লীডন

স্কট্‌লণ্ডের দক্ষিণাংশে, রক্‌সবরশায়র প্রদেশে ডেন্‌হলমনামক এক গ্রাম আছে। তথায় লীডনের জন্ম হয়। লীডন অতি দুঃখীর সন্তান। তাঁহার পিতা জন খাটিয়া প্রতিদিন যাহা পাইতেন, তাহাতেই অতিকষ্টে সংসার নির্বাহ করিতেন।

লীডনের জন্মের এক বৎসর পরে, তাঁহার পিতা সপরিবারে, শ্বশুরালয়ে গিয়া, বাস করেন। তথায় তিনি ষোল বৎসর থাকেন। এই ষোল বৎসরের কিছু কাল মেষরক্ষকের কর্ম্ম করেন, আর কিছু কাল শ্বশুরের ক্ষেত্রসংক্রান্ত সমুদয় কর্ম্ম করেন। তাঁহার শ্বশুর অন্ধ হইয়াছিলেন; সুতরাং, তিনি নিজে ক্ষেত্রের কোন কর্ম্ম করিতে পারিতেন না।

 এই স্থানে, লীডন তাঁহার মাতামহীর নিকটে লেখা পড়া শিখিতে আরম্ভ করিলেন। কিছু শিখিয়াই, ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিবার নিমিত্ত, তাঁহার অত্যন্ত যত্ন হইল। অল্প‌ দিনের মধ্যেই তিনি অনেক শিখিয়া ফেলিলেন। কোন বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইতে না পারিলে, উত্তম রূপে লেখা পড়া শিখা হয় না; কিন্তু পিতা মাতার অসঙ্গতি প্রযুক্ত, কিছু কাল উহার সে সুযোগ ঘটিয়া উঠিল না। পরে, দশ বৎসর বয়সের সময়, তিনি এক বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইলেন।

 কিছু দিন পরেই, ঐ পাঠশালার শিক্ষকের মৃত্যু হইল। সুতরাং, লীডনের লেখা পড়া শিখিবার যে সুযোগ ঘটিয়াছিল, তাহা গেল। কিন্তু ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিবার নিমিত্ত, তাঁহার আন্তরিক যত্ন ও অনুরাগ জন্মিয়াছিল। শিখিবার সুযোগ গেল বলিয়া, তিনি এক বারে লেখা পড়া পরিত্যাগ করি-

লেন না; অন্যের সাহায্য না পাইয়াও, স্বয়ং প্রাণপণ যত্ন করিয়া, বিলক্ষণ শিক্ষা করিতে লাগিলেন। ডেন্‌হলম গ্রামে ডস্কন নামে এক পাদরি ছিলেন। তিনি কিছু দিন লীডনকে লাটিন শিখাইলেন; আর, লীডন স্বয়ং পরিশ্রম করিয়া, বিন সাহায্যে, গ্রীক শিক্ষা করিলেন।

 স্কট্‌লণ্ডের কৃষিজীবীরা যে বালককে বুদ্ধি মান ও লেখা পড়ায় যত্নবান্‌ দেখে, তাহাকে পাদরি করিবার নিমিত্ত যত্ন পায়। তাহার কারণ এই যে, অন্যান্য কর্ম্ম অপেক্ষা পাদরির কর্ম্ম অনায়াসে হইতে পারে। লীডনের পিতা, তাঁহার লেখা পড়ায় যত্ন ও শিখিবার ক্ষমতা দেখিয়া, মনে মনে বাসনা করিয়াছিলেন, তাঁহাকে পাদরি করিবেন। তদনুসারে তিনি, ঐ কর্ম্মের উপযোগী লেখা পড়া শিখাইবার নিমিত্ত, পুত্রকে এডিন্‌বরার কালেজে প্রবিষ্ট করিয়া দিলেন।

 এ পর্য্যন্ত, লীডন ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখিবার সুযোগ পান নাই; এক্ষণে কলেজে

