামান্যরূপ লেখা পড়া শিখিয়াছিলেন। তাঁহার পিতা ঋণগ্রস্ত ছিলেন; ঋণপরিশোধ করিতে না পারাতে, উত্তমর্ণ, বিচারালয়ে অভিযোগ করিয়া, তাঁহাকে কারারুদ্ধ করেন। সুতরাং, নিজে কিছু কিছু উপার্জ্জন করিতে না পারিলে, ওগিলবির চলা ভার। কিন্তু তিনি তাদৃশ লেখা পড়া জানিতেন না; উপায়ান্তর দেখিতে না পাইয়া, অবশেষে নর্ত্তকের ব্যবসায় অবলম্বন করিলেন। এই ব্যবসায়ে তাঁহার বিলক্ষণ নৈপুণ্য জন্মিল। কিছু টাকা হস্তে হইবামাত্র, তিনি সর্ব্বাগ্রে পিতাকে কারাগার হইতে মুক্ত করিলেন।
কিছু দিন পরে, কোন কারণ উপস্থিত হওয়াতে, তাঁহাকে নর্তকের ব্যবসায় পরিত্যাগ করিতে হইল। সুতরাং, তিনি পুনরায় দুঃখে পড়িলেন। দুঃখে পড়িয়া, কিছু অর্থ ব্যয় করিয়া, তিনি পুনরায় ডবলিন নগরে একটি সামান্য নাট্যশালা স্থাপন করিলেন। এই নাট্যশালা দ্বারা তাঁহার কিছু কিছু লাভের উপক্রম হইল। কিন্তু সেই সময়ে রাজবিদ্রোহ উপলক্ষে যুদ্ধ উপস্থিত হওয়াতে, তাঁহার লাভের পথ রুদ্ধ হইয়া গেল। নাট্যশালার সমুদয় দ্রব্যসামগ্রী লুষ্ঠিত হইল, এবং তাঁহার নিজের প্রাণসংশয় পর্য্যন্ত ঘটিয়া উঠিল।
এই রূপে, যৎপরোনাস্তি দুঃখে পড়িয়া ও বিপদগ্রস্ত হইয়া, ওগিলবি লণ্ডনে প্রত্যাগমন করিলেন। তথায় তিনি কেম্ব্রিজ বিদ্যালয় সংক্রান্ত কোন ব্যক্তির বিশিষ্টরূপ সাহায্য পাইয়া, লাটিন শিখিতে আরম্ভ করিলেন। এই সময়ে, তাহার বয়স চল্লিশ বৎসরের অধিক। ইহার পূর্ব্বে তাঁহার ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখা হয় নাই। তিনি, এত বয়সে শিখিতে আরম্ভ করিয়াও, অল্প দিনেই, লাটিন ভাষায় বিলক্ষণ বুৎপন্ন হইয়া উঠিলেন, এবং বর্জ্জিলনামক সুপ্রসিদ্ধ লাটিন কবির রচিত কাব্যের ইঙ্গরেজী ভাষায় পদ্যে অনুবাদ করিলেন। এই গ্রন্থ, মুদ্রিত হইয়া, সর্ব্বত্র আদরপূর্ব্বক পরিগৃহীত হইল; এবং গ্রন্থকর্ত্তার বিলক্ষণ লাভ হইল। তদ্দর্শনে তাঁহার অতিশয় উৎসাহবৃদ্ধি হইল।
গ্রীক ভাষায় হোমরনামক মহাকবির রচিত ঈলিয়ড ও অডিসি নামক দুই অত্যুৎকৃষ্ট কাব্য আছে। ইঙ্গরেজী ভাষায় পদ্যে ঐ দুই কাব্যের অনুবাদ করিবার নিমিত্ত, ওগিলবির অত্যন্ত,ইচ্ছা হইল। এ পর্য্যন্ত তিনি গ্রীক ভাষার বিন্দু বিসর্গও জানিতেন না। এক্ষণে তাঁহার বয়স চুয়ান্ন বৎসর; তথাপি তিনি গ্রীক পড়িতে আরম্ভ করিলেন, এবং কিছু দিনের মধ্যেই, গ্রীক ভাষায় বিলক্ষণ ব্যুৎপন্ন হইয়া, ঐ দুই কাব্যের অনুবাদ করিয়া, মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলেন। এই দুই গ্রন্থও আদরপূর্ব্বক পণ্ডিতসমাজে পরিগৃহীত হইল।