 প্রবিষ্ট হইয়া, প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়া, মনের সাধে লেখা পড়া শিখিতে লাগিলেন। তিনি, কিছু কাল কলেজে থাকিয়া, অদ্ভুত পরিশ্রম সহকারে লাটিন, গ্রীক, ফরাসি, জর্ম্মন, স্পানিশ, ইটালীয়, প্রাচীন আইসলণ্ডিক, হিব্রু, আরবি, পারসী, এই দশ ভাষা, এবং ধর্ম্মনীতি ও গণিতবিদ্যা উত্তম রূপে শিথিলেন, এবং পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি আর কয়েক বিদ্যাও একপ্রকার শিক্ষা করিলেন। যাহারা উত্তর কালে পাদরি হইবার নিমিত্ত বিদ্যা শিখিত, অধ্যাপকেরা তাহাদের নিকট কিছু না লইয়া, লেখা পড়। শিখাইতেন, এই নিমিত্ত, লীডন এত শিখিতে পারিয়াছিলেন।

 এই রূপে, পাঁচ ছয় বৎসর কলেজে থাকিয়া, লীডন বিলক্ষণ বিদ্যা উপার্জন করিলেন। কিন্তু, তাঁহাকে অর্থের অসঙ্গতিনিবন্ধন বিস্তর ক্লেশ পাইতে হইয়াছিল। তিনি যে সকল পুস্তক পাঠ করিতেন, তাহার অধিকাংশই অন্যের নিকট হইতে চাহিয়া আনিতেন।

যে সকল পুস্তক চাহিয়া পাওয়া যাইত না, তাহা কিনিতে হইত; কিন্তু, কিনিবার সঙ্গতি ছিল না। যাহা কিছু তাঁহার হস্তে আসিত, আহারাদির ক্লেশ স্বীকার করিয়াও, তিনি তাহার অধিকাংশ দ্বারা পুস্তক ক্রয় করিতেন। লীডনের দুঃখ দেখিয়া, কালেজের এক অধ্যাপক, অনুগ্রহ করিয়া, তাঁহাকে এক পড়ান কর্ম্ম জুটাইয়া দেন। তাহাতে লীডনের বিস্তর আনুকূল্য হয়। বালকদিগকে শিক্ষা দিয়া, যে সময় থাকিত, সে সময়ে তিনি অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া, স্বয়ং লেখা পড়া করিতেন।

 লীডন অসাধারণ যত্নে ও অসাধারণ পরিশ্রমে যে অসাধারণ বিদ্যা উপার্জন করিয়াছিলেন, তদ্দ্বা‌রা তিনি বিখ্যাত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার পরিশ্রমের ও বিদ্যালাভের কথা যে শুনিত, সেই চমৎকৃত হইত ও প্রশংসা করিত। ক্রমে ক্রমে, সেই প্রদেশের অনেক বিদ্বান্‌ ও বিদ্যানুরাগী সন্ত্রান্ত লোকের সহিত তাঁহার আলাপ হইল। তাঁহারা সকলেই যথেষ্ট স্নেহ ও সমাদর করিতেন,

এবং যাহাতে তাঁহার ভাল হয়, সে বিষয়ে যত্নবান্‌ ছিলেন।

 কিছু দিন পরে, তিনি পাদরির কর্ম্মে নিযুক্ত হইলেন; কিন্তু সে কর্ম্ম, তাঁহার মনোনীত না হওয়াতে, অল্প‌ দিনের মধ্যেই, পরিত্যাগ করিলেন; এবং মনে মনে স্থির করিলেন, কাব্যরচনা করিব, এবং তাহা বিক্রয় করিয়া যাহা লাভ হইবেক, তাহাতেই জীবিকা নির্বাহ করিব। কিন্তু, এই ব্যবসায় দ্বারা যে লাভের সম্ভাবনা ছিল, তাহাতে চলা ভার। এজন্য, তাঁহার আত্মীয়েরা তাঁহাকে কোন লাভকর বিষয়কর্ম্মে নিযুক্ত করিবার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। তাহারা, বোর্ড‌ অব কণ্ট্র‌োলের এক মেম্বরের নিকট লীডনের বিদ্যা, বুদ্ধি ও স্বভাবের পরিচয় দিয়া, তাঁহাকে ভারতবর্ষে কোন কর্ম্মে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইতে অনুরোধ করিলেন।

 এই সময়ে, ভারতবর্ষে ডাক্তরি ভিন্ন অন্য কর্ম্মের সুবিধা ছিল না। কিন্তু, চিকিৎসাবিদ্যায় পরীক্ষা দিয়া, উত্তীর্ণ হইয়া, প্রশংসা-

পত্র না পাইলে, কেহ ডাক্তরিকর্ম্ম‌ পাইতে পারে না। ইতিপূর্ব্ব‌ে লীডন কলেজে চিকিৎসাবিদ্যাও কিছু শিখিয়াছিলেন; এক্ষণে তিনি, অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া, উক্ত বিদ্যা শিখিতে আরম্ভ করিলেন; এবং অদ্ভুত পরিশ্রম করিয়া, অল্প‌ দিনের মধ্যেই, ঐ বিদ্যায় সুশিক্ষিত ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন। তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, প্রশংসাপত্র পাইবামাত্র, ডাক্তরিকর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া, ভারতবর্ষে আসিলেন।

 লীডন, মান্দ্রাজে উপস্থিত হইয়া, কর্ম্ম করিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু, সেখানকার জল বায়ু তাঁহার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিল। তিনি অবিলম্বে নানা রোগে আক্রান্ত হইলেন; এজন্য, মান্দ্রাজ পরিত্যাগ করিয়া, তাঁহাকে কিছু দিন মালাকা উপদ্বীপে থাকিতে হইল। তিনি এই স্থানে থাকিয়া, স্বাস্থ্যলাভ করিয়া, কলিকাতায় উপস্থিত হইলেন। তৎকালীন গবর্ণর জেনেরল লার্ড মিণ্টো, তাঁহার গুণের পরিচয় পাইয়া, আহ্লা‌দিত হইয়া, তাঁহাকে

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে অধ্যাপক নিযুক্ত করিলেন। কিছু দিন পরেই, তিনি চব্বিশ পরগনার জজের পদে নিযুক্ত হইলেন।

 এই পদে অধিক বেতন ছিল। অধিক টাকা পাইলে, অনেকে বাবুগিরি করিয়া থাকেন। কিন্তু লীডন সেপ্রকার লোক ছিলেন না। তিনি বাবুগিরিতে এক পয়সাও ব্যয় করিতেন না; ন্যায্য খরচ করিয়া, বেতনের যাহা অবশিষ্ট থাকিত, তাহার অধিকাংশই এতদ্দে‌শীয় ভাষা ও বিদ্যা শিক্ষা এবং এতদ্দে‌শীয় পুস্তক সংগ্রহ বিষয়ে ব্যয় করিতেন। তিনি এতদ্দ‌েশীয় ভাষা ও বিদ্যা শিক্ষা বিষয়ে অত্যন্ত যত্নবান্‌ হইয়াছিলেন। যত্নের কথা অধিক কি বলিব, তিনি এক মুহূর্ত্তও বৃথা নষ্ট না করিয়া, ঐ বিষয়েই নিবিষ্ট থাকিতেন। এই সময়ে, তিনি এক আত্মীয়কে এই মর্ম্মে পত্র লিখিয়াছিলেন, যদি আমি সর উইলিয়ম জোন্স অপেক্ষা শতগুণ অধিক না শিখিয়া মরি, তাহা হইলে, যেন আমার জন্যে কেহ অশ্রুপাত না করে।

 কিছু দিন পরেই, গবর্ণর জেনেরল, সৈন্য লইয়া, জাবাদ্বীপ জয় করিতে গেলেন। লীডন সেই দেশের ভাষা, বিদ্যা ও রীতি নীতি অবগত হইবার মানসে, ঐ সঙ্গে গমন করিলেন। সেখানকার জল বায়ু অত্যন্ত মন্দ। কয়েক দিন পরেই, তাহার কম্পজ্বর হইল। তিনি শয্যাগত হইলেন, এবং তিন দিনের জ্বরেই প্রাণত্যাগ করিলেন। এই সময়ে, তাঁহার ছত্রিশ বৎসর মাত্র বয়ঃক্রম হইয়াছিল|

 লীডন অতি দুঃখীর সন্তান। পিতা মাতার এমন সঙ্গতি ছিল না, তাঁহাকে ভাল করিয়া লেখা পড়া শিখান। কিন্তু তিনি কত ভাষা ও কত বিদ্যা শিখিয়াছিলেন। অনুধাবন করিয়া দেখ, কেবল অসাধারণ যত্ন ও অসাধারণ পরিশ্রম লীডনের এই সমস্ত ভাষা ও এই সমস্ত বিদ্যা শিক্ষার মূল।