ইতিমধ্যে, ওগিলবি পুনরায় ডবলিন্ নগরে গিয়া, এক নূতন নাট্যশালা স্থাপন করিয়াছিলেন; এবং তদ্দ্বারা বিলক্ষণ লাভও হইয়াছিল। বস্তুতঃ, এই সময়ে তিনি সম্যক্ সুখে ও সচ্ছন্দে ছিলেন; অর্থের অভাবজন্য কোন ক্লেশ ছিল না। অবশেষে, ডবলিন্ নগরে ভূমি আদি যে কিছু সম্পত্তি ছিল, সমুদয় বিক্রয় করিয়া, তিনি পুনরায় লণ্ডনে আসিয়া বাস করিলেন। তাঁহার বাস করিবার অব্যবহিত পরেই, লণ্ডনে বিষম অগ্নিদাহ হইল, তাহাতে তাঁহার সর্ব্বস্ব দগ্ধ হইয়া গেল। অগ্নিদাহে সর্ব্বস্বান্ত হওয়াতে, তিনি পুনর্বার পূর্ব্বের ন্যায় বিষম দুঃখে পড়িলেন।
এই রূপে, তিনি বিষম দুঃখে পড়িলেন বটে, কিন্তু তাহাতে হতবুদ্ধি বা ভগ্নোৎসাহ হইলেন না; বরং উৎসাহ ও পরিশ্রম সহকারে নূতন নূতন গ্রন্থের অনুবাদ প্রভৃতি কর্ম্ম করিয়া ত্বরায় গুছাইয়া উঠিলেন; যৎকিঞ্চিৎ সংস্থান করিয়া, পুনরায় বসতিবাটী নির্মাণ করাইলেন; এবং একটি ছাপাখানা স্থাপন করিলেন। ছাপাখানা দ্বারা তিনি পুনরায় সঙ্গতিপন্ন হইয়া উঠিলেন। ছিয়াত্তর বৎসর বয়সে ওগিলবির মৃত্যু হয়।
দেখ! ওগিলবি কেমন লোক। তিনি কত বার কত বিপদে ও কত দুঃখে পড়িলেন; কিন্তু উৎসাহ ও পরিশ্রমের গুণে, প্রতিবারেই গুছাইয়া উঠিলেন। উৎসাহ ও পরিশ্রমের গুণে, চল্লিশ বৎসরের অধিক বয়সে লাটিন পড়িতে আরম্ভ করিয়া, তাহাতে ব্যুৎপন্ন হইলেন; উৎসাহ ও পরিশ্রমের গুণে, চুয়ান্ন বৎসর বয়সে গ্রীক পড়িতে আরম্ভ করিয়া, তাহাতেও ব্যুৎপন্ন হইলেন; অগ্নিদাহে সর্ব্বস্বাস্ত হইয়া গেল; কিন্তু উৎসাহ ও পরিশ্রমের গুণে, পুনরায় গৃহাদিনির্মাণ ও সংস্থান করিয়া, শেষ দশা সুখে ও সচ্ছন্দে যাপন করিলেন। ফলতঃ, কেবল উৎসাহ ও পরিশ্রমের গুণে, তিনি বৃদ্ধ বয়সে লেখা পড়া শিখিয়াছিলেন, এবং সুখে ও সচ্ছন্দে কালক্ষেপণ করিতে পারিয়াছিলেন। যদি তিনি উৎসাহহীন ও পরিশ্রমকাতর হইতেন, তাহা হইলে, অধিক বয়সে লেখা পড়াও হইত না, এবং দুঃখেরও সীমা থাকিত না।
অতএব, উৎসাহ ও পরিশ্রম বিদ্যা ও সম্পত্তির মূল, তাহার সন্দেহ নাই।